ক্রিস্টোফার শিশুর মত সরল হাসি হেসে বলে-হা…হ্যাঁ, কম্যাণ্ডার, নিশ্চয়… তিনি বাইরে বেরিয়ে দরজাটা সশব্দে বন্ধ করে দিলেন। সোজাসুজি জিল এবার ফিরে তাকালো মলির দিকে। তারপর বলল–মলি, তোমার কি একটুও কাণ্ডজ্ঞান নেই? ওই খুনে পাগলটার সঙ্গে ঘর বন্ধ করে বসে আছো?
বক্তব্যটা গুছিয়ে নিয়ে মলি বলল–তবে ওই লোকটা খুব একটা ভয়ঙ্কর প্রকৃতির নয়, তাছাড়া আমি নিজেই খুব সাবধান হয়ে আছি। যে কোনো বিপজ্জনক পরিস্থিতির সঙ্গে আমি মোকাবিলা করতে পারব।
জলি মুচকি হেসে বলল–মিসেস বয়েলও এই একই কথা বলেছিলেন।
মলি বিরক্ত সুরে বলল–ও…জিল, আবার তুমি সেই একই কথা বলতে শুরু করেছ?
আমি দুঃখিত মলি, কিন্তু সব কেমন যেন আমার গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। এই বাজে প্রকৃতির লোকটির মধ্যে তুমি যে কি এমন দেখলে আমি তো বুঝতে পারছি না।
মলি শান্তস্বরে বলল–ওই লোকটার জন্য আমার কষ্ট হয়।
জিল বিদ্রূপ সুরে বলল–একটা খুনে পাগলার জন্য সমবেদনা? মলি এবার অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে রইল জিলের দিকে।
তারপর বলল–হ্যাঁ, একটা খুনে পাগলার জন্য আমার মনে সমবেদনা জাগতে পারে!
শুনলাম তুমি ওকে ক্রিস্টোফার বলেই ডাকছিলে। এতটা ঘনিষ্ঠতা কি করে হলো?
মলি রেগে গিয়ে বলল–জিল, বোকার মত কথা বলো না, আজকাল সবাই সবার নাম ধরে ডাকে, সেটা তুমি ভালোভাবেই জানো!
হ্যাঁ, জানি, তবে তার জন্য সময় লাগে দু-চারদিন। এক্ষেত্রে যেন একটু তাড়াতাড়ি মনে হচ্ছে। সম্ভবতঃ তুমি ক্রিস্টোফার রেনকে আগে থেকেই চিনতে। ভদ্রলোক যে মিথ্যে পরিচয়ে এখানে আসবেন তা আগে থেকে ঠিক করা ছিল। আসলে তাকে তুমিই হয়ত ডেকেছিলে। এটা নিশ্চয় তোমাদের দুজনের কারসাজি।
মলি অবাক চোখে জিলের দিকে তাকিয়ে বলল–জিল তোমার কি বুদ্ধি কি লোপ পেতে শুরু করেছে? তোমার কথার মানে কি?
জিল বলল–আমার কথার মধ্যে এমন কোনো জটিলতা নেই। আমি বলতে চাই ক্রিস্টোফার রেনের সঙ্গে তোমার অনেকদিনের পুরনো পরিচয়। এবং কোনো কারণে তোমাদের এই পরিচয়টা আমার কাছে গোপন করতে চাও।
মলি বলে নিশ্চয় তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
জিল বলে–এই পুরোন পরিচয়ের কথা যে তুমি আমার কাছে গোপন করবে তা আমি জানি। তবে একটা নির্জন হোটেলে রেনের হঠাৎ আবির্ভাবটাও কেমন আশ্চর্যজনক যোগাযোগ বলে মনে হয়।
মেজর মেটকাফ…
কিংবা মিসেস বয়েলের চেয়েও বেশি আশ্চর্যের?
অবশ্যই! আমি অন্তত সেই রকমই মনে করি। তাছাড়া বইয়ে যা পড়েছি–এই সমস্ত উন্মাদ প্রকৃতির খুনিদের নারীর প্রতি একটা তীব্র মোহ থাকে।
এখানেও প্রমাণ পাওয়া গেছে।…
আচ্ছা তোমাদের কি ভাবে পরিচয় হলো? এর ইতিহাসই বা কতদিনের?
তোমার কথাবার্তা ক্রমেই পাগলের প্রলাপে গিয়ে পৌঁছেছে, জিল।
এখানে আসবার আগে ক্রিস্টোফার রেনের সঙ্গে আমার কোনো পরিচয়ই ছিলো না।
তুমি কি দুদিন আগে ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করবার জন্যে লণ্ডনে গিয়েছিলে? অপরিচিত অতিথি হিসাবে এই হোটেলে এসে আশ্রয় নেবার ব্যাপারেও নিশ্চয় তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিলো?
তুমি নিশ্চয় জান ভালোভাবে, আগের কয়েক সপ্তার মধ্যে আমি লণ্ডনে যাইনি।
তাই বুঝি? খুবই আশ্চর্যের কথা! জিল পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা পশমের দস্তানা বের করল। তারপর বলল–গত পরশু এই দস্তানাটাই তো ছিল তোমার হাতে–আমি যেদিন তারের জাল কিনতে সেলহ্যামে গেলাম?
তীব্র অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে বিড়বিড় করলো মলি, সেদিন বাইরে বেরোবার সময় আমি ওই দস্তানাটাই পরেছিলাম।
তুমি আমাকে জানালে, জরুরী প্রয়োজনে তোমাকে গ্রামের দিকে যেতে হয়েছিল। কিন্তু তুমি গ্রামের গেলে তো এটা এলো কোথা থেকে? ক্ষুব্ধ চিত্তে গোলাপী মাথা নেড়ে মলির দিকে বাড়িয়ে ধরলো জিল।
ক্ষনেকের মধ্যে বোবা হয়ে গেল মলি, তুমি লণ্ডন গিয়েছিলে, তাই না? প্রশ্ন করলো জিল।
হা, গিয়েছিলাম। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো মলি। তার দু গালে রক্তিম আভা।
আমি এখান থেকে লণ্ডনেই চলে যাব।
ক্রিস্টোফার রেনের সঙ্গে দেখা করেছে?
না না, ওসব কোনো ব্যাপারই নয়।
তবে কি জন্যে?
মলি দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করল,–এই মুহূর্তে তোমায় আমি তার উত্তর দিতে রাজি নই।
তার অর্থ একটা বিশ্বাস যোগ্য গল্প বানাবার সময় চাইছো।
এই তো? তুমি… তুমি এত নিচ জিল!
উত্তেজনায় মলি গলা কাঁপিয়ে বলল, আমি তোমাকে ঘৃণা করি।
আমি অবশ্য করি না, কিন্তু করতে পারলেই যেন স্বস্তি পেতাম।
এখন মনে হচ্ছে…, তুমি আমার কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত, অপরিচিত… তোমার সম্বন্ধে প্রায় কিছুই আমি জানি না।
আমার বক্তব্যও ঠিক তাই।
তুমি আমার জীবনে একজন বিদেশী আগন্তুক ছাড়া আর কিছুই নয়। আমার কাছে নির্দ্বিধায় মিথ্যে বলতেও তোমার বাধে না…।
আমি কখন তোমাকে মিথ্যে বলেছি?
মলির ঠোঁটের ফাঁকে রুগ্ন হাসি ফুটে উঠলো।
তুমি কি ভাবছো আমি তোমার এই তারের জাল কিনতে আসার আষাঢ়ে গল্প সত্যি বলে বিশ্বাস করি?
ওই একই দিনে তুমিও লণ্ডনে গিয়েছিলে।
তুমি নিশ্চয় আমাকে কোথাও দেখেছিলে? ক্লান্তকণ্ঠে জিল বললো, এবং আমার ওপর এইটুকু বিশ্বাসও তোমার নেই যে…।
তোমাকে বিশ্বাস!
আমি আর কোনোদিনই কাউকে বিশ্বাস করবো না… কখনও না।
ইতিমধ্যে কিচেনের ভেজানো দরজাটা যে নিঃশব্দে ঈষৎ ফাঁকা হয়েছিলো, দুজনের কারোরই সেটা নজরে পড়েনি।