হাত দিয়ে বিছানার চাদরটা মলি ঝেড়ে দেয়। তারপর আবার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল। ইতিমধ্যে অন্ধকার নেমে এসেছে। বাড়িটা যেন তার কাছে বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। খুব বেশি নির্জন ঘরটা। এখান থেকে নিকটবর্তী গ্রামের দূরত্ব দু-মাইল মত। শহরে যেতে গেলেও এই দু-মাইল পেরিয়েই যেতে হয়। অর্থাৎ দু-মাইলের মধ্যে কোনো লোকালয়ের চিহ্ন নেই।
এর আগেও সে এই বাড়ির মধ্যে অনেকবার একা একা কাটিয়েছে। কিন্তু আজকের এই নির্জনতা তার কাছে বড় অস্বস্তিকর মনে হচ্ছে। স্নায়ুর ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে তার।
কাঁচের জানালার ওপর বরফ এসে পড়ায় এক ধরনের মৃদু খসখসে শব্দ হচ্ছে। একনাগাড়ে কেউ যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। অস্বস্তিতে মলি কেঁপে উঠল, যদি জিল কোনো কারণে পৌঁছতে না পারে। এই ভয় তার মনের কোণে উঁকি মারে। সে ভাবতে থাকে তুষার পাতের ফলে যদি রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় তাহলে? যদি সত্যিই তাকে এই নির্জন বাড়িতে একা একা থাকতে হয়? ঈশ্বর না করুন, যদি প্রকৃতই সেই রকম অবস্থা হয় তবে কদিনের জন্যে যে তাকে এখানে বন্দী হয়ে থাকতে হবে তার কি কোনো অনিশ্চয়তা আছে? একদিনের মধ্যে যে রাস্তাঘাট পরিষ্কার হবে, এমন আস্থাও সে রাখতে পারছে না।
মলি একবার রান্নাঘরটার মধ্যে চোখ বোলাল। আকারে প্রকারে বেশ বড় ঘরটা। বিরাট চেহারার একজন পাঁচক না হলে এ ঘর মানায় না। শক্ত কেকের সঙ্গে দুধবিহীন কালো চা পান করতে করতে মনে মনে এই কথাটাই ভাবছিল। আর পাঁচকের একজন সাহায্যকারীও চাই, সে হবে একজন বয়স্কা। সেই সঙ্গে একজন ছিপছিপে চেহারার তরুণী ঝিও চাই।
তাছাড়া রান্নাঘর পরিষ্কারের জন্য আরো একজন বুড়ি ঝি-এরও একান্ত প্রয়োজন, যে বাবুদের খাওয়া দাওয়ার সময় দূরে দাঁড়িয়ে ভয়ের চোখে লক্ষ্য করবে সবকিছু। কিন্তু এখন মলি সম্পূর্ণ একা। এবং তাকে যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হচ্ছে সেটাও তার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত নতুন এই মুহূর্তে তার সমস্ত জীবনটাই ঠেকছে অস্বাভাবিক ও অবাস্তব। এমন কি জিলও এখন যেন স্বাভাবিক নয়। মলি যেন শুধু একটা নির্দিষ্ট ভূমিকায় অভিনয় করে যাচ্ছে, নিছকই অভিনয়।
জানলার ওপাশে কার যেন কালো ছায়া পড়ল; মলি চমকে লাফিয়ে উঠলো। তুষারের ওপর দিয়ে একজন অপরিচিত আগন্তুক দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে। সদর দরজায় মলি শুনতে পেল কে যেন ঠকঠক শব্দ করছে। অপরিচিত আগন্তুক এখন উন্মুক্ত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বর্ষাতির ওপর থেকে হিমের কুচিগুলো ঝেড়ে ফেলছে। তারপর সে বাড়ির মধ্যে বেশ ধীরে সুস্থে ঢুকে পড়ল।
মলির পলকের মধ্যে দৃষ্টি বিভ্রম হল। আনন্দে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল। ওঃ জিল। তুমি ফিরে এসেছে, জেনে বা দেখে আমার খুব ভালো লাগছে।
আজকের আবহাওয়াটা এত জঘন্য যে, আমি ঠান্ডায় প্রায়ই জমে গেছি বললেই চলে।
জিল ভেতরে ঢুকে সানবাঁধানো মেঝের ওপর পা ঝাড়ল জোরে জোরে। হাত দিয়ে হাতটা ঘষে শরীরের মধ্যে উষ্ণতা সঞ্চারে ব্যর্থ প্রয়াস করল সে।
সহজাত অভ্যাস বলেই মলি জিলের ছুঁড়ে দেওয়া কোটটা হ্যাঁঙ্গারে টাঙ্গিয়ে রাখলো। কোটের পকেট থেকে একগাদা জিনিষপত্র বের করে টেবিলের ওপর গুছিয়ে রাখল। একটা মাফলার, ঘরের কাগজ, এক বাণ্ডিল গুলিসুতো আর সকালের ডাকে আসা কয়েকটা চিঠি পত্র। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে গ্যাসের উনুনে কেটলি করে জল চাপালো।
মলি প্রশ্ন করল, তুমি কি তারের জাল পেয়েছ? সামান্য একটা জিনিষ কিনতে গিয়ে যেন একটা যুগ কাটিয়ে ফিরে এলে।
না যে ধরনের জালের কথা ভেবেছিলাম এগুলো সেরকম নয়, এতে আমাদের কাজ হবে না, খবর পেয়ে অন্য আরেক জায়গাতেও খোঁজ করলাম। কিন্তু সেগুলোও দেখতে একই রকম। এদিকে তুমি এতক্ষণ কি করছিলে? ইতিমধ্যে নিশ্চয় কেউ আসেনি?–জিল প্রশ্ন করল মলিকে।
মিসেস বয়েল সকালের আগে এসে পৌঁছচ্ছেন না।
মেজর মেটকাফ আর মিঃ রেনের তো আজকেই আসার কথা ছিল।
মেজর ভদ্রলোক চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, তিনিও কাল সকালের আগে আসছেন না।
তাহলে তো ডিনারের জন্য কেবল মিঃ রেনই অবশিষ্ট রইলেন। তিনি কেমন লোক হবেন বলে তোমার ধারণা? আমার তো মনে হয় ভদ্রলোক কেমন গম্ভীর প্রকৃতির অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারী।
উত্তর এল, না না, আমার মনে হয় তিনি একজন শিল্পী।
ঠাট্টার সুরে জিল বলল। তোমার আশঙ্কাই যদি সত্য হয় তবে তার কাছ থেকে আমরা একসপ্তার অগ্রিম নিয়ে রাখবো।
মলি বলল, তুমি যে কি বোকার মত কথা বল। আমাদের এত ভাবনার কি আছে? তিনি তো শুধু হাতে এখানে থাকছেন না। মালপত্র নিশ্চয় কিছু সঙ্গে থাকবে। যদি সত্যিই বিল তিনি মেটাতে না পারেন তবে আমরা তার মাল আটকে রাখব।
কিন্তু ধর যদি দেখা যায় যে তার মালপত্র কেবল পুরনো খবরের কাগজে মোড়া বড় বড় পাথরের টুকরো তাহলে? জিল বলল। তারপর আবার বলতে শুরু করে আসল সমস্যাটা হচ্ছে এই ব্যবসার নাড়িনক্ষত্র আমরা কিছু জানি না। কোনো অভিজ্ঞতাই আমাদের নেই। আরেকটা কথা, আমরা যে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, সেটাও যেন আমাদের অতিথিরা বুঝতে না পারেন।
সন্দেহের সুরে মলি বলল, মিসেস বয়েলের কাছে কিন্তু ব্যাপারটা গোপন রাখা খুবই কষ্টকর হবে। কেননা তিনি হচ্ছেন সেই প্রকৃতির মহিলা…।