উত্তর দিলনা।
মলি বলল–তবে তুমি কেন…।
নাম বদলিয়ে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি এই তো? আমার এটাকে একটা ব্যক্তিগত খেয়ালও বলা যায়। ছোটবেলায় আমার সহপাঠীরা আমাকে ক্রিস্টোফার রবিন বলে ডাকতো। সেখান থেকেই এই নামটা মাথায় এসেছে আমার।
মলি জিজ্ঞেস করল–তাহলে তোমার আসল নামটা কি?
শান্ত গলায় ক্রিস্টোফার জবাব দিলেন-আসল নামটা শুনে তোমার কোনো উপকার হবে না। তবে স্থপতি আমি নই। প্রকৃতপক্ষে আমি একজন পলাতক সৈনিক।
কিছুক্ষণের জন্য মলির দু চোখে একটা ভয় ও উদ্বেগের ছায়া ঘনিয়ে এল।
সেটা ক্রিস্টোফারের নজর এড়াল না, বলল–হ্যাঁ,…ঠিক আমাদের অজ্ঞাতকুলশীল হত্যাকারীর মত। সেইজন্যেই তো বললাম, আমার সঙ্গে খুব ভালো মিশে যায় খুনীর বৈশিষ্ট্যগুলো।
মলি ধমকে উঠে বলল–বোকার মত কথা বলো না। আগেই জানিয়েছি, হত্যাকারী বলে আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না, ঠিক আছে আগাগোড়া খুলে বল তোমার কাহিনীটা। সেনাবাহিনী থেকে পালাতে গেলে কেন? ভয়…?
ভয় পেয়ে পালিয়েছি কিনা সে বিষয়ে জিজ্ঞেস করছো? না। ব্যাপারটা অদ্ভুত হলেও সত্যি। তেমন কোনো ভয় ছিল না আমার। অন্ততপক্ষে সাধারণ অন্যান্য সৈনিকদের চেয়ে আমার সাহস কিছু কম ছিল না। এমন কি গোলাগুলি চলাকালীনও আমার মেজাজ শান্ত থাকত আশ্চর্যভাবে। সেজন্য আমার একটা বিশেষ সুনাম ছিল সেনাবাহিনীতে। এই সব তুচ্ছ কারণে আমি সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসিনি। প্রকৃত কারণ হল আমার মা।
মলি বলল–তোমার মা?
রেন বলল–হ্যাঁ, গত যুদ্ধের সময় নাৎসী বিমানবাহিনীর আক্রমণে আমার মা মারা যায়। তিনি যে বাড়িতে ছিলেন, বোমার আঘাতে সেই বাড়িটা একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়। সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে মৃতদেহটা বার করে আনতে হয়েছিল। খবরটা শোনার পরই কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেল মাথাটা। সাময়িকভাবে আমি বোধহয় পাগলই হয়ে গেলাম। আমার মনে হল–মা নয়, আমিই যেন সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে চাপা পড়ে আছি। আমাকে সেই মুহূর্তে উদ্ধার না করলে আমি শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাব।–অসহায়ভাবে ক্রিস্টোফার মাথা ঝাঁকালেন। অপরিসীম ক্লান্তিতে বুজে আসতে চাইছে কণ্ঠস্বর। দুঃস্বপ্নে ভরা সেই দিনগুলির কথা কেউ বোঝে না। শিবির ছেড়ে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেলাম।
৪. উদভ্রান্তের মতো
উদভ্রান্তের মতো বনে জঙ্গলে পাহাড় পর্বতে ঘুরে বেড়ালাম। তারপর যখন সম্বিৎ ফিরে এলো তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। শান্তি ফেরাতে পুনরায় শিবিরে গেলেও ওড়াতে পারলুম না। কারণ ইতিপূর্বেই আমার নাম ফেরারীদের তালিকায় উঠে গেছে। এই সাময়িক অন্তর্ধানের কোনো সন্তোষজনক কৈফিয়ৎ আমার জানা নেই। তখন থেকে আমি কেবল পালিয়ে পালিয়েই বেড়াচ্ছি। ক্রিস্টোফার এক জোড়া শূন্য হতাশ চোখে মলির দিকে তাকিয়ে রইলেন।
তোমার ধারণাটাই সম্পূর্ণ ভুল। সান্ত্বনার সুরে মলি বললো, তুমি আবার নুতন করে সব কিছু আরম্ভ করতে পারো।
কারোর পক্ষেই কি তা আর সম্ভব? নিশ্চয়! তাছাড়া তুমি তো এখনও যুবক! তোমার বয়সও কম।
হ্যাঁ তা ঠিক। তবে আমি একবারে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি। সব কিছুই আজ আমার নিঃশেষ হয়ে গেছে।
নাঃ, দৃঢ় কণ্ঠে প্রতিবাদ জানালো মলি। তোমার কিছুই ফুরিয়ে যায়নি। এর সমস্তটাই তোমার কল্পনাপ্রসূত। আমার বিশ্বাস, প্রত্যেকের জীবনেই একবার করে এই ধরনের একটা অনুভূতির জোয়ার আসে। তখন মনে হয়, দিগন্ত জুড়ে গভীর অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। পায়ের নিচে মাটিটুকু তো আর খুঁজে পাব না। সবকিছুর চরম পরিসমাপ্তি বুঝি আসন্ন।….
তুমি নিশ্চয় কোনো এক সময় এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলে? তা না হলে তো এত নিখুঁত ভাবে বর্ণনা দিতে পারতে না?
অকপটে মাথা দুলিয়ে বলল–হ্যাঁ, তা হয়েছিলাম বৈকি।
তোমার সমস্যাটা কি ছিলো?
সমস্যাটা যদিও কিছু নতুন নয়। অনেকের ভাগ্যেই সেরকম ঘটতে দেখা গেছে। আমি যে যুবকটির বাগদত্তা ছিলাম সে একজন পাইলট ছিল। আগের যুদ্ধে সে মারা যায়।
শুধু এই…আর কিছু নয়তো?
সে বলল–হ্যাঁ, আরো আছে। ছেলেবেলায় আমি একটা প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পাই। আমাকে হিংস্রতা ও নিষ্ঠুরতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তখন থেকেই একটা বিরূপ ধারণা ছিল বুকের মধ্যে। জ্যাকও যখন তারপর দুর্ঘটনায় মারা গেল, তখন মনে হল–সমস্ত জীবনটাই বুঝি এইরকম ক্রুর বিশ্বাসঘাতকতায় ভরা ছিল। মানুষের কোনো স্বপ্নই সত্যি হয় না।
হা…পেরেছি বুঝতে। আর তারপরে বুঝি… রেন মলির দিকে চোখ তুলে প্রশ্ন করল জিলের সঙ্গে বুঝি পরিচয় হল?
মলির পাতলা ঠোঁটে হাসির রেখা ছড়িয়ে গেল। বলল–হ্যাঁ এবং জিলের আসার সঙ্গে সঙ্গে নতুনভাবে যেন আমার জীবনটা বইতে শুরু করল। এ যেন সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। আগের যাবতীয় ভয় আর দুর্ভাবনা কোথায় যেন একমুহূর্তে মিলিয়ে গেল। জিল নামটার মধ্যে যেন লুকিয়ে আছে সুখ আর নিরাপত্তার আস্বাদ।
তার ঠোঁট থেকে যেন হঠাই হাসির রেখাটুকু মিলিয়ে গেল। চোখে মুখে দেখা গেল ঝড়ের পূর্বাভাস। প্রচণ্ড ঠান্ডার জন্যও তার শরীরটা বারকয়েক কেঁপে উঠল।
সে বলল–সত্যিকারের ঘটনাটা কি? কিসের জন্য তুমি এত বিচলিত হচ্ছো মলি? সত্যিই তুমি মনে মনে খুব অস্থির হয়ে পড়েছে। বল কথাটা ঠিক কিনা?