রেন মাথা নেড়ে বললেন–আমাকে নয়, আমি বরং উদ্বুদ্ধ হয়ে যাচ্ছি বলতে পারেন। সমস্ত ব্যাপারটা এত বেশি অস্বাভাবিক….
মলি তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচিয়ে বলল–আপনি যদি মিসেস বয়েলের মৃতদেহটা প্রথম আবিষ্কার করতেন, তাহলে…তাহলে আপনি এরকম কথা বলতে পারতেন না। দৃশ্যটা যেন আমার চোখের সামনে ভাসছে…কিছুতেই যেন সেটা আমি ভুলতে পারছি না। সারা মুখটা বিশ্রীভাবে ফুটে উঠেছে, তার মধ্যে একটা গাঢ় বেগুনি আভা…
আপনা-আপনি কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এল মলির। ওর সারা শরীর যেন কেঁপে উঠল থরথরিয়ে। ক্রিস্টোফার এগিয়ে এসে মলির পিঠে হাত রাখলেন। বললেন–সত্যিই, আমি বাস্তবিকপক্ষে খুব নির্বোধ। আমার উচিত ছিল বোঝা, আমি দুঃখিত মিসেস ডেভিস, আমি এতটা ভেবে দেখিনি।
একটা বোবা কান্না যেন মলির গলাকে আটকে ধরল। সে বলল–এইমাত্র সবকিছু যেন কিরকম সহজ ও স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। এই রান্নাঘর…সমস্ত জিনিষপত্র..মলি অস্পষ্ট ধরা গলায় বলে গেল–কিন্তু…কিন্তু আবার হঠাৎই দুঃস্বপ্নের ছায়াগুলো পুনরাবির্ভাব ঘটল!
রেন মলির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। তার চোখেমুখে দেখা গেল এক অদ্ভুত অভিব্যক্তি। সব বুঝতে পেরেছে এরকম ভান করে মাথা নাড়িয়ে বার কয়েকবার বললেন হ্যাঁ আমি বুঝতে পারছি। তাহলে…তাহলে এখন আমি যাই। এখন আপনাকে বিরক্ত না করাই ভালো!
অনুরোধের সুরে মলি বললনা, আপনি যাবেন না।
ততক্ষণে রেন দরজার কাছে পৌঁছে গেলেন। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তিনি ঘাড় ঘুরে তাকালেন। তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে বললেন–আপনি কি সত্যিই তাই চান?
মলি বলল–কি চাওয়ার কথা বলছেন?
মানে আমি এখানে থাকি সেটাই কি আপনি চান?
মলি বলল হ্যাঁ, নিশ্চয়, আমি এখন একলা থাকতে চাই না। একলা থাকলেই আমায় ঘিরে ধরছে হাজার রকমের দুশ্চিন্তা।
একটা চেয়ার টেনে বসলেন ক্রিস্টোফার রেন শান্ত ভঙ্গিতে। মলিও তার হাতের কাজ শেষ করে একটা চেয়ার টেনে বসল।
ক্রিস্টোফার বিড়বিড় করে বলল সত্যিই খুব আশ্চর্যের ব্যাপার!
মলি বলল–কি আশ্চর্যের ব্যাপার?
আপনি যে আমার সঙ্গে একা থাকতে ভয় পাচ্ছেন না সেইজন্য খুব অবাক লাগছে। আচ্ছা সত্যিই আপনি ভয় পাচ্ছেন না তো?
মলি মাথা নাড়ল, জোরে বলল–না, মোটেই না।
এই ভয় না পাওয়ার কারণ কি, মিসেস ডেভিস?রেন প্রশ্ন করল।
আমি জানি না ঠিক, তবে এটা সত্যি।
কিন্তু অপরাধী হিসেবে আমার ওপরেই তো প্রথম জাগে সন্দেহটা। আমার সঙ্গে মিলে যায় সবকিছুই।
মলি দৃঢ়কণ্ঠে জানাল–না। সন্দেহভাজন আরো অনেকেই আছে। সার্জেন্ট ট্রেটারের সঙ্গে কথাবার্তা হচ্ছিল সেই বিষয়ে।
তিনি কি বিশ্বাস করেছেন আপনার কথা?
ধীরে ধীরে মলি উত্তর দিল–অবিশ্বাসও করেননি।
কতগুলো টুকরো টুকরো শব্দ তার মাথার মধ্যে বার বার ভেসে আসছে। বিশেষ করে ট্রেটারের সেই অমোঘ উক্তি–আপনার মনের মধ্যে এমন কি ধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটে চলেছে আমি তার কিছুটা বুঝতে পারি, মিসেস ডেভিস!
সব কিছুই কি তিনি জানতে পেরেছেন? আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য তিনি করেছেন। প্রকৃত হত্যাকারী নাকি সমস্ত পরিস্থিতিটা বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছেন? এটাও কি সত্যি!
ঈষৎ উদ্বিগ্ন কণ্ঠেই রেনকে প্রশ্ন করলো মলি, আপনি নিশ্চয়ই এই বিপদসঙ্কুল পরিবেশটা মনে মনে বুঝতে পারছেন না। মুখে আপনি যাই বলুন না কেন।
আসল ব্যাপারটা নিশ্চয় তা নয়।
না না, নিশ্চয় না, অবাক হয়ে মলি তাকিয়ে রইল ক্রিস্টোফারের দিকে।
এ ধরনের একটা ঘটনা আপনার মাথায় ঢুকলো কি করে?
এটা আমার বক্তব্য নয়, সার্জেন্ট ট্রেটারের। আমি…আমি…ওই লোকটাকে ঘৃণা করি।
কিভাবে আপনার মাথায় ঢুকলো এই ধরনের একটা ধারণা? যা একদমই সত্যি নয়…যা একেবারেই অসম্ভব…
মলির কণ্ঠস্বর ভাঙা ভাঙা।
তার শরীরটা অবসাদে এখন ভেঙে পড়েছে।
কান্নার ভারে চোখ দুটো বুজে আসছে।
মলি টেবিলে মাথা রেখে মুখ ঢাকলো। ক্রিস্টোফার এগিয়ে এসে মলির পিঠে হাত রাখলো।
তার কণ্ঠে গভীর সমবেদনার স্পর্শ। ক্রিস্টোফার ডাকলেন, মলি মুখ তোলো, এই প্রথম নাম ধরে ডাকলেন।
তোমার কি হয়েছে?
ধীরে ধীরে মলি সংযত করলো নিজেকে। ক্রিস্টোফারের আচার আচরণের ছেলেমানুষ সুলভ প্রগলভতার কোনো চিহ্ন নেই।
কি ব্যাপার মলি?
ক্রিস্টোফার পুনরায় প্রশ্ন করলেন।
মলি অপলখ চোখ তুলে রেনের দিকে তাকিয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত।
তার দৃষ্টির গভীরে একটা স্থির আলোর উদ্ভাস। ক্রিস্টোফার আমাদের এই পরিচয়টা কত দিনের?
দু দিন মাত্র…?
প্রায় সেই রকমই। কিন্তু তোমার কি মনে হচ্ছে না পরস্পরকে আমরা জানি অনেকদিন আগেই?
হ্যাঁ, ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত! তাই না?
ঠিক বলা যায় না। তবে আমরা যেন পরস্পরের হৃদয়টা গভীরভাবে বুঝতে পারছি। দুজনেই আমরা এখন একই বিপদের মুখোমুখি এসে পড়েছি বলেই হয়ত এমন একটা সহমর্মিতা গড়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে।
ক্রিস্টোফারের গলায় কোনো প্রশ্নের আভাস ছিল না। সহজ সরল বিবৃতির মতই শোনাল কথাটা। এর উত্তর দেওয়ার জন্যও মলির মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা গেল না। একটু থেমে অন্য প্রসঙ্গ শুরু হল। তার কথার সুরেও ঝঝ নেই প্রশ্নের। স্বাভাবিক একটা সত্যকে সে নির্বিঘ্নে বলেছে। বলল তোমার আসল নামটা নিশ্চয় ক্রিস্টোফার রেন নয়…?