ওদের মা মারা গিয়েছিল অনেকদিন আগেই। যুদ্ধকালে দরকারী কাজে ওই তিনটে বাচ্চাকে বাবার দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
সেই ভদ্রলোকেরই বা কি খবর? এখন তিনি কোথায়?
আমাদের কাছে কোনো খবর নেই। যুদ্ধের প্রয়োজন মিটে যাওয়ায় এক বছর আগে সেনাবাহিনী থেকে তাকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়।
ছেলের যদি মানসিক ভারসাম্য বজায় ঠিক না হয় তবে তার বাবার ক্ষেত্রেও এই একই ব্যাপার ঘটতে পারে?
হা নিশ্চয়!
তাহলে আমাদের বর্তমান হত্যাকারী যে মাঝবয়সী বা বৃদ্ধলোক এ ধারণা কিছু অসম্ভব নয়? এই প্রসঙ্গে আমার একটা কথা খুব মনে পড়ছে। মেজর মেটকাফ যখন প্রথম জানতে পারেন যে পুলিস কর্তৃপক্ষ এখানে আসছেন তখন খুব বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন তিনি।… হ্যাঁ তিনি সত্যিই খুব ভয় পেয়েছিলেন।
সার্জেন্ট ট্রেটার শান্ত গলায় বললেন–আমাকে বিশ্বাস করুন মিসেস ডেভিস। প্রথম থেকে সবরকম বিচার-বিবেচনা করেছি আমি। জিম নামে ওই ছেলেটা বা তার বাবা–এমন কি তার বোনের সম্ভাবনাও বাদ দেওয়া যায় না। আমাদের বর্তমান হত্যাকারী একজন মহিলাও হতে পারেন–তা জানেন? কোনো কিছুই আমার নজর থেকে এড়িয়ে যায়নি। আমি মনে মনে নিশ্চিত, তবে নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমাণের খুবই অভাব। বর্তমানে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর সম্বন্ধে সম্পূর্ণ তথ্য জানা খুবই কঠিন কাজ।
আমাদের এই কর্মজীবনে অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতারই মুখোমুখি হতে হয় সে সম্বন্ধে কোনো ধারণা নেই আপনার। যদিও অধিকাংশ মামলাই বিবাহ-সংক্রান্ত। কিছুদিনের পরিচয়েই বিয়ে, বা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মধ্যে তাড়াতাড়ি করে বিবাহ–এ সমস্তই খুব বিপজ্জনক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে চেনে না, এমন কি তাদের আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবের কোনো পাত্তা নেই। একে অন্যের মুখের কথাতেই বিশ্বাস করে। হয়ত ছেলেটা বলল–যে সে একজন পাইলট, কিংবা সেনাবাহিনীর কোনো মেজর। ব্যস্ মেয়েটাও তাই বিশ্বাস করে নেয়। তারপর বছর দুই পার হতে না হতেই বিবাহিত জীবনযাপনের পর জানা গেল– ছেলেটা কোনো পালিয়ে আসা ব্যাঙ্ক কর্মচারী। তার নামে বিরাট একটা অঙ্কের বিল কুলছে মামলার জন্য। তার অন্য কোনো সংসার থাকাটাও বিচিত্র কিছু নয়। অথবা হতে পারে সে আসলে একজন যুদ্ধ পলাতক কোনো সৈনিক। সামরিক বিভাগ তার নামে হুলিয়া জারি করেছে…।
ট্রেটার একটু থেমে আবার বলতে শুরু করল, আপনার মনের মধ্যে যে কি হচ্ছে তা আমি বেশ ভালোই বুঝতে পারছি। তবে মিসেস ডেভিস একটা কথা মনে রাখবেন আমাদের বর্তমান হত্যাকারী সমস্ত পরিবেশ-পরিস্থিতিটা ভালো করেই বেশ উপভোগ করছে।…হ্যাঁ, এ বিয়ে আমি নিশ্চিত।
আস্তে আস্তে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল ট্রেটার। মলি কিছুক্ষণ পাথরের মত নিশ্চল অবস্থায় রইল। তার হাত-পাগুলো যেন অসাড় হয়ে গেছে। তার চোখের কোণে দেখা দিয়েছে চিন্তার ছাপ। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল জ্বলন্ত গ্যাসের দিকে। পরিচিত মসলার সুগন্ধে মলি যেন নিজেকে নতুন করে ফিরে পেল। গুরুভার হৃদয়টা অনেকটা যেন হাল্কা হল। অনেকক্ষণ পরে সে তার নিজের ঘরের গৃহস্থালীর নিবিড় নীড়ে একটা আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে। রান্নাবান্না সংসারের খুঁটিনাটি দায়দায়িত্ব–এইসব হাসি-কান্না নিয়েই তার গদ্যময় জীবন। এবং অনেক অনেক বছর আগে থেকে নারীরাই এর ঝামেলা-ঝক্কি সামলে এসেছে। বিপদসঙ্কুল উন্মত্ত পৃথিবীর বুকে এই রান্নাঘরটাই নিরাপদ আশ্রয় নারীদের।
বন্ধ করা দরজাটা একটুখানি খুলল। ঘাড় ঘুরিয়ে মলি তাকিয়ে দেখল ক্রিস্টোফার রেন ঢুকল। ভদ্রলোক এখনও বেশ হাঁপাচ্ছেন।
রেনের তীব্র গলা শোনা গেল–এদিককার খবর সব শুনেছেন। কি ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানাই না চারদিকে ঘটে চলেছে–সার্জেন্ট ট্রেটার তার স্কী দুটো খুঁজে পাচ্ছেন না।
মলি বলল–চাকা লাগানো স্কী দুটোর কথা বলছেন? কেন…সে-দুটো চুরি করেছে কে? আর কি লাভ সে-দুটো চুরি করে?
খবরটা আমারও ভাবনার বাইরে চলে যাচ্ছে…মানে..আমি বলতে চাই, সার্জেন্ট ট্রেটার সত্যিই যদি আমাদের ছেড়ে যেতে চান তাহলে খুনীরই তো সব থেকে বেশি লাভ হবে। সেই জন্য এই ঘটনার মধ্যে আমি সুনির্দিষ্ট কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছি না।
জিল তো নিজেই সিঁড়ির নিচে কাঠের আলমারিতে স্কী দুটো রেখে এসেছিল।
রেন মৃদু হেসে বললেন–ভালো, কিন্তু এখন সেদুটো সে জায়গায় নেই। ব্যাপারটা সত্যিই আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। আমাদের সার্জেন্ট কিন্তু খুব রেগে গেছেন–জানেন! রাগী কচ্ছপের মত সারা বাড়িটা তিনি এখন ঘুরে বেড়াচ্ছেন। হতভাগ্য মেজরকে তো জেরার পর জেরা করে কাহিল করে ছাড়ছেন। কিন্তু মেজর একটা কথাই বলে চলেছেন। তিনি যখন কাঠের আলমারিটা খুলছিলেন তখন স্কী দুটো আছে কি নেই ভালোভাবে তিনি সেটা লক্ষ্য করেননি। এ বিষয়ে কোনো খেয়ালই তার ছিল না। ট্রেটারের বক্তব্য এতবড় জিনিষটা ভদ্রলোকের নজর এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কোনো রহস্যময় কারণেই তিনি এখন সত্যি কথাটা গোপন করছেন। রেন আরেক পা এগিয়ে এসে বললেন–এই সমস্ত ব্যাপারটা সার্জেন্ট ট্রেটারকে বেশ খানিকটা দমিয়ে দিয়েছে।
ব্যাজার মুখে মলি বলল–আমিও খুব এতে বিব্রত বোধ হচ্ছি। প্রত্যেকের স্নায়ু এখন অসুস্থ হয়ে উঠেছে।