মলি একে একে সমস্ত আলুর খোসা ছাড়িয়ে রাখলো একটা পাত্রের মধ্যে। তারপর তাতে নুন-মশলা ছড়িয়ে উনুনের উপর বসিয়ে দিল। তার বাঁপাশে জ্বলছে আরো দুটো গ্যাসের উনুন। তাদের প্রত্যেকটির মাথার ওপরে বসানো বিভিন্ন রকম আয়তনের পাত্র। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস মলি ফেলল। যেন সব কিছুই এগোচ্ছে পরিকল্পনা মতো।
কিছুটা দূরেই টেবিলের ওপর দুদিনের পুরোন ইভনিং স্ট্যাণ্ডার্ডটাও নজরে পড়ল, তবে তার ক্রু জোড়া আপনা-আপনি কুঁচকে গেল। শুধু যদি ঘটনাটা মনে রাখতে পারত…
হঠাৎ যেন তার মাথায় বজ্রপাত হল। দু-হাতে চোখ ঢেকে ভয়ার্ত সুরে চেঁচিয়ে উঠল মলি, না…না…কখনই না…।
আবার আস্তে আস্তে মলি হাত নামাল। তার দুচোখে রয়েছে একটা বিভ্রান্তির ছাপ। এমন ভাবে সে সবদিকে চোখ মেলে চাইল মনে হল এ পরিবেশে সে যেন নতুন। অথচ ঘরটার মধ্যে আবহাওয়াটা এতই গরম ও আরামদায়ক, কত খোলামেলা। তার সঙ্গে মনের মত খাদ্যবস্তুর তৃপ্তিকর গন্ধ।
চাপা কণ্ঠে মলি আবার ফিসফিস করে বলল–না..না…এ হতে পারে না।
স্বপ্নের মতোই মলি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। রান্নাঘরের বাঁদিকের দরজা পার হয়ে দাঁড়াল বড় হলঘরটার মধ্যে। সমস্ত বাড়িটার মধ্যে বিরাজ করছে এক অদ্ভুত নীরবতা। কেবলমাত্র অনেক দূরে মনে হচ্ছে কেউ যেন একনাগাড়ে শিস্ দিয়ে চলেছে। তার খুব পরিচিত সুরটা। কান পেতে ভালোভাবে শোনার চেষ্টা করল সেই সুরটা মলি। কিছুক্ষণের পর এক তীব্র অস্বস্তিতে তার সর্বাঙ্গ শিউরে উঠল। সেই ছেলেভুলোনো সুরটা।
মলি ভয়ে ভয়ে তার রান্নাঘরে ফিরে গেল। পরিচিত পরিবেশের মধ্যে দাঁড়িয়ে নিজের মনটা কিছুটা স্বস্তি পেল। হ্যাঁ, সুশৃঙ্খলভাবেই যেন সবকিছু এগিয়ে চলছে।
মেজর মেটকাফ পিছনের সিঁড়ি বেয়ে বড় হলঘরটার মধ্যে ঢুকলেন। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন এক মিনিট। তারপর সিঁড়ির নিচে বাসনপত্র রাখবার জন্য কাঠের আলমারীর দিকে গেলেন এগিয়ে। চারদিকে শেষবারের মত একবার চোখ তুলে তাকাল। কেউ নেই আশেপাশে। কোনো সাড়াশব্দও পাওয়া যাচ্ছে না। কাজকর্ম সব সেড়ে নেবার এটাই হল উপযুক্ত সময়।…
একা একা ঘরের মধ্যে পশমের মাফলার বুনছিলেন মিসেস বয়েল। বোনার কাজটা বন্ধ রেখে রেডিওর সুইচটা অন্ করে দিলেন হাত বাড়িয়ে। চোখেমুখে তার যেন লেগে রয়েছে। বিরক্তির ছাপ। মেয়ে গলার সুন্দর প্যানপ্যানানি তার বিরক্তিকে আরো যেন বাড়িয়ে তুলল। ছেলেভুলোনা ছড়াটার মানে নিয়েই ভদ্রমহিলা বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। একটু অধৈর্য হয়ে মিসেস বয়েল রেডিওর নবটা আবার ঘোরালেন। এখানেও পুরোদমে চলছে বক্তৃতা। তবে সুরটা ছিল পুরুষ মানুষের। এবং গলাটাও ছিল বেশ ভরাট ও মার্জিত। মানসিক কীর্তির বিচিত্র গতিপ্রকৃতি বিষয়েই তিনি আলোচনা করছিলেন।
বক্তা বলছিলেন, ভয়ের দিকটাই প্রথমে ভালোভাবে লক্ষ্য করতে হবে। মনে করুন নিঃশব্দে আপনার পেছনের দরজাটা খুলে গেল…
সত্যি সত্যি পেছন দিকের একটা দরজা নিঃশব্দে গেল খুলে।
মিসেস বয়েল ভীষণ ভাবে চমকে উঠে পেছন দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, ওঃ আপনি? তারপর বয়েল একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, তারপর আবার বললেন কি ক্লান্তিকর অনুষ্ঠানই যে রেডিওর মাধ্যমে প্রচার করা হয়। আমি তো দুদণ্ড ধৈর্য্য ধরে শোনার মত কিছুই খুঁজে পাই না।
আজকাল আমি রেডিও নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাই না মিসেস বয়েল।
মিসেস বয়েল একটু রেগে গেলেন। বললেন–কিন্তু তাছাড়া এখানে করার মত কী-ই আছে। সম্ভাব্য খুনির সঙ্গে বাস করা অবশ্য যদিও আমি ওইসব আজগুবি নাটকের একবিন্দুও বিশ্বাস করি না…
আগন্তুক বললেন–সত্যিই বিশ্বাস করেন না, মিসেস বয়েল?
মিসেস বয়েল বললেন–আপনার এ প্রশ্নের অর্থ…?
আগন্তুকের বর্ষাতির বেল্টটা এত দ্রুত গতিতে মিসেস বয়েলের গলায় জড়িয়ে গেল, তিনি এর ভেতরকার মর্মার্থটা ঠিকমত বুঝে উঠতে পারলেন না। রেডিওর আওয়াজটা আরও বেশি করে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সারা ঘরটা বিদগ্ধ বক্তার গমগমে হয়ে উঠেছে তার বক্তৃতায়।
তবে মিসেস বয়েল গণ্ডগোল করতে পারেনি শেষ সময়ে। কারণ হত্যাকারী সত্যিই দক্ষ এবং তৎপর। সকলেই বড় রান্নাঘরে জমায়েত হল। গ্যাসের আগুনে টগবগ করে ফুটছে আলুগুলো। মাংসের ডেকচি থেকে বের হয়ে আসছে রসনার তৃপ্তিকর সুগন্ধি।
সন্দেহের চোখে একে অপরকে দেখে চলছে। মলি পাঁচপায়ার চেয়ারে গা এলিয়ে বসেছিল। তার সমস্ত মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ভয়ে। তার দুচোখে রয়েছে উদভ্রান্ত দৃষ্টির ছাপ। সার্জেন্ট ট্রেটার খুব জোরের সঙ্গে মলিকে বীয়ার খাবার নির্দেশ দিলেন।
সার্জেন্ট ট্রেটারের মুখে একটা থমথমে রাগের আভাস। তিনি তাকালেন সবার দিকে। পাঁচ মিনিট আগে মলির ভয়ার্ত চীৎকারে সবাই ছুটে এসেছিল লাইব্রেরি ঘরে।
ট্রেটার বললেন–আপনি যখন মৃতদেহটা দেখতে পেলেন, খুব সম্ভব তার দু-এক মিনিট আগেই ভদ্রমহিলা খুন হয়েছেন। আচ্ছা, লাইব্রেরি ঘরে ঢোকার কারুর পায়ের আওয়াজ শুনতে পাননি?
ক্লান্ত গলায় মলি জবাব দিল–একটা শুধু মৃদু শিশের শব্দ শুনতে পেয়েছিলাম। তবে সেটা কিছুক্ষণ আগে। আমার…আমার মনে হচ্ছে যেন…অবশ্য সে বিষয়ে যদিও আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত নই…দরজা বন্ধ করার একটা শব্দও আমার কানে এসে পৌঁছেছিল। তখন আমি লাইব্রেরি ঘরের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিলাম।