তবে তার চালচলনে কোনো চিহ্নই ছিল না আত্মগোপনের জন্য, সহজাত বলিষ্ঠ পদক্ষেপেই তিনি বিদায় নিলেন সেখান থেকে।
জিল মন্তব্য করলেন–ভদ্রলোক সত্যিই গভীর জলের মাছ।
ট্রেটার বললেন–হ্যাঁ, কেন যেন অপরাধী সুলভ মনোভাব, এক বিন্দুও বিশ্বাস করা উচিত নয়।
মলি চেঁচিয়ে বলল–তাই বুবি : তাহলে…তাহলে আপনি কি মনে করেন.কিন্তু বয়সটাতো বেশি দেখায় অনেকটা। অবশ্য এই বয়সটাই সত্যি কিনা সেটা জানা খুবই কঠিন। মেকআপ করেও অনেকসময় বয়স বাড়িয়ে নেওয়া যেতে পারে তবে ভদ্রলোক যখন চলাফেরা করেন তখন মনে হয় যেন এক যুবকই হেঁটে যাচ্ছে। সত্যিই সার্জেন্ট, খুব সম্ভবতঃ মিঃ প্যারাভিসিনি গোপন করতে চায় তার আসল বয়সটা। সত্যিই কি আপনি ওনাকে সন্দেহ করছেন।
সার্জেন্ট ট্রেটার বিরক্তি সহকারে মলির উত্তরটা বা সিদ্ধান্তটা ভেঙ্গে দিয়ে বললেন ঐভাবে শুধুমাত্র কল্পনার উপর নির্ভর করে আমরা সঠিক জায়গায় গিয়ে পৌঁছতে পারব না, মিসেস ডেভিস। তবে সুপারিন্টেন্টে হগবেনকে সব খুলে বলতে হবে। কথা বলতে বলতেই তিনি টেলিফোনটার দিকে এগিয়ে গেলেন।
মলি মাথা নেড়ে বলল–কিন্তু এখন আর তা সম্ভব নয়। কারণ ফোন এখন অচল।
ট্রেটার চমকে চোখ তুলে তাকিয়ে বললেন–কি বললেন? ফোন অচল? কখন থেকে? তার গলার স্বরের তীক্ষ্ণতায় সকলে চমকে উঠলেন।
একটু আগেই মেজর মেটকাফ রিং করছিলেন তখনই ধরা পড়ল ব্যাপারটা।
কিন্তু সকালে তো লাইন চালু ছিল! সুপারিন্টেন্টে হগবেনের জরুরী নির্দেশও পেয়েছেন। আপনারা!
হা, সে কথা ঠিক। বোধ হয় সকাল দশটা নাগাদই ফোনটা বিকল হয়ে যায়, বাইরে যা অবস্থা, কোথাও হয়ত তার ছিঁড়ে গেছে!
ট্রেটারের গম্ভীর মুখটা তাও কাটলো না। তিনি বললেন–খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার! তিনি যেন নিজেকে শুনিয়েই বললেন, কেউ ইচ্ছে করেই লাইন কেটে দিতে পারে।
মলির দুচোখে দেখা গেল অবাকের ছাপ। সে বলল–আপনার কি ধারণা?
ঐ বিষয়ে প্রয়োজন নিশ্চিত হওয়া–ট্রেটার কথাটা বলতে বলতে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল। জিল দু-এক মুহূর্ত ইতস্ততঃ করল। এর পর সার্জেন্টের পেছন পেছন সেও একসময় চোখের বাইরে চলে গেল।
মলি করুণ সুরে আর্তনাদ করে বলল–হ্যায় ভগবান, লাঞ্চের সময় তো প্রায় হয়ে এল। আমাকে এখনি গিয়ে সব কাজ শেষ করতে হবে। তা না হলে অতিথিদের আর খাওয়া জুটবে না।
মলি ঘর ছেড়ে দৌড়ে চলে যাওয়ার পর মিসেস বয়েল ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠলেন–পদে পদেই অযোগ্যতার চূড়ান্ত নিদর্শন! এটা কি একটা হোটেল। আমি কখনও এর জন্য সপ্তায় সাত গিনি দিতে রাজী নই।
সার্জেন্ট ট্রেটার টেলিফোনের লাইন ধরে সামনের দিকে এগিয়ে চললেন। তিনি বললেন এর সঙ্গে কোনো অন্য সংযুক্ত লাইন আছে নাকি? তিনি জিলকে প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ, দোতলায় শোবার ঘরে এর লাইনটা টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে! আমি কি দেখে আসব ওপরে গিয়ে?
যদি কিছু মনে না করেন…?
ট্রেটার জানলার সার্শি খুলে মাথা ঝুঁকিয়ে দেখতে লাগলেন বাইরেটা। সার্শির গায়ে জমে থাকা বরফের টুকরোগুলো ঝরিয়ে দিলেন ঠুকে ঠুকে। জিত দোতলায় উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে!
বড় ড্রইং রুমটার মধ্যে ছিলেন প্যারাভিসিনি। দেওয়ালের গা ঘেঁষে বিরাট লম্বা ধাঁচের সাবেকী আমলের পিয়ানো, তিনি আস্তে আস্তে পায়ে এগিয়ে গিয়ে সাদাকালো রীডের ওপর হাতটা রাখলেন। ক্ষিপ্ত আঙ্গুলগুলো তার সঞ্চালনের সঙ্গে সঙ্গে সারা হলটা করে উঠল গমগম। ছেলেভুলানো ছড়ার সুরটা যেন বুকের মধ্যে বয়ে আনলো রহস্যের মাদকতা।
তিনটে ইঁদুর অন্ধ।
জানলা কপাট বন্ধ
বন্ধ ঘরে তারা
ছুটতে ছুটতে সারা…
একটি সোফায় গা এলিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন শোবার ঘরে ক্রিস্টোফার রেন। যন্ত্রসঙ্গীতের বাজনা তার কানে এল, কিছুটা আনন্দ সহকারে রেন সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের বাইরে পায়চারি করতে লাগল। গানের তালে তালে শিস্ দিতে শুরু করল মৃদুস্বরে। আচমকাই বন্ধ হয়ে গেল তার শিস্। রেন এবার পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে বসে পড়লেন শৌখিন মেহগনি। খাটের প্রান্তে। তার সারা দেহটা অস্থির একটা আবেগে থরথর করে কেঁপে উঠল। ক্রিস্টোফার দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে বিড়বিড় করে বলল আর পারছি না! আমি আর পারছি না…
পরক্ষণেই তার স্বভাবে ঘটল এক আমূল পরিবর্তন। কান্নার আবেগটুকু শক্ত হাতে মুছে দিয়ে তিনি দৃঢ় পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–পারতেই হবে।…নিয়তি নির্দিষ্ট এই পথ দিয়েই আমাকে চলতে হবে। তার গলায় দেখা গেল প্রত্যয়ের সুর।
জিল তার নিভৃত শোবার ঘরে টেলিফোনটার পাশে দাঁড়িয়েছিলো। দেওয়ালের ধারে সরু কাঠের জানলায় মলির পোশাক পরিচ্ছদ সাজানো আছে। একটা পশমের দস্তানা গড়াগড়ি যাচ্ছে মেঝের ওপর। জিল হেঁট হয়ে দস্তানাটা তুলে নিয়ে টাঙ্গিয়ে রাখল আলনার হুকের ওপর। একটা গোলাপী রঙের বাসের টিকিট উড়তে উড়তে এসে পড়ল জিলের কোটের গায়ে। টিকিটটা যে দস্তানার মধ্যে থেকেই বেরিয়ে এসেছে সেটা তার নজরে এড়ায়নি। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে কোটের উপর সেঁটে থাকা ডাকটিকিটটা কাগজের টুকরোর দিকে জিল তাকিয়ে রইল। আস্তে আস্তে তার মুখের স্বাভাবিক রঙটা গেল বদলে। কিছুক্ষণ আগে যে লোকটা এখানে এসেছিল, এ যেন সে নয়। স্বপ্নের মত আস্তে আস্তে এসে যে দরজা ঠেলে বেরিয়ে এল সে বোধহয় অন্য কেউ। ও বাইরে বেরিয়ে এক মিনিটের জন্য থমকে দাঁড়াল। লম্বা টানা বারান্দার বিপরীত দিকে এক পলক দেখে নিল চওড়া সিঁড়িটা।