মলির ভয়ার্ত গলা ভেদ করে একটা যন্ত্রণাকাতর শব্দ বেরিয়ে এল। রাগের ঝঝও দেখা গেল জিলের গলায়। সে বলে উঠল–মিঃ রেন, আপনার পৈশাচিক ঠাট্টার জন্য আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। সম্ভবতঃ সভ্য সমাজের রীতিনীতিগুলো…
মেজর মেটকাফ ব্যাজার মুখ করে বললেন–যদিও এটা কোনো ঠাট্টাতামাশার ব্যাপার নয়।
প্রতিবাদে মুখর হয়ে রেন বলল–কিন্তু মেজর সত্যিই কি তাই? পাগলদের তো ঠাট্টা তামাশা এরকমই হয়ে থাকে। আর সেইজন্যই তো সমস্ত পরিস্থিতিটির মধ্যে একটা অদ্ভুত মাদকতা মিশে আছে।
তার দুটো চোখ সবার চোখের উপর দিয়ে ঘুরে গেল আস্তে আস্তে। ঠোঁটের ফাঁকে লেগে রয়েছে তার হালকা হাসির রেখা। সে বলল–একবার যদি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের বর্তমান চেহারাগুলো আপনারা দেখতেন…।
ট্রেটারের মতোই সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন তিনি।
মিসেস বয়েলই এই চেতনা ফিরে পেলেন। তিনি বললেন–সভ্যতা ভব্যতার লেশটুকুও নেই ওর মধ্যে। কথাবার্তাগুলো শুনলে মনে হয় বিকৃত মস্তিষ্কের লোক। কিন্তু এমন ভাব দেখায় যেন তার খুব টনটনে জ্ঞান।
চিন্তার সুরে মেজর বলল–ভদ্রলোক বলেছিলেন, গত যুদ্ধের সময় একবার বিমান দুর্ঘটনার মুখে পড়ে তাকে নাকি পুরো আটচল্লিশ ঘণ্টা থাকতে হয় মাটির নিচে কবরস্থ হয়ে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ঘটনাটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
মিসেস বয়েল তার গলায় কাঠিন্যের ছোঁওয়া রেখে বললেন, লোকে তাদের স্নায়ুদূর্বলের কারণ হিসাবে এত বাজে অজুহাত দেখায়… আমি জোর গলায় বলতে পারি যে এই যুদ্ধের ধকল আমাকেও খুব একটা কম সামলাতে হয়নি। অনেকের চেয়ে আমারই অভিজ্ঞতা বেশি। তবে তার জন্য স্নায়ুবিক বৈকল্য আমার ঘটেনি।
তির্যক সুরে মেটকাফ বললেন–আমার মনে হয় বর্তমানে যা কিছু সমস্যা সব আপনাকে ঘিরে মিসেস বয়েল!
তার মানে? কি বলতে চান আপনি? মিসেস বয়েল জিজ্ঞেস করলেন।
মেটকাফ শান্ত গলায় বললেন–১৯৪০ সালে আপনিই তো এ অঞ্চলের রিফিউজি পুনর্বাসন দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত অফিসার ছিলেন। কথার মাঝখানে ভদ্রলোক এক নজর তাকালেন মলির দিকে। বিষাদগ্রস্ত ভঙ্গিতে মলি মাথা নাড়ল, তিনি আবার প্রশ্ন করলেন-বলুন তো, কথাটা কি সত্যি নয়?
মিসেস বয়েলের চোখে মুখে দেখা গেল রাগের ছাপ। তিনি বললেন–তাতে কি অন্যায়টা হয়েছে? ঝাঝালো সুরে তিনি জানতে চাইলেন।
মেটকাফ গম্ভীর গলায় বলল–তিনটে অনাথ শিশুকে লরিজ ফার্মে পাঠানোর জন্য আপনিই মুখ্যত দায়ী।
কিন্তু মেজর মেটকাফ ওইরকম শোচনীয় ঘটনার জন্য কেনই বা দায়ী থাকবো আমি বলতে পারেন? আমি ওই ফার্মের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথাবার্তা বলে সন্তুষ্ট হয়েছিলাম। তারাও তিনটে বাচ্চাকে সবিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছিল মানুষ করবার দায়িত্ব নিয়ে। তবে আমি কেন মাঝখানে দোষের ভাগীদার হব, বা এর দায়-দায়িত্ব সমস্তই আমার উপর বর্তাবে…? শেষের দিকে তার গলার স্বর ম্লান হয়ে গেল।
জিল তীক্ষ্ণকণ্ঠে চেঁচিয়ে বলল–সার্জেন্ট ট্রেটারকে আপনারা এ সম্বন্ধে সবকিছু জানালেন না কেন?
চড়া সুরে বয়েল উত্তর দিলেন–এটা পুলিসের কোনো ব্যাপার নয়, আমি নিজেই দেখাশোনা করতে পারি নিজেদের।
মেটকাফ মৃদুস্বরে তার মন্তব্যটা ছুঁড়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। তিনি বললেন– আমরাও দেখবার একটা সুযোগ পাব।
জিল প্রশ্নের বান ছুঁড়ে দিল মলির দিকে–তুমি কি ভদ্রমহিলাকে আগে থেকে জানতে?
বাজারের সামনেই বড় রাস্তার উপরেই তো আপনাদের দোতলা বাড়ি ছিল তাই না?
সেটা সামরিক কর্তৃপক্ষ জরুরী প্রয়োজনে দখল করে নিয়েছিলেন। বয়েল কথার উত্তর দিলেন। তারপর আবার বিরাজপূর্ণ স্বরে আবার বললেন–এখন একেবারেই অবস্থা ভেঙ্গে গেছে! জানলা বরগাগুলোরও আর চিহ্ন নেই কোনো, হয়ত খুঁজে পাওয়াই যাবে না। এটাতো একধরনের ডাকাতি বললেই হয়।
অকারণে হাসতে শুরু করেন মিঃ প্যারাভিসিনি। তাঁর হাসির ভঙ্গিটাও সম্পূর্ণ আলাদা। পেছন দিকে মাথা হেলিয়ে চোখ দুটো বুজে দুর্বল বেগে তিনি হেসে চললেন।
হাসির ফাঁকে ফাঁকে তিনি সকলের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বললেন–তামাকে মাপ করুন। কিন্তু সমগ্র ঘটনাগুলো এতই মজার যে হাসিটাকে আমি কিছুতেই আর সামলাতে পারছি না। হ্যাঁ, সত্যিই পরিবেশটাকে খুব ভালোভাবে আমি উপভোগ করছি!
সার্জেন্ট ট্রেটার ভেতরে পা দিলেন। তার দু চোখের বিরূপ দৃষ্টি হাস্যরত প্যারাভিসিনির মুখের উপর কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। বিরক্তিতে তার দীর্ঘ ভজ জোড়া কুঁচকে গেল। তারপর বললেন, প্রত্যেকে যে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য একটা মজার ইন্ধন খুঁজে পেয়েছেন এজন্য বিশেষ আনন্দিত আমি।
আমি দুঃখিত ইনসপেক্টর! সত্যিই খুবই অনুতপ্ত আমি, এর জন্য আপনার সাবধান বাণীই কিছুটা হালকা হয়ে যেতে বসেছে।
ট্রেটার হাল্কাভাবে নিজের বঁটা বাঁকিয়ে বললেন–সমস্ত পরিবেশটা আপনাদের চোখের সামনে ফুটিয়ে তোলার যথাসাধ্য চেষ্টা করছি আমি। যদিও, আমি ইনসপেক্টর নই সামান্য একজন সার্জেন্ট মাত্র। ট্রেটার মলির দিকে একবার ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন–মিসেস ডেভিস, আমি এখনকার ফোনটা একবার ব্যবহার করতে চাই।
প্যারাভিসিনি নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলল–সত্যিই আমি ব্যাপারটাকে বড় বেশি ঘু করে তুলেছি। এখানে তার বেশিক্ষণ না থাকাই ভালো।