ট্রেটার আবার মুখ খুললেন– কিছু মনে করবেন না, তবে হোটেল ব্যবসা চালাবার পক্ষে আপনাদের খুব অল্প বয়স।
বেশ! এ ব্যাপারে সে সম্বন্ধে কোনো রারি বিধিনিষেধ আছে কি? আর তাছাড়া বয়স বাইশ বছর হতে চলল আমার।
ট্রেটার আনন্দ মনে মহা দুলিয়ে বলল– হ্যাঁ, তাহলে মিসেস ডেভিস, আপনি নিশ্চয় এর জন্য প্রস্তুত? সার্জেন্ট ট্রেটার লাইব্রেরী ঘরে পা রাখতে না রাখতে সবাই যে যার বক্তব্য পেশ করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল।
ক্রিস্টোফার রেনের তীক্ষ্ণ গলাই প্রথমে তীরের মত বিদ্ধ করল কানে। তিনি যে এই বিষয়ে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন এবং রাতভোর তিনি যে আজ দু-চোখের পাতা এক করতে পারেননি সেই কথাই বললেন তিনি দৃঢ়স্বরে। আনুপূর্বিক সমস্ত বৃত্তন্ত শোনার জন্যও তার আগ্রহ কিছুমাত্র কম দেখা গেল না।
মিসেস বয়েলের মেদবহুল গলা ভেদ করে একথা চাপা ক্রদ্ধ ঘরঘরে আওয়াজ বের হল। অপদার্থ। সম্পূর্ণ অপদার্থ! এইভাবে একজন খুনে পাগলকে রাস্তায় চলাফেরা করতে দেওয়া যে কতটা বিপজ্জনক তা দায়িত্বজ্ঞান পুলিস কর্তৃপক্ষের বোঝা উচিত।
মিঃ প্যারভিসিনি স্বগতোক্তির সুরে হাত নেড়ে বলল। কিন্তু অঙ্গভঙ্গিই তার সার হল। মিসেস বয়েলের মোটা ঘরঘরে গলার নিচে তার সমস্ত বক্তব্যই চাপা পড়ে গেল। মেজর মেটকাফের হাবভাবেও একটা অধৈর্য্যের ছাপ লক্ষ্য করা যায়। তিনি মূল তথ্যগুলো ঠিকভাবে বুঝে নিতে চাইছিলেন।
ট্রেটার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর সকলকে থামিয়ে দেবার জন্য হাত তুললেন। তার চালচলনে পরিপূর্ণ কর্তৃত্বের আভাস। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, সঙ্গে সঙ্গেই সকলে থেমে গেল। ঘরের মধ্যে এখন শুধু নীরবতা।
ট্রেটার মুচকি হেসে বলল– ধন্যবাদ। মিঃ ডেভিসের কাছে আপনারা নিশ্চয় এতক্ষণে আমার আসার কারণটা শুনেছেন? আমি সঠিক উত্তরটা আপনাদের কাছ থেকে জানতে চাই। লরিজ ফার্মের ওই মামলাটার সঙ্গে কি আপনারা কেউ কোনোভাবে জড়িত ছিলেন?
ঘরের মধ্যে আবার দেখা দিল নীরবতা যেটা ছিল খুবই স্বস্তিকর। ভাবলেশহীন চারটে মুখ ট্রেটারের চোখের দিকে চোখ রাখল। কিছুক্ষণের পর উত্তজনা ও চাঞ্চল্যটুকুও যেন ব্লটিং পেপারের মত সবার মুখ থেকে শুকিয়ে গেল।
৩. নীরবতা ভাঙ্গল
পুনরায় ট্রেটার নীরবতা ভাঙ্গল, তার গলায় গম্ভীর আবেদনের সুর। তিনি বললেন, দয়া করে আমার বক্তব্যটা বোঝাবার চেষ্টা করুন মন দিয়ে। পুলিস কর্তৃপক্ষের বিশ্বাস আপনাদেরই কোনো একজন এখন গভীর বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন এসে। মনে রাখবেন আপনারা, খুবই সাংঘাতিক ধরনের বিপদ। কার ভাগ্যে এই দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, সেই প্রশ্নের মীমাংসা করাই এখন সবার আগে প্রয়োজন।
তবুও কথা শোনা গেল না কারুর মুখে।
প্রশ্নটা শুরু করি। মিঃ প্যারাভিসিনি, আপনি…?
মিঃ প্যারাভিসিনি ঠোঁটের কোণে হাসির ঝিলিক টেনে দিল যেটা ছিল সাময়িক। প্রতিবাদের ইঙ্গিতে হাত নাড়তে লাগলেন। তার আচার-আচরণে বিদেশী ঢং সহজেই চোখে লাগে।
এ অঞ্চলে আমি যে একজন নবাগত বিদেশী, সে কথা সার্জেন্ট ভুলে যাবেন না। এখানকার স্থানীয় কোনো ঘটনার সঙ্গেই আমার যোগ ছিল না কোনো কোনোদিন ছিলোও না।
মিঃ রেন?
ক্রিস্টোফারের শানিত কণ্ঠ বেজে উঠল। সে বলল– ওই ঘটনার আমার বয়স ছিল খুবই কম। এমন কি সমস্ত ঘটনাটাও এখন আমি আবছাভাবে মনে করতে পারি না।
মেজর মেটকাফ…এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?
ভদ্রলোক উত্তর দেবার জন্য ঠিক প্রস্তুত ছিলেন না। তাই তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন– দৈনিক পত্রিকার মারফৎ আমি সমস্ত ঘটনাটাই, জানতে পারি, কিন্তু তখন আমি চাকুরীসূত্রে এডিনবুয়োয় থাকতাম।
ট্রেটার বললেন, এই আপনাদের শেষ কথা তাহলে? কেউ কিছু বলবেন আর?
আবার সেই আগের মত নীরবতা নেমে এল।
আস্তে আস্তে ট্রেটার তার বুকের মধ্যে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লেন। বললেন– যদি আপনাদের মধ্যে কেউ মারা যান–কথাটা থামিয়ে সকলের দিকে তাকিয়ে আবার বললেন তবে তার জন্য তিনিই দায়ী থাকবেন। এই বলে তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
আপন মনে রেন চেঁচিয়ে উঠে বললেন– কি আশ্চর্যের ব্যাপার! ঠিক যেন কোনো রোমাঞ্চকর নাটকের দৃশ্য। …তবে ভদ্রলোকের চেহারাটা যে রীতিমতো সুন্দর সন্দেহ নেই তাতে। এইজন্য পুলিস কর্মচারীদের এত পছন্দ করি আমি। কত শক্তসমর্থ আর দৃঢ়চেতা, সমস্ত পরিবেশটার মধ্যেও একটা ভয়ার্ত শিহরণের ঘনঘটা। ছেলেভুলানো ছড়াটাও বেশ মজার তাই না। তিনটে ইঁদুর অন্ধ…জানলা কপাট বন্ধ…
শিস্ দিয়ে ছড়ার সুরটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করল রেন।
মলি এবার বিমূঢ় চিত্তে চেঁচিয়ে উঠে বলল– দোহাই আপনার, থামুন..থামুন।
রেনের চোখেমুখে হাসির ছটা। বলল– কিন্তু ম্যাডাম এটাকে আমার স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দেরই প্রকাশ বলে মেনে নেবেন। জীবনে কখনো কোনো খুনের মামলায় জড়িয়ে পড়ার সৌভাগ্য হয়নি। এ অভিজ্ঞতা একেবারে নতুন। সেই কারণে বুকের মধ্যে অস্থির একটা উত্তেজনা অনুভব করছি।
মিসেস বয়েল গর্জে উঠে বললেন, নাটক না ছাই। আমি এর একবর্ণ বিশ্বাস করি না।
ক্রিস্টোফারের চোখে আনন্দের ঝিলিক দিয়ে উঠল। সে বলল–তাহলে মিসেস বয়েল, এক মিনিট অপেক্ষা করুন আপনি, মৃদুস্বরে ফিসফিস করে সে বলল–আমি নিঃশব্দে পেছনে দাঁড়িয়ে আপনার গলাটা…