সলিসিটার তাদের এ বিষয়ে ভরসা দিয়েছিলেন। সবকিছুই আজকালকার দিনে বিক্রি হয়। এমনকি হোটেল বা অতিথিশালার জন্যেও কেউ হয়তো বাড়িটা কিনতে চাইবে। তখন ফার্নিচারগুলোও দরকার হবে। তার ওপর স্বগীয়া মিস মরি যুদ্ধের আগে বিস্তারিত ভাবে বাড়িটা মেরামত করে নিয়েছিলেন। তিনি আধুনিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যেরও নানা রকম ব্যবস্থা করেছিলেন। সমস্ত বাড়িটা এখন খুব ভালো অবস্থাতেই আছে।
তারপরেই মলির মাথায় মতলবটা খেলে গেল। সে বলল, জিল, আমরা নিজেরাই তো একটা অতিথিশালা চালু করতে পারি। জিল প্রথমে উড়িয়েই দিয়েছিলো মলির এই আষাঢ়ে ধ্যান-ধারণা। মলি কিন্তু নাছোড়বান্দা। কেন প্রথম প্রথম আমরা না হয় দু-চার জন অতিথি নেবো। একেবারে গোড়াতেই বেশি বাড়াবাড়ি করবার কোনো দরকার নেই, বাড়িটা এমনিতেই বেশ ঝকঝকে তকতকে। প্রতিটি শয়নকক্ষে ঠান্ডা এবং গরম দুরকম জলের বন্দোবস্ত আছে, ঘর গরম রাখবার জন্যে বড় বড় চুল্লি, তাছাড়া রান্নাঘরে গ্যাসের ব্যবস্থা খুব ভালো, বাগানের একপাশে হাঁস-মুরগীও পুষতে পারি আমরা, বাগানটায় নানা ধরনের তরিতরকারিও লাগানো যায়।
এতসব ঝামেলা ঝক্কি সামলাবেটা কে? চাকর-বাকর পাওয়া যে কি দুঃসাধ্য ব্যাপার সে তো তুমি জানোই।
হাঁ সে কথা ঠিক। কাজ আমাদের কিছু করতে হবে বটে তবে আমরা নিজেরাও যদি বাড়ি কিনে বাস করি সেখানেও তো সেই একই কাজের ঝামেলা এসে পড়বে। অবশ্য এক্ষেত্রে কাজের চাপ একটু বাড়বে এই যা। সেটা আর এমন কি?
ব্যবসাটা পুরোদমে চালু হবার পর দু-একজন ঝি-দাসীও আমরা নিশ্চয় পেয়ে যাবো। তার ওপর মনে করো আমরা যদি প্রথমে পাঁচজন অতিথি নিয়ে হোটেল চালু করি এবং তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে সপ্তায় সাত গিনি করে পাই…মাঝপথে কথা থামিয়ে মলি মনে মনে তার কল্পিত ব্যবসার লাভ-লোকসানের অঙ্ক নিয়ে মেতে উঠলো। তাছাড়া আর একটা কথা আছে, মলি আবার বোঝাতে চেষ্টা করলো জিলকে, বাড়িটাতো আমাদের থাকবে। আসবাবপত্রে সুসজ্জিত এমন একটা বাড়ি থাকাও কম কথা নয়। আমাদের দুজনের বাসের উপযোগী কোনো ছোট বাসাবাড়ি দু-এক বছরেও খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। মলির এই শেষের যুক্তিটা জিল উড়িয়ে দিতে পারলো না।
বিয়েটা তার খুব তাড়াতাড়িই সেরে নিয়েছিলো কিন্তু তারপর থেকে দুজনে ঘর বেঁধে বাস করবার মতো তেমন কোনো অখণ্ড অবসর খুঁজে পায়নি। এখন একটা ছোট সংসার পাতবার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওরা দুজন। তার মনে প্রথম সূত্রপাত এই বৃহৎ প্রচেষ্টার স্থানীয় সংবাদপত্রে এবং লন্ডন টাইমস-এ বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়েছিল। তার উত্তর নানারকম ভাবে এল।
আজকেই উদ্বোধন হবে, অতিথিশালার প্রথম অতিথিটিরও আসবার কথা আজ। সাত সকালেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে জিল। সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত কিছু পুরোন তারের জাল নিলামে বিক্রি হবে, তাই যদি সুবিধা দামে পাওয়া যায় এই ছিল তার আশা। নিলাম ঘরটি এখান থেকে বেশ কিছুটা দূরে। শহরের অপর প্রান্তে। মলি জানিয়ে রেখেছিল ও একবার পায়ে পায়ে গ্রামের দিকে যাবে। শেষবারের মত প্রয়োজন আছে কিছু কেনাকাটার।
ওদের কাছে এখন প্রতিকূল আবহাওয়া বইছে। গত দুদিন ধরে যা ঠান্ডা পড়ছে তা বলার নয়। তার সঙ্গে আবার নতুন উপদ্রব যুক্ত হল–তুষারপাত। মেঠো পথ ধরে মলি দ্রুত পা চালালো। তার একরাশ উজ্জ্বল কোকড়া চুলের ফাঁকে ফাঁকে শুভ্র তুষার জড়িয়ে আছে। বাহারি ওয়াটারপ্রুফের খাঁজে খাঁজেও পেঁজা তুলোর মত বরফের কুচি পড়ে আছে। আবহাওয়া সম্বন্ধে রীতিমত বেতারে আশঙ্কাজনক ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছে। শীগগিরই নাকি প্রবল বেগে পড়তে থাকবে বরফ।
জলের পাইপগুলোর মধ্যে যদি বরফ জমে যায় তাহলে তো প্রচণ্ড সর্বনাশ। মলি ক্ষণে ক্ষণে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। প্রারম্ভিক সূচনাতেই এধরনের বিপর্যয় অশুভ নিদর্শনের সূচনা। হাতের ঘড়িটা একপলক দেখ নিল সে। বৈকালিক চায়ের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। তার একবার মনে পড়ল জিল কি ইতিমধ্যে ফিরে এসেছে। তাকে না দেখতে পেয়ে জিলের একটু ভাবনা চিন্তা হচ্ছে।
সে ভাবছিল জিল যদি প্রশ্ন করে কি করব বল, কতগুলো দরকারী জিনষ ভুলে যাবার জন্য আবার আমাকে গ্রামের দিকে ছুটতে হল। তাহলে মলি ভেবেই রেখেছিল কি দেবে সে এর উত্তর, সে ভাবছিল উত্তরটা শুনে হয়ত জিল একটু ঠাট্টা করবে। বলবে, তোমার সেই টিনের খাবার তো?
টিনের খাবার নিয়ে প্রায় সময়ই জিল ঠাট্টা তামাশা করে। এ বিষয়ে বাতিক আছে বলা চলে মলির। রাশিকৃত খাবারের প্যাকেট ঘরের মধ্যে জমা করা হয়। কখন কোনোটার দরকার পড়বে তার কি ঠিক আছে। তাছাড়া দুজনের ঘর গৃহস্থালির পক্ষে টিনের ভালো খাবার তো আছেই। বিশেষ ঝামেলা পোহাতে হয় না রান্নাবান্নার ব্যাপারে।
মলি অপ্রসন্ন অবস্থায় আকাশের দিকে একবার তাকালো। সত্যিই পরিস্থিতিটা খুব ঘোরালো মনে হচ্ছে তার।
বাড়িতে এসে দেখল, এখনো জিল পৌঁছয়নি। আগের মতই ঘর এখন ফাঁকা হয়ে পড়ে আছে, রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল মলি। যদিও করবার কিছুই ছিল না, তবু বাসনগুলোকে একবার নেড়েচেড়ে গুছিয়ে রেখে দিল। তারপর উঠে গেল চওড়া সিঁড়ি বেয়ে। সমস্ত শোবার ঘরগুলো এখন নিখুঁতভাবে সাজানো গোছানো। দক্ষিণ দিকের বড় ঘরটা মিসেস বয়েলের জন্যে নির্দিষ্ট আছে। ঘরের মধ্যে একটা পালঙ্ক আছে মেহগনি কাঠের। পালঙ্কের চারকোণে মশারি টাঙাবার জন্য ছাতা লাগানো। আকাশী রঙের বাহারি কাগজে মোড়া ঘরটায় মেজর মেটকাফ থাকবেন বলেছেন। পশ্চিম দিকের বড় খোলামেলা ঘরটা হল মিঃ রেনের। সমস্ত ঘরগুলোই এখন খুব ছিমছাম পরিপাটি দেখায়। তার ওপর বৃদ্ধা ক্যাথারিনের যে এত লিনেনের স্টক ছিল তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকবে মলি। এখন সেগুলো খুব কাজে লাগছে।