বিকারগ্রস্ত রুগীর মতোই হাসতে লাগলেন ভদ্রলোক। অবশেষে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের সবরকম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। হাসির ফাঁকে ফাঁকেই সরস ভঙ্গিতে মন্তব্য করলেন তিনি, ব্যাপারটা খুবই মজার…ভারি মজার….
কিন্তু এতে এত হাসির কি ব্যাপার ঘটলো কিছুই আমার মগজে ঢুকছে না। মেজরের কণ্ঠস্বরে কাঠিন্যের আভাস।
হ্যাঁ, ঠিকই তো। মিসেস বয়েলও সায় দিলেন মাথা নেড়ে। ক্রিস্টোফারের হাসি তখনও থামেনি।
না না, আপনারা কিছু মনে করবেন না। এটা আমার একটা ব্যক্তিগত রসিকতা। …চুপ…চুপ… ঠোঁটের ওপর তর্জনী রাখলেন তিনি, গোয়েন্দাপ্রবর এদিকেই আসছেন।
জিলের সঙ্গে সঙ্গেই সার্জেন্ট ট্রেটার হাজির হলেন। ভদ্রলোক এখন তার বদখদ স্কী দুটোর হাত থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
শুভ্র তুষারের কুচিগুলোও ঝেড়ে ফেলেছেন গা থেকে। তার হাতে ধরা একটা লম্বা নোট বই আর পেনসিল। চালচলনে সুগভীর পুলিস গাম্ভীর্যটুকুও ফুটে উঠেছে নিখুঁত ভাবে।
মলি, জিলের কণ্ঠে ব্যস্ততার আভাস, সার্জেন্ট ট্রেটার আমাদের সঙ্গে আলাদা ভাবে দু একটা কথা বলতে চান।
দুজনকে অনুসরণ করে মলি ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালো। জিলই তাদের পথ দেখিয়ে স্টাডিরুমের দিকে নিয়ে গেলো। বড় হলঘরটার ঠিক পেছনেই সাজানো-গোছানো ছোট আকারের স্টাডিরুম। সকলে ভেতরে ঢোকবার পর বাইরেটা একবার দেখে নিয়ে সন্তর্পণে দরজা ভেজিয়ে দিলেন ট্রেটার।
আমাদের অপরাধটা কি সার্জেন্ট…?
মলি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। একরাশ উৎকণ্ঠাই ঝরে পড়লো তার কণ্ঠস্বরে। অপরাধ! সার্জেন্ট ট্রেটার কয়েক মুহূর্ত অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ধীরে ধীরে তার ওষ্ঠাধরে চওড়া হাসি ফুটে উঠলো। না না, আপনারা সম্পূর্ণ ভুল বুঝেছেন। এই ভুল বোঝাবুঝির জন্যে আমি দুঃখিত। কিন্তু প্রকৃত ঘটনাটা একেবারেই আলাদা।
এটাকে এক ধরনের পুলিসি সাহায্যও বলা যেতে পারে। আমার আগমনের তাই হল মূল উদ্দেশ্য।
এবারেও সার্জেন্টের বক্তব্য তাদের বোধগম্য হয়েছে বলে মনে হয় না। দুজনেই তাকিয়ে রইল অবাক দৃষ্টিতে আগন্তুকের মুখের দিকে।
ট্রেটার আবার বলতে শুরু করলেন মিসেস লিয়ন মিসেস মউরীন লিয়নের নাম ইতিমধ্যে নিশ্চয় আপনারা শুনে থাকবেন? দুদিন আগে লণ্ডনের এক ভাড়াটে ফ্ল্যাট বাড়িতে ভদ্রমহিলা খুন হয়েছেন।
মলি মাথা নেড়ে বলল–হ্যাঁ।
ট্রেটার বলল–আমার প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, এই ভদ্রমহিলা কি আপনাদের পরিচিত ছিলেন? জিল বিড়বিড় সুরে বলল–না আগে কোনোদিন এর নাম পর্যন্ত আমরা শুনিনি। মলিও সেই কথায় সায় দিল।
ট্রেটার শান্ত গলায় বলল–আমাদেরও ধারণা সেইরকম। তবে মহিলাটির আসল নাম মনে হয় লিয়ন ছিল না। পুলিসের রেকর্ড বইয়ে আঙুলের ছাপ দেখে প্রকৃত সত্যটা জানা গেছে। তার আসল পদবী হচ্ছে গ্রেগ। মউরীন গ্রেগের মৃতস্বামী জন গ্রেগ ছিলেন একজন কৃষক। তাই হাতে তৈরি লরিজ ফাটাও। ফার্মটাও এখান থেকে বেশি দূরে নয়। নামটাও হয়তো আপনার এবং আপনাদের কাছে পরিচিত।
পড়ার ঘরের ভেতর একটা থমথমে পরিবেশ। কেবল ছাদ থেকে বাইরের উঠোনে বরফ ঝরে পড়ার টুপটাপ শব্দই মাঝে মাঝে এই মৌনতা ভেঙ্গে দিয়েছে। এই শব্দটার মধ্যেও কেমন এক ধরনের অশুভ অশরীরী সঙ্কেত।
ট্রেটার কোনো উত্তর না পেয়ে মুখ খুললেন। বললেন–তিনটে অনাথ শিশুকে এই ফার্মে রেখে মানুষ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাদের সরকারই খরচ জোগাতেন। এসব ১৯৪০ সালের ঘটনা। অল্প কয়েকদিন পর এদের একটি ছেলে মারা যায়। অত্যাচার এবং অবহেলাই যে ছেলেটির মৃত্যুর কারণ, সেটাও জানাজানি হতে দেরি হয়নি বিশেষ। অনেক পত্রপত্রিকাতেও ব্যাপারটা নিয়ে খুব লেখালেখি হয়েছিল। তার ফলেই আদালতের বিচারে জন আর মউরীনের যাবজ্জীবন জেল হয়ে যায়। কারাবাসের অল্প কিছুক্ষণকালের পর জন পুরনো একটা গাড়ি চুরি করে জেল থেকে পালিয়ে গিয়েছিল কিন্তু নিজের নিয়তিকে এড়াতে পারেনি। পালাবার পথেই বেচারা মোটর দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। মাস দুয়েক আগে মউরীনের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।
জিল প্রশ্ন করল, তিনিই কি সম্প্রতি খুন হয়েছেন? এটা কার কীর্তি বলে আপনারা সন্দেহ করছেন?
উত্তর দেবার জন্য কোনোরকম ব্যস্ততা দেখা গেল না ট্রেটারের মধ্যে। তিনি তার নিজের প্রশ্নেই অবিচল। তিনি বললেন–লরিজের ঘটনাটা নিশ্চয় আপনাদের মনে আছে?
জিল ঘাড় নাড়ল। সে বলল–১৯৪০ সালের কথা বলছেন? আমি তো তখন জাহাজে চাকরি নিয়ে ভূমধ্যসাগরের বুকের ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছি। পৃথিবীর সঙ্গে তখন আমার খুব একটা যোগাযোগ ছিল না।
ট্রেটার এবার প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে মলির দিকে ফিরে তাকালেন। আমতা-আমতা করে মলি বলল –আমার… আমার অবশ্য কিছু কিছু মনে পড়ছে। কিন্তু আপনিই বা সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলছেন কেন? তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কই বা কি?
আপনার সামনে মস্ত বিপদ, মিসেস ডেভিস। এই মুহূর্তে নিরাপত্তার একান্তই প্রয়োজন।
জিলের কণ্ঠে শোনা গেল অবিশ্বাসের সুর। বলল–বিপদ…কিসের বিপদ?
ট্রেটার বলল–তাহলে সমস্ত ঘটনাটা শুনুন মন দিয়ে। মিসেস লিয়ন যেখানে খুন হন সেই অকুস্থলের কাছেই পাওয়া গেছে একটা নোটবই। তার মধ্যে লেখা ছিল দুটো ঠিকানা। তার মধ্যে একটা হচ্ছে চুয়াত্তর নম্বর কার্লভার স্ট্রীট।