ভদ্রলোক আবার প্রশ্ন করলেন। এবার তার কণ্ঠস্বরে শুধু একটা সামান্য কৌতূহলের সুরই প্রকাশ পেল–পুলিস কেন?
মলি জবাব দিল–দুচার মিনিট আগে পুলিস কর্তৃপক্ষ একটা ফোন করেছিলেন। তারা নাকি একজন সার্জেন্টকে এখানে পাঠাচ্ছেন। এবার তার জানলা দিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ হল। চোখে মুখে দেখা গেল আশার আলো। তিনি বললেন– তবে এই দুর্যোগের মধ্যে তিনি এখানে পৌঁছতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস হয় না।
মলির দিকে আরেক পা এগিয়ে এসে মেজর বললেন–কিন্তু একজন পুলিসকেই বা তারা পাঠাচ্ছে কেন এখানে? মলি জবাব দেবার আগেই দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলো জিল।
রাগের সুরে জিল বলল, ওঃ কয়লার চাওড়গুলো যেন বিশমনের ওপর ভারী। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে অবাক সুরে প্রশ্ন করল–ব্যাপার কি? সবাইকে এত বিচলিত লাগছে কেন?
মেজর মেটকাফ তার দিকে এবার ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন– শুনলাম, এখানে নাকি পুলিস আসছে। এর কারণ কি?
মাথা নেড়ে জিল বলল–তাতে ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। কেউই এসে পৌঁছতে পারবে না এখানে। বরফ এখন পাঁচফুট উঁচু। সমস্ত পথঘাট বরফের তলায় চাপা পড়ে গেছে। সবরকম যানবাহন এখন বন্ধ।
সেই মুহূর্তে জানলার সার্শিতে কেউ ঠকঠক করে যেন শব্দ করল। শব্দটা পরিষ্কার শোনা গেল। প্রথমেই এক্সঙ্গে ঘরের প্রত্যেকেই চমকে উঠল। প্রথমে কেউই বুঝতে পারল না শব্দটা কোথা থেকে ঠিক আসছে। একটা অদৃশ্য ভৌতিক সঙ্কেতের মতো মনে হল।
তারপরই মলি গরাদহীন বড় ফ্রেঞ্চ জানলাটার দিকে ইঙ্গিত করে চেঁচিয়ে উঠল। একজন লোক বাইরে দাঁড়িয়ে সার্শির ওপর টোকা দিচ্ছে। লম্বা কাঠের স্কী জুতো পায়ে আছে বলেই যে তার পক্ষে বরফ ভেঙ্গে এতদূর আসতে পেরেছে সে রহস্যটা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না।
জিল বিস্ময়সূচক অস্ফুট একটা শব্দ করেই দ্রুত এগিয়ে এসে ছিটকিনিটা খুলে দিল।
আগন্তুক ঘরের মধ্যে ঢুকেই জিলকে অভিবাদন করে বলল–ধন্যবাদ স্যার, আমি ডিটেকটিভ সার্জেন্ট ট্রেটার। তার চোখে মুখে উজ্জ্বল তারুণ্যের দীপ্তি। সকলের দিকে একবার চোখ তুলে তাকিয়ে নিজের পরিচয় তিনি নিজেই দিলেন।
মিসেস বয়েল তার বোনা বন্ধ করে একটু নড়েচড়ে বসলেন। তারপর মৃদু প্রতিবাদের ভঙ্গিতে বলল–আপনাকে দেখে তো ঠিক সার্জেন্ট বলে মনে হয় না। বয়স যেন খুবই কম।
ভদ্রলোক বয়সে যদিও নিতান্তই নবীন তবুও এই মন্তব্য শুনে রীতিমত অপমানিত বোধ করলেন। তার উত্তরের মধ্যে রাগের আভাস ফুটে উঠল–আমাকে দেখে যতটা অল্পবয়সী মনে হয়, আসলে কিন্তু ততটা ছেলেমানুষ আমি নই ম্যাডাম।
আগন্তুক ভদ্রলোক আরেকবার সকলের দিকে তাকিয়ে জিলের দিকে শেষে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলো। তারপর বলল।–আপনিই তো মিঃ ডেভিস, তাই না? আমি আমার ধরাচুড়ো সব খুলে কোথাও রেখে দিতে চাই!
হা… নিশ্চয়। আমার সঙ্গে আসুন…।
জিল আগন্তুককে ডেকে নিয়ে ভেতরে চলে যাবার পর মিসেস বয়েল রুক্ষ্ম ব্যাজার মুখে মন্তব্য করলেন–এই জন্যেই আমরা সরকারকে পুলিস পোষবার ট্যাক্স গুণে দিই। আর এদিকে বেতনভুক পুলিস কর্মচারীরা বরফের ওপর শীতকালীন খেলাধুলা এবং আমোদ প্রমোদ নিয়ে ব্যস্ত।
মলির মুখোমুখি এবার দাঁড়ালেন প্যারাভিসিনি। তাঁর কণ্ঠস্বরে এবার ক্রুদ্ধ মাপের গর্জন শোনা গেল। কেন আপনি পুলিস ডেকে পাঠিয়েছেন মিসেস ডেভিস?
প্যারাভিসিনির এই রক্তবর্ণ মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল মলি। ভদ্রলোকের এ চেহারা যেন সম্পূর্ণ নতুন। একটা ভয়ের ছায়া ঘনিয়ে উঠল বুকের মধ্যে তার। অসহায় ভাবে জবাব দিল–কিন্তু…আমি তো ডেকে পাঠাইনি ওদের…
মলির কথা শেষ হতে না হতেই উত্তেজিত ভঙ্গিতে ক্রিস্টোফার রেন ঘরে এসে দাঁড়ালেন। তার কণ্ঠস্বরে তীক্ষ্ণ প্রশ্নের খোঁচা, বড় হলঘরটায় যে ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন উনি কে? কোথা থেকেই বা উনি হাজির হলেন? এদিককার রাস্তাঘাট তো সব বন্ধ।
এ প্রশ্নের জবাব দিলেন মিসেস বয়েল। তার কণ্ঠে ক্ষোভ ও ভর্ৎসনা দুয়ের মিল। তিনি বললেন–বিশ্বাস করুন বা না করুন, সে আপনার খুশি–তবে এই ভদ্রলোক একজন পুলিস কর্মচারী। ব্যাপারটা একবার ভেবে দেখবেন। কর্তব্যরত পুলিস কর্মচারী স্কী পায়ে দিয়ে মাঠে ময়দানে ঘুরে বেড়াচ্ছে!…
সরকারী কর্মচারীরা আজকাল কিভাবে ফাঁকিবাজ ও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে সেই কথাটা ভালো করে বুঝিয়ে দেওয়াই যেন এই বক্তব্যের মূল উদ্দেশ্য। মেজর মেটকাফ মৃদুসুরে মলিকে প্রশ্ন করলেন, মাপ করবেন মিসেস ডেভিস, আমি কি এখানকার ফোনটা একবার ব্যবহার করতে পারি।
হা হা, যতবার খুশি!
এতে অনুমতি নেবার কোনো প্রয়োজন নেই! ফোনের দিকে এগিয়ে গেলেন মেজর।
ক্রিস্টোফার রেনের তীক্ষ্ণকণ্ঠ মন্তব্যও তার কানে এলো। ভদ্রলোকের চেহারাটা ভারী সুন্দর।
আপনারাও কি তাই মনে হয় না?
অবশ্য প্রত্যেক পুলিস কর্মচারীই কমবেশি স্মার্ট ও হ্যাণ্ডসাম।
হ্যাল্লো …হাল্লো…, রিসিভারটা তুলে নিয়ে দুচার মুহূর্ত নাড়াচাড়া করলেন মেজর, তারপর মলির দিকে ফিরে তাকালেন।
মিসেস ডেভিস, আপনার ফোনটা তো অচল হয়ে পড়ে আছে! নিশ্চয় কোথাও লাইনের কিছু গণ্ডগোল হয়েছে।
কিন্তু এতক্ষণ তো লাইন ঠিকই ছিলো। এইমাত্র.. ক্রিস্টোফার রেনের উচ্চকণ্ঠ সুরেলা হাসিই তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিলো।