হালকা সুরে মলি জবাব দিল–আজকে সকাল থেকেই নানারকম অশান্তির উপদ্রব দেখা দিয়েছে। হতচ্ছাড়া তুষারপাতই তার প্রধান কারণ।
মিঃ প্যারাভিসিনি মাথা নাড়তে নাড়তে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বললেন– হ্যাঁ, তা ঠিক। এই বরফই যত নষ্টের গোড়া, তাই সে কথা অস্বীকার করা যায় না।
আপনি কি বলতে চাইছেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না!
প্যারাভিসিনি চিন্তান্বিত সুরে জবাব দিল বলল–সেটা খুব অস্বাভাবিক নয়। পৃথিবীতে অনেক কিছুই আছে যা আপনি জানেন না। এবং একটা বিষয় সম্বন্ধে আমি নিশ্চিন্ত অতিথিশালার পরিচালনার ব্যাপারে আপনার খুব একটা অভিজ্ঞতা নেই।
মলির গাল লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল বলল–তা হয়তো সত্যি, তবে আমাদেরও উৎসাহের শেষ নেই। আমরা এর পেছনে লেগে থাকবো স্থির করেছি। প্যারাভিসিনি বললেন– বাহবা…বাহবা। এই তো চাই।
রাঁধুনি হিসাবে আমি মন্দ নই, বলুন? মলির কণ্ঠে উদ্বিগ্নতার সুর চাপা রইলো না।
না না, আপনার রাঁধুনির হাতে জাদু আছে। ঠিক আপনার মতো মোহনীয়।
উৎসাহিত ভাবে সায় দিলেন প্যারাভিসিনি। এই বিদেশীরা কি জঘন্য প্রকৃতিরই না হয়, মনে মনে চিন্তা করলো মলি।
প্যারাভিসিনি যেন মলির মনের কথা বুঝতে পারলেন। সঙ্গে সঙ্গে তার আচার আচরণও সম্পূর্ণ বদলে গেলো। তিনি আবার রীতিমতো গম্ভীর ভাবেই বললেন, আমি কিন্তু একটা বিষয়ে আপনাকে সাবধান করে দিতে চাই মিসেস ডেভিস। আপনারা দুজনে বাইরের লোকদের খুব বেশি বিশ্বাস করবেন না।
এখানে যারা অতিথি আছেন, তাদের সবার পরিচয় কি আপনি জানেন?
এটা কি সত্যিই খুব প্রয়োজনীয়? মলিকে কিছুটা বিচলিত বোধ হতে হলো।
আমার ধারণা, অতিথিরা সাধারণত এমনিই এসে থাকেন… যাকে আপনি ছাদের নিচে আশ্রয় দিয়েছেন, তার সম্বন্ধে যতটা সম্ভব খোঁজখবর নেওয়াই কি সুবিবেচকের পরিচয় নয়?
সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে পড়ে কিছুটা ভয় দেখানো ভঙ্গিতেই মলির কাঁধে দু-একটা টোকা দিলেন ভদ্রলোক। এই যেমন আমার কথাই ধরুন না! মাঝরাতে হুট করে আবার আবির্ভাব ঘটলো। আমি আপনাকে জানালাম, তুষারপাতের ফলে রাস্তার মধ্যিখানে আমার গাড়িটা আটকে পড়েছে। তাহলে প্রকৃতপক্ষে আপনি আমার সম্বন্ধে কতটুকু জানতে পারলেন?
একেবারে কিছুই না। এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, অন্যান্য অতিথিদের সম্বন্ধেও আপনার অভিজ্ঞতা ঠিক একরকম!
মলি বলল কিন্তু মিসেস বয়েল তো… মলিকে মাঝখানে থেমে যেতে হল। কেননা মিসেস বয়েলই তার বোনার সাজসরঞ্জাম হাতে নিয়ে সেখানে এসে আবার হাজির হলেন।
ভদ্রমহিলা মৃদুস্বরে মন্তব্য করে তাপচুল্লীর পাশে একটা চেয়ারের দিকে এগিয়ে বললেন ড্রয়িংরুমটা বড় বেশি ঠাণ্ডা। তার চেয়ে এখানকার আবহাওয়া অনেক উষ্ণ আছে।
দ্রুত পায়ে মিসেস বয়েলকে অতিক্রম করে সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন প্যারাভিসিনি। তিনি বললেন–যদি ম্যাডাম অনুমতি দেন, আমি আপনার জন্যে তাপচুল্লীর আগুনটা একটু উস্কে দিতে পারি।
মিঃ প্যারাভিসিনির হাঁটাচলার মধ্যে একটা ক্ষিপ্রতাভাব আছে যা সহজেই সবার নজর কাড়ে। গতরাত্রেও তার এই বিশিষ্ট ভঙ্গিটি লক্ষ্য করেছিল মলি। ভদ্রলোক যখন হাঁটু গেড়ে বসে তাপচুল্লীর আগুনটা উস্কে দিতে ব্যস্ত ছিলেন তখন আরো একটা জিনিষ চোখে পড়ল মলির। এই বিদেশী অতিথি সব সময় তার পেছনের অংশটাই আলোর দিকে ফিরিয়ে রাখেন। তার কারণটাও এখন মনে মনে মলি উপলব্ধি করল। প্যারাভিসিনির সমস্ত মুখটাই যেন কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে।
তাহলে এই ক্লান্তিকর বোকা বুড়োটা বরাবর ছোকরা সেজে থাকবার জন্যেই এমনভাবে ভোল ধরেছে। তবে ভদ্রলোকের উদ্দেশ্য যে সিদ্ধ হয়নি সে কথা বোঝা যায় স্পষ্ট ভাবে। বয়সের ছাপ মুখ থেকে লুকোতে পারেনি। এমন কি সময় সময় প্রকৃত বয়সের অনুপাতে ছাপটা ফুটে উঠেছে একটু বেশি মাত্রায়। কেবলমাত্র হাঁটাচলার মধ্যে যৌবনোচিত ভঙ্গীটুকু কেমন যেন অসঙ্গতিপূর্ণ। মনে হয় একটা সযত্নলালিত কৃত্রিম আবরণ এটা তার।
হন্তদন্ত হয়ে মেজর মেটকাফের আগমনই অনুমান-নির্ভর কাল্পনিক জগৎ থেকে রূঢ় বাস্তবে মলিকে টেনে আনলো। তিনি বলেন–মিসেস ডেভিস, আমার ভয় হচ্ছে… ভয় হচ্ছে… তারপর চারদিকে তাকিয়ে নিজেকে সংযত করে গলার স্বর নামিয়ে মেজর বললেন–নিচের তলায় বাথরুমের জলের পাইপগুলো বোধহয় ঠান্ডায় জমে গেছে।
মলি বিড়বিড় করে বলল–হ্যায় ভগবান! আজকেই একের পর এক যত দুর্ভোগ শুরু হয়েছে। প্রথমে পুলিস,… তারপর এই পাইপ…।।
মিঃ প্যারাভিসিনি রীতিমত শব্দ করে লোহার খোঁচানিটা নামিয়ে রাখলেন পাশে। মিসেস বয়েলের বোনার কাজ হয়ে গেল বন্ধ। অবাক চোখে মলি তাকিয়ে দেখল, মেজর মেটকাফের সারা মুখ থেকে কে যেন রক্ত শুষে নিয়েছে। মুখের মাংসপেশীগুলোও শক্ত হয়ে উঠেছে অদ্ভুতভাবে। ভাবলেশহীন কাঠের মূর্তির মতো এখন যেন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
চকিত সুরে প্রশ্ন করলেন তিনি–পুলিস? আপনি কি পুলিসের কথা বললেন?
মলি মনে মনে বুঝতে পারল, ভদ্রলোকের এই আপাত ভাবলেশহীন মুখের পেছনেই একটা ঘটে চলেছে প্রচণ্ড রকমের আলোড়ন। অথবা তীব্র উত্তেজনাও এর উৎস হওয়া এমন কিছু বিচিত্র নয়। কিন্তু কিছু একটা যে আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই লোকটা…বিড়বিড় করে মলি বলল, আসলে ভয়ঙ্কর প্রকৃতির লোক হতে পারে।