মলিও কোনো কথা বললো না। দুজনে দুজনের দিকে উল্কণ্ঠিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ভেজানো দরজা ঠেলে মিসেস বয়েল ভেতরে প্রবেশ করলেন।
এই যে..আপনি এখানে মিঃ ডেভিস? মিসেস বয়েলের কণ্ঠস্বরে সুগভীর কাঠিন্য। ড্রয়িং রুমের তাপচুলল্লীটা যে ঠান্ডা পাথর হয়ে গেছে সে খবর কী আপনার কানে এসে পৌঁছেছে?
আমি খুবই দুঃখিত মিসেস বয়েল। আমাদের কয়লার মজুতটা একেবারে ফুরিয়ে এসেছে, তাই…
মিসেস বয়েল নির্দয় কণ্ঠে মন্তব্য করলেন, কিন্তু আমি সস্তায় সাত গিনি করে দিচ্ছি, সে কথাও ভুলে যাবেন না। সাতসাতটা গিনি! সেটাও নিশ্চয় ঠান্ডায় জমে যাবার জন্যে নয়।
জিল লজ্জিত গলায় বলে উঠল, এক্ষুনি গিয়েই আমি ওটা জ্বালাবার বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি।
জিল দ্রুতপায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। মিসস বয়েল এবার ফিরে তাকালেন মলির দিকে। একটা কথা আপনাকে বলছি বলে কিছু মনে করবেন না মিসেস ডেভিস। তবে এই যে যুবকটি এখানে আছে তার চালচলন খুবই অস্বাভাবিক। তার কথাবার্তা…এমন কি গলায় বাঁধা টাইটা পর্যন্ত…সব কিছুই খুব অদ্ভুত ধরনের। তার ওপর চুলটুল আঁচড়ানোর কোনো অভ্যাসও বোধহয় ওর নেই।
মলি জবাব দিল –কিন্তু যুবকটি তো একজন ভালো স্থপতি।
মাপ করবেন, আপনার কথার অর্থ…
ক্রিস্টোফার রেন একজন স্থপতি, এবং….
মিসেস বয়েল মাঝপথে বাধা দিয়ে বললেন– শুনুন শুনুন, মিসেস ডেভিস স্যার ক্রিস্টোফার রেনের নাম আমি শুনেছি। তিনি যে সত্যই একজন প্রথম শ্রেণীর স্থপতি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেন্টপল ইত্যাদি তাঁর অনেক কীর্তির কথাই সকলের জানা আছে। কিন্তু আপনারা মনে করেন যে দুদিন কোনো আর্ট স্কুলে পড়লেই শিল্পতত্ত্বের সবকিছু অনায়াসে শিখে ফেলা যায়।
আমি এখন এই যুবকটির কথাই বলছি। এর নামও ক্রিস্টোফার রেন। যুবকটির বাপ-মা চেয়েছিলেন বড় হলে তাদের ছেলে একজন নাম করা স্থপতি হবে। সেইজন্যেই ওরকম নামকরণ দেওয়া হয়েছিল এবং তাদের সেই স্বপ্নও প্রায় সত্যি হয়েছে বলা চলে।
মিসেস বয়েল নাক কোঁচকালেন বললেন, তবে আমার কাছে সমস্ত বিষয়টা খুবই সন্দেহজনক বলে মনে হচ্ছে। আমি যদি থাকতাম আপনার জায়গায় তাহলে ছেলেটির সম্বন্ধে রীতিমত খোঁজখবর না নিয়ে ছাড়তাম না। ওর সম্বন্ধে আপনিই বা কতটুকু জানেন?
আপনার সম্বন্ধে যতটুকু জানি ঠিক ততটুকুইমিসেস বয়েল। সেটা হচ্ছে এই যে আপনারা দুজনেই সস্তায় সাত গিনি করে দেবেন। এবং এইটুকু জানলেই চলে যাবে আমার, তাই নয় কি? কারণ সেটাই শুধু আমার জানার বিষয়। সত্যিই আমি আমার অতিথিদের পছন্দ করি কি…মলি চোখ তুলে তাকালেন সোজাসুজি। তারপর বলল–করি না, তাতে কিছু এসে যায় না।
মিসেস বয়েল এবার একটু রেগে গেলেন। বললেন– আপনার বয়স এবং অভিজ্ঞতা, দুটোই খুব কম। সেই কারণে কোনো অভিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শ গ্রহণ করাই এ ক্ষেত্রে সমীচিন। আচ্ছা, ওই অদ্ভুত-দর্শন বিদেশী ভদ্রলোকটিই বা কে? কখনই বা হাজির হলেন তিনি।
উত্তর দিলেন–মাঝরাতে।
তাই নাকি, ভারি অদ্ভুত তো। কোনো নতুন জায়গায় এসে ওঠবার পক্ষে সময়টা নিশ্চয় উপযুক্ত নয় খুব একটা?
মিষ্টি করে মলি ফোড়ন কেটে বলল–কিন্তু প্রকৃত ভ্রমণকারীকে ফিরিয়ে দেওয়া নীতিবিরুদ্ধ, মিসেস বয়েল। আপনি হয়ত এই আইন সম্পর্কে ঠিক অবহিত নন?
মিসেস বয়েল বললেন–আমার বক্তব্য হচ্ছে, এই যে ভদ্রলোক, প্যারাভিসিনি না কি যেন নাম–খুব সুবিধের বলে…
সাবধান…সাবধান ম্যাডাম। যদি আপনি শয়তানের সম্বন্ধে কোনো মন্তব্য করেন এবং ঘটনাচক্রে সে যদি…
মিসেস বয়েল সামনে ভূত দেখার মতই আচমকা লাফিয়ে উঠল। সাক্ষাৎ শয়তানই যেন এখন তাকে করছে সম্বোধন। নিঃশব্দ পায়ে মিঃ প্যারাভিসিনি যে কখন সেখানে হাজির হয়েছেন দুজনের কারুরই সেটা নজরে পড়েনি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক বিনম্রভঙ্গিতে হাত কচলাচ্ছিলেন। তার ঠোঁটের আগায় শয়তান সুলভ কুটিল হাসির উল্লাস।
মিসেস বয়েল বিব্রত ভঙ্গিতে মন্তব্য করে বললেন–আপনি আমায় চমকে দিয়েছিলেন, কখন যে চুপিসারে আমাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, একেবারে টের পাইনি।
প্যারাভিসিনি জানালেন–হ্যাঁ, আমি নিঃশব্দ পায়েই চলাফেরা করি। কেউ আমার পায়ের আওয়াজ শুনতে পায় না। ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই মজার লাগে। তার ফলে কখনো সখনো আমার কানে অপরের আলাপ-আলোচনা এসে পৌঁছায়। তাতেও আমি খুব মজা পাই। একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন, কিন্তু একবার যানি তা কিন্তু আমি কোনোদিন ভুলি না।
মিসেস বয়েল দ্বিধার সুরে বলে উঠলেন–তা তো বটেই। আমি আমার সাজসরঞ্জাম বোধহয় ড্রেসিংরুমেই ফেলে এসেছি যাই… দ্রুতপায়ে স্থান ত্যাগ করলেন মিসেস বয়েল। মলি কিছুটা বিমূঢ় চোখে বিদেশী ভদ্রলোককে দেখছিলেন। বেশ লাফিয়ে ঝাঁপিয়েই ভদ্রলোক এবার তার দিকে এগিয়ে এলেন।
তিনি বললেন–আমার মহীয়সী গৃহকত্রীকে যেন কিছুটা বিচলিত লাগছে! এর কারণ কি ম্যাডাম? মলি কোনো বাধা দেওয়ার আগেই ভদ্রলোক তার একটা হাত নিজের মুঠোর মধ্যে টেনে নিয়ে তালুর উল্টোদিকে মৃদু চুম্বন এঁকে দিল।
মলি একপা পিছিয়ে গেল। মিঃ প্যারাভিসিনিকে সে সত্যিই পছন্দ করে কিনা এ বিষয়ে সে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারল না। ভদ্রলোকের দুর্বোধ্য বাঁকা চোখে যেন এক পাশবিক লালসার আভাস দেখা যাচ্ছে।