মিসেস বয়েল নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি নিশ্চয় মানসিক ভাবে অসুস্থ। তাছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। একটু থেমে ছোকরার নিয়ম মাফিক মাথা নেড়ে অভিবাদন ফিরিয়ে দিলেন। ঘরটি বেশ আয়তনে বড়। দেওয়াল ঘেষে সারি সারি সুন্দর চেয়ার পাতা। বিশেষ করে গেলাপী রঙের বড় চেয়ার যে খুবই আরামদায়ক সেটা আর কাউকে বলার অপেক্ষা রাখে না। ওই গোলাপী চেয়ারটিই যে তার হবে সেটা মনে মনে ঠিক করে নিলেন তিনি। পাছে অন্য কোনো দাবিদার এসে ঝামেলা করে সেইজন্য দখল-স্বত্ব কায়েম করবার জন্য বোনার সাজসরঞ্জাম ভরা ব্যাগটা তার ওপর নামিয়ে রাখলেন। তারপর ডানদিকে থাকা বৈদ্যুতিক চুল্লীর সামনের দিকে এসে দাঁড়ালেন।
হ্যাঁ, তিনি যা সন্দেহ করেছিলেন, ঠিক তাই। চুল্লীটা নিজে উত্তপ্ত হলেও এর উষ্ণতা সঞ্চারের ক্ষমতা খুবই সীমিত। মিসেস বয়েলের চোখদুটো কিছুক্ষণের জন্য গোলাকার হয়ে উঠলো। এ বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য রাখা উচিত।
বিরক্তি চোখে তিনি এবার বন্ধ জানলার সার্শি ভেদ করে বাইরের দিকে তাকালেন। খুবই জঘন্য আবহাওয়া। খুবই ভয়ঙ্কর। তবে তিনি যে এখানে বেশিদিন থাকবেন না, সেটা সুনিশ্চিত। অবশ্য আরো দু-চারজন নতুন অতিথির আগমন ঘটলে জায়গাটা যে বাসযোগ্য হয়ে উঠবে তখন নতুন করে না হয় চিন্তা করা যাবে।
কেউ যেন চাপা গলায় পেছন থেকে হেসে উঠল। তারপর তাড়াতাড়ি মিসেস বয়েল ঘুরে দাঁড়ালেন। যুবক রেনই দরজার দিকে দাঁড়িয়ে তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টির মধ্যে সেই একই ভাবে হাসির আভাস।
মেজর মেটকাফ খিড়কির দরজায় বরফ দূর করার জন্য সাহায্য করছিলেন জিলকে। ভদ্রলোক রীতিমত পরিশ্রমী। জিলও আনন্দভরা মনে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিলেন সেজন্য।
মেজর মেটকাফ মাথা নেড়ে মন্তব্য করলেন, সত্যিই এটা একটা ভালো ব্যায়াম। দেহের যন্ত্রপাতিগুলো ঠিক রাখার জন্য রোজ এধরনের কোনো না কোনো শরীরচর্চা করা উচিত।
জিল মনে মনে এটাই চিন্তা করছিলেন যে মেটকাফ নিশ্চয় নিয়মিত স্বাস্থ্যচর্চা করেন! কেননা সকাল সাড়ে সাতটায় জিল প্রাতঃরাশ সেরে ফেলেন, তার সম্বন্ধে এই ধরনের চিন্তাই সবার আগে আসবে।
জিলের মানসিক চিন্তাভাবনার আঁচ ধরেই যেন মেজর বললেন–আমার জন্য আপনার স্ত্রী যে প্রাতরাশের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন এর জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। ডিমটাও খুব সুন্দর খেতে হয়েছিল।
জিলকে হোটেলের নানারকম কাজকর্মের জন্য সকাল সাতটার আগে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়তে হয়। এবং সে ও মলি দুজন মিলে ডিম সেদ্ধ করে চা তৈরি করল। তারপর সবকিছু বসবার ঘরে এনে রাখলো সাজিয়ে গুছিয়ে। প্রতিটি বস্তুই নিখুঁত ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। জিল। একটা কথা মনে মনে না ভেবে পারেনি।
সে যদি এই হোটেলের কোনো অতিথি হত তবে এমন বরফ ঝরা সকালে বিছানার গরম জায়গা ছেড়ে কেউই তুলতে পারত না তাকে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সে বিছানা আঁকড়ে পড়ে থাকত।
তবে এই মেজর ভদ্রলোক খুব সকালেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছেন। প্রাতঃরাশও সেরে ফেলেছেন সকাল সকাল। তারপর সারা বাড়িময় ঘুরে বেড়িয়েছেন। দেখলেই বোঝা যায় অদম্য প্রাণশক্তিতে ভরপুর সুস্থ সবল মানুষ তিনি।
জিল আড়চোখে সাহায্যকারীর দিকে একবার তাকালো। ভদ্রলোকের প্রকৃতির সঠিক হদিশ পাওয়া শক্ত। পরিশ্রমী বয়স পেরিয়ে গেছে মনে হয় পঞ্চাশ। তবে তার দুটো চোখই যেন কেমন কেমন। সর্বদাই যেন একজোড়া তীক্ষ্ণ অনুসন্ধান দৃষ্টি মেলে সকলের ভাবগতিক লক্ষ্য করছেন। কিছুই যেন তার নজর এড়িয়ে যায় না। কি উদ্দেশ্য নিয়ে যে তিনি মঙ্কসওয়েল ম্যানরে এসে উঠেছেন জিল সেই কথাই চিন্তা করছিল। যুদ্ধ শেষ হবার ফলেই হয়তো তাকে সেনাবাহিনী থেকে নিতে হয়েছে অবসর এবং হাতে এখন আর কোনো কাজ নেই।
ঘুম থেকে দেরীতে উঠলেন মিঃ প্যারাভিসিনি। কফি আর এক টুকরো টোস্ট ছাড়া কিছুই খেলেন না তিনি। প্রাতঃরাশেও ইউরোপের স্বভাবজাত মিতব্যয়িতার পরিচয় দিলেন। তবে মলির সঙ্গে প্রথম দর্শনেই তার যেন বিনয়ের বাঁধ ভেঙে গেল। মলিও রীতিমতো অপ্রতিভ হয়ে উঠলো। ভদ্রলোক দু পায়ে ভর দিয়ে ব্যগ্রভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নত করে তাকে অভিবাদন জানালেন। বললেন, আসুন আসুন, আমাদের মহীয়সী গৃহকত্রী…সুপ্রভাত! সত্যিই আপনি অসামান্য। বলুন আমি ঠিক বললাম কিনা?
মলি মাথা নেড়ে ইতস্ততঃ ভাবে সায় দিল। প্রকৃতপক্ষে এই প্রসঙ্গ দীর্ঘতর করবার তার কোনো ইচ্ছা ছিল না। এখন ভনিতা করবার মত একচুল সময় নেই।
ভাড়ার ঘরে তদারকি করতে করতে মলি বিড়বিড় করে বলল, আর কেন যে….প্রত্যেকে নিজের খেয়াল খুশিমত প্রাতঃরাশের সময় বেঁধে রাখে ঝক্কি-ঝামেলা সামলানো সত্যি বড় কঠিন কাজ।
মলি ডিসগুলো মুছে রেখে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল দোতলায়। তাকে এখন যাবে না। জিল এখন সারা বাড়ির বরফ সাফ করতে ব্যস্ত।
মলি দ্রুত হাতে কাজ সারল। তবে তার মধ্যে যত্নের কোনো অভাব ছিল না। অতিথিদের স্নানঘরে জলের ঠিকমতো সরবরাহ করা হয়েছে কিনা সেদিকেও চোখ দেওয়া প্রয়োজন। মলি এবারে স্নানঘরগুলো ঘুরে দেখতে লাগল। এই সময় বেজে উঠল টেলিফোন। এত কাজের মধ্যে নতুন উপদ্রব যুক্ত হলে স্বভাবতঃই মনটা একটু বিগড়ে যায়। মলির বুকে জমতে শুরু করেছিল বিরক্তি। কিন্তু এই ঘোর দুর্যোগের দিনে টেলিফোনের লাইনটা ঠিক চালু আছে — এই কথা ভেবেও শান্তি পেল সে আবার কিছুটা। মলি যখন ছুটতে ছুটতে লাইব্রেরী ঘরে এসে পৌঁছলো তখন সে রীতিমতো হাঁপাচ্ছে।