চারদিকে এখন উপস্থিত হচ্ছে নানা ঝামেলা। কি যে শুরু হল এই দুর্যোগ…। তাড়াতাড়ি কর জিল, এই ভদ্রলোক কি যেন নাম তার প্যারা-না কি তাকে ডেকে আন। আর আমি দাঁড়াতে পারব না। ঘুম পাচ্ছে। মলি বলল কথাগুলো।
জিলের আশঙ্কা যে ভুল নয় তার প্রমাণ পাওয়া গেল রাস্তার ওপর পাঁচ ফুট বরফ জমে আছে। অনেক ক্ষেত্রে দুঃসাধ্য বাপার হল জানলা দরজা খোলা। তুষারপাতের কোনো থামার চিহ্ন নেই ঝরছে তো ঝরছেই। সারা পৃথিবীটাই এখন নিরাবরণ বিধবার মতো সাদা পোষাকের মত জড়ানো। তার বুকের মধ্যে নিঃশব্দ মৃত্যুর হিমেল বিস্তার!
মিসেস বয়েল সকালের প্রাতঃকালীন খাবারে ব্যস্ত ছিলেন। এই মুহূর্তে ডাইনিংরুমে উপস্থিত ছিল না কেউই। পাশের টেবিলটা মেজর মেটকাফের জন্য ছিল নির্দিষ্ট। তিনি কিছু আগেই প্রাতঃরাশ সেরে উঠে গেছেন। তার ব্যবহৃত কাপপ্লেটগুলো পরিষ্কার করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মিঃ রেনের টেবিলটা সাজানো গোছানো আছে অবশ্য। কিন্তু ভদ্রলোকের এখনো দেখা পাওয়া যায়নি। একজন নিশ্চয় খুব সকালেই বিছানা ছেড়ে উঠে গেছেন। আরেকজনের সূর্য মাথার ওপর না উঠলে তার ঘুমই ভাঙে না। কিন্তু মিসেস বয়েল জানেন একটিমাত্র সঠিক সময় আছে প্রাতঃরাশের জন্য। সেই সময়টা হচ্ছে সকাল নটা।
মিসেস বয়েল এসব ভাবতে ভাবতেই সুস্বাদু ওমলেটটা শেষ করলেন। দুপাটি মজবুত শক্ত দাঁতের সাহায্যে শেষ করলেন হাতে গরম টোস্টগুলোও। তার মনে একটা রাগ রাগ ভাব ফুটে উঠছে। অভিযোগ করার মত কিছু খুঁজে না পাওয়ায় তার মধ্যে একটা আছে বিচলিত ভাব। মঙ্কসওয়েল ম্যানরকে যেমনটি হবে বলে তিনি ভেবেছিলেন, এসে দেখলেন তার ভাবনার সঙ্গে ওনার কোনো মিলই নেই। তিনি ভেবেছিলেন যে যেখানে হয়ত প্রত্যেকদিন তাস খেলার আসর বসে। কয়েকজন বর্ষিয়সী রমণীরও দেখা পাবেন বলে তার ধারণা ছিল। তাদের কাছে তিনি আড়ম্বর সহকারে তার সামাজিক খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার গল্প করতে পারবেন। কত গণ্যমান্য উচ্চপদস্থ ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তার। সেকথা সকলের মনে শুনিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। এছারা সামরিক দপ্তরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যে তার নখদর্পণে সে কথাও শুনিয়েছেন তিনি।
যুদ্ধ পরিসমাপ্তি তার মনে এক নিঃসঙ্গতা এনে দিয়েছে। তিনি যেন এক নির্জন দ্বীপে পরিত্যক্ত কোনো নাবিক। যুদ্ধ চলাকালীন তিনি ছিলেন একজন কর্মব্যস্ত মহিলা। চারদিকে তার হাঁকডাকে তটস্থ হয়ে থাকত। সমস্ত অফিসটাই সেই মেজাজের ভারে থরথর করে কাপতো? তার চেয়ে উচচপদস্থ কর্তাব্যক্তি এই মহিলাটিকে ভয় পেতেন বিশেষভাবে। আর অধীনস্ত কর্মচারীরা তার সামনে পড়ে গেলে ভয় পেয়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করত। এমনকি প্রকৃতই তার কোনো সাংগঠনিক ক্ষমতা আছে কিনা সে বিষয়ে কেউ মাপার সাহস করত না। কিন্তু এই উত্তেজনার মধ্যে বছরগুলো কেমন করেশেষ হয়ে গেছে। তিনি আবার কর্মস্থল থেকে সরে এসে ব্যক্তিজীবনে ফিরে এসেছেন। যুদ্ধের আগে তার যে নিজস্ব ব্যক্তিগত জীবন ছিল এখন যেন তার কোনো অস্তিত্বই নেই। এতদিন মিলিটারিরা তার বাড়িটা দখল করে রেখেছিল। সম্পূর্ণ না সারিয়ে নিলে তার মধ্যে বাস করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
তার যে সব পুর্বপরিচিত বন্ধুবান্ধব ছিল তারা প্রায় কে কোথায় রয়েছে তার ঠিক নেই। অবশ্য নতুন পাড়াপড়শিরাও ঠিকই খুঁজে যোগাড় করে নেবেন, তবে তার জন্যও কিছুটা সময় চাই! সেইজন্য কোনো হোটেল বা বোর্ডিং হাউসই সব সমস্যার সমাধান বলে আপাততঃ মনে হয়। এই সব ভেবেই মঙ্কসওয়েল ম্যানরকে তিনি নির্বাচিত করেছিলেন।
মিসেস বয়েল রাগতদৃষ্টিতে চারপাশে দেখলেন। বিড় বিড় করে মনে মনে বললেন, খুবই অসাধুতার পরিচয়। এরা যে সবেমাত্র শুরু করতে যাচ্ছে, সে কথাটা আগে আমাকে জানানো উচিত ছিল।
তিনি হাত দিয়ে ডিসটা একটু দূরে ঠেলে দিলেন। প্রাতঃরাশের প্রতিটি খাবার যে সুস্বাদু এবং সুপরিবেশিত এইজন্যেই তার রাগটা একটু বেশি। বিশেষ করে কমলালেবুর মোরব্বা এবং কফি, দুটোই প্রসংসার যোগ্য। মিসেস বয়েলের মনে হল, অভিযোগ জানাবার ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে অন্যায়ভাবে তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এমনকি তার বিছানাটাও পরিপাটি করে গোছানো। ওপরের চাদরটারও চারদিকে নক্সা করা। মাথার বালিশটাও ছিল খুব নরম এবং মোলায়েম। মিসেস বয়েল এই ধরনের আরাম ও সুখস্বাচ্ছন্দ্য পছন্দ করেন। কিন্তু অন্যের কাজের খুঁত ধরাটাও ছিল তার বিলাসের অঙ্গ। আর দুটোর মধ্যে তুলনামূলকভাবে দ্বিতীয়টির প্রতি তার বেশি আসক্তি।
সম্রাজ্ঞীর মত মহিমান্বিত ভঙ্গিমায় চেয়ার ছেড়ে উঠে তিনি দাঁড়ালেন। তারপর ডাইনিংরুম পেরিয়ে পা দিলেন বারান্দায়। লাল-চুল বিশিষ্ট অস্বাভাবিক স্বভাবের যুবকটির সঙ্গে তার মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল। যুবকটির গলায় ঝুলছে এক পশমের টাই। কি-ই বা তার রঙের বাহার। গাঢ় রঙের সবুজের ওপর কালো লাইন দিয়ে চেককাটা।
মিসেস বয়েল মনে মনে ভাবলেন অস্বাভাবিক….। সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। তার ওপর পাশ কাটিয়ে যাবার সময় যুবকটি যেরকম তির্যক দৃষ্টিতে তাকালেন সেই তাকানোটাও তার একদম পছন্দ হল না। তার এই তির্যক দৃষ্টির মধ্যেই আছে এক অস্বস্তিকর অস্বাভাবিকতা– মনে মনে ভাবলেন তিনি।