জিল বিরক্তিসুরে বলে উঠল–দূর ছাই। এটা তো সদর দরজার ঘণ্টার আওয়াজ! এতরাত্রে আবার কে…।
ব্যস্ত সুরে মলি বলল-তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে দেখো।
২. ভৎর্সনার দৃষ্টি
মলির দিকে ভৎর্সনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে অনিচ্ছুক ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল জিল। তারপর ড্রেসিং গাউনটা গায়ের ওপর জড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল নিচে। মলি সদর দরজা খোলার শব্দ পেল। কার মৃদুকণ্ঠের আওয়াজও কানে ভেসে এল তার। মলি ধৈর্য রাখতে পারল না। আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে উঁকি মারার চেষ্টা করল। জিল একজন অপরিচিত দাঁড়িওলা ভদ্রলোককে গায়ে ওভারকোট খুলতে সাহায্য করছে। ভদ্রলোকের আপাদমস্তক পেঁজা পেঁজা বরফে আপদমস্তক ছেয়ে গেছে। তারপর সেই সঙ্গে তাদের কথাবার্তার দুচারটে শোনা গেল। একটা ঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে ভদ্রলোক বললেন–উফ। কথার সুরে বিদেশী সুরটা কানে লাগলো। তারপর বলল–হাতের সমস্ত আঙুলগুলো অসাড় হয়ে গেছে। ওগুলো আমার যে শরীরের অংশ তা বোঝাই যায় না। পায়ের অবস্থা তার চেয়েও খারাপ। শান বাঁধানো মেঝের ওপর শোনা গেল জোরে জোরে পা ঠোকার শব্দ।
আসুন… ভেতরে আসুন। এই বলে জিল লাইব্রেরী ঘরের দরজাটা খুলে দিল। তারপর বলল, ঘরটা এখনও বেশ গরম আছে। দুঃপাঁচমিনিটের মধ্যেই আপনার জন্য একটা ঘরের বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি। ততক্ষণ এখানে আপনি অপেক্ষা করুন।
বিনীত কণ্ঠে আগন্তুক বলল, আমাকে সত্যিই ভাগ্যবান বলা যায়।
মলির কৌতূহল আরো উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। সিঁড়ির মাথা থেকে দুধাপ নেমে এসে ও এবার জাফরিকাটা রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে অপরিচিত আগন্তুককে ভালোভাবে দেখতে লাগল। বয়স হয়েছে ভদ্রলোকের, গালের দুপাশে কালো চাপদাড়ি। দীর্ঘ, ঘন কালো ভূজোড়া ধনুকের মত বাঁকা। গ্রীক পুরাণে বর্ণিত প্রজ্ঞাবান শয়তানের চেহারার সঙ্গে কোথায় যেন একটা মিল পাওয়া যায়। রগের দুপাশের চুলে অল্প পাক ধরেছে, কিন্তু হাঁটা চলার মধ্যে আছে তারুণ্যের সাবলীল ভঙ্গি।
লাইব্রেরীর দরজাটা টেনে দিয়ে জিল দ্রুত পায়ে সিঁড়ি টপকে উঠে এল ওপরে। মলিও আড়িপাতা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল সোজা হয়ে।
মলি জানতে চাইল–ভদ্রলোকটি কে?
জিল মৃদু হেসে বলল–আমাদের অতিথিশালারই আরেক অতিথি বরফ ঝড়ের ধাক্কায় রাস্তার মাঝখানে গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে ভদ্রলোকের। কোনোরকমে গাড়ি থেকে নেমে এক হাঁটু বরফ পেরিয়ে অন্ধের মত সামনের দিকে এগোচ্ছিলেন, যদি কোনো আশ্রয় খুঁজে পাওয়া যায় এই আশা করে। এমন সময় আমাদের টাঙানো সাইনবোর্ডটা ওনার চোখে পড়ল। প্রথমে উনি ঠিক বিশ্বাস করতে পারেননি। সকাতর অনুনয়ে সাড়া দিয়ে ভগবান যেন এটা মিলিয়ে দিয়েছেন বলে এটা তার মনে হয়।
মলি প্রশ্ন করল, কোথাও কোনো গণ্ডোগোল নেই তো?
জিল বলল–আরে না না। এসব রাতে সিঁদেল চোরেরা রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় না।
মলি বলল–মানে আমি বলতে চাই…একজন বিদেশী তো বটে?
জিল বলল–হ্যাঁ তা ঠিক। নাম বললেন প্যারভিসিনি, তবে ভদ্রলোকের মানিব্যাগটা আমি দেখেছি। মনে হল শুধুমাত্র আমাকে দেখাবার জন্যই ইচ্ছে করে উনি বার করলেন ব্যাগটা পকেট থেকে। করকরে ক্যারেন্সি নোটে ঠাসা। ভদ্রলোককে কোনো ঘরটা দেওয়া যায় বল তো?
মলি বলল–কেন, সবুজ ডিসটেম্পার করা ঘরটাই দাওনা। সবকিছুই আছে সাজানো গোছানো। কেবলমাত্র বিছানাটা পেতে দিলেই হয়।
আমার মনে হয় ভদ্রলোককে গোটা দুয়েক পাজামাও ধার দিতে হবে। কেননা গাড়িতেই আটকে আছে ওনার সব মালপত্র। আমাকে বললেন, কোনোরকমে গাড়ির জানলা দিয়ে তিনিই শুধু নেমে আসতে পেরেছেন।
মলি বিছানার চাদরটা আর বালিশের ওয়াড় আর তোয়ালে আনতে ভেতরে গেল। তারপর দুজনে মিলে আবার দ্রুত হাতে শয্যা তৈরি করতে লাগল।
আকাশের যেরকম অবস্থা তাতে মনে হয় পথঘাট সব চাপা পড়ে যাবে বরফে। এই বরফ কেটে রাস্তা বার করতেও সময় লাগবে অনেক। আমরা দু-চার দিনের জন্য হয়তো বাইরের পারিপার্শ্বিক জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বো। ব্যাপারটা তাহলে খুব মজার হবে তাই না?– সম্পূর্ণ এক নতুন ধরনের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা!–জিল বলল।
সন্দেহের সুরে মলি জবাব দিল–আমার বাপু অত কিছু মনে হচ্ছে না, কেবলমাত্র পাউরুটি দিয়ে নানা ধরনের খাবার তৈরি করা যা অসুবিধেজনক…। আচ্ছা জিল, আমার পাউরুটির কেক আর মিষ্টিটা তোমার খেতে খারাপ লাগে না তো?
জিল তাকে ভরসা দিয়ে বলল–কি যে বল! একেবারে অমৃত! অতিথিরা খেলে বর্তে যাবে। তবে রুটিওলা যে কি রকম রুটি দিয়ে গেছে সেটাই প্রধান চিন্তার বিষয়। পথঘাট বরফে ঢেকে গেলে অন্য কোনো রুটিওলাও আসবে না এদিকে।
শুধু রুটিওলা না, মাংসবিক্রেতাকেও তুমি দেখতে পাবে না। না আসবে কোনো পিওন, না আসবে কোনো হকার। এমনকি টেলিফোন যোগাযোগ পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে বিচ্ছিন্ন।
তখন একমাত্র সম্বল হবে রেডিও তারাই আমাদের কাছে কর্তব্যের নির্দেশ পাঠাবে।
তবে একটাই আমাদের ভরসা আছে যে আমাদের জেনারেটার আছে। জেনারেটারের সাহায্যেই আমরা নিজেদের ইলেকট্রিক লাইনগুলো চালু করতে পারব।
কাল সকালে উঠে প্রথমেই আমাদের জেনারেটারটা প্রস্তুত রাখা দরকার। তাছাড়া কয়লা ভর্তি করতে হবে চুল্লীটাতে।
তবে আমার বিশ্বাস আগামী দুচার দিনের মধ্যে নুতন করে কয়লা পাবার কোনোও সম্ভাবনা নেই। মজুত কমে যায়নি তো?