খাতার দিকে তাকিয়ে মৃদু শিস দিয়ে উঠল কেন্। নিজের মনে বলতে থাকে তিনটি ইঁদুর অন্ধ আশ্চর্য! আমি তো একেবারে বেকুব বনে যাচ্ছি।
পারমিন্টার গম্ভীর চালে মাথা দুলিয়ে বললেন, হ্যাঁ, সামনের টানা থেকে একটুকরো কাগজ বের করে কেনের দিকে দিলেন এগিয়ে, মৃত মহিলার পোশাকের সঙ্গে পিন দিয়ে আটকানো ছিল এই কাগজটা।
কাগজটায় লেখা আছে–এই প্রথম। নিচে শিশুসুলভ অপটু হাতে তিনটি ইঁদুরের আঁকা ছবি। তারপরে বাদ্যসঙ্গীতের একটা লাইনের স্বরলিপি।
শিস দিয়ে কেন সুরটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করল। তিনটে ইঁদুর অন্ধ…জানলা কপাট বন্ধ?
ঠিক আছে, ঠিক আছে। তোমাকে আর সুর মেলাতে হবে না। ওটা যে এই গানের স্বরলিপি সেটা আমার কাছে জলের মত পরিষ্কার।
সে জিজ্ঞেস করল–কোনো পাগলের কাণ্ড তাই না স্যার?
পারমিন্টার ভ্রু কুঁচকে বললেন, হু মেয়েটার সম্বন্ধে যে সব খোঁজখবর পাওয়া গেছে তার মধ্যে কোনো ভুল নেই তো?
সে বলল, না স্যার সমস্তই খাঁটি। ফিঙ্গারপ্রিন্টের বিশেষজ্ঞের রিপোর্টটা একবার পড়ে দেখলেই সব জানা যাবে। মিসেস লিয়ন বলে যে মেয়েটা তার পরিচয় দিয়েছে তার আসল নাম মউরীন গ্রেগ। মেয়েটা দুমাস আগে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। ওই সময় তার জেলের মেয়াদও শেষ হয়ে গিয়েছিল।
পারমিন্টার চিন্তান্বিত কণ্ঠে বললেন–ছাড়া পাবার পর মেয়েটা চুয়াত্তর নম্বর কার্লভার স্ট্রীটে গিয়ে উঠল। নিজের নাম রাখল মউরীন লিয়ন। কখনো কখনো মদ খেয়ে বেহুশ হয়ে পড়ে থাকত। সপ্তায় এক-একদিন দু-একজন পুরুষ অতিথিও ওর ঘরে আনাগোনা করত। তবে ও বিশেষ কাউকে যে ভয় পেত তা কিন্তু নয়। নিজের আসন্ন বিপদ সম্বন্ধেও ওর কোনো ধারণা ছিল না। এই লোকটা প্রথমে এসে কলিংবেলের বোতাম টেপে। তার ঝি-এর কাছে মিসেস লিয়নের ঘর কোনোটা জেনে নেয়। সেও যদিও লোকটার বর্ণনা দিতে পারেনি। শুধু জানিয়েছে সে মাঝারি ধরনের উচ্চতা, আর গলার স্বর কিছুটা ভাঙ্গাভাঙ্গা। তারপর কাজ সারতে ঝি নিচের তলায় চলে যায়। কিন্তু সন্দেহজনক কোনো চেঁচামেচি তার কানে এসে পৌঁছায়নি। এমন কি লোকটা কখন নিঃশব্দে বেরিয়ে গেছে তাও বলতে পারে না সে।
মিনিটদশেক বা আরো কিছু পরে ও যখন মিসেস লিয়নের জন্য চা নিয়ে যায় তখনই দেখতে পায় মেয়েটাকে কে গলা টিপে মেরে গেছে।
হঠাৎ বেঁকের মাথায় কেউ এ খুন করেনি কেন্। খুবই সুচিন্তিত পরিকল্পনায় কাজটা শেষ করা হয়েছে। কিছুক্ষণ চুপ করে পারমিন্টার আবার বললেন, ইংলণ্ডে মঙ্কসওয়েল ম্যানর নামে কটা বাড়ি আছে…?
কেন জবাব দিল, খুব সম্ভবতঃ একটাই।
তাহলে তো বলতে হয় আমরা অসীম সৌভাগ্যবান। তবে এ বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া উচিত। বেশি দেরী করা উচিত হবে না।
সার্জেন্টের চোখের দৃষ্টিও এবার নোটবইয়ের পাতার ওপর স্থির হয়ে রইল। দুটো ঠিকানা লেখা আছে সেখানে একটা চুয়াত্তর নম্বর কার্লভার স্ট্রীট, অন্যাটা মঙ্কসওয়েল ম্যানর।
আপনি কি তাহলে মনে করেন…?
পারমিন্টার দ্রুত চোখ তুলে তাকালেন। তোমারও কি সেইরকম সন্দেহ হচ্ছে না…।
মঙ্কসওয়েল হতে পারে তাই না? কিন্তু…কিন্তু দু-চার দিনের মধ্যেই যেন নামটা কোথায় দেখলাম। আমি খুব নিশ্চিত ভাবেই বলতে পারি… অল্প কয়েক দিন আগেই?…
দেখলে কোথায়?
সেটাই তো মনে রাখবার চেষ্টা করছি। এক মিনিট ধৈৰ্য্য ধরুন… সম্ভবতঃ কোনো খবরের কাগজের পাতায়…বোধহয় দৈনিক টাইমসে। একেবারে শেষের পাতায় সেদিনের ক্রসওয়ার্ড পাজলটা সমাধানের চেষ্টা করছিলাম। তখনই যেন এক জায়গায় ছোট্ট করে নজরে পড়ল…
কেন্ কথা বলতে বলতে দ্রুত পায়ে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। একমুহূর্ত পর যখন ফিরে এলেন তখন তার চোখে মুখে জয়ের হাসি। বলল– এই যে স্যার, এখানে দেখুন, কয়েকদিন আগের দৈনিক পত্রিকার একটা পাতা এগিয়ে দিলেন পারমিন্টারের দিকে। পারমিন্টার চোখ বোলান তার ওপর।
মঙ্কসওয়েল ম্যানর হারগ্লেডন, বার্কস।–এই পড়ে আসতে আসতে চোখ তুললেন তিনি। তারপর বললেন, তুমি আমাকে বার্কায়ারের পুলিশ অফিসারের লাইনটা ধরিয়ে দাও।
মেজর মেটকাফের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে মঙ্কসওয়েল ম্যানর একটা যেন রীতিমত হোটেলের মত পরিণত হল। কাজকর্ম চলতে লাগল সেই ভাবে। তিনি অবশ্য মিসেস বয়েলের মত উগ্রচণ্ডী স্বভাবের ছিলেন না, আর ক্রিস্টোফার রেনের মত অস্থির প্রকৃতিও তিনি ছিলেন না। শক্তসমর্থ চেহারার মাঝবয়সী সুপুরুষ ছিলেন তিনি।
চালচলনে মিলিটারি ভঙ্গি। চাকরি জীবনটা অধিকাংশ সময় ভারতবর্ষতেই কাটিয়েছেন তিনি। তার জন্য নির্দিষ্ট ঘর এবং ঘরের আসবাবপত্র দেখেও তিনি সন্তুষ্ট হলেন। মিসেস বয়েলের সঙ্গে তার আগে পরিচয় না থাকলেও ভদ্রমহিলার দু-একজন দূর সম্পর্কের ভাইকে তিনি চিনতেন। দু-দুটো নরম চামড়ার দামী স্যুটকেসে ভরা তার মালপত্র দেখেও মনে মনে জিল আশ্বস্ত হল। আর যা হোক বিল না মিটিয়ে কেটে পড়ার মানুষ নন মেটকাফ।
সত্যি কথা বলতে কি মলি এবং জিলও অতিথিদের সম্বন্ধে তাদের পারস্পরিক মনোভাব আদানপ্রদান করবার মতো কোনো নিশ্চিন্ত অবসর ইতিমধ্যে খুঁজে পায়নি। সারাদিনটা তাদের কেটে গেছে কাজের মধ্যে। লাঞ্চ এবং ডিনার তৈরি করা, পরিবেশন করা, কাপ ডিস ধোওয়া- আরও কতরকম যে কাজের ঝামেলা তার ঠিক ঠিকানা নেই কোনো। মেজর মেটকাফ অবশ্য কফির প্রশংসা করলেন খুব। এবং মলি ও জিল যখন সমস্ত কাজ শেষ করে রাত্রে বিছানায় শুতে এল তখন তারা রীতিমত ক্লান্ত হলেও দুজনের চোখে তখন ফুটে উঠছিল সাফল্যের দীপ্তি। বিজয়গর্বে তাদের বুক ফুলে উঠেছিল। কিন্তু উষ্ণ শয্যার মদির আরামও বেশিক্ষণ জুটলো না তাদের কপালে। দুটো বাজতে না বাজতেই কলিংবেলের মর্মভেদী আর্তনাদে উঠে পড়তে হল বিছানা ছেড়ে।