Site icon BnBoi.Com

দি হলো – আগাথা ক্রিস্টি

দি হলো - আগাথা ক্রিস্টি

দি হলো

০১. শুক্রবার সকাল

০১.

শুক্রবার সকাল ছ’টা তেরো মিনিটে বড়সড় মাপের চক্ষুজোড়া খুলতেই বরাবরের মতো লুসি এ্যাঙ্গক্যাটেল সম্পূর্ণরূপে নিদ্রা কাটিয়ে জেগে উঠলেন এবং চোখ খুলতে যতক্ষণ দেরি, চোখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে তার সদা ব্যস্ততৎপর মন সমস্যা সমাধানে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আলোচনার প্রয়োজনেই খুড়তুতো বোন মিডগে হার্ড ক্যাসলকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন এবং সে-ও গতকাল হলোতে এসে হাজির হয়ে গেছে। গৃহকত্রী এ্যাঙ্গক্যাটেল চটপট শয্যা ত্যাগ করে, নিজের অনিন্দ্যসুন্দর কাঁধের ওপর শিথিল হয়ে পড়া পোষাকটা সরিয়ে নিয়ে মিডগের শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে চললেন। অহেতুক চিন্তার জাল ভদ্রমহিলার উর্বর মস্তিষ্কে সর্বক্ষণ বিচরণ করে, তাই তিনি চলতে চলতে আপন খেয়ালের বশে কথোপকথনের অবতারণা করে ফেলেন এবং তাই মিডগের জবাবও নিজের উর্বর মস্তিষ্ক থেকেই জোগাতে থাকেন।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল মিডগের শোবার ঘরের দরজা খুলে ঘরে পা রাখলেন, কথোপকথনের জের তখনও পুরোদমে চলছে। তিনি বললেন, প্রিয় বোনটি আমার, তুমি নিশ্চয়ই একথা স্বীকার করবে যে, সপ্তাহান্তে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে।

সদ্য সুনিদ্রা থেকে হঠাৎ জেগে ওঠা মিডগে অস্পষ্ট স্বরেই বলে ওঠে, আঁ? হ্যাঁ!

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল চটপট করে খুব দ্রুত জানলাগুলো খুলে দিতেই, ঝঝন শব্দের রেশ তুলে জানলা দিয়ে শরৎপ্রাতের পাংশু আলোর রেখা ঘরে এসে পড়ে। তিনি আপনমনেই বলে ওঠেন, পাখিগুলো সত্যি কি সুন্দর।

মিডগে, কী?

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলতে থাকেন, সে যাই হোক, মোটের ওপর একটা বিষয় পরিষ্কার বোধগম্য হয়ে যাচ্ছে যে, আবহাওয়া কোনো সমস্যা সৃষ্টি করছে না এবং খুব সম্ভব ভালোর দিকে যাবে। কিন্তু তাতে করে কী এসে যাবে, পরস্পরবিরোধী কতগুলো ব্যক্তিত্ব তো ঘরের মধ্যেই এসে ভিড় জমাবে। আমিও বলে রাখছি, গতবারের মতো এবারেও যদি রাউণ্ড গেম নিয়ে কোনো ঝাট বাধে, আর কেউ না বলুক, আমি জাদাকে ছেড়ে কথা বলব না। গতবারের অবশ্য গোলমালের পর আমি হেনরিকে বলেছিলাম। আবার এও ভেবে দেখলাম, এ কাজটা আমার পক্ষে মোটে শোভন হবে না–তাকে তো আনতেই হবে। তাছাড়া জার্দাকে বাদ রেখে জনকে আসতে বলা একদিকে যেমন হৃদয়হীনতা হবে, আবার অন্যদিকে দৃষ্টিকটুও বটে! সবচেয়ে বড় কথা, জার্দা অত্যন্ত ভালো হয়েও যে এমন নির্বোধ হতে পারে এ কথা ভাবতেও অবাক লাগে। যাকগে কি আর করা যাবে।

মিডগে এতক্ষণে নড়েচড়ে বসে বলে ওঠে, আচ্ছা তুমি ঠিক কোন্ ব্যাপারে কথা বলছে বল তো, লুসি?

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল জবাবে বলেন, আমি সপ্তাহান্তিক ছুটির কথা ভাবছি। কাল যাঁরা আসছেন আমি তাদের কথাই বলতে চাইছি। দিনরাত একটা ব্যাপার আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে, যতই ভাবছি ততই মনটা বড় অস্থির লাগছে। মিডগে, ভাবনার হাত থেকে রেহাই পেতে তোমার সঙ্গে আলোচনায় বসতে চাইছি, মনটা অনেক হালকাও লাগবে। তোমার বিচক্ষণতা আর বাস্তব বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারছি না।

মিডগে রূঢ় স্বরে বলে ওঠে, লুসি, জানো এখন ক’টা বেজেছে?

–ঠিক জানি না, তোমার তো অজানা নয়। ঘড়ির কাটা ধরে চলার অভ্যাস আমার কস্মিনকালেও ছিল না।

মিডগের সঙ্গে সঙ্গে জবাব, এখন ঠিক ছ’টা বেজে পনেরো।

বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে সপ্রতিভ থেকেই লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, তা হবে হয়তো বোন।

মিডগে অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকে। সত্যি দিনকে দিন কী অসম্ভব পাগলাটে হয়ে উঠেছে আজকাল লুসি।

মিডগে ভাবতে বসে যায়, কেন যে ওকে আমরা সহ্য করে চলেছি? ওর সঙ্গে মনের মিল রেখে মানিয়ে চলছি-বা কেন?

কিন্তু প্রশ্নটা মনে উদয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উত্তরটাও মনের মণিকোঠায় এসে হাজির হয়ে যায়, লুসি এ্যাঙ্গক্যাটেলের মুখে মুচকি হাসির রেখা এবং মিডগে তার দিকে দৃষ্টি যেতেই লুসির মোহিনী মায়ার জালে এমনভাবে জড়িয়ে পড়ে যে, মুহূর্তের বিহ্বলতায় মনের সব ক্রোধ আর রূঢ়তা নিমেষে উবে গেল। সারা জীবন ধরে সে যে মোহজাল বিস্তার করে সকলকে ভুলিয়ে রেখেছে, আজ ষাট বছর অতিক্রান্ত হবার পরেও তার সেই শক্তির মহিমা বিন্দুমাত্র ক্ষয়ে যায়নি–সেই জন্যই বোধহয় পৃথিবী জুড়ে গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, এডি. কং এবং সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারীবৃন্দ সকলকেই অসুবিধা, অসন্তুষ্টি আর হতবুদ্ধিতার শিকার হতে হয়েছে। তার শিশুসুলভ স্বভাব আর চপলতাই তাকে সমালোচনার উর্ধ্বে নিয়ে যেত, ডাগর চোখে বিস্ফারিত নেত্রে কমনীয় ও রমণীয় শুভ্র হস্তদুটো মেলে ধরে ভ্রমরগুঞ্জনের মতো মিষ্টি সুরে বলে উঠতেন, ওঃ, আমি সত্যি দুঃখিত…তাঁর প্রতি সকলের সব অসন্তোষ মুহূর্তের মধ্যে লুপ্ত হয়ে যেত।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল এই সময় বলে ওঠেন, প্রিয় বোনটি আমার, সত্যি আমি দুঃখিত, আমাকে আগে থাকতে বলে দেওয়া উচিত ছিল।

–আমি এখন তোমাকে বলে দিচ্ছি…অবশ্য ঘুম তো আমার ভেঙে গেছে, আর বলেই বা। লাভ কি?

-বড়ই লজ্জার কথা! কেন? অসুবিধাটা ঠিক কোথায় হচ্ছে?

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বিছানার প্রায় প্রান্তে এসে বসে পড়ে, মিডগের মুহূর্তের জন্য মনে হল কোনো পরী বোধ হয় তার শয্যায় এসে বসেছে।

চঞ্চল হাত দুটো অত্যন্ত রমণীয় এবং অসহায় ভাবে মেলে ধরলেন লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল-হাত, নেড়ে বলে ওঠেন, সব খারাপ লোকেরাই তো একসঙ্গে হাজির হচ্ছে, মানে–আমার বক্তব্য হল- যারা আসছে তারা লোক হিসেবে খারাপ নয়, সত্যি তারা ভালো লোক, শুধু ভালো নয় খুব ভালো।

চতুষ্কোণ আকৃতির কপাল থেকে চুলগুলো ধীরে ধীরে সরাতে সরাতে মিডগে জিজ্ঞাসা করে, কারা আসছে?

কেন, জন এবং জার্দা? ব্যক্তি হিসেবে জন খুবই ভালো এবং তার একটা আশ্চর্য আকর্ষণী শক্তিও আছে। তবে বেচারা জার্দা-তাকে আমরা সকলেই দয়ার চোখে দেখব এবং আমাদের প্রায় সকলেরই তার প্রতি অনুকম্পা থাকা একান্তই উচিত।

জার্দার পক্ষ সমর্থন করে মিডগে বলে ওঠে, খারাপ যতটা ভাবছো তত খারাপ সে নয়।

-না, না, বোন, সে সত্যিই করুণার পাত্রী, তার কারণ সকলের বক্ষ জুড়ে দয়ার উদ্রেক হয়, লোকের একটা কথারও মানে বোঝে না।

-হয়তো বোঝে না, তোমার কথার অর্থ না বোঝার জন্য আমি তাকে চাপ দিতে পারি না। লুসি, তোমার মন এত দ্রুত এগিয়ে চলে যে, তার সাথে তাল রাখতে গিয়ে তোমার কথোপকথনের মাত্রাকেও বিস্ময়কর লাফ লাগাতে হয়। সংযোগের সব সূত্রই তাই মাঝপথে খেই হারিয়ে ফেলে।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল–ঠিক বাঁদরের মতো? কি বলো?

মিডগে–ক্রিস্টোস ছাড়া আর কে আছে? হেনরিয়েটা নিশ্চয়?

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের মুখ মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তিনি বলে ওঠেন, হা, তবে আমার মন বলে, হেনরিয়েটা একটা শক্তির পাহাড়। সে চিরটাকাল একইরকম রয়ে গেল। তোমার নিশ্চয়ই অজানা নয় হেনরিয়েটা দয়ার সাগর। সে জাদার ব্যাপারেও যতটা সম্ভব সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। গতবারের কথা ভেবে দেখো, সে কত সাহায্য করেছিল। সে বারে আমরা লিমেরিক বা শব্দবাঁধন বা উদ্ধৃতি নিয়ে খেলছিলাম এবং খেলা প্রায় শেষের দিকে তখন খেয়াল হলো, জার্দা সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে; শুরুটাই সে করতে পারেনি। সে বুঝতেই পারেনি, কোন্ খেলায় আমরা মেতে উঠেছি! সত্যি এটা বড় বিপজ্জনক। নয় কি, মিডগে?

মিডগে-অন্যের কথা আর কি বলব, তোমার উর্বর মস্তিষ্কের ফল, রাউন্ড গেম, সেই সঙ্গে তোমার কথা বলার ধরন–এসব আমার কিছুই বোধগম্য হয় না। সত্যি লুসি, তোমার কথা বলার ধরনধারণ কি বরাবরই অদ্ভুত?

মিডগের কথায় কর্ণপাত না করে লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল তার বক্তব্য পেশ করেই যেন এগিয়ে চলেছে, হ্যাঁ বোন, আমাদের সকলেরই উচিত চেষ্টা করে দেখা, কিন্তু চেষ্টা করতে গেলে জার্দার মনে ঘৃণা জন্মাবে। আমার মনে হয়, জার্দার যদি সাহস থেকে থাকে তবে সাহসিকতার পরিচয় না দিয়ে সে যেন দূরে নিজেকে সরিয়ে রাখে। কিন্তু তা সে করে না, হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে খুব অল্পেই, বিমর্ষের লক্ষণ চোখে-মুখে ফুটে ওঠে। জন এইসব দেখে ধৈর্য হারিয়ে ফেলে, আমি কিছুতেই ভেবে পাই না, কী করলে অবস্থাটা স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। আর, ঠিক তখনই হেনরিয়েটা ব্যাপারটাকে আরো ঘোলা করে তোলে। জার্দার দিকে ফিরে সে এমনভাবে পুলওভার সম্বন্ধে মুখরোচক আলোচনা জুড়ে দেয় যে, জার্দাও নিজের পোষাকের গর্বে এমন ভাব দেখাতে থাকে যে পুলওভারটা যেন তার নিজের হাতেই বোনা। ধীরে সুস্থে পূর্বের বিমর্ষতা কাটিয়ে জাদার মুখ খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, সমস্ত পরিবেশটা পরিচ্ছন্নতার আলোয় প্রস্ফুটিত হয়ে একটা নতুন দিকে বাঁক নেয়। বিশেষ এই গুণটার জন্য হেনরিয়েটার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ–সমস্ত সমস্যার এমন সুন্দর সুষ্ঠু সমাধান, সেইসঙ্গে মেঘমেদুর নীলাকাশে সূর্যালোকের আলোকে ভাসিয়ে দিতে হেনরিয়েটার জুড়ি নেই।

মিডগে–হ্যাঁ, সে ঝুঁকিটা ঘাড়ে নেয়।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল-হা, সে জানে কোথায় কী বলতে হবে, কি করতে হবে।

মিডগে-কাজ করার শক্তিও আছে। সেবারে সে পুলওভারটা হেনরিয়েটা গায়ে চাপিয়েছিল, সত্যি কী সুন্দরই না তাকে মানিয়েছিল। হেনরিয়েটা ওটা নিজের হাতেই তৈরি করেছিল।

-সত্যি?

–নিশ্চয়ই।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল–এই জন্যই তো, হেনরিয়েটার প্রশংসায় আমি পঞ্চমুখ। আর দেখো, হেনরিয়েটা যা করে ঠিকই করে, সুন্দর করে–সকলেই এক বাক্যে তার কাজের প্রশংসায় সামিল হয়। আর ঠিক এই একটা জায়গাতেই জার্দা ও হেনরিয়েটার মধ্যে অমিল চোখে পড়ে। তুমি আমার কথা মিলিয়ে নিও, সাপ্তাহাত্তিক ছুটিতে হেনরিয়েটা নানা ভাবে আমাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। সব কাজেই তার চাতুরী স্পষ্ট ধরা পড়ে। জাদাকে সে সাহায্য করবে, হেনরিয়েটাকে আনন্দ দেবে, জনকে তার মেজাজ বুঝে পরিচালনা করবে, আমার তো মনে হয় সে ডেভিডকেও সাহায্য করবে।

মিডগে–কোন ডেভিড? ডেভিড এ্যাঙ্গক্যাটেল?

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল-হ্যাঁ, এই তো সবে সে অক্সফোর্ড না কেমব্রিজ থেকে ফিরে আসছে। এই বয়সের ছেলেগুলোর সম্বন্ধে সমালোচনা করা সত্যি বড় কঠিন, বিশেষ করে যদি সে প্রখর বুদ্ধির অধিকারী হয়। ডেভিড তো নিঃসন্দেহে তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন যুবক। এই ধরনের যুবকদের ক্ষেত্রে যে বৈশিষ্ট্যটা চোখে পড়ে তা হল, হয় তারা গম্ভীর, না হয় অত্যন্ত তার্কিক মনোভাবাপন্ন হয়। তবে আমার স্থির বিশ্বাস, হেনরিয়েটা যেভাবেই হোক নিজের মতো করে তাকে মানিয়ে নেবে, কারণ অত্যন্ত কৌশলের সঙ্গে সে কাজ করে। এছাড়া আরও একটা গুণ, তার ভাস্কর্যের জন্যও সকলে তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। সে শুধু পাথর কেটেই মূর্তি তৈরি করে না, নানাপ্রকার ধাতু ও প্লাস্টার দিয়ে সুন্দর সুন্দর শিশু, জন্তু বা মানুষ নির্মাণেও সে সিদ্ধহস্ত। গতবারে নিউ আর্টিস্ট-এ তার হাতের তৈরি বহু জিনিসের প্রদর্শনী হয়ে গেছে–সেগুলো দেখতে রবিনসনের মই বেয়ে ওঠার মতোই যেন লাগছিল। সুচিন্তার উর্ধ্বারোহন তাতে খুবই সুন্দর ভাবে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল। ডেভিডের মতো যুবক এই সব জিনিসের প্রতি সহজে আকৃষ্ট হবে।…আমার কাছে কিন্তু এইসব নিছক বালখিল্য বলেই মনে হয়।

মিডগে-প্রিয় বোন লুসি।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল-হেনরিয়েটার কিছু কাজ আমার খুব মনোরম বলেই মনে হয়। যেমন ধরো; উয়িপিং এ্যাশট্রি ফিগার। মিডগে, একটা কথা না বলে পারছি না যে, হেনরিয়েটার মধ্যে প্রতিভা আছে। তাছাড়া ব্যক্তিগত ভাবেও সে সকলের কাছে প্রিয়পাত্র।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়েন, জানলার কাছটিতে এসে দাঁড়ান। অন্যমনস্ক ভাবে ছেঁড়া তারে সুর তোলার চেষ্টা করেন। আপন মনেই লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বিড়বিড় করতে থাকেন, কেমন যেন বেসুরো লাগছে?

বেসুরো?

তাই তো ভাবি কেন এমন হচ্ছে। সদর দরজার দু’ধারে আনারস গাছের মতো বেমানান, বেসুরো কেন মনে হচ্ছে? ছেঁড়া তার বলে। একটা-না-একটা কারণ নিশ্চয়ই থাকবে।শূকরছানার মতো অনুসন্ধিৎসু হতে হবে, তবে যদি কারণ মেলে।

মিডগে-দেখো লুসি, একটা বিষয় শেষ হতে না হতেই অন্য প্রসঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে যেও না। সপ্তাহান্তের আলোচনার জন্যই তোমার এখানে আগমন, এবং যতদূর দেখছি। তোমার মনে বিন্দুমাত্র উদ্বেগের কোনো লক্ষণ চোখে পড়ছে না। তুমি যদি রাউন্ড গেম থেকে দুরে সরে থাক, জাদার সঙ্গে সহনশীলতার মাত্রা বজায় রেখে কথাবার্তা বলে চল এবং হেনরিয়েটাকে দিয়ে যদি তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন ডেভিডকে পোষ মানাতে পার, তবে আর অসুবিধাটা রইল কোথায়

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল–আছে, আছে বোনটি, অমও একটা জিনিষ আছে, এডওয়ার্ড আসছে যেন!

মিডগে-ওঃ, এডওয়ার্ড! মিডগে নামটা উচ্চারণ করেই চুপ করে গেল। কিছুক্ষণ পরে ধীরে ধীরে মুখ খুলল, কোন্ লোভের বশবর্তী হয়ে এডওয়ার্ডকে নিমন্ত্রণ করে আনছ শুনি?

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল–আমি তাকে ডাকিনি, সে নিজেই উপযাজক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছে সে “এখানে উপস্থিত হতে পারে কি না।” যদি তাকে মুখের ওপর ‘না’ বলে দিই, সে আর কোনোদিন এ পথ মাড়াবে কিনা সন্দেহ, কারণ তার যা স্বভাব চরিত্র।

মিডগে ধীরে ধীরে শুধু মাথা নাড়ে। আর ভাবে, হ্যাঁ, কথাটা মিথ্যে নয় সত্যি তার যা স্বভাব। মুহূর্তের মধ্যে তার মনের মণিকোঠায় প্রিয় মুখখানি তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কতকটা যেন লুসির অহেতুক মোহময় মুখশ্রীর ন্যায় শান্ত নির্ভীক বিদ্রুপাত্মক…।

মিডগের মনের সুরের প্রতিধ্বনি তুলে লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে চলেন, প্রিয় এডওয়ার্ড… হেনরিয়েটা যদি একবার মনস্থির করে সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারত, যদি সে তাকে বিবাহ করত…আমি জানি, এডওয়ার্ডকে সে মনে মনে খুবই পছন্দ করে…যদি একবার সাপ্তাহান্তের ছুটিতে ক্রিস্টো এসে হাজির না হতো তবে সব পূর্বের মতোই চলতো, সব ঠিক হয়ে যেত…কি এডওয়ার্ডের ওপর জনের খুব খারাপ প্রভাব ফেলেছিল। জনের প্রয়োজন যত বাড়ে, এডওয়ার্ডের উপস্থিতি তত বেশি অপ্রয়োজনীয় আর নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে।

বুঝতে পারছ আমি ঠিক কী বলতে চাইছি?

মিডগে শুধু নিঃশব্দে মাথা নাড়ে।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল–এই সাপ্তাহান্তিক ছুটি উপভোগের ব্যবস্থা অনেক আগে থাকতেই ঠিক হয়ে আছে, তাই ক্রিস্টোফারকে দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। একটা কথা ভেবেই আমার মন বারবার উতলা হয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে একদিকে ডেভিড যেন দাঁতে রেখে নখ কাটবে, জাদাও বেসামাল হয়ে পড়বে। অপরদিকে জন অত্যন্ত ধনাত্মক এবং এডওয়ার্ড তেমনি ঋণাত্মক…কি যে পরিস্থিতি দাঁড়াবে কিছুই ভেবে উঠতে পারছি না।

মিডগে–পুডিংয়ের উপাদানগুলো মোটেই উৎসাহব্যঞ্জক নয়।

লুসি, মিডগের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন। হাসিমুখেই বলে ওঠেন, এমন অনেক সময়ও গেছে যখন সমস্যাগুলোর সমাধান সহজভাবে হয়ে যায়। আগামী রবিবার আমরা একজন অপরাধশাখার লোককে আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ করার নিমন্ত্রণ করেছি–তাতে করে হয়তো অবস্থার কিছু হেরফেরও হতে পারে। কি বলো হতে পারে না?

মিডগে-শেষ পর্যন্ত অপরাধশাখার লোক?

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল-হ্যাঁ, ভদ্রলোক আগে থাকতেন বাগদাদে, হেনির তখন হাইকমিশনার ছিলেন। অন্য জনাকয়েক সরকারি কর্মচারীর সঙ্গে তাকেও নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। ভদ্রলোক হাঁসের রঙের মতো সাদা স্যুট পরে এসেছিলেন, বোম ঘরে ছিল গোলাপী রঙের ফুল এবং পায়ে কালো পেটেন্ট চামড়ার জুতো। তাঁর সম্বন্ধে আর বেশি কিছু আমার জানা নেই। কারণ, কে কাকে মারল এই সব আজেবাজে গল্প শুনতে আমার কোনোদিনই ভালো লাগে না। আমার বক্তব্য হল যে, লোকটা মরে গেলে আর তার বাকি কী রইল? মৃত্যুর পরে-কে মারল, কেন মারল, কখন মারল–এইসব নিয়ে হৈ-হুঁল্লোড় বোকামি ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে!

মিডগে-তোমাদের এখানে কি কোনো খুন-টুন হয়েছে নাকি, লুসি?

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল-না, না বোন, আমাদের এখানে খুন হতে যাবে কেন? ঐ ভদ্রলোক নতুন ঐ বাড়ির লোক–ঐ যে নতুন বাড়ি করেছে। বাড়িতে বিশ্রী রকমের একটা বাগানও করেছে লন্ডনের লোকেদের যা রুচি, তারা বরাবরই এরকম কুৎসিত জিনিষের প্রতি আসক্ত। ঐ ভদ্রলোকের বাড়ির গায়েরই বাড়িটা এক অভিনেত্রীর। তারা আমাদের মতো বারোমাস বাড়িতে কাটায় না…। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল ঘরময় পায়চারি করতে লাগলেন এবং সেই সঙ্গে এও বললেন, যাকগে, ও সব বাজে ব্যাপার। এসব ভেবে আর কী লাভ, তোমার সাহায্য পেয়ে আমি বড়ই উপকৃত হলাম, প্রিয় মিডগে।

মিডগে–আমার তো মনে হয় না, আমি তোমার কোনো কাজে এসেছি বলে।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বিস্ময়ভরা চোখে মিডগের দিকে তাকাল।–কি? করোনি? আচ্ছা, একটা ভালো ঘুম দিয়ে নাও, প্রাতঃরাশেও ওঠা চলবে না। আর যদি ডাক দিয়েও থাকি, ওঠার পরিবর্তে যত খুশী মন চায় আমার প্রতি কঠোর হবে।

হাসিমাখা মুখে লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বেরিয়ে গেলেন। যেতে যেতে খোলা বাথরুমের দিকে চোখ পড়ল, কেটলি আর গ্যাসরিং দেখা মাত্র তার মাথায় আর এক বুদ্ধি খেলে গেল।

পৃথিবীতে এমন কোনো লোক নেই যে চা ভালোবাসে না। মিডগেকে চা করে দেওয়ার জন্য তিনি কেটলি চাপালেন। কেটলি চাপিয়েই আর দাঁড়ালেন না, চলে গেলেন।

এবার তিনি এসে দাঁড়ালেন স্বামীর ঘরের সামনে, দরজার হাতলে হাত রাখলেন হেনরি এ্যাঙ্গক্যাটেল। লুসিকে তিনি ভালোবাসতেন এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, সকলের ঘুমে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয় এটা তিনি কখনোই মনেপ্রাণে চাইতেন না। তাই সবদিক ভেবেই দরজায় তালা দিয়ে পরম নিশ্চিন্তে নিদ্রা গিয়েছিলেন।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল নিজের ঘরে ফিরে এলেন। হেনরির সঙ্গে তাঁর আলোচনায় বসা সত্যিই দরকার ছিল, কিন্তু কি আর করেন–পরে হবে বলে এখনকার মতো তুলে রাখলেন।

ঘরের খোলা জানলার কাছটিতে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বিছানায় এসে নিজেকে এলিয়ে দিলেন। বালিশের ওপর মাথা রেখে দুমিনিটের মধ্যেই শিশুর মতো তার চোখেও ঘুম নেমে এল।

বাথরুমের কেটলিতে জল ফুটছে তো ফুটেই চলেছে…দাসী সাইমনস বলে ওঠে, মিঃ গাজন, আর একটা কেটলিও অন্তিম যাত্রা নিল, খানসামা মুখের ভাষা আর জোগাতে না পেরে তার ধূসর মাথা নাড়ে।

সাইমনস-এর কাছে সে পুড়ে যাওয়া কেটলিটা নিয়ে আসে এবং আলমারি থেকে আর একটা নতুন টেনে বের করে। আলমারিতে তার জিম্মায় আধডজনের মতো কেটলি জমা ছিল। সে বলল, দেখে নিও, মিস সাইমন, গৃহকত্রীর কানে কিছুই পৌঁছবে না।

সাইমনস–তিনি কি আজ পর্যন্ত কখনো এসব ব্যাপারে দৃষ্টিপাত করেছেন?

গাজন দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে, গৃহকত্রীর দয়ার অন্ত নেই, কিন্তু দুর্ভাগ্য তার কিছুই মনে থাকে না।

এই গৃহে তার উদ্বেগ বা অসন্তোষ যাতে কোনোদিন মাথা চাড়া না দিয়ে উঠতে পারে সেজন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাই।

.

০২.

হেনরিয়েটা স্যাভারনে একটা কাদার তালকে চাপড়ে চ্যাপ্টা করে, লম্বা করে, চেপে চেপে প্রস্তুতকার্যে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে। মাটি দিয়ে একটা বালিকার মাথা তৈরি করছিল। অভ্যাস আছে বলে তার মূর্তি নির্মাণের কাজ দ্রুতই এগিয়ে যাচ্ছিল।

মনের সৌন্দর্য মূর্তির মধ্যে স্থাপন করতে সে সক্ষম হয়েছিল। কাজের খুঁটিনাটি সব দিক, বিভিন্ন রকমের ব্যবস্থাপনা, সেইসঙ্গে একাগ্রতা আর নৈপুণ্যের ছাপ স্পষ্ট। এই সবের গুণেই একজন শিল্পী গড়ে ওঠেন। শিল্পী হেনরিয়েটা স্যাভারনেক, যতদূর মনে হয়, শিল্পীর চেয়ে শিল্পের ক্ষমতাই বোধ হয় বেশি হয়, কারণ শিল্পই পারে শিল্পীকে আত্মস্থ করতে, তখন সে আর নিজের মধ্যে থাকে না, ভূতে পাওয়া মানুষের মতো যন্ত্রচালিত হয়ে সে মুখ বুজে কাজ করে যাচ্ছে। হেনরিয়েটাও ঠিক তেমনি এক মানুষ। সে যেমন কাজ করে যাচ্ছে এবং এর-ওর সঙ্গে কথাবার্তাও চালিয়ে যাচ্ছে। বোধ হয় নিজেকে সে এইভাবে তৈরি করেছে, অন্যের সঙ্গে মিশে মনটাও ভালো থাকে। কিন্তু কাজের জন্য যে ভাগটা পৃথক করে নিয়েছে সেটাই বড় ভাগ–অর্থাৎ মনের পাঁচ ভাগের মধ্যে চার ভাগ তো বটে, বাকি এক ভাগ পড়ে থাকে বাইরের ভাগ চালানোর জন্য।

স্টুডিওতে বন্ধুবান্ধব বা অন্য দর্শনার্থী যারাই এখানে আসুক-না-কেন হেনরিয়েটা কাউকেই নিরাশ করে না। সকলকেই সে আদর করে বসায়, গল্পগুজব করে, চা-পান করায় অর্থাৎ আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রাখে না। সবকিছুর মধ্যে তার কাজ কিন্তু এগিয়ে চলেছে-কাজ সমানেই এগিয়ে চলেছে মনের সেই বড় অংশের সাহায্যে। ক্ষুদ্রতম এক-পঞ্চমাংশ গুণে কম নয়, বাইরের সব কাজ সে সুশৃঙ্খলভাবেই করে যাচ্ছে।

কারো বোঝার কোনো উপায় নেই–সকলেই খুশী হয় এবং প্রয়োজনের তাগিদেই যারা আসে, তারা নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে আবার ফিরে যায়।

বহুদিনের অভ্যাসের ফলে হেনরিয়েটার মধ্যে এমন এক শক্তি জন্মেছে যে, সে তাস খেলতে খেলতে অন্যের সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যেতেও অসুবিধা হয় না বা নির্ভুল রচনা বা কোনো তর্জমা তৈরি করতে পারে, এমন কি কাউকে কোনো বিশেষ নির্দেশ বা উপদেশও দিয়ে যেতে পারে। এই মন-বিভাজন করে বিভিন্ন কাজ একই সঙ্গে করে যাওয়া কম-শক্তি বা দক্ষতার একমাত্র পরিচয় নয়।

কিন্তু আজ যে কী হয়েছে হেনরিয়েটার, তার আরব্ধ কাজ কিছুতেই সম্পূর্ণ হচ্ছে না। মাটি দিয়ে যে বালিকার মাথা তৈরির কাজে সে নেমেছিল তা কিছুতেই তার মনোমতো হচ্ছে না। চোয়াল ঠিক হয় তো ঠোঁট ঠিক হয় না, মুখের আদলের সঙ্গে চোখের গরমিল থেকেই যাচ্ছে ইত্যাদি, ইত্যাদি। মাটির পুতুলের সঙ্গে তার মনের ছবি মিলছে না–এই ব্যাধিই তাকে আজ বড় বিব্রত করছে।

সময় কেটে যায়…পরবর্তী আধঘণ্টায় তার কাজ আরও দ্রুত এগিয়ে চলে, কপালে চুলে কাদার দাগ লাগে, অর্ধেক হাত আরও গতিশীল হয়ে পড়ে, চোখের পর্দায় ভেসে ওঠে অন্ধ অভিব্যক্তির ভীষণতা…হচ্ছে, হবে, সে করতে পারবে…

এখনও যদি হেনরিয়েটা মাটির পুতুলের মাথা ঠিকমতো বানিয়ে উঠতে না পারে তবে সে ক্ষেপে আগুন হবে–গত দশদিন ধরে সে চেষ্টা করে যাচ্ছে, ধৈর্য বলেও তো একটা জিনিষ আছে!

নসিকা–পুতুলের নাম রাখা হয়েছে নসিকা–কিন্তু শিল্পীর মনকে নসিকা কিছুতেই সন্তুষ্ট করতে পারছে না। সদাই নসিকার সঙ্গে থাকে, নসিকার সঙ্গে প্রাতঃরাশ শেষ করে, নসিকার সঙ্গে ভ্রমণে গিয়েও তাকে তার নাগালের মধ্যে আনতে পারছে না শিল্পী হেনরিয়েটা। অন্য কিছুতেই তার মন আজ উতলা হচ্ছে, সে চাইছে সুন্দর মুখে দৃষ্টিহীন চোখের চাউনি–যেটা হেনরিয়েটার মানস চক্ষে সর্বদা ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু যেটা দেখছে তা কিছুতেই মূর্তির মধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। সে কম মডেল দেখেনি, গ্রীক মডেল দেখে চক্ষু সার্থক করেছে, ইতস্তত করেও মনকে শান্ত করতে পারেনি, পছন্দ হয়নি, অতৃপ্ত মন নিয়েই সে…

এখন তার দরকার একটি মডেলের। প্রথম ধাপ এগোতে পারলেই আশা করা যায় বাকি কাজটাও সে নিজেই উদ্ধার করতে পারবে–তার মনে যে ছবিটা ঘুরপাক খেয়ে চলেছে তাকে একবার এনে স্থাপন করলেই হবে–কিন্তু প্রাথমিক একটা আধার দরকার। এইজন্য সে বহুদূর হেঁটে গেছে, বহু মেয়ে, স্ত্রীলোক, বালিকাও চোখে পড়েছে–দেখে দেখে চোখে ক্লান্তি নেমে এসেছে–হেঁটে হেঁটে শরীর অবসন্ন হয়ে পড়েছে, তবু মনের সাধ মেটেনি, মনের ছবির মিল খুঁজে পায়নি।

পথ চলতে চলতে হেনরিয়েটার মনে হল, তার নিজের চোখেই বোধহয় দৃষ্টিহীনতা আশ্রয় নিয়েছে, চারিদিকে চোখ বুলিয়েও কিছুই তার নজরে আসছে না…

..এই সময় নিজেকে বড় ক্লান্ত, পীড়িত আর অসহায় মনে হল…

হঠাৎ করে বাসের মধ্যে যেন তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে এল। রক্তমাংসের চোখে সে দেখতে পেল তারই সামনে বসে আছে তার নসিকা, অন্যমনস্ক ভাবেই সে বাসে উঠে পড়েছিল পা রেখেছিল–কোথায় যাবে তাও সে জানত না…এবারে স্পষ্ট তার নজরে এল…শিশুসুলভ ছোট একটি মুখ, আধ-খোলা ঠোঁট এবং চোখ–সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন, অন্ধ, ঠিক যেমনটি হেনরিয়েটার বাসনা ছিল।

ঘন্টা বাজিয়ে বালিকা নেমে গেল, হেনরিয়েটা তাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে চলল। হেনরিয়েটা এখন ধীর-শান্ত–এতদিনের দৌড়ঝাঁপ শেষ হয়েছে। প্রার্থিত জিনিষ আজ মিলে গেছে। বালিকাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, মনে কিছু কোরো না। তোমাকে একটা কথা বলতে চাইছি। ভাস্কর্য আমার পেশা, তোমার মাথাটা আমি আমার মডেল হিসেবে ব্যবহার করতে বড় উদগ্রীব।

বালিকার ব্যবহার বড়ই মধুর এবং গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু হেনরিয়েটার কথা শোনা মাত্র সে ভীত-শঙ্কিত হয়ে পড়ল। শিল্পীর কথায় আপনা থেকে গর্ব আর সন্দেহ এসে ঠাই করে নিল। আমতা-আমতা করে দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলে উঠল, দেখুন আপনার যদি সত্যি কোনো মডেল প্রয়োজন হয়ে থাকে, এ ব্যাপারে আমার কোনো আপত্তি থাকার কথা উঠছে না…কিন্তু…আমি কোনোদিন এমন কাজ করিনি…।

ডোরিস স্যান্ডার্স একটু ইতস্তত করায় হেনরিয়েটা তাকে বলল, আমি কিন্তু তোমাকে, তোমার উপযুক্ত পারিশ্রমিক গ্রহণে পীড়াপীড়ি করবো।

নসিকা মঞ্চের ওপর বসে নিজের সৌন্দর্যের অহংকারে বিভোর হয়ে নিজের মনে ভাবছে যে, তার রূপ তাহলে অমর হয়ে গেল। স্টুডিওতে কিন্তু বিন্দুমাত্র ভালো লাগেনি। তবু হেনরিয়েটার কাজকর্ম দেখে তার একটা কথাই মনে হল যে, একজন শিল্পী মনপ্রাণ ঢেলে তার রূপের সুষমা আহরণ করছে একটা মাটির পুতুলকে রূপ দেবার জন্য এর চেয়ে গর্বের বিষয় আর কি হতে পারে!

প্রকারান্তরে এটাই তো অমরত্ব লাভ।

টেবিলের ওপর মডেলের ঠিক পাশটিতে ডোরিস স্যান্ডার্স-এর চশমা জোড়া পড়ে আছে। চশমা ছাড়া সে এক-পাও চলতে পারে না, তাই সে যতটা সম্ভব কম ব্যবহার করে। হয়তো এটাও তার একটা ফ্যাশন। অনেক সময় সে চেষ্টা করে দেখেছে–চশমা ছাড়া পথ চলতে পারে কিনা–কিন্তু চশমা ছাড়া সে একগজ দূরে থেকেও কিছু ঠাওর করতে পারে না। একথা সে নিজের মুখেই হেনরিয়েটার কাছে স্বীকার করেছে। হেনরিয়েটার এখন বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না ডোরিস স্যান্ডার্স-এর চোখের চাহনির মাধুর্যের পেছনে লুকিয়ে আছে তার দৈহিক অপটুতা।

সময় এগিয়ে চলে, হেনরিয়েটা তার যন্ত্রপাতি রেখে দিয়ে হঠাৎ বাহু ছড়িয়ে উঠে পড়ল এবং এও বলল, ঠিক আছে, আমার কাজ হয়ে গেছে। আশা রাখি, তোমাকে খুব বেশি ক্লান্ত করিনি, নয় কি?

-না, না, মোটেই না। ধন্যবাদ মিঃ স্যাভারনেক, আমার তো বেশ ভালোই লাগলো। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কী করে সমাপ্ত করে ফেললেন? সত্যি কি আপনার কাজ শেষ হয়েছে?

হেনরিয়েটা শুধু হাসে। হাসিমাখা মুখেই বলে, না কাজ এখনও সম্পূর্ণ হয়নি, আমাকে আরও পরিশ্রম করতে হবে। তবে তোমাকে নিয়ে যতটা কাজ ছিল তা হয়ে গেছে। আমি যা চেয়েছিলাম তা পেয়ে গেছি–তবে আসল কাঠামো বানানো হয়ে গেছে।

বালিকা মঞ্চ থেকে নেমে এল, তার চশমা চোখে পরে নিল। চশমা মুখে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে চোখমুখের সরল সৌন্দর্য মুহূর্তের মধ্যে উবে গেল এবং তার স্থানে এসে বিরাজমান হল সহজ সস্তা এক সুষমা।

ডোরিস স্যান্ডার্স মাটির মডেলের দিকে চোখ পড়তে হতাশ কণ্ঠে বলে ওঠে, ওঃ! এটা ঠিক আমার মতো হয়নি তো, তাই না?

হেনরিয়েটা হেসে ফেলে,-ওঃ, এটা তো ঠিক ছবি নয়!

সত্যিই মিল চোখে না পড়াটাই স্বাভাবিক। হেনরিয়েটার কাল্পনিক নসিকার মুখশ্রী সৃষ্টি করতে প্রাথমিক কাজ হিসেবে যে জিনিষগুলো প্রয়োজন ছিল, শুধু আবশ্যিক জিনিষগুলোই সে ডোরিস স্যান্ডার্স-এর কাছ থেকে গ্রহণ করছে। এগুলো হল-চোখের বিন্যাস এবং চোয়ালের হাড়ের সঠিক অবস্থান। মাটির যে পুতুলটা তৈরি হচ্ছে–সেটা মোটেই ভোরিস স্যান্ডার্স নয়, –একটি অন্ধ বালিকা–যার সম্বন্ধে একটা কবিতা রচনা করা যেতে পারে।

ডোরিসের মতো এর ঠোঁট দুটোও ফাঁক করা–কিন্তু কথা বলার সময় অন্য ভাষার আশ্রয় নেবে এবং যে ভাবনা তারা ব্যক্ত করবে তাও ভোরিসের ভাবনা হবে না

মুখাবয়বের বৈশিষ্ট্যগুলোর কোনোটাই স্পষ্ট নয়, এই নসিকাকে কল্পনা করা যায় কিন্তু তাকে দেখা যায় না, সন্দেহের বশেই মিস স্যান্ডার্স বলে ওঠে, মডেলের আরও কিছু কাজ হলে হয়তো বেশ ভালোই দেখাবে…আমাকে আর কোনো প্রয়োজন লাগবে না তো?

হেনরিয়েটা সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, না ধন্যবাদ। সত্যিই তুমি চমৎকার। আমি তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ।

ডোরিসের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে হেনরিয়েটা কালো কফি বানানোর জন্য পা পাড়াল। সে সত্যিই খুব ক্লান্ত-ক্লান্তির মধ্যে তার মনে আজ খুশির ঢেউ–তৃপ্তি ও শান্তির আনন্দ, তাই প্রাপ্তির সুখও আলাদা।

হেনরিয়েটা আপন মনেই কথা বলতে থাকে, আমি আবার রক্তমাংসের মানুষ হয়ে উঠব। তার চিন্তা এবার স্থান পরিবর্তন করে জনকে আশ্রয় করল। মনের কথা মনে হতেই তার গণ্ডদেশে এক দ্যুতি খেলে গেল। হৃদয়ের আস্ফালন তার সাহসিকতাকে আকাশচুম্বী করে তুলল। সে ভাবল, কাল আমি হলোতে যাচ্ছি–সেখানে গেলেই জনের দেখা পাব..

পেটে তিন-তিনবার গরম কফি পড়তেই হেনরিয়েটার মধ্যে অনেক শক্তি ফিরে এল। ডিভানের ওপর চিত হয়ে শুয়ে নিজের মেরুদণ্ডকে সোজা ও সতেজ করে নিল।

রক্তমাংসের মানুষ হওয়া বোধহয় সবদিক থেকেই ভালো। অকারণে উদ্বাস্তুর মতো পথে পথে ছায়া আর মায়ার পেছনে ছোটাছুটি করা মোটেই ভালো নয়। নিছক অপ্রাপ্তির দুঃখে দগ্ধ হওয়ার মতো অশান্তি বোধহয় আর কিছুতে নেই। আসলে না পাওয়ার বিড়ম্বনার চেয়ে প্রার্থিত বস্তু কি, তা সঠিক না জানাই সব চেয়ে বড় দুঃখ এবং এই দুঃখই মানুষকে আর স্বাভাবিক থাকতে দেয় না, সব কিছু ভুলে তাকে পাগল করে তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটায়। কঠোর পরিশ্রম কে না করতে পারে, পরিশ্রমের ভয়ে কেউ বা পিছু হাটে। কিন্তু পরিশ্রম করেও কি সব সময় ইঙ্গিত বস্তুর দর্শন মেলে?

হেনরিয়েটা কাপ খালি করে নসিকার নিকটে এসে দাঁড়াল। অপলক নয়নে তার দিকে তাকিয়ে রইল। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকাকালীন নিজের অজান্তে ভ্র-কুঁচকে সে বলে ওঠে, না ঠিক হয়নি; যেমনটি বাসনা ছিল, এখনও ঠিক যথাযথ হয়নি। তবে কি কিছু ভূল হল? দৃষ্টিহীন চোখ। এটাই তো চেয়েছিলাম। এর সুষমার কোনো বর্ণনাই করা যায় না। যে চোখের দৃষ্টিশক্তি আছে তা এত সুন্দর নয়, মধুরও নয়। দৃষ্টিহীন চোখ না হলে কী ভালো ছিল? কিন্তু অন্ধ চোখই তো পারে মানুষের হৃদয় বিদীর্ণ করতে, বিভিন্ন পন্থায় কথা বলাতে পারে, নানান ভাষায়! সে এটাই চেয়েছিল, এর জন্যই সে অধীর হয়ে পথে পথে ঘুরে ফিরেছে। এখন নাগালের মধ্যে পেয়েও মনে এত কুণ্ঠা, কেন এই অতৃপ্তি? না, অতৃপ্তি নয়। তার ভাগ্যে যা জুটেছে এটাই তার কাম্য ছিল, ভাগ্যদেবী প্রসন্ন থাকায় হয়তো পাওয়ার অতিরিক্তই সে পেয়েছে। এই অতিরিক্ত পাওয়ার কথা সে কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি। কাঠামোটা কিন্তু ভালোই হয়েছে, ভালো শুধু নয়, খুব ভালো…কাঠামোটা মোটামুটি ভালোই কিন্তু নির্দেশ কোথা থেকে এল? কে হেনরিয়েটাকে নসিকা গড়ার প্রেরণা জুগিয়েছে? না, কেউই না। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া হয় যে কানের কাছে কেউ গুনগুন করেছে; তবে সে নিঃসন্দেহে কোনো ঈর্ষাপ্রবণ প্রকৃতির লোক…কিন্তু হেনরিয়েটা তো কারো কথা শোনেনি, শুনে থাকলেও সেই মতো কাজও সে করেনি…কিন্তু হেনরিয়েটা কাজ না করলেও তার আঙুলগুলো হয়তো মাটির তালে তালে কাজ করে বেরিয়েছে… নিজের অজান্তেই আঙুলগুলো বোধহয় মডেল বানিয়ে ফেলেছে… কিন্তু সম্পূর্ণ এখনও হয়নি… হয়তো আর কোনোদিন হবে না, অসমাপ্তই থেকে যাবে…হেনরিয়েটার মন বলছে নসিকা গড়া তার বোধহয় কোনোদিন শেষ হবে না…ভাবল, এখন যদি না করি তবে আর কোনোদিন পেরে উঠব না, কাল দিনের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে হয়তো অন্য চিন্তা ঘিরে ধরবে…নসিকার ছবি মন থেকে হয়তো চিরতরে মুছে যাবে, নয়তো অন্যরূপে সামনে হাজির হবে… হেনরিয়েটা সময় নষ্ট না করে মাটি নিয়ে কাজে লেগে পড়ল-মাটির কাজ আর বেশি বাকিও নেই, তবে তাড়াহুড়ো করার কোনো প্রয়োজন নেই…হেনরিয়েটা স্টুডিওতে তার পায়চারি শুরু করে দিল…

হঠাৎ ‘পূজারিনী’ পুতুলটির কাছে এসে দাঁড়াল..এটা মনোমতো হয়েছে, কোনো খুঁত নেই…হ্যাঁ, এটা দেখলে মন ভরে যায়। মুখে লেগে আছে বিনীত আত্মনিবেদনের ভাব, ঘাড় এবং মাংসপেশীতে শক্তি, নুয়ে পড়া কাঁধ, ঈষৎ উপরের দিকে তোলা মুখ, বৈশিষ্ট্যহীন মুখশ্রী– সব মিলিয়ে সর্বগুণে গুণান্বিতা এই মডেল, এককথায় উপযুক্ত মডেল। চমৎকার হয়েছে। হেনরিয়েটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে, জনের মনে রাগ নামক ভীষণ বস্তুটি যদি না থাকত, সে যদি অন্যের মতো শান্ত খোশমেজাজী হতো!

নসিকার কাছে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে আসে হেনরিয়েটা। দু’চোখের অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি মেলে তাকে পর্যবেক্ষণ করে। না, কোথাও কিছু বাকি নেই–সবই ঠিকঠাক হয়ে গেছে। এইভাবে সোমবার কি মঙ্গলবার পর্যন্ত রেখে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই কারণ তার আগে যখন কিছু কাজ করা সম্ভব হবে না। ভিজে একটা কাপড় দিয়ে নসিকার সর্বাঙ্গ ঢেকে রাখল। ধৈর্য ধরে এগোতে হবে–তাই কিছুদিন বাদে। তার মধ্যে তিনটি মধুর দিনও এসে যাবে–এ তিনটে দিন সে কাটাতে চায় লুসি, হেনরি এবং মিডগের সান্নিধ্যে, আর সঙ্গে থাকবে জন।

শরীরের প্রত্যেক কটা মাংসপেশী সঙ্কুচিত আর প্রসারিত করে এক মোচড়ে শরীরটাকে টেনে টান টান করে উঠে দাঁড়াল। এতক্ষণে তার অনুভূতি হল, সে আজ সত্যিই বড্ড ক্লান্ত। গরম জলে যতটা তাড়াতাড়ি স্নানপর্ব সেরে শুতে গেল সে।

শয্যা থেকে স্কাইলাইটের মধ্যে দিয়ে সে নীলাকাশের দিকে তাকিয়ে রইল…সুদূর আকাশ জুড়ে কত-না অগুন্তি তারা…একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হল কতগুলো তারা বিশেষ পরিচিত, আর কয়েকটা শুধু নতুন আগন্তুক…হয়তো তারা-কাশে সবগুলোই তারা তার পরিচিত, বা সকলেই হয়তো অপরিচিতের দল…সকলেই হয়তো অনাহুত আগন্তুক অথবা সকলেই চিরটাকাল ধরে আকাশ জুড়ে তার পরিক্রমা অব্যাহত রেখেছে, মহাশূন্যে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত।

হেনরিয়েটা ঘুমোত চাইছে, কিন্তু ঘুম ধরা দিল না…মনের অর্গল বোধহয় ভোলা আছে, তাই চিন্তাগুলোও একে একে মুক্ত হয়ে চলে এসেছে, বাইরে থেকে আসছে গাড়ি চলার শব্দ, হর্ন, ভাঙা গলার বিদীর্ণ চিৎকার, উচ্চকণ্ঠে হাসি…এই মুহূর্তে গাড়ির শব্দটা শোনার পর তার মনে হতে লাগল বাঘ গর্জন করছে..হলদে কালো ডোরাকাটা বাঘ…রঙবাহারী পাতার মতো রঙের…আলোছায়া…ঘন জঙ্গল…নদীর তীর…গ্রীষ্মপ্রধান দেশের চওড়া নদী এসে মিশেছে নীল বিশাল সমুদ্রে…জাহাজে মাত্র দুটি প্রাণী…হেনরিয়েটা আর জন…দুজনেই ডেকের ওপর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে…নীল সমুদ্রের বুক চিরে জাহাজ এগিয়ে চলেছে কোনো এক অজানা দেশের সন্ধানে…জাহাজের ডাইনিং রুমে মুখোমুখি বসে জন ও হেনরিয়েটা ভোজন পর্ব শেষ করতে ব্যস্ত..হঠাৎ জন যেন রেগে ওঠে, ডাইনিং স্যালুনের নিচে নীল সমুদ্র, কিন্তু রাগ তাকে স্পর্শ করতে পারে না–শুধু হাসে…হেসে হেসে কোথায় কোন্ অনির্দিষ্টের পথে চলে যায় সে…জন ও হেনরিয়েটা এখন জাহাজের সুন্দর একটি সুস্থিত কক্ষে..দুজনেই আবার একই সঙ্গে লন্ডন শহরে…দু’জনে একটি ছোট্ট গাড়ির মধ্যে…পাশাপাশি…হেনরিয়েটার হাতে স্টিয়ারিং ধরা, জন তার পাশটিতে বসে…লন্ডন ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা দূরে তারা চলেছে গ্রাম্য পরিবেশের উদ্দেশ্যে..সুন্দর সুন্দর কত ঝর্ণা, পাহাড়ি নদী, লতাগুল্ম, গাছ, ফুল, ফলের বাগান…তারা যাচ্ছে কোথায়?…আবার…হলো…লুসি, হেনরি…জন…জন…জন…হেনরিয়েটার চোখে ঘুম নেমে এসেছে সুখের স্বপ্নে সে এখন বিভোর…তার অবচেতন মনে ঘুরে ফিরে একটি মাত্র ব্যক্তিত্ব ধরা দিচ্ছে–একজন পুরুষজন।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়–স্বপ্নও কোথাও বিলীন হয়ে যায়…অপরাধীর মুখে হেনরিয়েটা বাস্তব জগতে ফিরে আসে–কি যেন করা হয়নি, কোথায় যেন একটা অন্যায় করা হয়েছে, কি যেন করা উচিত ছিল, কিন্তু সে করেনি!

নসিকা?

অনিচ্ছা সত্ত্বেও হেনরিয়েটা বিছানা ত্যাগ করে, আললাগুলো জ্বেলে দেয়, নসিকার কাছটিতে এসে দাঁড়ায়, ঢাকা তুলে ফেলে–জোরে জোরে নিশ্বাস পড়তে থাকে।

নসিকা নয়–ডোরিস স্যান্ডার্স।

হেনরিয়েটা কোথায় যেন একটা অজানা ব্যথা অনুভব করে, নিজের মনকে নিজেই বোঝাবার চেষ্টা করে–আমি ভুলটা সংশোধন করে নিতে পারি, শুধরে নিতে পারি আমার করা ভুলটা। আপন মনেই বলে যেতে থাকে, মূর্খ তুমি কী জান তোমার কী করণীয়।

আগেই এখুনি সেরে ফেলতে হবে–কাল আর করার সাহস কুলোবে না। এটা যেন ঠিক নিজের রক্তমাংস ধ্বংস করার পথে। এতেই বড় আঘাত লাগে-হ্যাঁ, এটাই মনে বড় আঘাত হানে।

হেনরিয়েটার মনে হল, বেড়ালজাতটাও বোধহয় এমনটাই অনুভব করে। তাদের সদ্যোজাত কোনো ছানার মধ্যে যখন কোনো খুঁত নজরে আসে তখন তারা ছানাটিকে বাঁচিয়ে রাখে না এবং হত্যা করার ঠিক পূর্বে তাদের মনেও হয়তো যেন চিন্তাধারার উদয় হয়।

ঘন ঘন দ্রুতগতিতে নিশ্বাস পড়তে থাকে হেনরিয়েটার। মাটির মডেলটাকে সে ধরে দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে কাঠামো থেকে মাটি তুলে নিয়ে বড় মাপের একটা তাল মাটিতে পরিণত করে। কাদামাখা হাতের দিকে সে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, শারীরিক আর মানসিক দিক দিয়ে উত্তেজনা তার মনকে বড় নাড়া দিচ্ছে।

হেনরিয়েটা সঙ্গে সঙ্গে হাত ধুয়ে ফেলে। একটা অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা সঙ্গী করে সে শুতে চলল। বিষণ্ণ মনে সে ভাবতে থাকে, নসিকা এই পৃথিবীতে এসেছিল অল্প কিছুদিনের জন্য, কিন্তু রোগে তার অকালমৃত্যু ডেকে আনে। অদ্ভুত সব ভাবনা-চিন্তা, মানুষ টেরও পায় না, তার নিজের অজ্ঞাতে কখন জেগে ওঠে আবার বিলীন হয়ে যায়।

কারুর কথাই সে কানে ঢোকায়নি–তবু নিজের অজান্তেই ডোরিসের ঈর্ষান্বিত গুঞ্জন বা মন–এই দুটি বস্তু বোধহয় হেনরিয়েটার কানের মধ্যে দিয়ে বা মনের মধ্যে দিয়ে হেনরিয়েটার আঙুলগুলোকে প্রভাবিত করেছিল এবং তাই নসিকা–ডোরিস হয়ে উঠতে পেরেছিল।

স্বপ্নবিষ্টের মায়ায় বিভোর হয়ে হেনরিয়েটা ভাবতে থাকে, যাকে মারণ নামে সম্বোধন করা হয়, তবে কি এটা তাই?

যাকে আমরা ব্যক্তিত্ব বলে থাকি? তা কি কোনো ব্যক্তি বিশেষের চিন্তার গঠন। কার চিন্তার? ঈশ্বরের।

পিয়ার গিন্টের চিন্তাধারা কি একেই বলে? বোম প্রস্তুতকারীর হাতার মধ্যে ফিরে যাওয়া। আমি কোথায়? স্বয়ং আমি? সম্পূর্ণ মানুষটা? প্রকৃত মানুষটা? আমার তে ঈশ্বরের মার্কা কোথায়?

জন কি এভাবে অনুভব করেছিল? সেই রাতে সে এমনই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল–এইরূপ হতাশ হয়ে পড়েছিল। রিজওয়ের ব্যাধি–সেই বইগুলোর কোনোটাতেই উল্লেখ করেনি রিজওয়ে কে?

মুর্খ, সে ভেবে নিল, সে জানবে…রিজওয়ের ব্যাধি..জন।..

.

০৩.

ডাক্তার জন ক্রিস্টো তার রোগী দেখার ঘরে বসে সকালের সর্বশেষ রোগীর আগের রোগীটিকে দেখা শেষ করলো। তার চোখমুখ এখন সহানুভূতি ও উৎসাহব্যঞ্জনায় ভরপুর। রোগের খুঁটিনাটি জানার সময় সে বারেবারে মাথা নাড়ছিল এবং মাঝে মাঝে নির্দেশ প্রদানও করছিল।

প্রশ্নোত্তরের পর্ব সমাধা হতেই দেখা গেল, রোগীর মুখ খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ডাক্তার ক্রিস্টো সত্যিই বিস্ময়কর! রোগীর প্রতিভার প্রকৃত দরদ এবং যথার্থ নিরাময় করার উদ্দেশ্যে তার আন্তরিক প্রচেষ্টা অভূতপূর্ব। তার সঙ্গে কথা বলেও অনেক রোগীরা নিজেদের হালকা বোধ করে এবং উপকৃত হয় ও শরীরে পুনরায় শক্তিও পেয়ে যায়।

জন ক্রিস্টো একখানা কাগজ নিয়ে ব্যবস্থাপত্র লেখার কাজ শুরু করে দেয়। রেচক ওষুধের দরকার, সেই আমেরিকার সোফেন মোড়কে ফিকে গোলাপী রঙের চিত্তাকর্ষক ওষুধটাই ভালো ফল দেবে। সংগ্রহ করতে হলে ওয়ার্ডার স্ট্রিটের সেই ছোট্ট দোকানে গিয়ে উপস্থিত হতে হবে। কিন্তু মূল্য একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে, আর সব দোকানে তা মেলা ভার। আশা করা যায় দু’একমাস এতেই ভালো করে চলে যাবে এবং উপকারও ভালো হবে, পরে না হয় অন্য কিছু ভেবে ঠিক করা যাবে। এর চাইতে আর বেশি কিছু তার জন্য করা সম্ভবপরও নয়, শারীরিক গঠন খারাপ হওয়ার দরুন কিছু করাও যাবে না এবং দাঁত গজানোর জন্য কোনো উপযুক্ত ব্যবস্থা করা যাবে না। বুড়িমা ক্যাবট্রির মতো অসম্ভব অবস্থা নয়।…

একঘেয়ে সকাল, আর্থিক সুবিধা এখন উন্নতির দিকে–কিন্তু ঐ পর্যন্তই, আর কিছুই নয়। ডাক্তার ক্রিস্টো সত্যি বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। রুণ স্ত্রীলোক এবং তাদের নিত্য নতুন ব্যাধি; তাকে শরীর আর মন দুয়ের দিক থেকে অবসন্ন করে ফেলেছে।

কিছু কথা বলা বা উপশম, এছাড়া আর কিছু নয়। এমন অনেক সময় আসে যখন তার বড় অবাক লাগে, এইটুকুই কি যথেষ্ট। তখনই তার মনে পড়ে যায় ক্রিস্টোফার হাসপাতালের মার্গারেট রাসেল ওয়ার্ডের শয্যা শ্রেণী এবং মিসেস ক্যাবট্রির দন্তহীন মুখের বিগলিত হাসি।

ডাক্তার ক্রিস্টো এবং রোগিণী পরস্পর পরস্পরের কাছে পরিচিত। পাশের শয্যার থলথলে চেহারার খোসা ছাড়ানো স্ত্রীলোকটির পর্যায়ে তাকে ফেলা যায়। সে একজন যোদ্ধী। সে তার দিকেই ছিল, বাঁচার জন্য সে অধীর ছিল–একমাত্র ঈশ্বরের পক্ষে জানা সম্ভব কেন তার মধ্যে বাঁচার প্রবণতা ছিল। আমরা অবশ্য তার জঘন্য বেঁচে থাকার দুর্দশা দেখেই একথা জানতে বাধ্য হচ্ছি। সে এক নোংরা বস্তিতে বাস করত, মাতাল স্বামী আর এক দঙ্গল অবাধ্য সন্তান নিয়েই ছিল তার সংসার। দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করতে সে বাধ্য থাকত। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অসংখ্য গৃহস্থ বাড়িতে, অনেক খেটে খেটে বেড়ায় অফিস বাড়িতে, বিরতিহীন হাড়ভাঙা কঠোর পরিশ্রম,অমানুষিক কষ্ট, আনন্দ লেশহীন জীবনই সে বেছে নিয়েছিল তবু সে বাঁচতে চায়, প্রাণভরে জীবন উপভোগ করতে চায়, জন ক্রিস্টো যেমন ভাবে জীবন উপভোগ করছে। জীবনের অবস্থা কিন্তু তারা উপভোগ করতে চায় না, শুধু জীবনটাই উপভোগ করে ক্ষান্ত হয়

বেঁচে থাকার প্রয়োজনে শুধু রঙ্গকৌতুক, অস্তিত্ব বজায় রাখার প্রচেষ্টা। অত্যন্ত অদ্ভুত ব্যাপার–তার যথাযথ ব্যাখ্যা বোধ হয় কারো পক্ষেই করা সম্ভব নয়। মনে মনে ক্রিস্টো ভাবে, হেনরিয়েটার সঙ্গে সে এ বিষয়ে কথা বলতে চায়।

ডাক্তার রোগিণীকে দরজা পর্যন্ত ছেড়ে আসার জন্য উঠে পড়ল। উষ্ণ সহৃদয়তার সঙ্গে তার হাত তুলে নিল নিজের হাতের মধ্যে, বন্ধুর মতো উৎসাহ দিতে দিতে এগিয়ে চলল। তার কণ্ঠস্বর থেকে বর্ষিত হচ্ছিল সহানুভূতি এবং উৎসাহ। রোগিণী যেন তার ব্যাধির যন্ত্রণা ভুলে গেছে। তাকে দেখে অতিশয় সুখী ও সন্তুষ্ট মনে হচ্ছিল। ডাক্তার ক্রিস্টো এমনই একজন যত্নপরায়ণ চিকিৎসক।

দরজা বন্ধ হবার যতক্ষণ দেরি, দরজা বন্ধ হওয়া মাত্র ক্রিস্টোর মন থেকে তার অস্তিত্ব লুপ্ত হয়ে যায়। দরজার আড়ালে উপস্থিত থাকলেও ক্রিস্টো তার অস্তিত্ব টের পায় না। মুখ বুজে সে তার কর্তব্য করে যায়। সবই যেন গতানুগতিক। তার মনোজগতে এ বিষয়ে যদিও কোনো আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে না, তবু তার শক্তি ক্ষয়ের পথেই এগিয়ে যাচ্ছে।

আরোগ্যকারীর স্বতঃস্ফূর্ত ডাকে সে সাড়া না দিয়ে পারে না। আবার নিঃশেষিত শক্তিও অনুভব করে। সে মনে মনে এও অনুভব করে যে, সে বড় ক্লান্ত।

আর একটি মাত্র রোগী দেখা শেষ হলেই সপ্তাহান্তের স্থান পরিষ্কার হয়ে যায়। কৃতজ্ঞ চিত্তে তার মনে এই চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছিল। লাল এবং কটা রঙ মেশানো সোনালি পাতা, শরতের নরম সিক্ত গন্ধ-বনের মধ্যে দিয়ে রাস্তাদাবানল–সবকিছু মিলিয়ে অপূর্ব সুন্দর ছুটির আমেজ গৃহকত্রী লুসির কথা মনে পড়তেই এক অজানা খুশীর হিল্লোল তার সারা মনে প্রবাহিত হয়ে যায়। অতিথিপরায়ণা এবং অকপট মনের এমন স্ত্রীলোকের সন্ধান সংখ্যায় খুব কমই। মেলে। অনেক সময় তিনি এমন ইন্দ্রজাল রচনা করেন যে, তাকে আলেয়া বলে ভ্রম হওয়া খুবই স্বাভাবিক। হেনরি এবং লুসির মতো লোকের আতিথ্য গ্রহণ বোধহয় খুব কম জনের ভাগ্যেই জোটে, অর্থাৎ এরকম আতিথেয়তা পাওয়া সবচেয়ে সৌভাগ্যের বিষয়। ইংলন্ডে তারা ছাড়া আর অন্য কারো আতিথ্য গ্রহণে মনের দিক থেকে সাড়া পায় না ক্রিস্টো। তাছাড়া হলোর মতো সুদৃশ্য বাড়িও তার নজরে আসে না। রবিবারে সে বনের মধ্যে প্রমোদভ্রমণে সঙ্গী হিসেবে হেনরিয়েটাকে কাছে পাবে-কখনো পাহাড়ের চূড়ায়, কখনো পর্বতের সানুদেশে স্বচ্ছন্দে বিচরণের সুযোগ তারা পেয়ে যাবে।

হেনরিয়েটার সঙ্গে বেড়াবার কথা তার ভুলেও স্মরণে আসবে না, জগত জুড়ে এত ব্যাধি এত যন্ত্রণা! ডাঃ ক্রিস্টো মনে মনে ভাবে, হেনরিয়েটার সাহচর্যে বোধহয় সব কদর্যতা দূরীভূত হয়ে যায়। সে যেন তাকে ঘাড়ে নতুন কোনো দুঃখের বোঝা চাপাতে চায় না। তার মোহময়ী আবেষ্টনী সে যে কোন মহিমায় সৃষ্টি করে। ভাবতেও সত্যি অবাক লাগে।

তার একজন মাত্র রুগী দেখা বাকি। কিছুক্ষণ পরেই সে টেবিলের ঘণ্টা বাজাবে। যদিও তার অনেক দেরি হয়ে গেছে। উপরে খাবারের ঘরে লাঞ্চ প্রস্তুত হয়ে পড়ে আছে, জার্দা এবং তার সন্তানেরা তার জন্যই পথ চেয়ে বসে আছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে হাজির হতে হবে।

তবু সে একইভাবে বসে আছে। নড়েচড়ে বসার শক্তি সে হারিয়েছে, আজ সে ক্লান্ত, খুব ক্লান্ত।

কিছুদিন ধরেই তাকে এক ক্লান্তি ঘিরে ধরেছে। যার ফলস্বরূপ তার মেজাজটাও দিন দিন রুক্ষ হয়ে উঠেছে। অত্যাধিক পরিশ্রম বা মনের অশান্তি বা অবসাদ এর কারণ হলেও হতে পারে। বেচারী জার্দা, সে তো তার সঙ্গে মানিয়ে নেবার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। তার স্বভাব যদি বিনীত নষস্বভাবের না হতো এবং নিজের দোষ স্বীকার করে না নিত তবে হয়তো একটা কারণ মিলে যেত। এমন একটা সময় ছিল, যখন জার্দা যা কিছু বলতো ক্রিস্টো তাতেই অগ্নিশর্মা হয়ে উঠতো, এবং সে মনে করতো যে, জার্দা যুক্তি করেই তাকে ক্ষেপানোর জন্য এরকম কথা বলছে, তার কথা বলার ধরনই ঐরকম, লোককে ক্ষেপিয়ে তোলা। তার ধৈর্যশক্তি, তার স্বার্থের ব্যাপারে উদাসীন ভাব, তার নিজের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ–ক্রিস্টোর রাগের মাত্রাকে আরও দ্বিগুণ করে ফেলত। জার্দা কখনো প্রতিবাদ করেনি, নিজের জেদ ধরে সে বসে থাকতো তা নয় কিন্তু নিজের কথার ধরনধারণ বিন্দুমাত্র পরিবর্তন করত না।

কিন্তু অদ্ভুত লাগে তখনই যখন দেখা যায় যে, জার্দার যে গুণগুলো ক্রিস্টোকে ক্ষেপিয়ে তুলত, সেই গুণগুলো সে হেনরিয়েটার মধ্যে পেতে চায়, যে জিনিষে ক্রিস্টোর রোগ হয় তা হলো হেনরিয়েটার একপ্রসঙ্গ থেকে অন্যপ্রসঙ্গে যাওয়ার সাধুতা।

একদিন ক্রিস্টো তাকে কথাচ্ছলে বলেছিল, আমার মনে হয়, সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদী তুমি। হেনরিয়েটা বলেছিলেন, বোধহয় তাই হবে।

ক্রিস্টো–তুমি সদাই লোকের মন বুঝে কথা বল।

হেনরিয়েটা–সেটাই আমার ইচ্ছে বেশি প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়।

ক্রিস্টো–সত্য বলার থেকেও কী প্রয়োজনীয়?

হেনরিয়েটা-প্রয়োজনটা সত্যই একটু বেশি।

ক্রিস্টো–তাহলে তুমি ঈশ্বরের নামে শপথ করে আমার কাছে মিথ্যে বুলি আওড়াও না কেন?

হেনরিয়েটা–তুমি আমাকে এমনটি করতে বল?

ক্রিস্টো-হা।

হেনরিয়েটা–সত্যি আমি অনুতপ্ত, জন, আমি পারি না।

ক্রিস্টো-তোমার অনেক সময় জানা উচিত, আমি কি বলতে চাই। না, হেনরিয়েটার কথা আর নয়। সে আজ বিকেলের দিকে হেনরিয়েটার সঙ্গে দেখা করতে যাবে। এখানকার যা কাজ আছে তা তাড়াতাড়ি সমাপ্ত করে নিতে হবে। দশভাগের এক ভাগ আসল রোগ, অবশিষ্টটা বিষাদ ব্যাধি বা চিত্তোন্মাদনা–একপ্রকার স্নায়বিক রোগ। নড়াচড়ার নামগন্ধও নেই, চুপচাপ স্থবিরের মতো বসে রইল, রোগী দেখার বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টাও সে করল না। ডাক্তার জন ক্রিস্টো ক্লান্ত অত্যন্ত ক্লান্ত। তার মনে হল সে বহুদিন ধরেই ক্লান্ত। কোনো একটা জিনিসের অভাব ঘটেছে তার শরীরে, খুব অভাব। হঠাৎ সে মনের তাগিদ অনুভব করল, তার বাড়ি যাওয়ার বাসনা জেগেছে।

তার খুব অবাক লাগল, কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল এই চিন্তা? এর অর্থই বা কি? বাড়ি? কোনো দিন তার বাড়ি ছিল না। তার মা-বাবা ছিলেন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, সে বড় হয়েছে কখনো মাসির স্নেহে কখনো কাকার কাছে–একটা ছুটি সে একজনের কাছেই কাটাত। হার্লি স্ট্রিটের বাড়িটা বোধহয় তার জীবনের প্রথম স্থায়ী গৃহকোণ। কিন্তু এই গৃহকোণকে সে কোনোদিন বাড়ি বলে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পেরেছে কি? সে মাথা নাড়ে। না, কোনো দিন ভাবতেও পারেনি। তবে? এই চিন্তা তার মনে উদয় হলো কী করে? কেনই বা হল? কোথা থেকে এল? চিকিৎসকের উৎসুক মনে এই চিন্তা বার বার ঘুরপাক খেতে লাগল

‘আমি বাড়ি যেতে চাই।

কারণ খুঁজলে কিছু একটার সন্ধান নিশ্চয়ই মিলবে–কোনো প্রচ্ছদপট অবশ্যই থাকবে।

খুব স্পষ্ট, সে তার মানস চক্ষে দেখতে পেল অগভীর নীল ভূমধ্যসাগর, সারিবদ্ধ পাম গাছ, কন্টকময় নাশপাতি আর ক্যাক্টাসের সমারোহ। কল্পনার জগৎ থেকে তার নাকে আসছে গ্রীষ্মের গন্ধ এবং সমুদ্রসৈকতে সূর্যের চড়া রোদে শুয়ে শুয়েই অনুভব করছে জলের শীতলতা। সল মিগুয়েল।

হঠাৎ যেন চমকে ওঠে–একটু যেন বিব্রতও বোধ করে। অনেক বছর হয়ে গেল সল মিগুয়েলের কথা তার স্মরণে আসেনি। সে আর সেখানে ফিরে যেতে চায় না। সেখানকার সবকিছুই এখন তার জীবনের অতীত অধ্যায়।

সে আজ বারো-চোদ্দ কী বছর পনেরো আগের কথা। সে ঠিক কাজই করেছে। তার কাছে তার বিচার অভ্রান্ত! সে ভেরোনিকার প্রেমে পাগল হয়ে উঠেছিল। ভেরোনিকা তার দেহমন জুড়ে বসেছিল। নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু ভাবতে পারত না এবং তা সে লুকোনোর চেষ্টাও করতো না। ভেরোনিকা একবার যা চাইত তা সে জোর করে হলেও আদায় করে নিত। কেবল জনকেই সে জোর করে নিজের করতে পারেনি। কোনো ভাবে সে মুক্তি পেয়ে গেছে। তার মনে হচ্ছে সে তার সাথে ভালো ব্যবহার করেনি। সোজা কথায় প্রেমের ব্যাপারে সে তার কাছে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু সত্যি কথা, সে নিজের মতো করে বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু ভেরোনিকা সে ব্যাপারে রাজী ছিল না। ভেরোনিকা নিজের মতো করে তার জীবন কাটাতে চেয়েছিল এবং তার জীবনে জনের স্থান ছিল অতিরিক্তের তালিকায়। সে যখন জনকে তার সঙ্গে হলিউডে যাবার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল, জন তার প্রস্তাবে রাজী না হওয়ায় সে অবাক হয়েছিল। ক্ষুণ্ণ মনেই সে বলেছিল, তুমি যদি সত্যিকারের একজন ডাক্তার হতে চাও, তুমি আমেরিকা থেকেও এই ডিগ্রি পেতে পার, তবে তার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু প্রয়োজন তোমার কাছে আছে তাই যথেষ্ট এবং আমিও প্রচুর উপার্জন করব।

জন খুব দৃঢ়তার সঙ্গে বলে উঠেছিল, আমি যে পেশার সঙ্গে যুক্ত আছি সেই পেশার বিষয়ে আমি যথেষ্ট উৎসাহী এবং মনোযোগী। র‍্যাড়লের সঙ্গে কাজ করার জন্যই আমি যাচ্ছি।

তার কণ্ঠস্বর-উৎসাহী-উগ্রীব তরুণের কণ্ঠস্বর–অত্যন্ত দৃঢ়চেতা, গুরুগম্ভীর এবং নির্ভীক। ভেরোনিকার কণ্ঠ দিয়ে নিশ্বাস টানার শব্দ বেরিয়ে আসে। বলে, সেই নস্য-টানা বুড়োটা? জন ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে ওঠে, সেই নস্য-টানা বুড়ো লোকটা প্র্যাটু তার রোগ নিয়েই তার মূল্যবান গবেষণা করছে।

বাধা প্রদান করে সে বলে ওঠে, পাটের রোগ নিয়ে কারা এত মাথা ঘামাচ্ছে– ক্যালিফোর্নিয়ার জলহাওয়া কি সত্যি চমৎকার! জগৎটাকে দেখা কি কৌতুকের। এই জন্যই তোমাকে আমার প্রয়োজন জন!

প্রত্যুত্তরে জন বলেছিল, ভেরোনিকা, তুমি হলিউডের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আমাকে বিবাহ কর এবং চল, আমরা বরং লন্ডনে গিয়ে বসবাস করি। জনের এই প্রস্তাব শুনে ভেরোনিকা মনে মনে হেসেছিল তাই বলেছিল যে, হলিউডে যাবেই এবং জন যখন তাকে মন দিয়ে বসে আছে, বিবাহ তাদের কোনো কারণেই আটকাবে না। নিজের রূপ এবং শক্তি সম্বন্ধে তার খুব অহংকার ছিল।

জনের কাছে তখন একটা রাস্তা খোলা ছিল, বাগদান সে ভেঙে দিল।

সে যথেষ্ট ভুগেছে কিন্তু সে, যে কাজ করেছে তাতে তার গভীর জ্ঞানের পরিচয়ই মেলে। সে আবার লন্ডনে ফিরে এল এবং র‍্যাড়লের সঙ্গে কাজও শুরু করে দিল। একবছর বাদে জাদার সঙ্গে তার বিবাহ ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়ে গেল। সব দিক থেকে বিচার করলে জার্দা ভেরোনিকার থেকে একেবারে পৃথক ছিল…

দরজা খুলে গেল এবং সেক্রেটারি বেরিল ভেতরে প্রবেশ করল।

মিসেস ফরেস্টারের সঙ্গে সাক্ষাৎ আপনার এখনও বাকি।

সংক্ষেপে ছোট্ট উত্তর দিল সে, আমি জানি।

সেক্রেটারি বলে উঠল, আমি ভাবলাম, আপনার হয়তো মনে নেই।

ঘর থেকে সে বেরিয়ে গেল। ক্রিস্টোর দৃষ্টিও নিঃশব্দে নিষ্ক্রমণ অনুসরণ করলো। বেরিল একটা সাধারণ মেয়ে, কিন্তু খুবই কর্মঠ। ছ’বছর ধরে সে এখানে কাজ করে যাচ্ছে, এর মধ্যে এমন একটা দিনও যায়নি যেখানে একটা ভুলও হয়েছে। চঞ্চলতা, উদ্বেগ, বা ব্যস্ততা এর কোনোটাই তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তার কালো কেশ, মেটে মেটে রঙ এবং দৃঢ়চেতা চিবুক।

যথেষ্ট শক্তিসম্পন্ন চশমার সাহায্যে সে তাকে এবং পুরো জগৎটাকে সমান নিরাসক্ত ভাবে দেখতে পায়।

সে খুব সাধারণ, সৎ স্বভাবের সেক্রেটারি চেয়েছিল এবং সে তার বরাত জোরে পেয়েও গেছে। কিন্তু জন ক্রিস্টো মাঝে মাঝে অকারণেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। মঞ্চ এবং কাহিনীর সব নিয়মে বেরি তার মা প্রভুর কাছে নিরাশ মন নিয়েই অনুগতশীল, কিন্তু সে জানে যে সে বেরিলকে কখনোই মূল্যহীন ভাবে না। কোনো ভক্তি বা আত্মোৎসর্গ নয়–বেরিল তাকে নিশ্চয়ই ভ্রমণশীল এক মানুষ রূপেই গণ্য করে। সে তার ব্যক্তিত্বে অভিভূত বা মাধুর্যে বিগলিত হবার পাত্র নয়। অনেক সময় তার মনে এই সন্দেহ দানা বাঁধে যে, বেরিল হয়তো তাকে পছন্দ করে না।

জন একদিন নিজের কানে বেরিলকে তার বন্ধুকে টেলিফোনে বলতে শুনেছে, না, আমি এটা ভাবি না যে, তিনি আগের থেকেও আরও বেশি স্বার্থপর হয়ে উঠেছেন বরং চিন্তারহিত ও অবিবেচক হিসেবেই তিনি জ্ঞাত।

জন ক্রিস্টোর বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি যে, বেরিল ও তার বন্ধুর আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু সে নিজে এবং এই কথা শোনা মাত্র পুরো চব্বিশ ঘন্টা সে ক্রুদ্ধ ছিল।

জার্দার অসংলগ্ন ভঙ্গীপনা যেমন জনকে স্বাভাবিক থাকতে দেয় না, তেমনি বেরিলের হৃদয়হীন মূল্যায়নও তাকে সহজেই রাগিয়ে দেয়। বেরিলের ধারণা যে, প্রায় সব ব্যাপারেই জন ক্ষেপে যায়…

কোনো একটা গোলমাল নিশ্চয়ই আছে। অতিরিক্ত পরিশ্রম? হয়তো তাই। না, সেটা নেহাত ঐ অজুহাত মাত্র। অধৈর্য, কাজে বিরক্তি, হঠাৎ রেগে ওঠা–সবকিছুর মূলে একটা না-একটা নিশ্চয়ই থাকবে। সে ভাবে এভাবে চলতে পারে না, আমি এভাবে থাকতে পারি না! আমার কী হয়েছে? আমি যদি পালিয়ে যাই..

আবার সেই এক চিন্তা–অন্ধ আবেগ আর মুক্তির পথের সন্ধানে ঘুরে ফিরছে–পালিয়ে যাওয়ার কথা মাথায় আসছে!

আমি বাড়ি যেতে চাই…জাহান্নামে যা সব। ৪০৪, হার্লি স্ট্রিটের বাড়ি আমার!

ওয়েটিং রুমে চুপচাপ বসেছিলেন মিসেস ফরেস্টার। বিরক্তিকর স্ত্রীলোক। অত্যধিক অর্থের অধিকারিণী এবং নিজের ব্যাধি সম্বন্ধে চিন্তা করার অফুরন্ত সময় তার হাতে। কে যেন তাকে বলেছিল, ধনী রোগীরাই তোমাকে আরও ক্লান্ত করে তুলবে, আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে নিও। তারা সদাই চিন্তা করবে এবং এটাই দেখাতে চাইবে যে, তারা পীড়িত, কিন্তু গরীব লোকেরা তোমার কাছে তখনই হাজির হবে যখন তারা সত্যি-সত্যিই কোনো রোগের শিকার হবে। একমাত্র ধনী লোকেরাই বিনা কারণে ডাক্তারখানায় এসে ভিড় জমায়। বৃদ্ধ মিসেস পিয়ারস্টক পাঁচটি বিভিন্ন ক্লিনিকে প্রতিসপ্তাহে উপস্থিত হয় এবং পিঠের, বুকের, ঘাড়ের, সর্দি, কাশির, হজমের, মাথা ঠাণ্ডা রাখার, হাত-পা কন্ করার সবরকম ব্যাধির কথা ভেবে সব ওষুধ নিয়ে থাকে। সেবারে বয়সে তরুণ এক ডাক্তার তাকে সাদা রঙের ওষুধ দিয়েছিল, ভদ্রমহিলা ওষুধের রঙ দেখামাত্র বলে ওঠে, চোদ্দ বছর হয়ে গেল আমি বাদামী রঙের ওষুধ ব্যবহার করছি এবং তাতে একটু উপকারও হয়, কিন্তু এ সাদা ওষুধে আমার কোনো কাজ হবে না। আমাকে বাদামী রঙের ওষুধ দাও।

ওতেই…

অথচ ভদ্রমহিলার কোনো ব্যাধি নেই, শরীরস্বাস্থ্যও বেশ ভালো। কণ্ঠস্বর ঘন্টার মতো, সারা দেহে তার কোনো জ্বালা-যন্ত্রণা নেই, তবু মুখে একটাই বুলি লেগে আছে, রোগের জ্বালা আর সে সহ্য করতে পারছে না।

হটেনহ্যামের মিসেস পিয়ারস্টক এবং পার্ক লেন কোর্টের মিসেস ফরেস্টার একই প্রকৃতির স্ত্রীলোক। তারা যেন পরস্পর পরস্পরের সহোদরা। অর্থ আর সময়ের কোনো হিসেব তারা রাখে না, তাই তার সদ্ব্যবহারও বোধহয় একই পদ্ধতিতে করে থাকে…

জন ক্রিস্টোর সরল সাদাসিধে স্বভাবের এক সেক্রেটারি আছে এবং সে বিবাহও করেছে সহজসারল্যযুক্ত একটি মেয়েকে। এটাই বোধহয় তার মনোগত বাসনা ছিল।নয় কি? সে নিজের সৌন্দর্যের এক ডালি, অন্য লোকের ক্ষেত্রে হলে হয়তো অনেক কিছুই করতে পারতো! জীবনে চলার জন্য পৃথক পথই হয়তো বেছে নিত, কিন্তু সে তো তা করলো না। সে তো সোজা পথ ধরেই চলতে শুরু করেছিল এবং এখনও সে তার চলার পথে কোনো পরিবর্তন করেনি। মানুষ রূপের জোরে কি করতে পারে তা সে ভেরোনিকাকে না দেখলে হয়তো বুঝতে পারতো না। তাছাড়া, রূপবান পুরুষদের দর্শনও সে পেয়েছে তারা কি করতে চায় এবং করে থাকে। ভেরোনিকার কাছ থেকে সে জীবনের নিরাপত্তা পেতে চেয়েছিল, আর সেইসঙ্গে শান্তি ও নিশ্চিন্ত জীবন সুখেরও কামনা করেছিল। কিন্তু তার মনের বাসনা মনেই রয়ে গেছে–তা সে কোনোদিন পায়নি! জার্দাকে জীবনসঙ্গিনী রূপেই সে হয়তো চেয়েছিল। জাদার মধ্যে সে জীবনের শান্তি, সহনশীলতা আর জীবনের প্রতি তার আনুগত্য এইগুলোর সন্ধান পেয়ে গেছে! তবে কী জার্দার মধ্যে সে সব কিছু খুঁজে পেল? জার্দাই কী তার জীবনের সাদ মিটিয়েছে? জন কিন্তু এ কথার সঠিক উত্তর খুঁজে পায় না। মনে মনে সে বোধ হয় জার্দাকেই চেয়েছিল। কিন্তু তার মনে এত অস্থিরতা কেন?

কার মুখে জন শুনেছিল, মানুষ যা পাবার আশা করে; তা সে পেয়ে গেলেই জীবনে নেমে আসে ট্র্যাজেডি!

ক্রুদ্ধভাবে জন টেবিলের ঘন্টায় ঘা বসায়।

.

এখন সে মিসেস ফরেস্টারকে দেখবে। দর্শন পেতে মিনিট পনেরোর বেশি লাগল না। আরও একবার সহজেই হাতের মুঠোয় টাকা এসে গেল। এবার সে রোগিণীর কথা মন দিয়ে শুনলো, জিজ্ঞাসাবাদ করলো, সহানুভূতিও দেখাল, সাহস দেখাল, সব শেষে নিজেকে সারিয়ে তোলার শক্তিও একই সঙ্গে রোগিণীকে দান করল। পরিশেষে মূল্যবান একটা ওষুধের ব্যবস্থাপত্র শোনানোর পরেই তার কর্তব্য শেষ হল।

এতক্ষণ ধরে ঠায় বসে বসে যে রোগিণী নিজের ব্যাধির চিন্তায় আকুল হয়ে অবসন্ন মনে বসেছিল, এখন সে অন্য এক মানুষ, সদর্পে উৎসাহ-উদ্দীপনাকে সঙ্গে করে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল–তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন নতুন জীবনের স্বাদ পেয়েছে, চোখমুখ জুড়ে বিরাজ করছে নতুন এক রঙ।

জন ক্রিস্টো চেয়ারে গিয়ে আবার নিজেকে হেলিয়ে দিল। এখন তার অবকাশ, উপরে গিয়ে জার্দা এবং ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিলিত হবার কথা। সারা সপ্তাহ ধরে রোগ আর রোগীর যন্ত্রণা উপশমের প্রচেষ্টার অফুরন্ত বিশ্রাম।

কিন্তু কিছুতেই আর নড়েচড়ে বসতে মন চাইছে না। এই কি তার সদিচ্ছার অদ্ভুত অবসাদ?, মনের ক্লান্তি, সে অত্যন্ত ক্লান্ত, ক্লান্ত…।

.

০৪.

রোগী দেখার ঠিক উপরের ফ্ল্যাটে জার্দা ক্রিস্টো একদৃষ্টে অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে একটা ভেড়ার মাংসের টুকরোর দিকে।

কল্পনার জগতে থেকে সে আবার চিন্তার জাল বুনতে শুরু করে দিয়েছে, রান্নাঘরে গরম রাখার জন্য মাংসটাকে পাঠাবে কিনা তাই ভাবছে। জন যদি আসতে একটু দেরি করে তবে মাংস একদম ঠান্ডা হয়ে যাবে এবং ব্যাপারটা তখন বড়ই খারাপ দেখাবে। কিন্তু মাংসটা যদি রান্নাঘরে গরম করতে পাঠানো হয় এবং এই সময় যদি জন এসে উপস্থিত হয়ে যায় তাহলে ব্যাপারটা বিসদৃশ ঠেকবে। কারণ জন দেরি হোক এটা কিছুতেই মেনে নেবে না। সে অধৈর্য হয়েই বিরক্তির সুরে বলে উঠবে, তুমি তো জান আমার রোগী দেখা যখন শেষ হয়ে গেছে, আমি এক্ষুনি চলে আসব।…জনের এই ধৈর্যচ্যুতি নানা অশান্তি ও ভুল বোঝাবুঝির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাছাড়া বেশি গরম করলে মাংস সেদ্ধ হয়ে যাবে এবং জন তখন আরও চটে যাবে, ফারণ বেশি সিদ্ধ করা জিনিস জন কখনোই খুশী মনে মুখে তুলবে না। আবার মাংস ঠান্ডা থাকলেও সে রেগে যাবে, কারণ ঠান্ডা খাদ্য সে একেবারেই পছন্দ করে না।

মাংসের পদটা কিন্তু খুবই সুস্বাদু হয়েছিল। তার মন এখন দোদুল্যমান এবং দুঃখ ও দুশ্চিন্তা একইসঙ্গে তার মনকে আরও বিচলিত করে তুলেছিল।

সমস্ত জগৎ যেন তার চোখের সামনে মেষের পায়ের মাংসের ওপর সঙ্কুচিত হয়ে শীতল হয়ে যেতে লাগল। ডাইনিং টেবিলের অন্য প্রান্তে বারো বছরের টরেন্স বলে ওঠে, বোরাসিক সল্ট সবুজ শিখাতেই জ্বলে, হলদে রঙের শিখা সোডিয়াম সল্টের।

জার্দা টেবিলের অন্য প্রান্ত থেকে উদ্ভ্রান্তের মতো একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। ছেলে কী বলে চলেছে এ ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র অনুমান পর্যন্ত নেই।

মা, তুমিও জান না? ]

জার্দা-কি আর জানবো, বাবা?

টরেন্স–সল্ট সম্বন্ধে?

জাদার চোখ গিয়ে থামল লবণ রাখা কৌটার দিকে।

হ্যাঁ, লবণ এবং গোলমরিচের গুঁড়ো টেবিলের ওপর সযত্নে রাখা আছে, তা ঠিকই আছে। গত সপ্তাহে লুই ওটা রাখতে ভুল করেছিল এবং জন আরও রেগে গিয়েছিল। সদাসর্বদাই একটা-না-একটা গোলমাল…

টরেন্স স্বপ্নালু চোখে বলে উঠল, এটা একটা রাসায়নিক পরীক্ষা।

জেনা বোধহয় এই ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহ পাবে।

ন-বছরের জেনা তার সুন্দর মুখের মুখভঙ্গী করে বলে ওঠে, আমি আমার ডিনার চাইছি। মা, আমরা কি শুরু করে দিতে পারি না?

এক মিনিটের মধ্যেই কিন্তু খেতে শুরু করবে, তোমার বাবার জন্য কিছুক্ষণ প্রতীক্ষা অন্তত কর।

টরেন্স সঙ্গে সঙ্গে বলে, আমরা শুরু করতে পারি, বাবা মনে কিছু করবেন না। দেখোনি, তিনি কত চটপট ভোজন সমাপ্ত করেন?

জাদা নীরবে মাথা নাড়ে।

মাংস কাটবো? সে ঠিক করে উঠতে পারে না, কোন্ দিক থেকে চাকু বসানো উচিত। লুই অবশ্য ঠিক ভাবেই চাকু দিয়ে সুন্দর করে মাংস কাটছিল। কিন্তু অনেক সময় হয়েছে যখন সে ভুল করে ফেলেছে এবং জন তাতে ক্ষেপে গেছে। লুই ভুল করে চাকু ধরলে জার্দা তাকে ধমক লাগাতে ভোলে না। কিন্তু আজ আর ধমক বর্ষণ হলো না। আজ সে অন্য কারণে উদ্বিগ্ন।

মাংসের ঝোল এর মধ্যে ঠান্ডাও হয়ে গেছে এবং ঝোলের ওপর একটা পাতলা সুর ভেসে উঠেছে। তাকে যতশীঘ্র সম্ভব ওটা রান্নাঘরে পাঠিয়ে দিতে হবে–কিন্তু জন যদি এর মধ্যে এসে হাজির হয়ে যায়–এখন তার আসার সময় হয়েই গেছে। তার মনে ক্রমেই দুশ্চিন্তা আসতে লাগল..ঠিক খাঁচায়বন্দী প্রাণীর ন্যায়।…

আবার কেদারায় বসে ডাক্তার জন ক্রিস্টো কতকিছুই না ভেবে চলেছে। এক হাত সামনের টেবিলের ওপর রেখে অতীতে ফিরে গিয়ে তখনকার স্মৃতিচারণ করতে করতে হঠাৎ তার মনে হচ্ছে জাদা এবং ছেলেমেয়েরা ওপরে খাবার টেবিলে তার জন্য প্রতীক্ষায় বসে আছে। তার সত্যি অনেক দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু কিছুতেই সে উঠে দাঁড়াবার শক্তি সঞ্চয় করতে পারছে না।

চোখের সামনে এসে ভিড় জমাচ্ছে সব মিগুয়েল..নীল সমুদ্র…সিনেমার গন্ধ…উজ্জ্বল সূর্য…ধূলিকণা…দুঃসাহসিক সেই ভালোবাসা এবং যন্ত্রণা…

সে ভাবতে থাকে, হায় ভগবান, আবার এসব চিন্তা কেন! এসব চিন্তার দিনের অবসান ঘটেছে?

হঠাৎ তার মনে হল, তার সঙ্গে ভেরোনিকার যদি কোনো পরিচয় না থাকতো, জার্দার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ না হতো, এবং হেনরিয়েটার সঙ্গে যদি সাক্ষাৎ না হতো।…

মিসেস ক্যাবট্রির কথা তার মনে পড়ে যায়। তার বর্তমান অবস্থা যথেষ্ট সন্তোষজনক। প্রতিক্রিয়া তো খুবই উত্তম, সে এখন .০০৫ সহ্য করার ক্ষমতা রাখে। টক্সিসিটির অসম্ভব শ্রীবৃদ্ধি এবং ডি.এল, প্রতিক্রিয়া ধনাত্মক না হয়ে ঋণাত্মক-এ দাঁড়িয়েছে। তার রোগ নিয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চলছে। ডাক্তার তার দিকে চেয়ে হাসিমুখে বলেছিল, আপনাকে আমরা সুস্থ করেই তুলবো।

সে প্রত্যুত্তরে বলেছিল, ভগবান তোমার সহায় হোন, তুমি পরীক্ষা চালিয়ে যাও।

নাড়ী ধরে ডাক্তার শুধু প্রশ্ন করেছিল, আপনি অসুস্থ বোধ করছেন কি?

ডাক্তারের হাতের স্পর্শ পেতেই রোগিণীর মধ্যে যেন সতেজ ভাব ফিরে আসে। শ্বাস নিতে নিতে রোগিণী শুধু কটা কথা উচ্চারণ করেছিল, তুমি কিছু ভেবো না, আমি ঠিক সহ্য করতে পারব, তোমার কাজ তুমি বন্ধ রেখো না, চালিয়ে যাও।

জন ক্রিস্টো উৎসাহিত হয়ে বলে উঠেছিল, আপনি বড় মহৎ। আমার সব রোগী যদি আপনার মতো মন পেত।

–আমি সুস্থ হতে চাই, তাই সবকিছু সহ্য করার মতো শক্তি পেয়ে যাই। আমার মা আশি বছর পর্যন্ত বেঁচেছিলেন, ঠাকুমা নব্বই বছরের ওপর ইহকাল ত্যাগ করেছিলেন। আমার দীর্ঘ আয়ুর গোষ্ঠী হওয়াটাই স্বাভাবিক।

ডাক্তার মনে দুশ্চিন্তা আর সংশয় নিয়ে ফিরে এসেছিল। যদিও সে তার কাজের ব্যাপারে পরম নিশ্চন্ত ছিল যে, সে ঠিক পথেই এগোচ্ছে, তবু তার মনে ভয় ছিল। কোনো কিছু ভুল হয়ে যায়নি তো?

নিশ্চিন্ত থেকেও তার মনের চিন্তা আর দূর হয় না। কল্পনার জগতে বিচরণ করতে করতে হাসপাতালের সিঁড়িতে একটা দুরন্ত অবসাদ এসে ক্রিস্টোফারকে ঘিরে ধরল–বহুদিন ধরে এই গবেষণার কাজ করতে করতে তার ঘৃণা জন্মে গেছে। হঠাৎ করে হেনরিয়েটার কথা মনে পড়ে গেল। ঠিক তার জন্য নয়, তার রূপ, সজীবতা, স্বাস্থ্য এবং তার আলোকোজ্জ্বল জীবনীশক্তির জন্যই তার কথা বারে বারে মনে পড়ে যায়, আর মনে পড়ে তার চুলে আটকানো গোলাপের মোহিত করা গন্ধের জন্য।

বাড়িতে টেলিফোন করে খবর পাঠিয়ে সোজা হেনরিয়েটার কাছে গিয়ে উপস্থিত হলো, হেনরিয়েটার স্টুডিওতে পা রেখেই সে তাকে জড়িয়ে ধরল এবং সজোরে টেনে আনল বুকের খুব কাছে।

তাদের সম্পর্কে এমন আলিঙ্গনের বহর এই প্রথম। হেনরিয়েটার চোখেমুখে অবাক বিস্ময়। জনের উষ্ণ আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে কফি তৈরি করে খাওয়াল জনকে। স্টুডিওর মধ্যে চলাফেরা করতে করতে সে তাকে নানা প্রশ্নও করতে লাগল। সে জানতে চাইল, জন সোজা হাসপাতাল থেকে আসছে কিনা। জন কিন্তু চুপ করে থাকে। সে এখানে এসে হাজির হয়েছিল খানিকটা মোহগ্রস্ত হয়ে, আবার কিছুটা হেনরিয়েটার প্রেমে অন্ধ হয়ে।

হাসপাতালের কথা উল্লেখ করতে জনের ঠিক মন চাইছিল না। হেনরিয়েটার সঙ্গে প্রেমের গল্প করার বাসনা নিয়েই তাকে কাছে পাবার আশা নিয়েই সে হাজির হয়েছিল, হাসপাতলের কথা এবং মিসেস ক্যাবট্রি এবং রিজওয়ের রোগ সংক্রান্ত সব কথাই সে ভোলার জন্য উপস্থিত হয়েছিল।

প্রথমটায় অনিচ্ছাসত্ত্বে এবং পরে খুব দ্রুত তার প্রশ্নের জবাব ও দিল। চিকিৎসাবিদ্যার কতগুলো সহজলভ্য ভাষা তাকে বোঝাতে গিয়ে জন দু-একবার চুপ করে গিয়েছিল, হেনরিয়েটা চটপট উত্তর দিয়েছিল, হা, হা ডি. এল. প্রতিক্রিয়া ধনাত্মক-এ রূপান্তরিত হতে হবে। আমার ওসব বুঝতে অসুবিধে হয় না, তুমি বলে যাও।

সে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি করে জানলে?

হেনরিয়েটা-একখানা বইতে আমি পড়েছি।

জন–কি বই? কার বই?

হেনরিয়েটা ছোট্ট একটা বইয়ের টেবিলের দিকে এগিয়ে চললো। বই দেখে নিয়ে জন বলে উঠলো, স্কুবেলের বই মোটেই ভালো না, তার গোড়ায় গলদ। তোমার যদি বই পড়ার ইচ্ছা থাকে আমি তোমাকে উচ্চমানের ভালো বই দিতে পারি।

সে তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বলে ওঠে, না না, আমায় বই দিয়ে কি হবে? আমি শুধু তোমার বক্তব্যগুলো বুঝতে পারছি এই পর্যন্ত, তার চেয়ে বেশি জানতে চাওয়ার কোনো প্রবণতা আমার আছে কি? তুমি বলে যাও, মোটামুটি বোধগম্য আমার হবে।

আচ্ছা, মনে রেখো কিন্তু স্কুবেলের বই ঠিক নয়।

জন আড়াই ঘন্টা ধরে চিকিৎসাবিজ্ঞানের নানা তত্ত্ব পরিবেশন করে নিল। সে যখন হেনরিয়েটাকে এইসব কিছু বোঝাচ্ছিল, তখন তার এই খেয়ালও আসেনি যে, হেনরিয়েটা উপস্থিত আছে কিনা! তার দৃঢ় বিশ্বাস যে সে ভ্রান্ত নয়, নানান পদ্ধতিতে তার উপপাদ্য প্রমাণের চেষ্টায় লেগে গেল।

হঠাৎ সে মনের দিক থেকে ক্লান্তি অনুভব করল। আমি অত্যন্ত ক্লান্ত’ একথা বলতে বলতে বিছানায় শুয়ে পড়ে মরার মতো নিদ্রাদেবীর কোলে ঢোলে পড়ল।

শিশুর মতো সে ঘুমিয়ে পড়ল। পরের দিন সকালে যখন সে চোখ খুলল, তার চোখে পড়ল যে হেনরিয়েটা তার দিকে তাকিয়ে ফিকে হাসি হাসছে এবং সকালের চা তৈরি করতে বসে গেছে।

জন হেসে বইয়ের টেবিলের দিকে তাকিয়ে হেনরিয়েটার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, তুমি সত্যি খুব ভালো লোক, তবে দেখ, বই যদি পড়তে চাও তবে আমি তোমার হাতে ভালো বই তুলে দেব, স্কুবেলের নিম্নমানের বই পড়া তোমার বোধহয় উচিত হবে না।

হেনরিয়েটা সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, না-না ওসব পড়াশোনার ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। আমি যা কিছু উদ্দীপনা পাই তোমার মধ্যে এবং তোমার কথা শোনার পরই। এই বলে সে হেসে ফেলে।

জন কিন্তু বুঝে উঠতে পারে না, হেনরিয়েটার হাসির পেছনে আসলে কোনো কারণ লুকিয়ে আছে কি না? তবে কি হেনরিয়েটা স্কুবেলের বইকে উন্নতমানের বলে মনে করে? হেনরিয়েটা তবে কি তাকে উপহাস করছে? এমন পরিহাসে সে বড় একটা অভ্যস্থ নয়। জাদা তার সঙ্গে এভাবে ঠাট্টা-তামাশা করে না। ভেরোনিকা তো নিজেই স্বার্থ ছাড়া কিছু বুঝতে চায় না। হেনরিয়েটা কিন্তু অভিনবপন্থায় মাথা পেছন দিকে ফিরিয়ে আধবোজা চোখে তার দিকে তাকিয়ে রহস্য করে বলতে পারে, আমি কৌতুকপূর্ণ চোখে জনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বহুদূরে চলে যেতে পারি…।

সে ভেবে নেয় হেনরিয়েটা বোধহয় এখন একটু পালটে গিয়েছে–বোধহয় নিজেকে অনেক দূর সরিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু সেটা তার মনোগত বাসনা নয়। জন চায় যে, হেনরিয়েটা তার কথা ভাবুক, শুধু মাত্র তার কথাই ভাবুক–কোনো সময়ের জন্য যেন জনের অস্তিত্ব ছেড়ে অন্য কোথাও যেন চলে না যায়। কিন্তু যে গুণগুলো জার্দার মধ্যে দেখে জন নিজেকে ধরে রাখতে না পারে, সেগুলোই বা সে কেন হেনরিয়েটার মধ্যে পেতে চায়? এর একমাত্র অর্থ হয় যে, ন্যায়শাস্ত্র সম্বন্ধে সে একেবারে অজ্ঞ এবং তার মনের আকাঙ্ক্ষা সম্বন্ধে সে নিজেই জানে না।

আমি বাড়ি যেতে চাই–কি সম্ভবের বাইরে এবং বিদ্রুপের কথা! তার মানে কী দাঁড়াচ্ছে?

দু-একটা ঘন্টার মধ্যে জন লন্ডন থেকে বেরিয়ে পড়বে এবং শরৎ বনানীর মধ্যে দিয়ে পল্লীর পথ ধরে এগিয়ে যাবে…গাড়ির গতি তার মনে খুশী ডেকে আনবে…পল্লীপ্রকৃতির লতা-গুল্ম, ফল-ফুল, ঝর্না-নদী তার মনে আনন্দের ঢেউ তুলবে…

কিন্তু এসব কিছুই নির্ভর করছে একমাত্র জার্দার ওপর, ঈশ্বর জাদার প্রতি সহায় হোন। জার্দা খুব ভালো গাড়ি চালাতে পারে না।

সে থেকে থেকে গিয়ার বদল করে, জন তখন একেবারে নীরব থাকে। কখনও কখনও দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ওঠে, কিন্তু সাহস করে কিছু বলার মতো ক্ষমতা তার নেই। কারণ অতীতের অভিজ্ঞতা তাকে অনেক কিছু জানিয়েছে–সে জানে কিছু বললেই জাদা ক্ষেপে যাবে। আশ্চর্যের কথা এটাই যে, জার্দাকে কেউ গিয়ার বদল করা শেখাতে পারল না, এমনকি স্বয়ং হেনরিয়েটাও নয়। হেনরিয়েটার হাতে সে জাদাকে সমর্পণ করেছিল কারণ সে ভেবেছিল যে, তার উগ্র মেজাজের চাইতে হেনরিয়েটার শান্ত, উৎসাহ তাকে ভালো করার পেছনে যথেষ্ট লাভজনক।

হেনরিয়েটা গাড়ি ভালোবাসে। গাড়ির নাম উঠলেই সব কিছু ভুলে যায়। কেউ এ নিয়ে কোনো কথা বললেই তার মনে কাব্যরসের সঞ্চার হয় এবং সে এমন প্রাকৃতিক দৃশ্য নির্ণয়ের সঙ্গে গাড়ির শব্দধ্বনি, গতিবেগ প্রভৃতি তুলনা করে দেয় যে, শ্রোতারা বিরক্ত হয়ে ওঠে। জন তো বলেই বসল, হেনরিয়েটা তুমি কি তোমার গাড়ির কথা তুলে রেখে আমার জন্য দু’এক মিনিট ব্যয় করতে পার না? একদিন তো জনের এই ব্যাপারকে কেন্দ্র করে তার সঙ্গে বিরাট মনোমালিন্য হয়ে গেল!

জাদা একদিন জনকে বলে উঠেছিল, হেনরিয়েটা আমাকে যাবার জন্য বলেছে, আমার সঙ্গে তার কি কাজ আছে।

জন–কি কাজ? তোমাকে আবার কোন কাজে লাগবে তার? বোধহয় তোমার সঙ্গে ছলচাতুরি কিছু করবে।

জার্দা-কাল আমি স্টুডিওতে যাচ্ছি।

জাদাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে খুব খুশী। জনের মনে হল জার্দা বোধহয় মডেল হতে চায়–মুখে কিছু বলল না।

তার ঠিক দশদিন পরে জাদা বিজয়িনীর মতো প্লাস্টারের তৈরি একটা ছোট মূর্তি জনকে দেখাল, মূর্তি, মূর্তিটা হেনরিয়েটার আর দশটা মূর্তির মতোই বেশ সুন্দর। দক্ষ শিল্পীর হাতের স্পর্শ লাগলে যেমন সুন্দর এবং নিখুঁত হয়; তেমনি ভাবে অতুলনীয় হয়ে উঠেছে মূর্তিটি। জার্দাকে দেখেই তার অনুকরণে গড়া হয়েছে মূর্তিটি এবং আনন্দে আত্মহারা এখন জাদা, মূর্তির মধ্যে জাদা স্বয়ং যেন অমরত্ব লাভ করেছে–হাবভাব দেখে সেরকমই মনে হচ্ছে।

জার্দা–আমার মনে হয়, জন মূর্তিটা সত্যি খুব সুন্দর হয়েছে।

জন–এটা কি হেনরিয়েটার হাতের কাজ। কিন্তু তার কাজ তো এর চাইতে অনেক ভালো হতে পারতো। আমার তো দেখে মনেই হয় না এটা হেনরিয়েটার কাজ!

জার্দা–এটা যদিও একটু পৃথক ধরনের, কিন্তু আমার তো বেশ ভালোই লেগেছে। কাজের প্রশংসা না করে পারছি না, তুমি কী বল জন?

জন আর কিন্তু কিছু বলে না, জার্দার আনন্দে সে কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে চায় না। কিন্তু প্রথম সুযোগটাই সে সদ্ব্যবহার করল, হেনরিয়েটাকে আক্রমণ করল।

জন–তুমি জাদাকে এমনভাবে বোকা প্রতিপন্ন করতে চাইছ কেন? ওটা কী বানানো হয়েছে? তোমার মূর্তি গড়ার হাত তো বেশ পাকা!

হেনরিয়েটা–আমার তত মনে হয়, এটা বেশ ভালোই হয়েছে। জার্দাও এর জন্য যথেষ্ট খুশী।

জন–জাদা তো এ ব্যাপারে খুশী হবেই, কারণ আর্টের বিষয়ে সে কিছুই বোঝে না।

হেনরিয়েটা–আর্টের দিক থেকে বিচার করলে বোধহয় খুব খারাপ হয়নি জন। প্রতিকৃতি থেকেই যে মূর্তি বানানো হয়েছে সম্পূর্ণ নির্দোষ এবং সারল্যমিশ্রিত। বিন্দুমাত্র মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হয়নি।

জন–তুমি এমন সব নিম্নমানের কাজে সময় নষ্ট কোরো না…

জন পাঁচফুট উঁচু একটা কাঠের মূর্তির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, ওহে, এটা কি?

এটা বানানো হয়েছে আন্তর্জাতিক গ্রুপের জন্য। পিয়ারউড। পূজারিনী।

হেনরিয়েটা তার দিকে পলক নয়নে চেয়ে আছে। তারও চোখের পলক পড়ছে না–তার ঘাড় হঠাৎ ফুলে উঠলো, এবং তার দৃষ্টির তখন রঙ পাল্টে গেছে, দৃষ্টি থেকে ঝরে পড়ছিল কুদ্ধ ভাব।

তার মানে তোমার চোখে জার্দা এখন? তোমাকে কে এই সাহস প্রদান করল?

–আমি এই দেখে অবাক হচ্ছি যে তুমি বেশ এইসব বকে যাচ্ছ? তুমি যদি তা একবার চোখের দেখা দেখতে…সে একটা আঙুল রাখল তার বলিষ্ঠ চওড়া ঘাড়ের মাংসপেশীর ওপর।

হেনরিয়েটা মাথা নাড়ে, হা, এটা ঘাড় এবং কাঁধ–আমি এটাই করতে চেয়েছি–সেই ভারী সম্মুখে ঝোঁক–আত্মনিবেদন-নুয়ে পড়ার এক চিত্র। অত্যাশ্চর্য!

–অত্যাশ্চার্য? এদিকে একবার তাকিয়ে দেখ হেনরিয়েটা, জার্দার কি হাল করেছ তুমি!

জার্দা নিশ্চয়ই জানবে না, কেউ জানবে না। তুমি জান যে, জাদা মূর্তি দেখে কোনোদিনই নিজেকে চিনতে পারবে না, কেউ পারবে না। এটা জার্দা নয়, অন্য কেউও নয়।

জন–আমি কিন্তু ঠিক চিনতে পেরেছি, পারিনি?

হেনরিয়েটা–তুমি যা জেনেছ তা একটু অন্যরকম। তুমি দেখতে জান।

জন–চুলোয় যাক ঘাড়! কিন্তু হেনরিয়েটা তোমার এমন করার কোনো যুক্তি আমার চোখে পড়ছে না। তুমি অন্যায় করেছ।

হেনরিয়েটা–তাই কি?

জন–তুমি কি এখনও বুঝতে পারছ না? তোমার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি কি এখন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে?

হেনরিয়েটা–তোমার বোঝার ক্ষমতা নেই জন। আমার মনে হয় না, আমি তোমাকে কোনোদিন বোঝাতে পারব…তুমি বুঝতে পার না…কি করা হয়নি?…দিনের পর দিন দেখে দেখে সেই ঘাড়ের লাইনের পুনরাবৃত্তি এ মাংসপেশী-মস্তকের সামনের দিককার কোণ–পুরু ঠোঁট। আমি অনেক দেখেশুনে করেছি এবং আমি এই রূপটাই করতে চেয়েছি–প্রতিবার আমি জাদাকে প্রত্যক্ষ করেছি এবং দেখে দেখে ঐ রূপেই দাঁড় করাতে হয়েছে…দোষের মতো কিছু হয়েছে কি।

জন-বিবেকশূন্য!

হেনরিয়েটা-হা, ঠিক তাই। তোমার মনের বাসনা থাকে যদি এরকমটা পাওয়ার, তোমাকে তাই গ্রহণ করতে হবে।

জন–তার মানে এই দাঁড়াচ্ছে যে, তুমি কিছু গ্রাহ্য করো না, জাদাকেও তুমি গ্রাহ্য করো না…

হেনরিয়েটা–বোকার মতো কথা বলল না জন। জার্দাকে খুশী করার কথা ভেবেই আমি মূর্তিটা বানিয়েছি, আমি আর যাই হই, অমানুষ নই।

জন–নিঃসন্দেহে তুমি অমানুষ!

হেনরিয়েটা–তুমি সত্যি করে বলো তো জন, জার্দা কি নিজেকে তার মধ্যে খুঁজে পাবার আশা রাখে?

অনিচ্ছাসত্ত্বেও জন পূজারিনীর মূর্তির দিকে তাকাল-পূজারিনী নাম না দেবতার কাছে মাথা খুঁড়ছে–প্রার্থনা করে চলেছে–মুখ উত্তোলিত–অন্ধ, বোবা, ভক্তিমতী-শক্তিশালিনী ধর্মোন্মত্তা।

জন হেনরিয়েটার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, তুমি যে জিনিষটা তৈরি করেছ হেনরিয়েটা, সেটা দেখলে মনে এক ভীতি জাগে।

ঈষৎ কেঁপে ওঠে হেনরিয়েটা। সে বলে ওঠে, হ্যাঁ, আমি ভেবেছিলাম যে…

জন তাড়াতাড়ি করে তাকে বলে ওঠে, সে কার সন্ধান করছে? পূজারিনীর সামনে কে আছে?

হেনরিয়েটা কিছুক্ষণ ইতস্তত করে, সে বলে ওঠে, আমি জানি না, তবে আমার মনে হয় সে তোমার সন্ধানেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।

হেনরিয়েটার কণ্ঠস্বর কেমন অদ্ভুত শোনাল।

.

০৫.

খাবার ঘরে শিশু টেরি আরও একটা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করল।

সীসা লবণ গরম জলের চাইতে ঠান্ডা জলে অনেক বেশি দ্রবণশীল। যদি পটাসিয়াম আয়োডাইড যোগ করা হয় তবে সীসা–আয়োডাইডের হলদে তলানি তুমি পাবে।

সে তার মায়ের আশান্বিত চোখে তাকাল, কিন্তু আশার পরিবর্তে তাকে নিরাশ হতে হল। টরেন্সের মতে পিতা-মাতা সর্বদাই নিরাশ করেন।

-মা, তুমি জান কি?

আমি রসায়নশাস্ত্র সম্বন্ধে ঠিক কিছুই জানি না বাবা। টরেন্স সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়, তোমার বইতে এটা থাকলেও থাকতে পারে।

এর কতগুলো সহজ অভিব্যক্তি, কিন্তু এর পেছনেও অনেক আশা।

জাদার কোনো আশার কথাই পৌঁছচ্ছে না। সে যে এক উৎকণ্ঠার ফাঁদে পা দিয়েছে। বারংবার সে একই দুশ্চিন্তার কবলে আটক হচ্ছে। সকালে চোখ ভোলা থেকেই তার মন ভালো লাগছে না। এবং সবশেষে তার এটা বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে, এ্যাঙ্গক্যাটেলদের সঙ্গে সাপ্তাহান্তিক ছুটি কাটানোর সময় এসে উপস্থিত। এই অবসরকে সে আগে থাকতে ভয় পাচ্ছিল।হলোতে বাস করা তার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। সদাই তার বুদ্ধিভ্রম হতো এবং একাকিত্ব তার একমাত্র সঙ্গী হয়ে দাঁড়াত। লুসি এ্যাঙ্গক্যাটেল তার অসম্পূর্ণ বাক্যের দ্বারা দ্রুত অসঙ্গতি এবং বিনয়ের ব্যর্থ প্রচেষ্টায় এমন ভীতির সঞ্চার করতেন..যা, জাদার কাছে সত্যিই অহস্য লাগত। অন্যরাও তেমন ভালো নয়। জাদা এই দুটো দিন যেন শহীদের দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ করতো, শুধু জনের মুখ চেয়েই তাকে সহ্য করতে হতো। সেদিন শুয়ে জন খুশীমনেই বলছিল, ভাবতেও ভালো লাগে যে, সপ্তাহের শেষে আমরা পল্লীগ্রামে যাব। তোমার পক্ষেও এটা ভালো হবে জাদা, কারণ এটা একান্তই প্রয়োজন।

জাদা কিন্তু যন্ত্রচালিতের মতোই মুখ নিয়ে বলে উঠেছিল, হা, আনন্দ বৈকি! তার কারণ সুখহীন চোখ ঘরের দিকেই তাকিয়েছিল। দেয়াল-সাজানো কাগজ, ডোরাকাটা পোষাকের আলমারি, মেহগিনী কাঠের সুন্দর ড্রেসিং টেবিল, তাতে ঝোলানো রয়েছে মনোহারি সুদৃশ্য আয়না, নীল রঙের চাকচিক্যে ভরা কার্পেট, জলরঙের হ্রদের ছবিগুলো–এইসব চির-পরিচিত প্রিয় জিনিষগুলো সে আর সোমবারের পূর্বে প্রত্যক্ষ করতে পারবে না। বাড়ির চাকরানী একদিন মনের সুখে রাজত্ব চালাবে, তার শোবার ঘরে এসে জামাকাপড় সাজানোর নামে ওলটপালট করবে, পর্দা টেনে দিয়ে হয়তো গভীর ঘুম দেবে, নয়তো মন যা চাইবে তাই করবে–এটা ভাবতেই জাদার বিশ্রী লাগছে। জাদা একদম পছন্দ করে না সে ছাড়া কেউ তার জিনিষ নিয়ে নাড়াচাঙ্গা করে। ছুটি কাটাতে গিয়েও সে নিশ্চিন্ত হতে পারবে না, মন পড়ে থাকবে এখানেই, সদাই তার মনে হবে, তার সব প্রিয় জিনিষগুলো এই বুঝি নষ্ট হয়ে গেল! নিজের মনকে সে এইভাবে সান্ত্বনা দেবে, আর মাত্র তো একটা বা কয়েক ঘণ্টার মকদ্দমা। স্কুলের শিশুরা যেমন হা-পিত্যেশ করে গণনায় বসে যায় কবে ছুটির দিন আসবে, জার্দাও শিশুর মতোই ছুটি কাটাতে গিয়েও দিন-ঘন্টা গণনা করতে বসে যাবে–কবে ছুটি শেষ হবে আর কখন আবার বাড়ির মুখ দেখবে।

স্কুলও কোনোদিন জার্দার কাছে সুখের ছিল না। বাড়ি অবশ্য সেই তুলনায় ভালো ছিল, কিন্তু সেটাও তার পক্ষে ভালো ছিল একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। বাড়িতে জার্দা ছাড়া বাকি সকলেই বেশ চালাক-চতুর ছিল, সকলেই তাকে উপদেশ দিয়ে চলত। জার্দা, চটপট করো, তুমি এত ধীরজ কেন?–এইসব উপদেশ এবং বিদ্রূপ-বাণ তার নিকট শীতের দিনের শিলাবৃষ্টির মতোই মনে হতো। জার্দা অবশ্য তার জন্য কোনো আক্ষেপ করত না।

কিন্তু এইসব উপদেশ তার উন্নতির থেকে অবনতির কারণ হয়ে দাঁড়াল। যতদিন যেতে লাগল সে আরও বেশি বোকা এবং ধীরজ হতে লাগল। উপস্থিত বুদ্ধি তার একদম ছিল না। অনেক সময় কোনো কথার জবাবে সে শুধু উদাস নয়নে চেয়ে থাকতো, মুখে বাক্য সরত না।

অবশেষে একদিন সে তার আত্মরক্ষার কৌশল খুঁজে পেল। হ্যাঁ কৌশলই বটে, অস্ত্র হিসেবেও উপযুক্ত।

যত দিন যেতে লাগল সে যেন আরও ধীর হয়ে যেতে লাগল। খানিকটা ইচ্ছে করেই সে কাজে দেরি করতে লাগল। অন্য লোকগুলো ধৈর্য হারিয়ে তাকে যতই তাড়া দিতে থাকে সে যেন আরও ধীর গতিতে চলতে থাকে। অবশেষে তারা তার ওপর আর ছেড়ে না দিয়ে নিজেরাই সেটা করে ফেলে। জার্দা ফ্যালফেলে চোখে বোকার মতোই তার মনের চাহিদার তাগিদে তাকিয়ে থাকে। অপরপক্ষতার এই ভাব দেখে ভেবে নেয় ওর দ্বারা কিছুই হবার নয় এবং সেই সঙ্গে পরামর্শ দেয়, ওকে বেশি কাজ না দেওয়াই ভাল–বেশী কাজ দিও না। জাদার বেশ সুবিধাই হয়েছে, কাজের হার কমে যাওয়ায় তাকে খুব বেশি পরিশ্রমও করতে হয় না। এই কৌশলই সে শিখেছিল, মনে মনে সে খুব খুশী হতো, সকলে একটা কথাই ভাবতো, জার্দার জ্ঞানগম্যি আর হলো না, কোনো কাজ সে ভালো করে শেষ করে না। তারা মনে মনে এই ভাবনা ভেবেই সুখী থাকে যে তারা নিজেদের যথেষ্ট চালাক মনে করে, সেই সঙ্গে জ্ঞানীও।

জার্দা প্রকৃতপক্ষে মোটেই নিরেট নয়, তবে কাজের বেলায় শুধুমগতি। অনেকে সেটা পছন্দও করে না এবং তাতে অবশ্য সুবিধাই হয়। জাদার সবচেয়ে বড় অস্ত্র নীরবতা। কারুর কোনো কথায় সে প্রতিবাদ তোলে না। উত্যক্তর মাত্রা যদি একটু বেশি হয়, তবে আরও বোকা বোকা ভাব এনে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকাই শ্রেয়। পাষণ্ডের চোখে পড়লে তারও মায়া না হয়ে পারবে না।

তবু এ্যাঙ্গক্যাটেলদের মনে মনে সে ভয়ই পেত। এঁরা এত বেশি নিজেদের চতুর ভাবত যে, এদের নাগাল পাওয়া জার্দার পক্ষে সত্যি সম্ভব ছিল না। জার্দার গোপন অস্ত্রের কার্যকরী করার ক্ষেত্র এটা নয়, জার্দা এ্যঙ্গক্যাটেলদের যতই ঘৃণা করুক, জন এঁদের ভালোও বাসে। সেই জন্যই সাপ্তাহান্তে ছুটি কাটানোর জন্য ভালোবাসার টানে যেতে হয়।

জাদা মনে মনে ভাবে, জন সত্যি বড় ভালো,কী অত্যাশ্চর্য! জন সকলের কাছেই প্রিয়পাত্র। মেধাবী, যত্নশীল এমন ডাক্তার, যিনি রোগীদের প্রতি এমন স্নেহপ্রবণ, সকলের সঙ্গে এমন সুন্দর ব্যবহার–সত্যিই এমন মানুষের দর্শন খুব কমই মেলে। জন যে শুধু নিজের রোগীদের ক্ষেত্রেই যত্ন নেয় একথা ঠিক নয়। হাসপাতালের রোগীদের প্রতিও সমান যত্ন তার, জন তাই সত্যিই মহৎ। জার্দা প্রথম থেকেই এটা জানতো যে, ছাত্র হিসেবে জন সত্যিই মেধাবী এবং ডাক্তারি পরীক্ষাতেও সসম্মানে সে উত্তীর্ণ হয়েছিল। সে যে বৃক্ষের শীর্ষদেশে আরোহণ করবে এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ ছিল না। জার্দার সবথেকে অবাক লাগতো এই ভেবে যে, জন কেন তাকে পছন্দ করে বিবাহ করেছিল। জার্দা দেখতে মোটেই সুন্দরী নয়, নয় বুদ্ধিমতী, সেই সঙ্গে চাতুরী কলাও তার মধ্যে বিরল। সব কার্যেই তার মন্থর গতি! এর থেকে অনেক ভালো মেয়ে ডাক্তার জন চাইলে পেয়ে যেত। সে যখন তাকে পছন্দ করল, তখন সে ভালো ভাবেই জেনে গিয়েছিল যে জার্দা ধীরজ, বোকা এবং রূপের ডালিও নয়। জন শুধু বলেছিল, তুমি এ নিয়ে কিছু ভেবো না জার্দা, আমি তোমাকে খুব যত্ন করব…

একজন পুরুষ এর থেকে আর বেশি পৌরুষ কী বা দেখাতে পারে। জাদা শুধু নয়, জার্দার আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সকলেই একসঙ্গে অবাক হয়েছিল যখন তারা শুনেছিল যে জন জার্দাকে পছন্দ করেছে। শুধু জন নামী-দামী বড় ডাক্তারই নয়, রূপেও সে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, কথাবার্তায় তুখোড় এবং লোকের সঙ্গে ব্যবহারে অমায়িক। এরকম পাত্র সকলের কাছেই লোভের বিষয়, আর যদি সৌন্দর্যের কথাই উল্লেখ করা যায়, তাহলে সে মঞ্চ বা চিত্রজগতে নায়কের ভূমিকায় অনায়াসেই অবতীর্ণ হতে পারবে।

সব দিক থেকে বিচার করলে জনের স্ত্রী হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতাও জার্দার মধ্যে ছিল না।

নজরকাড়া হাসি হেসে জন বলে উঠেছিল, আমি আমার নিজের পথ ভালোবাসি, জার্দা।

জাদা প্রত্যুত্তরে বলেছিল, সে তো অতি উত্তম, সেটাই করা উচিত। সেও জনের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। অনেক সময় এমনও হয়েছে যে, জার্দার কোনো কাজ জনের ভালোই লাগেনি, তবু সে জার্দাকে দোষী বলে সাব্যস্ত করেনি। কারণ জন সর্বদাই তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত এবং নিজের স্বার্থের ব্যাপারে সে ছিল বরাবরই উদাসীন–এজন্যই বোধহয় জনের কোনো কাজই জাদার কাছে দোষের ছিল না।

হা ঈশ্বর! ভেড়ার মাংসের টুকরোটা বরফের মতো ঠান্ডায় জমে গেছে। সেটাকে একবার রান্নাঘরে পাঠানো তার উচিত ছিল, কিন্তু জনের তো দর্শন মেলাই ভার! জনও আসছে না, অন্যদিকে জাদাও তার কর্তব্য স্থির করতে পারছে না। জার্দা তার দায়-দায়িত্ব কর্তব্যের ব্যাপারে কেন স্থির সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না? এই চিন্তা মাথাতে আসতেই তার মন দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে, হায় ভেড়ার মাংস! ভীতিপ্রদ এই সাপ্তাহান্তে–এ্যাঙ্গক্যাটেলদের সঙ্গে ছুটি কাটানো অখণ্ড অবসর-সত্যি বড় খারাপ লাগছে! কপালের দু’পাশে হঠাৎ একটা ব্যথা তাকে বড্ড অধীর করে তুলছে। এক্ষুনি মাথার যন্ত্রণায় সে কাতর হয়ে পড়বে, জনের কানে যদি একবার যায়, সে ক্ষেপে আগুন হবে, ওষুধ তো দেবেই না বরং পরামর্শ দেবে যে, মাথা ধরেছে এই কথাটা মনে আনতে নেই, ওটাকে ভুলে যাও, দেখবে মাথাধরাও উধাও। এক কাজ কর, চটপট পা চালিয়ে একটু ঘুরে এসো, অযথা ওষুধ গিলে শরীরকে আর বিষাক্ত করে তুলতে হবে না। ভেড়ার মাংস! এই ভেড়ার মাংসই হয়েছে কাল–মাথা ধরার একমাত্র কারণ। এই মাংসই হলো সব অশান্তির মূল..

জাদার চোখ জলে ভরে যায়। সে মনে মনে ভাবে, আমার বেলায় কেন কোনো কিছুই ভালো হয় না। আমার সব কাজেই একটা না একটা গোলমাল লেগে থাকে।

টরেন্স খাবার টেবিলের অন্যপ্রান্তে বসা মায়ের দিকে একবার তাকাল, তারপরে চোখ নিয়ে গেল মাংসের টুকরোর দিকে। নিজের মনেই ভাবতে থাকে। ডিনার শুরু না করার পেছনে আমাদের কী কারণ থাকতে পারে? বয়স্ক লোকজন যারা উপস্থিত হয়েছে, এক কথায় সকলেই বোকার দল। জ্ঞান বলে কোনো বস্তু তাদের মধ্যে আছে বলে মনে হয় না।

একটু জোর দিয়েই বলে ওঠে, মা, আমি আর নিকলসন তাদের বাড়ির লতাগুল্মের উদ্যানে নাইট্রোগ্লিসারিন বানাবো। স্ট্র্যাথামে তাদের বাস। সম্মতির সুরে জার্দা বলে ওঠে, সে তো খুব উত্তম প্রস্তাব, একদিকে খুব ভালো হল।

–এখনও সময় আছে, ঘন্টা বাজিয়ে লুইকে বললেও এখন বলতে পারো, মাংসের টুকরোটা একবার গরম করে নাও।

টরেন্স উবে যাওয়া উদ্দীপনা নিয়েই মায়ের দিকে তাকাচ্ছিল। সে অনুভব করতে পারে, নাইট্রোগ্লিসারিন তৈরি এমন কোনো কঠিন কাজ নয়, যাতে করে মাতা-পিতার উৎসাহও মিলে যায়। সে ভেবেছিল, সুযোগ বুঝে মাতা-পিতার অনুমতি আদায় করার পালা, কারণ দুর্ঘটনা যদি কোনো ঘটে থাকে তবে আহত কণ্ঠে বলতে পারবে, মাকে আমার বলা তো বলেছিলাম।

কিন্তু এসব সত্ত্বেও তার মনে আজ হতাশা।

সেভাবে, নাইট্রোগ্লিসারিন তৈরির ব্যাপারটা মার কাছে একবার খুলে বলারও প্রয়োজন আছে।

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে টরেন্স, অসহায়তা এবং একাকিত্ব তাকে এখন ঘিরে ধরেছে। একথা শোনার মতো ধৈর্য এখন বাবার নেই, মাও সমান অমনোযাগী, জেনাকে তো ধর্তব্যের তালিকায় নেওয়া যায় না, নেহাতই ছোট এবং বোকা।

আর এমন সাধের রাসায়নিক পরীক্ষার কথা কার কাছে বলেই বা আনন্দ পাবে? ধৈর্য ধরে বসে শোনার মতো অবকাশ আছে?

কেউ না! কেউ না!

জার্দা চমকে ওঠে, তার কানে আসে জনের রোগী দেখার ঘরের দরজার শব্দ। জন ছুটে উপরে আসছে।

জন ক্রিস্টো ঘরে ঢোকে, নিজের উৎসাহের তাগিদ তাকে ঘরে এনে হাজির করেছে দ্রুতগতিতে। যদিও সে রঙ্গকৌতুক ভালোবাসে, কিন্তু এখনকার পরিস্থিতিটা একদম আলাদা ক্ষুধার জ্বালায় তার এখন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে।

চেয়ারে বসতে বসতে সে বলে ওঠে, রোগীদের আমি বড় একটা ভালো চোখে দেখি না–আমার কাছে তারা ঘৃণার পাত্র।

-ওঃ জন, এমন বলা তোমার শোভা পায় না, তোমার রোগীদের মনে তোমার সম্পর্কে খারাপ মনোভাব সৃষ্টি করবে–জার্দা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়।

ছেলেমেয়েদের উদ্দেশ্যে ইঙ্গিত দেয়, তারা যেন নিজেদের ভোজন শুরু করে।

জন ক্রিস্টো এবার মুখ খোলে, আমার বক্তব্য হল, অসুস্থ হওয়া বোধহয় কারও উচিত নয়।

টরেন্সের উদ্দেশ্যে জার্দাও জবাব দিতে দেরি করে না, তোমার বাবা আজ রঙ্গরসে মেতে উঠেছেন।

গভীর মনোযোগের সঙ্গে টরেন্স তার বাবাকে পরীক্ষা করে। সব জিনিষই সে গভীর মনোযোগ দিয়ে সম্পন্ন করে।

টরেন্স এবার বলে ওঠে, আমার তো মনে হচ্ছে না বাবা কৌতুক করছেন।

-তুমি যদি রুগণ লোককে ঘৃণার চোখে দেখ, তবে তোমার ডাক্তার হওয়া একেবারেই অনুচিত হয়েছে-জাদা হাসিমাখা মুখেই উত্তর দিয়েছে।

জন ক্রিস্টো–সেই জন্যেই বোধহয় ডাক্তারদের চোখে রোগীর ব্যাধি ধরা পড়ে না, হা ঈশ্বর মাংস যে পাথরের মতো ঠান্ডা-হিম হয়ে গেছে! কেন এটাকে, নিচে পাঠিয়ে রান্নাঘরে গরম করতে পারলে না?

জার্দা–তোমার যে আসতে এত দেরি হবে কী করে জানব? আমি তো ভেবে বসেছিলাম তুমি এসে হাজির হবে বলে।

জোরে জোরে জন ক্রিস্টো ঘন্টা বাজাতে থাকে, চটপট চলে আসে লুই। এই মাংসটা বরং পাঁচক দিয়ে গরম করিয়ে নিয়ে এসো।

সে সংক্ষেপে কোনোরকমে বলে, হ্যাঁ, মহাশয়। এই বলেই লুই তাড়াতাড়ি চলে যায়।

জাদা–সত্যি আমি দুঃখিত জন, সবাই আমার দোষ, প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসবে, তারপর যত সময় পার হতে লাগল ততই একটা চিন্তা আমার মাথায় ঘুরপাক করতে শুরু করে দিল, গরম করতে পাঠালে অনেক দেরি না হয়ে যায়–

অধৈর্য কণ্ঠে বাধা দিয়ে জন বলে ওঠে, ওঃ তাতে কিছু যাবে আসবে না, এটা এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় যে, এর জন্য নাচ আর গানের বন্দোবস্ত করতে হবে।

পরে সে জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা, গাড়িটা এখানে আছে তো?

–আমার তো তাই মনে হয়; কাল তো অর্ডার দিয়েছিল।

–তাহলে লাঞ্চের পরই আমরা বেরিয়ে পড়তে পারি।

জন শুধু ভেবে যায়। অ্যালবার্ট ব্রীজ পেরিয়ে ক্ল্যাপহ্যাম–কমনের ঠিক উপর দিয়ে–ক্রিস্টাল প্যালেসের পাশ দিয়ে সোজা পথ–ক্রয়ত–পারলিওয়ে, পরে প্রধান রাস্তাটা ঠিক বাদ দিয়ে –ডানদিককার মেথ্যার্ডলি হিল-এর মধ্য দিয়ে সোভেলের নিচে দিয়ে সোনালি সারি সারি বৃক্ষশ্রেণীর মধ্য দিয়ে শরৎ বনানীর ভেতর দিয়ে শরতের মৃদু গন্ধ নিতে নিতে পাহাড়ের চূড়ার পাশ দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।

লুসি এবং হেনরি…হেনরিয়েটা…।

চারদিন হল জন হেনরিয়েটার দেখা পায়নি। তার সঙ্গে যেদিন শেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল সেদিন সে রেগে গিয়েছিল। হেনরিয়েটার চোখেমুখেও সেই প্রভাব পড়েছিল। দুৰ্জেয় নয়, অন্যমনস্কতাও নয়–ঠিক বর্ণনা সে দিয়ে উঠতে পারছে না–কিছু–যার মধ্যে জন ক্রিস্টোর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না।

সে নিজের মনেই বলতে থাকে, আমি জানি, তার পরিচিতি সে একজন স্ত্রী-ভাস্কর। আমার অজানা নয়, তার হাতের কাজ উত্তম পর্যায়ের। চুলোর-দুয়ারে যাক সব! কখনও কি সে তার কাজ একাঁপাশে রেখে সে নিজেকে মুক্ত করতে পারে না? কখনও কি সে এক মনে আমার কথা ভাবার সময় পায় না? শুধু আপনার কথা? ঐকান্তিক ভাবেই শুধু আমার কথা?

সে ভালো নয়। সে খুব ভালো করেই এই সত্য বোঝে যে, লোক হিসেবে সে মোটেই ভালো নয়–অন্ততপক্ষে নিজের সম্পর্কে তার চিন্তাধারা এইরকম। হেনরিয়েটা নিজের সম্বন্ধে মুখে কিছু প্রকাশ করে না। নিজের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মুখে একেবারে কুলুপ এঁটে থাকে। অন্যান্য শিল্পীদের মতোই সে নিজের কাজ সম্বন্ধে কিছু বলা পছন্দ করে না। তবে তার শিল্পকে সমস্ত অন্তর দিয়েই সে ভালোবাসে। তাই শিল্পকে তার মনের সঙ্গে কতটা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়েছে, এই সংবাদ নেওয়ার সুযোগ অবশ্য জনের ভাগ্যে জোটেনি। তবে এমন ঘটনা খুবই কম চোখে পড়েছে যখন নিজের চিন্তার জগতে বিচরণ করতে করতে হেনরিয়েটা জনকে উপেক্ষা করেছে। জনের প্রতি হেনরিয়েটার বিন্দুমাত্র উদাসীনতা সে একদম বরদাস্ত করতে পারে না। তার বিন্দুমাত্র অন্যমনস্কতাও জনের মনে খুব সহজেই ক্রোধের সৃষ্টি করে।

একদিন সে সোজাসুজি হেনরিয়েটার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়েছিল, আমি যদি মরি তোমার পক্ষে এসব ছেড়ে দেওয়া কী সম্ভব?

–এসবগুলো কী? তার কণ্ঠজুড়ে বিস্ময়ের ধ্বনি।

সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল, বোকা! তুমি কেন ওকে এসব বলছ? পরে আবার চিন্তাভাবনা করে দেখেছে, দেখাই যাক না সে কি বলতে চায়! মিথ্যের আশ্রয় নিয়েই না হয় কিছু বলুক হ্যাঁ, জন আমি নিশ্চয়ই ছেড়ে দিতে পারি–শুধু তোমার মুখ চেয়ে।

কিন্তু যে কথাটা শোনার জন্য জন উদগ্রীব ছিল তা সে একটিবারের জন্যেও উচ্চারণ করল না। সে একেবারে নিশ্চুপ রইল। তার চোখ দুয়ে রহস্য সন্ধানে আপ্লুত হল। বহুক্ষণ এভাবে নীরব থাকার পর সে আবার বলে উঠল, হা, ছেড়ে দিলেও দিতে পারি; যদি তেমন কোনো প্রয়োজন সত্যি সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। একটু থেমে থাকার পর আবার তার বক্তব্য চালু করে, তুমি বোধহয় রেগে আছ। কিন্তু কি বললে তোমার এই রাগ গলে জল হবে–এমন কিছু যা শুনলে তুমি খুশি হও?

-তুমি খুব ভালো ভাবেই সেটা জান। একটিমাত্র শব্দই বোধহয় যথেষ্ট।

–হ্যাঁ, তুমি আসল কথা দুরে রেখে, ঝুড়ি ঝুড়ি বাজে কথা বলে লোকের মন ভোলাতে চাও কেন, ঐসব মিথ্যে বুলি আমার কাছে আওড়াও না কেন?

তবু খুব ধীরে ধীরে সে উত্তর দেয়, আমি জানি না…সত্যিই, আমি বুঝি জন, আমি পারি না–এই পর্যন্ত জানি, আমি পারি না। মিনিট খানেক এদিক-ওদিক পায়চারি করতে করতে জন বলে ওঠে, তুমি কী আমাকে শেষ পর্যন্ত পাগল না করে ছাড়বে না হেনরিয়েটা? আমার কখনও মনে হয় না যে, তোমার ওপর আমার কোনো অধিকার বা প্রভাব আছে বলে।

-তুমি অধিকার নিয়ে অযথা মাথা ঘামাচ্ছ কেন–কেনই বা এই প্রভাব পেতে চাইছ? হেনরিয়েটা জিজ্ঞেসা করে।

-আমি নিজেও জানি না, কেন চাই, কিন্তু আমি অন্তত দিতে চাই। কথা বলতে বলতে জন ধপ করে চেয়ারে এসে বসে।

জন–আমি আগে থাকতে চাই।

হেনরিয়েটা–আমার অজানা নয়, জন।

জন–আমি যখন আর এই জগতের বাসিন্দা থাকব না, তখন তোমার প্রথম কি করণীয় হবে জান? তোমার গণ্ডদেশ প্লাবিত করে অশ্রুবারি ঝরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তুমি কোনো শাকার্ত রমণীর মডেল বা কোনো সেবকের প্রতিমূর্তি গড়বে।

হেনরিয়েটাওঃ, সত্যিই কী সাংঘাতিক কথা! হ্যাঁ, যত সাংঘাতিক হোক-না কেন আমি করব–আমি সেই ভীষণ ভয়ঙ্কর কাজ উদ্ধার করেই ছাড়ব।

বিষণ্ণ চোখে হেনরিয়েটা জনের দিকে তাকিয়ে বসে রইল। পুডিং পুড়ে গেছে। সেদিকে চোখ পড়তেই ক্রিস্টোর, জাদা কোনো কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে তাড়াতাড়ি মাপ চেয়ে নেয়। সে তার স্বীকারোক্তিতে বলে যায়, আমি সত্যিই এর জন্য অনুতপ্ত জন। আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না, আমার বেলাতেই কী করে এগুলো হয়–এই সব আমারই দোষ। পুড়ে যাওয়া উপরের অংশটা না হয় আমাকে তুলে দাও এবং নিচের অংশটা তুমি নাও।

জনের দোষেই পুডিং-এর এই হাল। প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত প্রায় পনেরো মিনিট ধরে বেশি রোগী দেখার ঘরে ঠায় বসে–হেনরিয়েটা, মিসেস ক্যাবট্রি সল মিগুয়েল প্রভৃতির কথা চিন্তা করার ফলেই তার আজ এই দুর্দশার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ঠিক সময়েই যদি জনের আবির্ভাব ঘটত তবে আজ পুডিংটা পুড়ে যেত না। কিন্তু নিজের সব অপরাধ নিজের ঘাড়ে টেনে নিয়ে সে যে সমস্যার সমাধান করতে প্রত্যাশী হয়েছে এটা তার নির্বুদ্ধিতার পরিচয়। পুডিং-এর পোড়া অংশ নিজের জন্য নেওয়া তার নিছক পাগলামি ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে। সর্বদাই সে শহীদের যন্ত্রণা ভোগ করে আসছে কেন? টরেন্সের চোখের দৃষ্টি জনের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে? জেনাই বা অনবরত নাকের শব্দ করে শ্বাস টেনে চলেছে কেন? সকলের ব্যবহার এমন অপ্রীতিকর ঠেকছে কেন? তার সব রাগ এসে পড়ে বেচারি জেনার ওপর।

-তুমি সমানে নিচের দিকে নাক ঝাড়ছ কেন?

জাদা–ওর বোধহয় সর্দি হয়েছে!

জন–না, না, সর্দি ওর হয়নি। তোমাদের সবসময়ই এক চিন্তা যে ওর সর্দি হয়। জেনা বেশ ভালোই আছে।

এই সময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে জার্দা। তার মাথাতে কিছুতেই একটা ব্যাপার ঢোকে না যে, একজন ডাক্তার যে সর্বদা অন্যের রোগের চিকিৎসা করে বেড়ায়, সে নিজের ঘরের লোকের অসুখের ব্যাপারে কী করে এমন উদাসীন থাকতে পারে! ঘরের কারো রোগের কথা শোনামাত্রই সে অদ্ভুত আচরণ করে, উপহাস করে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেয়।

জেনা বলে ওঠে, লাঞ্চ নেবার পূর্বে আমি সময় করে বার আষ্টেক নাক ঝেড়েছি।

জন প্রত্যুত্তরে সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, গরমের হচি।

টরেন্স এতক্ষণ বাদে এই প্রথম কথা বলে, গরম তো নেই বাবা, আমাদের হলের তাপমাত্রা ৫৫ ডিগ্রি।

জন উঠে পড়ে। আমাদের ভোজন প্রায় সমাপ্ত? ভালো উঠে পড়! ফেরার জন্য এবার প্রস্তুত হয়ে নাও জাদা।

-এক মিনিট জন, আমার কিছু জিনিস নিয়ে যাওয়ার আছে।

নিশ্চয়ই নিয়ে যাবে, কিন্তু আগে সেরে রাখতে পারতে! সারা সকালে বসে কী এমন রাজকার্য করেছিলে?

রাগে গজরাতে গজরাতে খাবার ঘর থেকে বেরিয়ে যায় জন, জার্দা একছুটে নিজের শোবার ঘরে আসে। তাড়াতাড়ি করার উদ্বেগে তার যেন আরও দেরি হয়ে যায়। কিন্তু এখনও সে প্রস্তুত হতে পারেনি কেন? জনের নিজের স্যুটকেস ভর্তি হয়ে হলঘরের মাটিতে পড়ে আছে!

জেনা হাতে কয়েকটা কার্ড নিয়ে বাবার পাশটিতে এসে দাঁড়ায়, খেলা দেখানোর বাসনা নিয়ে।

–তোমার ভাগ্য আমি বলে দিতে পারি বাবা, বলব? আমি বলতে পারি। মায়ের টেরির, জেনের এবং কুবের ভাগ্যের কথাও আমি বলে দিয়েছি।

-ভালো বল।

জনের সত্যি বিরক্ত লাগছিল, জার্দার যে কত দেরি হবে। সে এই বাড়ি থেকে, ভয়ানক এই বাড়ি থেকে, বাড়ির এই ভয়ঙ্কর রাস্তা থেকে এবং রোগে পরিপূর্ণ শহর থেকে বেরিয়ে আসতে চায়–তবেই হাঁফ ছেড়ে সে বাঁচবে। বনানীর স্পর্শ চায়, পেতে চায় সে সবুজ পাতার স্পর্শ লুসি এ্যাঙ্গক্যাটেলের নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে তার দেহ মন লাবণ্যের সান্নিধ্যে আসতে চায়।

জেনা নিজের খেয়ালেই তাসের খেলা দেখিয়ে যাচ্ছে। এই তো বাবা, তুমি মাঝেই আছ, হরতনের সাহেব। যার ভাগ্য ভালো হবে সে সদাই হরতনের সাহেব থাকবে। এখন আমি অন্য মুখগুলো উল্টে নিচের দিকে করে রাখব। তোমার বামে দুটো, ডাইনে দুটো এবং মাথার উপরে একটা–তার প্রভাব থাকবে তোমার ওপর–এবং ঠিক তোমার পায়ের কাছে যেটা থাকবে, তার ওপর থাকবে তোমার প্রভাব। এটা কিন্তু তোমাকে ঢেকে দেবে। জেনা এক নিশ্বাসে বলে চলে, আমরা তাসগুলোকে এখন উল্টে দিলাম–ডাইনে রুইতনের বিবি–খুব কাছেই।

জন ভেবে নেয়, জেনার চাপল্য ভরা আন্তরিকতায় হেনরিয়েটা নিশ্চয়ই খুশী হতো।

জেনা বলে ওঠে, পরেরটা হল চিড়িতনের গোলাম–নিঃসঙ্গ এক যুবক। তোমার বাম দিকে ইস্কাবনের আট–তার পরিচিতি সে হল এক গুপ্ত শত্রু। বাবা, তোমার কি কোনো গুপ্তশত্রু আছে?

-আমি তো ঠিক জানি না।

তারপরে আছে ইস্কাবনের বিবি–সে এক বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা।

জন বলে ওঠে, লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল।

তোমার মাথার ঠিক ওপরে এখন যে অবস্থান করছে তার প্রভাব এসে সরাসরি পড়বে তোমার ওপর–সে হল হরতনের বিবি।

জন ভাবতে থাকে, ভেরোনিকা হলেও হতে পারে! না, আমি কি এতই নিরেট। ভেরোনিকা হতে যাবে কোন্ দুঃখে? ভেরোনিকার সঙ্গে আমার কোনো সম্বন্ধ নেই।

তোমার ঠিক পায়ের নিচে আছে চিড়িতনের বিবি-তোমার প্রভাব আছে এর ওপর।

এমন সময় ব্যস্ত পদক্ষেপে জার্দা এসে ঢুকে বলে ওঠে, আমি একেবারে প্রস্তুত জন।

একটু অপেক্ষা কর মা, একটু। বাবার ভাগ্য বলা সবে মাত্র শুরু করেছি। শেষের তাসটি বাবা? এটা সবথেকে বেশি প্রয়োজনীয়। এইটাকে তোমাকে ঢেকে রেখেছে।

জেনার ছোট্ট কাঠির মতো আঙুলগুলো তাসগুলোকে উল্টে দেয়। সে একবার শাস টেনে নিয়ে বলে, ওঃ–এটা তো ইস্কাবনের টেক্কা। এটা তো পরকালের–কিন্তু।

জন বলে ওঠে, লন্ডন ছেড়ে বেরিয়ে আসার পথে তোমার মা হয়তো কাউকে চাপা দিয়ে তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে। চলে এসো জাদা, টেরি এবং জেনা,-তোমাদের উভয়ের কাছেই বিদায়!

০৬. মিডগে হার্ডক্যাসল

মিডগে হার্ডক্যাসল শনিবার সকাল এগারোটার সময় নিচে নেমে আসে। বিছানায় বসেই সে তার প্রাতঃরাশ সমাপ্ত করেছে, বই পড়েছে, মাঝেমধ্যে ঝিমুনিও এসেছে এবং তারপরেই শয্যা ত্যাগ করেছে।

অলক্ষ্যে কাল কাটানোই সবথেকে বোধহয় উপভোগ করার উত্তম পথ।

সামনের দরজা দিয়ে শরতের মনকাড়া প্রভাতী সূর্যালোক নেমে এল। স্যার হেনরি এ্যাঙ্গক্যাটেল একটা সাধারণের আসনে বসে মনোযোগ সহকারে টাইমস পত্রিকা পড়ছিলেন। তিনি একবার মুখ তুলে তাকালেন এবং মুচকি হেসে ওঠেন।

মিডগেকে সত্যি তিনি ভীষণ ভালোবাসেন।

হ্যালো জামাইবাবু, আমার কি সত্যি খুব দেরি হয়ে গেছে?

হেনরি তেমনি হাসিমাখা মুখে উত্তর দেন, লাঞ্চ তো আছে, সেটা হারিয়ে বসোনি তো!

মিডগে তার পাশটিতে বসে পড়ে এবং দীর্ঘনিশ্বাস নেয়। এখানে আসা তো বড়ই সুখের।

-তোমাকে আজ বড় কৃশ দেখাচ্ছে।

-না, না, আমি বেশ ভালোই আছি। হৃষ্ট-পুষ্ট মহিলাগণ যেখানে তাদের মাপের চাইতে অনেক ছোট একাধিক পোষাক পরার চেষ্টায় না থেকে, সেখানে কি কোনো মজা আসবে।

হেনরি আবার একটু থেমে বলে ওঠেন, সাংঘাতিক তো! পরে হাতঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই বলেন, এডওয়ার্ড ১২.২৫ নাগাদ আসছে।

-তাই নাকি? মিডগে থেমে যায়, কিছুক্ষণ পরে বলে ওঠে, এডওয়ার্ডের আমি অনেকদিন দর্শন পাইনি।

-তার স্বভাবও ঐরকম, আইন্সউইক থেকে কদাচিৎ বেরোয়-স্যার হেনরি জবাব দেন।

আইন্সউইক! মিডগে ভাবতে থাকে, আইন্সউইক! কথাটা মনে পড়তেই তার অন্তরে কোথায় যেন একটা ব্যথা মোচড় দেয়। আইন্সউইকের মনোরম সেই দিনগুলো। মনে হয় এই যেন সেদিনের কথা। আইন্সউইকের স্মৃতি মিডগের মনের মণিকোঠায় এখন জ্বলজ্বল করছে। আইন্সউইকে চলে যাবার আগে করাত সে দু’চোখের পাতা এক করতে পারেন। শুধু কেবল জল্পনা-কল্পনা আর সেখানে যাওয়ার পর করণীয় কী হবে এটাই বোধহয় সকলের একমাত্র চিন্তাভাবনা। দেখতে দেখতে যাত্রার দিনও এসে উপস্থিত। গ্রামের ছোট স্টেশন। গার্ডকে আগে থাকতে নোটিশ দেওয়া থাকলে বড় লন্ডন এক্সপ্রেসকেও থামতে হবে। গাড়ি থেকে নেমে সুদীর্ঘ বনের পথ অতিক্রম করে তবে আসবে জনমানবশূন্য ফাঁকা মাঠ–সেখানে বিরাজমান সাদারঙের সুন্দর বড় বাড়ি–সে সাদরে অভ্যর্থনা জানাবে, আর দেখা মিলবে বৃদ্ধ কাকা জিওফ্রের। যার পরনে থাকে রঙ-বেরঙের কোট।

যুবক-যুবতীদের মনের সুখে ছুটি উপভোগ করার এটা বোধহয় উপযুক্ত স্থান। যেমন খুশী বিচরণ করতে পারে। আনন্দ উল্লাস করে দিন কাটাতে পারে। সেবারে হেনরিয়েটা আয়ারল্যান্ড থেকে এসে হাজির হল। এডওয়ার্ড তার বাড়ি এটন থেকে এসেছিল এবং সে নিজেই উপস্থিত ছিল উত্তরাঞ্চলের এক শিল্প-প্রধান শহর থেকে। তারা সকলেই ভেবেছিল তারা একত্র হয়েছে বুদ্ধিস্বর্গের নন্দন কাননে।

তাদের সমস্ত আনন্দের কেন্দ্রবিন্দু একজনকে ঘিরেই ছিল, সে এডওয়ার্ড। এডওয়ার্ড বেশ লম্বা, এবং শান্ত ভদ্র স্বভাবের। মিডগের দিকে সে তেমন ভাবে নজর রাখতে পারেনি, কারণ হেনরিয়েটা স্বয়ং সেখানে উপস্থিত ছিল।

এডওয়ার্ড অত্যন্ত চাপা স্বভাবের, বিশেষ করে অতিথিবৃন্দের কাছে, তার এই স্বভাবের জন্য কেউ তাকে ঠিকভাবে বুঝে উঠতেও পারে না। বুড়ো মালীর কাছ থেকে মিডগে যখন শুনেছিল যে এই বাড়িটা একদিন এডওয়ার্ডেরই হবে, শোনামাত্র সে কম অবাক হয়নি। বুড়ো মালীর নাম ট্রিমলেট, বাগানের সেই প্রধান মালী।

মিডগে জানতে চেয়েছিল, কেন ট্রিমলেট কাকা জিওফ্রের কি ছেলেপুলে নেই? জিওফ্রের উত্তরাধিকারী সে কখনোই হতে পারবে না এবং মিস্টার হেনরি, মিস্টার জিওফ্রের ভাইপো, কিন্তু সে যখন বিবাহ করেছে তাই সে এডওয়ার্ডের মতো এত কাছের নয় তাই সেও উত্তরাধিকারী হতে পারবে না। ট্রিমলেট সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে।

এডওয়ার্ড আইন্সউইক-এ একাই থাকে এখন কদাচিৎ এখানে চলে আসে। মিডগে এই কথা ভেবে অবাক হয়ে যায়, লুসি মনে কিছু না করে থাকেই বা কেন! লুসির হাবভাব দেখেও মনে হয় তার কোনো বিষয়েই ভ্রূক্ষেপ নেই।

আইন্সউইকে তার বাড়ি ছিল এবং তার প্রথম খুড়তুতো ভাই বলতে ঐ এডওয়ার্ড।–একবার বিতাড়িত হয়েছিল এবং বয়সে সে লুসির চেয়ে প্রায় কুড়ি বছরের ছোট। লুসির বাবা জিওফ্রে এ্যাঙ্গক্যাটেল দেশের এক মহান চরিত্রের লোক বলেই খ্যাত ছিলেন। প্রভূত সম্পত্তির সে অধিকারী ছিল এবং সম্পত্তির বেশির ভাগ অংশটাই তিনি লুসিকে দিয়েছেন। তাই এডওয়ার্ডকে গরীবই বলা যায় এবং সম্পত্তি বজায় রাখার উদ্দেশ্যেই তার সব ব্যয় হয়ে যায়।

বাবুগিরি করে যে এডওয়ার্ড সব ওড়ায়, তা নয়। কূটনৈতিক বিভাগে সে চাকরি করত, কিন্তু যে সময় আইন্সউইকের সম্পত্তির সে অধিকারী হল, তখন সম্পত্তি রক্ষার কথা ভেবেই চাকরি ছেড়ে আইন্সউইক-এ বসবাস শুরু করে দিল। বরাবরই সে ছিল বইয়ের পোকা, নতুন বই প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রথম সংস্করণ সে কিনে ফেলত। মাঝেমধ্যে ছোট পত্রিকায় সে ব্যঙ্গ রচনাও লিখত। সে তার দ্বিতীয় খুড়তুতো বোন হেনরিয়েটা স্যাভারনেককে বিবাহ করার প্রস্তাব বার তিনেক উত্থাপন করেছিল।

শরতের স্বর্ণবিগলিত মোহনকান্তি সূর্যালোকে বসে থেকে মিডগে এই সবই একের পর এক ভেবে যাচ্ছিল। এডওয়ার্ডকে দেখার পর তার মনে খুশীর উদ্রেক হবে কিনা সে জানে না, কারণ এখনও সে নিজেই মনস্থির করতে পারেনি। এডওয়ার্ডের মতো লোককে এড়িয়ে চলা মোটই সম্ভবপর নয়, আইন্সউইক-এ তাকে নিজের মতোই বাস্তব বলে মনে হয়েছে। লন্ডনের এক রেস্তোরাঁয় খাবার টেবিল থেকে দাঁড়িয়ে সে তাকে অভ্যর্থনা করেছিল। যতদূর তার মনে আছে, সেই থেকেই এডওয়ার্ডকে মন দেবার পালা চলেছে তার…স্যার হেনরির কণ্ঠস্বরে তার যেন সম্বিত ফিরে আসে।

-লুসিকে দেখে তোমার কেমন মনে হয়?

–খুবই ভালো, চিরটাকালই সে একইরকম রয়ে গেল। মৃদুহাসি হাসে মিডগে।

–হ্যাঁ, হ্যাঁ। স্যার হেনরি মন দিয়ে এবার পাইপ টানতে শুরু করে দেন।

অপ্রত্যাশিত ভাবেই তিনি শুধু বলে ওঠেন, মিডগে আমার অনেক সময় লুসির জন্য বড় চিন্তা হয়।

মিডগে বিস্ময়ের সুরে বলে ওঠে, উদ্বিগ্নতা? কেন?

স্যার হেনরি কেবল মাথা নাড়েন, লুসির এখনও উপলব্ধি করার মতো সেই বয়েস হয়নি যে, জগতে এমন অনেক জিনিষ আছে, যা তার একার পক্ষে করা সম্ভব নয়।

মিডগে অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকে। তিনি তার বক্তব্য অকপটে বলে যেতে থাকেন। জিনিষপত্র নিয়ে সে বেরিয়ে যায়। সরকারী প্রথাকে সে বিদ্রূপ করে-ডিনার পার্টিতে নানাধরনের কটুক্তি ছোঁড়ে-ডিনার টেবিলে বর্ণবৈষম্য-র কথা তুলে ঝগড়া বাধিয়ে শক্রতার সংখ্যা তৈরি করে নেয়! এমন সব কাজ সে করে যাতে ব্রিটিশ সরকারের অসম্মানে মাথা হেঁট হয়–অথচ আমার মতো একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীর স্ত্রী বলে তাকে মুখে কেউ কিছু বলে না, মনে মনে অসন্তোষ দানা বাঁধে নিশ্চয়ই। সকলের সঙ্গে মুচকি হাসি হেসে কথা বলে এবং এমন ভাব দেখানো এটা তার স্বভাবের একটা দিক–বড়ই বিরক্তিকর। চাকরগুলোও হয়েছে সেইরকম–সে যতই তাদের অসুবিধার সৃষ্টি করুক-না কেন, তবু তাকে তেল দিয়ে তোয়াজ করে চলাই তার স্বভাব।

মিডগের কণ্ঠে চিন্তার ছাপ, চিন্তিত সুরেই সে বলে ওঠে, আমার অজানা নয়, আপনি কী বলতে চাইছেন, সে কাজ অন্য লোকের দ্বারা সম্পন্ন হয় আপনি সহ্য করতে পারেন না, লুসি সেই একটাই কাজ করলে আপনি শুধু বলেন, ঠিক আছে। এর মানে কী? মোহিনী শক্তি? চৌম্বকত্ব?

নিঃশব্দে শুধু ঘাড় নাড়ে স্যার হেনরি।

তিনি বলতে থাকেন, ছেলেবেলা থেকেই লুসির স্বভাব চরিত্র ঐরকম, অনেক সময় এটাই ভেবে দেখেছি যে, ওর এই দোষটা মজ্জাগত হয়ে যাচ্ছে। সে বোঝে না যে, সব কিছুরই একটা সীমা থাকা ভালো, আমি মনেপ্রাণে এটাই বিশ্বাস করি যে, কাউকে প্রাণে মেরেও সে বোধহয় মুক্তি পেয়ে যেতে পারে!

মিডগে জানত যে, লুসিরও অনেক দোষ আছে, এমন অনেক চপলতা তার সঙ্গী, যেগুলো তার পদমর্যাদার পরিপন্থী। এমন সরকারী কর্মচারীর স্ত্রী হিসেবে তার যেটুকু গাম্ভীর্য থাকা প্রয়োজন, তার মধ্যে সেটা বিন্দুমাত্র ছিল না। সে তার মর্জির মালিক ছিল, নিজের খেয়ালখুশী মাফিক কৌশলের সঙ্গে সে গাড়ি চালাত। লন্ডন থেকে বাইরে যাওয়ার সময় নিজের বিচার করা পথ দিয়েই যাবে। এমনকি লন্ডনের মতো শহরেও সে গলিঘুজি দিয়ে এবং শর্টকাট রাস্তা ধরেই গাড়ি চালাবে। এই শহরের অলিগলি তার যেন নখদর্পণে, লুসির রাস্তা সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা, কোনো ট্যাক্সি চালকেরও বোধহয় এমন জ্ঞান নেই। লুসি শহরতলীর নতুন নতুন মোড় এবং রাস্তা সন্ধানী চোখে আবিষ্কার করে ফেলেছে।

হেনরিয়েটা সোভেল ডাইনের কাছে এসে যখন দাঁড়ায়, বেলা তখন সাড়ে বারোটা। এই স্থানটা তার খুব প্রিয়, এখান থেকে হেনরিয়েটা পাহাড়ের মনোরম দৃশ্য দেখতে খুব ভালোবাসত। তাই এমন জায়গায় এসে সে থামে, যেখান থেকে রাস্তা সোজা নিচের দিকে চলে যাচ্ছে। চতুর্দিকে এবং তার নিচে পরিবেষ্টিত বৃক্ষরাজির সমারোহ, সেই সঙ্গে সোনালী থেকে কটা রঙ ধারণ করতে শুরু করেছে। শরতের উজ্জ্বল মোহনকান্তি চতুর্দিকে যেন সোনার হোলি খেলায় মেতে উঠেছে। অবিশ্বাস্য রকমের সুন্দর নৈসর্গিক দৃশ্য।

হেনরিয়েটা নিজের মনে ভাবতে থাকে, শরৎ আমার প্রিয় ঋতু। বসন্তের চেয়েও এর সৌন্দর্য অনেক বেশি। এরকম একটা সুন্দর মুহূর্তের স্পর্শ পেলে মানুষ সবকিছু ভুলে যায়। প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য বিচ্ছুরণের মধ্য দিয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিলে সম্ভোগ করতে প্রয়াসী হয়ে ওঠে অফুরন্ত সুখ। সে ভাবে, এমন আনন্দের স্বাদ সে বোধহয় জীবনে পায়নি আর পাবেও না…

সৌন্দর্যের এই নগরপুরীতে মিনিট কয়েক প্রতীক্ষা করার পর হেনরিয়েটা ফিরে আসে। তার মনে হতে লাগল, সোনার মোহময় জগৎ যেন নিজেকে তৈরি করে আবার অনন্ত শূন্যে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নিজের রূপের চর্চায় নিজেই অস্থির হয়ে কি করবে সে ভেবে পাচ্ছে না– শুধু গড়ছে আর ভাঙছে।

হেনরিয়েটা সোজা এখান থেকে হলোতে এসে উপস্থিত হল। লুসি তাকে সহর্ষ অভিনন্দন জানায়।

মিডগের মনে পড়ে যায় লুসি তাকে একবার বলেছিল, আমার গাড়ি যেন আমার ঘোড়া। সে আমার অত্যন্ত অনুগত এবং বিশ্বাসের ক্রীতদাস।

মিডগে বলে ওঠে, আমি জানি লুসি সবকিছুরই উচ্ছেদ করে, সে আজ সকালেই আমাকে বলেছে যে, এখানে থাকাকালীন আমি যেন সর্বদাই রূঢ় ভাব দেখাই।

সাপ্তাহান্তিক ছুটিতে হেনরিয়েটা এসে গেছে, জন ক্রিস্টো এবং জার্দা অল্পক্ষণের মধ্যেই এখানে এসে হাজির হয়ে যাবে। এইমাত্র এসে উপস্থিত হয়েছে এডওয়ার্ড।

মিডগে তার নিজের চিন্তাজগতে বিচরণ করতে করতে এটাই ভাবতে থাকে, লুসি সত্যি এক পরী! আমি তার কথামতো সাপ্তাহান্তিক ছুটিতে সকলের সঙ্গেই রূঢ় ব্যবহার করব–সেই রূঢ়তা এমন হয়ে উঠবে গৌরবোজ্জ্বল! গাড়ি থেকে নামতে হেনরিয়েটা জানতে চায়– কার কার পদার্পণ ঘটেছে? মিডগে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়, ক্রিস্টোরা হয়তো এখুনি এসে হাজির হবে, এইমাত্র এসে উপস্থিত হয়েছে এডওয়ার্ড।

–এডওয়ার্ড? কি মজা কৃতদিন হল এডওয়ার্ডকে দেখিনি! আর কে এসেছে?

-ডেভিড এ্যাঙ্গক্যাটেল, দাঁতে দাঁত দিয়ে নখ কাটা–তার এই বদভ্যাস তোমার কিন্তু বন্ধ করা চাই!

–আমাকে এমন একটা অপ্রীতিকর কাজ করার কথা বলছই বা কেন? অন্যের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার মতো কোনো প্রবণতা আমার নেই, আমি কারো ব্যক্তিগত অভ্যাসে পরিবর্তন আনতে চাই না। এ বিষয়ে লুসির কী বক্তব্য? হেনরিয়েটার জানার কৌতূহল ক্রমেই বাড়ে।

-তোমাকে এবার আরও অনেক কাজ করতে হবে। একটা নিষিদ্ধ ফলও আছে, সেটার ব্যাপারেও তদারকের দায়িত্ব কিন্তু তোমার ওপর।

হেনরিয়েটা ভীতকণ্ঠে বলে ওঠে, এইসব কাজ আমার ঘাড়ে চাপানোর অর্থ কী?

-এখানেই শেষ নয়, আরও আছে, জার্দার প্রতি তোমাকে দয়া প্রদর্শন করতে হবে!

হেনরিয়েটা–আমি যদি জার্দার জায়গায় থাকতাম, লুসিকে আমি ঘৃণার চোখেই দেখতাম।

মিডগে–অপরাধ শাখার একজন লোক কাল আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ করবে।

হেনরিয়েটা–আমরা কি কোনো হত্যাকাণ্ডের খেলায় মেতে উঠেছি?

মিডগে–আমার কিন্তু মনে হয় না। নেহাতই এক প্রতিবেশীর আতিথেয়তা বজায় রাখতেই এডওয়ার্ড এখানে হাজির হয়েছে।

গভীর স্নেহের সুর হেনরিয়েটার কণ্ঠ দিয়ে উচ্চারিত হয়, প্রিয় এডওয়ার্ড! এডওয়ার্ড যথেষ্ট লম্বা, স্বাস্থ্য মোটেই ভালো নয়-রোগা। যুবতীদের দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসার সময়েই তার মুখে হাসি ফুটে উঠেছিল।

-হ্যালো হেনরিয়েটা, কী ব্যাপার, তোমাকে অনেকদিন পর দেখছি! হেনরিয়েটা হেসে ওঠে, হ্যালো এডওয়ার্ড!

এডওয়ার্ড সত্যি ভীষণ সুন্দর হয়েছে! মুখে সদাদীপ্ত শান্ত হাসি, চোখেমুখে দীপ্তি এবং দেহজ গঠনও বেশ ভালো–সারা শরীর শক্ত-মজবুত হাড়ে গঠিত। হেনরিয়েটা ভাবতে থাকে, এরকম চেহারার যুবক তার দৃষ্টিতে আকর্ষণ করে, এডওয়ার্ডের প্রতি দুর্বলতার এই মূর্তি দেখে সে নিজেই হতবাক। এতদিন সে এই গোপন সত্যটা ভুলে ছিল–এডওয়ার্ডের কাছে তার মন বাঁধা পড়েছে।

লাঞ্চ শেষ হতেই এডওয়ার্ড বলে ওঠে, এসো হেনরিয়েটা, আমরা না হয় কোথাও একটু বেড়িয়ে আসি।

এডওয়ার্ডের বেড়ানোর অর্থ খানিকটা জায়গা জুড়ে পায়চারি শুরু করা। বাড়ির পেছনের দিককার একটা বনের মধ্যে আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগিয়ে চলল। হেনরিয়েটার একবার মনে হল, আইন্সউইকের বন যেন। প্রিয় আইন্সউইক! সেখানে কতই না হাস্যরস লুকিয়ে আছে। এডওয়ার্ডের সঙ্গে সে আইন্সউইকের প্রসঙ্গেই কথা বলতে লাগল। তারা যেন অতীতস্মৃতি রোমন্থন করছে–অতীরে প্রসঙ্গ চলাকালীন সে নিজের অস্তিত্ব–তাদের বর্তমান একেবারেই ভুলে গিয়েছিল।

এওয়ার্ড–আমাদের কাঠবেড়ালিটার কথা তোমার মনে আছে? যার একটা থাবা ভেঙে গিয়েছিল এবং খাঁচার মধ্যে ঢোকাতেই সে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে উঠেছিল?

হেনরিয়েটা–অবশ্যই। তার একটা কৌতুকভরা বাহারি নাম-কী যেন?

এডওয়ার্ড-কলমস্তানী-মার্জারী ব্যাঙ্কস!

হেনরিয়েটা-হা, হ্যাঁ, ঠিক তাই।

তারা দুজনেই একসঙ্গে হেসে ওঠে।

এডওয়ার্ড–আমাদের বাড়ির রান্নাঘরের ঐ পরিচারিকা, বুড়ি মিসেস বন্ডী? সে বলত, দেখে নিও চিমনীর ওপরে এটা একদিন উঠে যাবে।

হেনরিয়েটা–আমরা কিন্তু মনে মনে বিরক্ত হতাম।

এডওয়ার্ড-এটা কিন্তু ঠিক চিমনীর ওপরে উঠে গেল।

হেনরিয়েটা–মিসেস বন্ডী এটাকে তেমনভাবে তৈরী করেছিল। বীই কাঠবেড়ালির মাথায় ওটা ঢুকিয়েছিল। সে না থেমে বলে যেতে থাকে। সবই কী একইরকমের আছে, এডওয়ার্ড? না, পরিবর্তন থেকে থাকেনি–অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে? আমি কিন্তু আমার কল্পনা দিয়ে সব সময়ে এই সত্যিই উপলব্ধি করছি যে আগের মতোই সব ঠিকঠাক আছে।

এডওয়ার্ড–তুমি এক বার চলে এসো না, হেনরিয়েটা, সবই দেখতে পাবে! তুমি সেই কবে ওখানে গিয়েছিলে।

হেনরিয়েটা–আমি জানি।

এডওয়ার্ড-তুমি তো খুব ভালোভাবেই বোঝো যে, সেখানে গেলে তোমাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাবে! তোমার যখন মন চায় চলে যেতে পার।

হেনরিয়েটা-তুমি সত্যি কী মিষ্টি, এডওয়ার্ড! সে ভাবে, এডওয়ার্ডের কী মজবুত হাড়!

এডওয়ার্ড–আইন্সউইককে তুমি নিজের বলে ভালো দেখো বলে আমি সত্যিই ভীষণ খুশী হেনরিয়েটা।

হেনরিয়েটা স্বপ্নবিষ্টের মতো বলে চলে, পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর শ্রেষ্ঠ স্থান এই আইন্সউইক।

লম্বা পায়ের মেয়ে…অবিন্যস্ত কটাচুলের কেশর…সুখী বালিকা…জীবন সম্বন্ধে তার কোনো মূল্যবোধ নেই…সে ভালোবাসে শুধু বন আর বন…বৃক্ষের নজরকাড়া শোভা তাকে আকৃষ্ট করে…তার মন হরণ করে…

হেনরিয়েটা ভাবে, সে যদি আবার অতীত স্মৃতির দিনগুলোতে যেতে পারতো তাহলে কত না সুখ হতো! সে দৃঢ় কণ্ঠে চিৎকার করে বলে ওঠে, ইয়াগড্রাসিল এখনও সেই আগের মতনই আছে?

এডওয়ার্ড-ওটার ওপর তো বাজ পড়েছিল।

হেনরিয়েটা–না, ইয়াগড্রাসিল তো নয়।

তার নামকরণ করা হয়েছিল ইয়াগড্রাসিল–এটা তার বিশেষ নাম। বড় সেই ওক গাছটার নাম ছিল ইয়াগড্রাসিল, সেটাকেও যদি বনদেবতা আঘাত হানতে পারে, তবে জগতে কোনো কিছুরই নিরাপত্তা নেই। তাহলে সেখানে ফিরে যাওয়া মোটেই ভালো হবে না।

এডওয়ার্ড–তোমার কী ইয়াগড্রাসিলের চিহ্ন মনে আছে?

হেনরিয়েটা-হ্যাঁ, টুকরো কাগজে পেনসিল দিয়ে ঐ গাছের আমি ছবি আঁকতাম। আমাকে একটা পেনসিল এনে দাও, আমি এক্ষুনি এঁকে দেখিয়ে দেবো।

এডওয়ার্ড সঙ্গে সঙ্গে তার দিকে একটা পেনসিল এবং নোটবুক এগিয়ে দেয়। হেনরিয়েটা হাসিমাখা মুখে কৌতুকপূর্ণ ওক গাছটার ছবি আঁকতে থাকে।

হেনরিয়েটা–চেয়ে দেখো, ইয়াগড্রাসিলের ছবি।

রাস্তার শেষ প্রান্তে বসে তারা মনের সুখে অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে সুখ দুঃখের কথাই বলে চলছিল। পড়ে যাওয়া একটা গাছের গুঁড়ির ওপর বসেছিল হেনরিয়েটা এবং ঠিক তার পাশে বসে ছিল এডওয়ার্ড। গাছের ফাঁক দিয়ে সে দেখছিল।

হেনরিয়েটা বলে ওঠে, এই জায়গাটা দেখলে আইন্সউইকের কথা মনে করিয়ে দেয় একপ্রকার পকেট আইন্সউক। আমি অনেক সময়ের জন্য এই চিন্তাতেই বিভোর থেকেছি এডওয়ার্ড এবং লুসি বাড়ি করার জন্য এই জায়গাটাই বেছে নিয়েছিল।

এডওয়ার্ড–তা হয়তো সম্ভব।

হেনরিয়েটা–কেউ জানতে পারে না, লুসি তার চিন্তাজগতে কী নিয়ে ব্যস্ত থাকে। লুসির মাথায় কখন কী অদ্ভুত খেয়াল ভর করে তা কারো পক্ষেই বলা সম্ভব নয়। তোমার সঙ্গে শেষ হওয়ার পরে তুমি কী করেছিলে?

এডওয়ার্ড–কিছুই না হেনরিয়েটা।

হেনরিয়েটা-সেটা বেশ শান্তির কথা।

এডওয়ার্ড–অমি কোনো কাজই সুষ্ঠুভবে করে উঠতে পারি না।

চোখের দ্রুত পলক পড়ে হেনরিয়েটার, তার স্বরে যেন লেগে আছে কৈশোরের ছোঁয়াচ। সে হেনরিয়েটার দিকে তাকিয়ে মৃদুমন্দ হাসছিল। হেনরিয়েটাও তার প্রতি গভীর এক আকর্ষণ অনুভব করে।

হেনরিয়েটা–জ্ঞানী মানুষ তুমি।

এডওয়ার্ড–জ্ঞানী?

হেনরিয়েটা–কিছু না করা বোধহয় জ্ঞানীর লক্ষণ।

এডওয়ার্ড–তুমি আবার সেই পুরানো কথায় ফিরে আসছ হেনরিয়েটা। তুমি তো সব ব্যাপারে ভীষণভাবে কতৃকার্য হয়েছ।

হেনরিয়েটা–তুমি কী মনে কর আমি কৃতকার্য হতে পেরেছি? এটা সত্যি বড হাস্যকর ব্যাপার!

এডওয়ার্ড-তুমি বরাবরই আমার খুব প্রিয়, শিল্পী মানুষ তুমি। এর জন্য তোমার গর্ববোধ হওয়া উচিত।

হেনরিয়েটা–আমি জানি, অনেক মানুষই আছে যারা আমাকে এমনটা ভাবে এবং মুখের ওপর বলেও থাকে। কিন্তু তারা এর বেশি আর কিছু জানে না–এর প্রথম ব্যাপারটাও তাদের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। এডওয়ার্ড, তুমিও বোধহয় জানো না। ভাস্কর্য এমন জিনিষ নয়, যা শুরু করলেই কৃতকার্যের শিখরে পৌঁছন যায়। এর এমন একটা আকর্ষণী ক্ষমতা আছে যা তোমাকে পেয়ে বসে, তুমি এটাকে অগ্রাহ্য করে এড়িয়ে চলতে পার না, যা তোমার কাছে আশ্রয় পেতে চায়–অনুসরণ করে তোমার সঙ্গে চলতে চায়–তোমার পিছু নেয়–কারণ আজ হোক বা কাল হোক তোমাকে তার সঙ্গে একটা বোঝাঁপড়ায় আসতে হবেই। সেই সময়ে হয়তো তুমি মনের দিক থেকে কিছুটা শান্তি পাবে–কিন্তু তুমি যদি আবার নতুন করে শুরু না কর, তোমার মন শান্তি থেকে বঞ্চিত থাকবে।

এডওয়ার্ড-শাস্তির মুখ দেখার তোমার কী কোনো বাসনা আছে হেনরিয়েটা?

হেনরিয়েটা–কখনো কখনো তোমার মনে এই ভাবনাই জাগে যে, সবকিছুর পরিবর্তে আমি শান্তিতে থাকতে চাই এডওয়ার্ড।

এডওয়ার্ড-আইন্সউইক এসে শান্তির মুখ তুমি দেখতে পার। আমার মন বলে সেখানে তুমি সুখে থাকবে, এমন কী আমার সঙ্গে থাকলেও তুমি মনের দিক থেকে পরম তৃপ্তি অনুভব করবে।

এ বিষয়ে তোমার কী মনে হয় হেনরিয়েটা? তোমার কী মত? আইন্সউইক তো তোমার পথ চেয়ে প্রতীক্ষায় বসে আছে।

ধীরে ধীরে মুখ ঘোরায় হেনরিয়েটা এবং নিচু স্বরে বলে, আমার মনে হয়, তোমাকে একান্তভাবে প্রিয় মনে না করে আমি পারিনি এডওয়ার্ড, তাই তোমাকে মুখের ওপর বোধহয় না বলতে পারিনি।

এডওয়ার্ড-তাহলে এখন কী না বলতে চাইছ?

হেনরিয়েটা–সত্যি আমি দুঃখিত।

এডওয়ার্ড–তুমি আগে না বলেছ–এখনও সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি-ভালো। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, তোমার মুখ দিয়ে হয়তো অন্য শব্দ বেরোবে। আজ বিকেলের দিকেও তুমি বেশ খুশী এবং প্রফুল্ল ছিলে, হেনরিয়েটা–তুমি নিশ্চয়ই একথা অস্বীকার করতে পার না।

হেনরিয়েটা-হা, আমি বেশ সুখেই ছিলাম।

এডওয়ার্ড–তোমার মুখ অন্য সবার থেকে একটু আলাদা লাগছে; অনেক কচি এবং সরল।

হেনরিয়েটা–আমার অজানা নয়।

এডওয়ার্ড-দেখো আমাদের উভয়ের চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু ঐ আইন্সউইক–যার সম্বন্ধে কথা বলতে, একসঙ্গে ভাবতেও আমরা ভালোবাসি! তুমি কী বুঝতে পার হেনরিয়েটা, এসবের প্রকৃত মানে কী দাঁড়াচ্ছে?

হেনরিয়েটা–এসবের মানে কী সত্যি তুমি বোঝ না এডওয়ার্ড! সারা বিকেলটা আজ অতীতের গর্ভে আমরা বসে আছি।

এডওয়ার্ড-বাসের পক্ষে অতীত অনেক সময় খুব সুখের।

হেনরিয়েটা–কিন্তু মানুষ অতীতে ইচ্ছে করলেই ফিরে যেতে পারে না, এই ফিরে যাওয়াটাই তার পক্ষে অসম্ভব।

দু-এক মিনিট সে নীরবতা পালন করে, পরে শান্ত আবেগবহির্ভূত কণ্ঠে বলে ওঠে, তোমার কথার মানে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, ক্রিস্টোর কথা ভেবেই তুমি আমাকে বিবাহ করতে রাজী নও, তাই নয় কী?

জবাব দেবার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পায় না হেনরিয়েটা। এডওয়ার্ড তার বলা থামায় না, বলে চলে–ঠিক বলেছি তো হেনরিয়েটা? জগতে যদি জন ক্রিস্টোর কোনো অস্তিত্ব না থাকত, তাহলে আমাকে বিবাহ করতে তোমার কোথাও কোনো দ্বিধা ছিল না।

হেনরিয়েটা এবার রূঢ় কণ্ঠেই বলে ওঠে, জন ক্রিস্টো নেই, এমন জগত আমি আমার কল্পনাতেও আনতে পারি না। এই সত্যটাই আমি তোমাকে বোঝানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি।

এডওয়ার্ড-তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম তোমার কথা যদি সত্যি বলে মেনেই নিই; তাহলে সে ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে ডিভোর্স করে তোমাকে বিবাহ করে না কেন?

হেনরিয়েটা–স্ত্রীকে ডিভোর্স করার কোনো বাসনা জনের এখনও নেই, যদি সে কোনোদিন স্ত্রীকে ডিভোর্সও করে তবে আমি তাকে বিবাহ করবো কিনা এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তুমি যেভাবে ব্যাপারটাকে দেখছ, বা তাই নিয়ে ভাবছ, আমরা কিন্তু জিনিষটাকে তোমার মতন করে ভাবতে পারছি না।

এডওয়ার্ডের কণ্ঠে চিন্তার ছাপ, সে কোনোরকমে বলে ওঠে, জন ক্রিস্টো! এ জগতে জন ক্রিস্টোর সংখ্যা কম নেই।

হেনরিয়েটা বলে ওঠে, তুমি আবার একই ভুল করছ এডওয়ার্ড, জগতে জনের মতো লোক কমই চোখে পড়ে।

তাই যদি হয়–তবে এটা তো উত্তম ব্যাপার! অন্তত আমি ভাবি। তার কথা শেষ না করেই এডওয়ার্ড উঠে দাঁড়ায়, বলে ওঠে, এসো আমরা ফিরে যাই।

.

০৭.

গাড়িতে উঠে বসার সঙ্গে সঙ্গে হার্লি স্ট্রিটের বাড়ির সদর দরজা বন্ধ হবার পর জাদার যেন মনে হতে লাগল সে যেন বনবাস যাত্রা করছে। চিরকালের জন্য বোধহয় সে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। এই সপ্তাহান্তিক ছুটি তার জন্য যেন নতুন কোনো অভিশাপ বহন করে আনছে। অনেক জিনিষ পড়েছিল হ্যাঁ, যাত্রা করার পূর্বে তার যেগুলো করে আসা উচিত ছিল। বাথরুমের কলটা বন্ধ করে আসতে সে ভোলেনি তো? লন্ড্রীর সেই হিসাবটা সে নির্দিষ্ট জায়গায় রেখেছে কিনা– রাখলেও কোথায় রেখে এসেছে? ছেলেমেয়েরা কি ঘরকন্নার পরিচারিকার কাছে ভালো থাকবে? পরিচারিকাও তো সেই স্বভাবের–ধরে নিন না উদাহরণস্বরূপ বলছি, টরেন্স কি পরিচারিকার কথা মতো চলার পাত্র? সত্যি বলতে কী, ফরাসি পরিচারিকাদের বশ মানানোর শক্তি পর্যন্ত নেই। সে চালকের জায়গায় বসে উদ্বিগ্ন মন নিয়ে স্টিয়ারিং চেপে ধরল, বরাবর সে এটাতে চাপ দিতে লাগল, জন এই সময় বলে ওঠে, ইঞ্জিনের বোতামে হাত পড়লেই গাড়ি খুব ভালো চলবে!

ভীতচকিত দৃষ্টি নিয়ে জাদা জনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠেছিল, আমি কি এতই বোকা। জার্দা ভেবেছিল যে, জন বোধহয় খুব ক্ষেপে যাবে। কিন্তু তাকিয়ে দেখলো রাগের পরিবর্তে তার মুখে হাসি। এ্যাঙ্গক্যাটেলদের কাছে যাচ্ছে এটা ভেবেই জন খুশিতে ডগমগ, জাদার দোষত্রুটিও তার নজরে আসছে না।

বেচারা জন! সে যথেষ্ট কঠোর পরিশ্রম করে, স্বার্থশূন্য এবং পরোপকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এমন স্বভাবের লোক বড় একটা চোখে পড়েনা! এত পরিশ্রমের পরেও সে যে ছুটি কাটানোর জন্য লালায়িত হয়ে উঠবে, তাতে আর আশ্চর্যের কী থাকতে পারে! জার্দার মন আজ বড়ই বিষণ্ণ। তার তো বাড়ি, তার ওপর ছেলেমেয়েদের জন্যেও চিন্তার শেষ নেই, এ ছাড়া সবসময় জনের মন জুগিয়ে চলার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে সে পরিশ্রান্ত। লাঞ্চ খেতে খেতে জন যেসব উক্তি করেছে যদিও সেরঙ্গ করেই এইসব বলে উঠেছে যে, রোগীদের দেখার মতো বাসনা তার নেই। জার্দা তার কথার আসল তাৎপর্য বুঝে ফেলেছে, কিন্তু যুক্তিবাদী নন টেরির, বাবার কোনো কথাকে ভ্রান্ত বলে মনে করার প্রবণতা তার মধ্যে নেই। বিশেষ করে সোজা পরিষ্কার এবং অলংকার বর্জিত মনের অধিকারী এই টেরি। জাদা অনেক সময়েই জনের অনেক কথায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে হেসে উড়িয়ে দিয়েছ, কারণ সে বোঝে জন তাকে বিরক্ত করার জন্যই এইসব বলে। সবকিছু বুঝেও সে নিজের মত থেকে একচুলও এদিক-ওদিক নড়ে না। অনেক সময় জাদা জনকে বোঝাতে চেয়েছে যে, ছেলেমেয়েদের মনে এই বোধটাও জাগাতে চায় যে, নিঃস্বার্থ, রোগীর সেবায় উৎসর্গীকৃতপ্রাণ এক চিকিৎসক রূপেই জনের পরিচিতি, কিন্তু এইকথার সহজ অর্থটুকুই উপলব্ধি করার মতো বোধও নেই। কথাচ্ছলে নিজের অসতর্কতায় এমন সব হালকা ধরনের কথা সে বলে ফেলে যাতে করে আদর্শবাদী এক নামকরা চিকিৎসক হিসেবে তার সুনাম ধুলোয় মিশে যেতে পারে।

দূর থেকে ট্রাফিক আলো চোখে পড়তেই জাদা গাড়ির গতি কমিয়ে দেয়, বহুক্ষণ ধরেই আলোটা সবুজ ছিল, তাই জার্দা ভেবে নিয়েছিল যে, আলোর স্থান পর্যন্ত পৌঁছতে-না-পৌঁছতে আলো পরিবর্তিত হবে বলে। কিন্তু আলোটা সবুজ সঙ্কেত দিয়েই যেন দাঁড়িয়ে পড়েছে।

জন ক্রিস্টো তার সব সঙ্কল্পের কথা ভুলে গিয়ে বলে ওঠে, তুমি অকারণে থেমে যাচ্ছ কেন ট্রাফিক-আলো যখন সবুজ জায়গাতেই থেমে আছে? জার্দা বলে, আমি ভেবেছিলাম আলো বোধহয় পরিবর্তিত হবে। জাদা অ্যাকসেলারেটরের ওপর পায়ের চাপ দিল, গাড়ি সামনের দিকে এগিয়ে চলল, আলোটা সবেমাত্র পেরিয়ে গেছে–ইঞ্জিন হঠাৎ করে থেমে যায়। আলোও পরিবর্তিত হয়ে যায়।

ক্রশ ট্র্যাফিক ধিক্কারজনক বাঁশি বাজাতে শুরু করে দেয়, জন বলে ওঠে, জার্দা, তোমার মতো খারাপ ড্রাইভার পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই।

ট্রাফিক আলো সবসময় আমার কাছে অযথা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারো পক্ষেই বলা সম্ভব হবে না যে, কবে সে নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনবে–অসহায় কাতরোক্তি কণ্ঠ থেকে ঝড়ে পড়ে জার্দার।

জার্দার উদ্বিগ্নে ভরা অখুশী মুখের দিকে জনের দৃষ্টি চলে যায়। জন ভেবে নেয় যে, জার্দা সব ব্যাপারেই একটু বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে, সে কিন্তু বোঝার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করে না যে, এই উদ্বেগ নিয়ে বেঁচে থাকা কত কষ্টকর! তার যদি কল্পনা শক্তি বলে কোনো অস্তিত্ব বেঁচে থাকে তবে তার চোখে পড়ত জার্দার অন্তরের ছবি।

জার্দা প্রায়-প্রায়ই বলে উঠত, দেখো জন, আমি সবসময় ছেলেমেয়েদের এটাই বোঝাবার চেষ্টা করি যে, একজন চিকিৎসকের জীবন শুধু ত্যাগের এবং আত্মোৎসর্গের–অন্যের দুঃখ-যন্ত্রণা দূর করার জন্য নিজের স্বার্থত্যাগ–অন্যের উপকার করা একমাত্র লক্ষ্য। এই মহৎ কাজ করার জন্য আমি মনে মনে গর্ববোধ করি এবং ছেলেমেয়েদেরও এই সত্য বোঝাতে চাই যে, তাদেরও এই জন্য গর্ববোধ হওয়া উচিত।

কিন্তু জন সঙ্গে সঙ্গে তাতে বাধা প্রদান করে বলে ওঠে, কেন, তোমার কি কোনোদিন মাথায় আসে না যে, চিকিৎসা করার মধ্যে আমি নিজের অন্তরে একটা সুখ অনুভব করি?–ঐ কাজ আমার কাছে সুখের-ত্যাগের নয়।

কিন্তু জাদা কিছুতেই এই ব্যাপারটা বোঝে না, বোঝার কোনো চেষ্টাও সে করে না, জনের কথা উপলব্ধি করার মতো বুদ্ধি বোধহয় জার্দার নেই। জন যখন মিসেস ক্যাবট্রি এবং হাসপাতালের মার্গারেট রাসেলওয়ার্ডের কথা বলে যায় সেই সময় জন জার্দার কাছে হয়ে ওঠে মহা পরোপকারী গরীবের বন্ধু এবং স্বর্গীয় ত্রাণকর্তা, জনকে সে গরীবের পরম বন্ধু বলেই মনেপ্রাণে গ্রহণ করে।

জন যদি জাদাকে বলতো যে, ক্যানসারের ওষুধ আবিষ্কারের কাজ এখন তাকে ডুবিয়ে রেখেছে–জাদা সেটা বুঝলেও বুঝতে পারত, কিন্তু রিজওয়ের ব্যাধির জটিলতা তার মাথায় ঢোকেনি। অনেক সময় জার্দার মনে হয় যে, রিজওয়ের আসল অসুখ সম্পর্কে জন নিজেও বোধহয় টের পায়নি। মাঝেমধ্যে তার এমনও মনে হতে পারত যে টরেন্স নেহাৎ-ই ছেলেমানুষ হয়েও রিজওয়ের অসুখের ব্যাপারে তার জানার প্রচেষ্টা আছে, বা ঔৎসুক্য নিয়েও বাবার কথা শোনে, জন কিন্তু জার্দার মত পোবণ করে। জন মনপ্রাণে এটাই চায় যে, তার ছেলে তার বিচার করুক, তার যোগ্যতার সঠিক মূল্যায়ণও সে করুক।

কফি মেসিনটা ভেঙে ফেলার পর থেকে জন ছেলের ওপর বেজায় চটে আছে। অ্যামোনিয়া তৈরি করতে গিয়ে টরেন্স মেসিনটা ভেঙেছে। কি দরকার পড়েছিল অ্যামোনিয়া তৈরির? যতসব বাজে কাজ! ছেলেটার সব বাজে কাজের প্রতি ভীষণ উৎসাহ এবং কৌতূহল…।

জন নীরব আছে দেখে জার্দা মনে মনে বেশ খুশী হয়। জন একনাগাড়ে বকে গেলে সে নিজের জগতেই অন্যমনস্ক হয়ে যেত এবং সেইজন্য গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অসুবিধার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া, চিন্তার জগতে মগ্ন থাকলে ইচ্ছেমতো জার্দার গিয়ার বদল জনের চোখে ধরা পড়তো না। ভালোভাবে গিয়ার বদলে জার্দা সিদ্ধহস্ত। কিন্তু জন গাড়িতে স্বমহিমায় উপস্থিত থাকলে সে সুষ্ঠুভাবে তা করে উঠতে পারে না। সুষ্ঠুভাবে করার উৎসাহে সে এমনই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে যে, হয় সে বেশি অ্যাকসেলারেট করে, নয় উপযুক্তভাবে শেষ করে না–ফলে সব গোলমাল হয়ে যায়। সে তখন গিয়ার লিভারে গিয়ে ধাক্কা মারে এবং তাতে ঝাঁকুনিও বেশ জোরেই হয়। গাড়ি চালানোর ব্যাপারে হেনরিয়েটাও জার্দাকে কম উপদেশ দেয়নি। হেনরিয়েটা গাড়ি চালানোর সময় জার্দাকে পাশে বসিয়ে নিয়ে বলেছে, তুমি অনুভব করতে পার না জার্দা, গাড়িটা কী ভাবে চলতে চায়!-ওটা কাত হতে চায়–যতক্ষণ ধরে এমন বোধ হবে, তুমি তোমার হাতে চাপটা ধরে রাখার চেষ্টা করবে–ভুলেও কোথাও ধাক্কা লাগাবে না-এই অনুভবটা মনে সর্বক্ষণই ধরে রাখার চেষ্টা করে যাবে।

কখনোই কিছু অনুভব করার মতো শক্তি জার্দার থাকে না। গিয়ার-লিভার–এর ঠিক কী কাজ জার্দা সেটা কোনোদিন অনুধাবন করতে পারল না! কিন্তু গাড়ি যারা চালায় গাড়ির সঙ্গে তাদের একটা ঐচ্ছিক ভাবের আদান-প্রদান হওয়ার বোধহয় প্রয়োজন থাকে।

জাদার মনে কিন্তু সেরকম অনুভূতি নেই, নিজের মানসিক অশান্তিতেই সে বিভোর থাকে, এইজন্য কোনোদিকে দৃষ্টি দেবার মতো সময় তার কাছে থাকে না। জানেন মন পাবার কাজেই সে এত ব্যস্ত থাকে যে, গাড়ির মন জোগানোর অবকাশ তার মেলে কী? তাই জাদা ভেবে নেয় যে, মারসাম্ পাহাড় পর্যন্ত গাড়ি সে ভালোভাবেই চালিয়ে আনতে পেরেছে। কারণ–এই সময়টা জন নিজের চিন্তার জগতে বিচরণ করছিল এবং জার্দাকে বিন্দুমাত্র বিরক্ত করেনি। গাড়ির গতিবেগ তাই যখন বাড়তে থাকে জার্দাও গিয়ার বদলে হাত লাগায়, অবশেষে ধীরেসুস্থে গাড়ি চলতে শুরু করে এবং জন হঠাৎ-ই তার বাস্তব জগতে পুনরায় ফিরে আসে। সে রেগে বলে ওঠে, তুমি যখন খাড়া পাহাড়ের নিকটবর্তী চলেই এসেছ তখন গিয়ার বদলানোর কী বা প্রয়োজন থাকতে পারে? জার্দা মুখে কিছু না বললেও ভেতরে ভেতরে অত্যন্ত বিচলিত। জন রেগে গেলেই জার্দার কাজে সব ভুল হয়ে যায়। জার্দার কাজ যতই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে জনের মনকে খুশী করতে চায়, প্রতি পদক্ষেপেই তার ভুলের সংখ্যা তত বেশি হয়ে যায়।

সোভেলডাউনের কাছে তারা যখন গাড়ি চড়ে এগোচ্ছে–জ্বলন্ত শরত্বনানী চতুর্দিক থেকে তাকে পরিবেষ্টিত করে আছে। উচ্ছ্বসিত হয়ে জন চিৎকার করতে থাকে, লন্ডনের বাইরে চলে আসা কী কম খুশীর। একবার ভেবে দেখো জাদা, এই বিকেলবেলা আমাদের অন্ধকার ঘরে বসে চা পানের কথা আর এখানের মনোরম দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।

আবছা আলোয় ঘেরা বসার ঘরের কথা মনে আসতেই আকুল হয়ে ওঠে জাদার মনপ্রাণ তার মনে হতে লাগল-হায়, এখনই যদি সে সেখানে পৌঁছে যেতে পারতো। বীরাঙ্গনার মতোই মুখ নিয়ে সে বলে ওঠে, পল্লীর রমণীর সৌন্দর্যের কোনো তুলনা করা কি চলে?

খাড়া পাহাড় থেকে নীচের দিকে নেমে এসেছে, ফেরার আর কোনো দ্বিতীয় পথও নেই। জাদার যেন মনে হতে লাগল, সে যেন অন্ধকার কারাগারে বন্দী হতে চলেছে। এ বন্দী জীবনের কোনো শেষ আছে কি? হার্লি স্ট্রিটে ফিরে যাওয়া তার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব, কারণ সে এখন দুঃস্বপ্নের গহ্বরে ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছে।

গাড়ি চালাতে চালাতে জার্দার দৃষ্টি চলে যায় খানিকটা দূরে, যেখানে হেনরিয়েটা এবং মিডগে একটা লম্বা লোকের সঙ্গে বসে কথা বলতে ব্যস্ত। হেনরিয়েটাকে দেখেই সে একটু আশ্বস্ত হয়, হেনরিয়েটার ওপর জার্দার অগাধ আস্থা ছিল, সে ভাবতে থাকে যে-কোনো অবস্থা থেকে উদ্ধার যদি করতে কেউ পারে সে হেনরিয়েটা। হেনরিয়েটাকে দেখে জন মনে মনে খুশী হয়। গন্তব্যস্থলে পৌঁছে জন এবং জার্দা হেনরিয়েটার অভ্যর্থনায় বড়ই প্রীত হয়। জন মুখে কিছু বলল না, কিন্তু মনে মনে এটাই উপলব্ধি করলে যে, হেনরিয়েটা এখানে না এলে ছুটির সমস্ত আনন্দটাই মাঠে মারা যেত।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বেরিয়ে আসেন, সাদর অভ্যর্থনা জানান জন এবং জার্দাকে। জাদার ব্যাপারে তিনি একটু বেশি আতিথেয়তা করলেন। যা তিনি সচরাচর অতিথিদের সঙ্গে করেন না। তিনি এমন একটা ভাব দেখাতে লাগলেন যে, জাদাকে পেয়ে তার খুশীর অন্ত নেই। জনকেও তার উপযুক্ত সম্বর্ধনা জানালেন। তার আচার-ব্যবহারে এটাই প্রস্ফুটিত হচ্ছিল যে, প্রধান অতিথি–জাদাই, সহযাত্রী হিসেবে তার পাশে থাকছে জন। জার্দা এ ব্যাপারটার জন্য মানসিক দিক থেকে একেবারে প্রস্তুত ছিল না, তাই সে মনে মনে একটু ক্ষুণ্ণই হয়।

লুসি বললেন, এডওয়ার্ডের সঙ্গে তোমাদের চেনা-পরিচিতি আছে তো?

এডওয়ার্ড এ্যাঙ্গক্যাটেল

কে? জন সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে বলে ওঠে, না, কই মনে কিছু করতে পারছি না তো।

বিকেলের পড়ন্ত সূর্যের রক্তিম আভায় তার নীল চোখের তারাও সুন্দর হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। যার চোখে পড়বে সেই বলে উঠবে কোনো এক দিগ্বিজয়ী বীর জাহাজ থেকে ধরণীর বুকে নেমে এসে সকলকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে, এবং শুভ সংবাদে সকলকে প্রসন্ন করে তুলেছে। তার কণ্ঠস্বরে যেমন রয়েছে আন্তরিকতার ছাপতেমনি হৃদয়কেও ছুঁয়ে যাচ্ছে এবং মুহূর্তের মধ্যে উপস্থিত সকলকেই চুম্বকের মতো নিজের দিকে আকর্ষণ করতে থাকে।

জনের প্রতিভা যেন সকলকে আড়ালে রেখে স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে জ্বলতে থাকে। এডওয়ার্ড যে এতক্ষণ কুশানী নায়কের মতো আপন প্রভাব বিস্তার করে বলে উঠেছিল সে যেন হঠাৎ কার নিষ্প্রভ হয়ে ওঠে, জীবন্ত থেকে ছায়ায় পরিণত হতে খুব বেশি সময় নিল না।

রান্নাঘর সংলগ্ন উদ্যানে হেনরিয়েটা এবং জাদা বেড়াচ্ছিল। হেনরিয়েটা জাদাকে বলে ওঠে, লুসি হয়তো আমাদের রক গার্ডেন এবং অটাম বর্ডার দেখানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠবে, আমার মনে হয় কিচেনগার্ডেন কিন্তু অনেক ভালো এবং শান্তিপূর্ণ জায়গা। শশার মাচার ওপর। বসে এখান থেকে অনেক দৃশ্য চোখে পড়ে এবং মনের সুখে গল্পও করা যায়। এদিকটা কেউ বড় একটা মাড়ায় না, সেই জন্যই বোধহয় বেশ নিঝুম নিরিবিলি।

জাদার সঙ্গে মনের কথা বলতে বলতে হেনরিয়েটা কাঁচা মটর তুলে তুলে খেতে থাকে কিন্তু জাদার এসবে কোনো সুখ নেই। সে-যে লুসি এ্যাঙ্গক্যাটেলের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতে পেরেছে এতেই তার আনন্দ। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলকে দেখে এবারও বেশ ভীতিপ্রদ লাগছিল। দশ মিনিট ধরে হেনরিয়েটা তার কাছে এমন সব প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল, চার উত্তর জাদার জ্ঞাত। হেনরিয়েটা তাকে বোকা প্রতিপন্ন করার জন্য তো প্রশ্ন করে না। সে শুধু মন খুলে লোকের সঙ্গে আলাপ জমায়, তাই জার্দাও খুশী হয়, সে ভাবে ছুটিটা বোধহয় খুব খারাপ যাবে না।

জেনা এখন নাচের ক্লাসে ভর্তি হয়েছে, তার জন্য যে নতুন ফ্রকটা কেনা হয়েছে জার্দা তার সবিস্তারে বর্ণনা দিয়ে যায়। সে এমনি আরও সংসারের দু-একটা কথা নিয়ে হেনরিয়েটার সঙ্গে সুদীর্ঘ আলোচনায় বসে যায়। হেনরিয়েটাও তাকে সস্নেহে উপদেশ দেয়।

জাদাকে খুশী করা সত্যিই খুব সহজ ব্যাপার এবং জার্দা খুশী হয়ে তার চেহারার আমুল পরিবর্তন হয়ে যায়।

শশার মাচায় বসে থাকতে থাকতে তারা একই সঙ্গে সূর্যাস্ত প্রত্যক্ষ করছে, গ্রীষ্মকালের উত্তাপ মনে মনে সেও উপভোগ করছে।

নীরবতা নেমে আসে হঠাৎ করে। জাদার মুখের অভিব্যক্তি যে এক লহমায় হারিয়ে যায়। সে যেন দুঃখের ছবির মতোই বসে রইল। হেনরিয়েটার কথা শোনা মাত্রই সে লাফিয়ে ওঠে।

হেনরিয়েটা–এ্যাঙ্গক্যাটেলদের তুমি যখন ঘৃণার চোখে দেখ, তখন তুমি এখানে আস কোন্ উদ্দেশ্যে?

জাদা–আমি ঠিক সে কথা বলতে চাইনি। তুমি শুধু শুধু এমন ভাবছ কেন যে

একটু থেমে থেমে সে আবার বলতে শুরু করে দিল, লন্ডন শহর থেকে বেরিয়ে পড়া খুবই সুখের এবং দয়াবতী হিসেবে লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের খুব পরিচিতি।

হেনরিয়েটাকে লুসি? তার দয়ার লেশমাত্র নেই।

জার্দা-তা কেন হতে যাবে, সে আমার প্রতি যথেষ্ট দয়াবান, আমার তো বেশ ভালোই লাগে।

হেনরিয়েটা–ভদ্রতা বলতে কোনো জিনিষ লুসির মধ্যে নেই, মহত্ত থাকলেও থাকতে পারে। অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির মহিলা হিসেবে বাজারে তার যথেষ্ট সুনাম। আমার মনে হয় । তিনি কোনোদিন সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে পারেননি। সাধারণ লোকের মতো চিন্তাভাবনা করার শক্তি তার নেই। এখানে আসলে তোমার যে বিরক্তির উদ্রেক করে তা আমার বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হয় না জার্দা। লুসিকে তুমি ঘৃণার চোখে দেখো এটা আমি জানি। সেই জন্যই আমি তোমাকে বলেছিলাম যে, তুমি যখন আহত হও, মনে দুঃখ পাও তখন তোমার এখানে না আসাই বোধহয় যুক্তিযুক্ত।

জাদা–জন কিন্তু এখানে খুশী মন নিয়ে আসে এবং অবশ্য না এসে পারেও না

হেনরিয়েটা–জনের যখন ভালো লাগবে সে আসবে বৈকি। তুমি তাকে একাই আসতে দেবে।

জার্দা–সে তা পছন্দও করে না, আমাকে না এনে ছুটি উপভোগ করার তার কোনো বাসনা নেই। নিজের স্বার্থের ব্যাপারে সে বরাবরই উদাসীন। সে মনে করে মাঝেমধ্যে শহরের বাইরে পা রাখলে আমার স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে।

হেনরিয়েটা-পাড়াগাঁয়ে আস তো ভালোই, কিন্তু এ্যাঙ্গক্যাটেলদের এখানেই যে আসতে হবে এমন কোনো কথা আছে কি?

জার্দা–আমি এ্যাঙ্গক্যাটেলদের ততটা খারাপ ভাবি না। তুমি আবার এই ভেবে বোসো না যে, আমি এতই অকৃতজ্ঞ!

হেনরিয়েটা–আমি জানি এ্যাঙ্গক্যাটেলরা সত্যি বিরক্তিকর লোক তবু এখানে আসি, আমরা একসঙ্গে মিলিত হয়ে একটু আনন্দ উপভোগ করতে চাই–এই যা! যাকগে এবারে না হয় চলল, খাবারের সময়ও হয়ে গেছে।

যেতে যেতে হেনরিয়েটা একদৃষ্টে জাদার মুখের ভাব লক্ষ্য করেই পথ চলছি। হেনরিয়েটা একমনে ভাবতে থাকে, জর্দার একটা অংশ বোধহয় পৃথক হয়ে পড়েছে। তার মনে হল, জাদার চোখে মুখে শহীদের নিগ্রহ যেন সদাই ভাসমান। দেয়াল পরিবেষ্টিত বাগান পেরিয়ে আসার সময় তাদের কানে এল গুলির আওয়াজ। হেনরিয়েটা সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, এ্যাঙ্গক্যাটেলদের ধ্বংস কার্য শুরু হয়ে গিয়েছে।

স্যার হেনরি ও এডওয়ার্ডের আলোচনার মুখ্য বিষয় ছিল আগ্নেয়াস্ত্র। গুলির শব্দ আলোচনার বাস্তব রূপায়ণ। হেনরি এ্যাঙ্গক্যাটেলদের নেশার জিনিষ ছিল আগ্নেয়াস্ত্র-মনের মতো বন্দুক পিস্তলের ভাণ্ডারও মজুত ছিল।

অনেক গুলিভরা একটা রিভলবার তিনি বার করেছিলেন এবং এডওয়ার্ড মনের সুখে একটার পর একটা গুলিবর্ষণ করে চলছিল। হেনরিয়েটাকে দেখে এডওয়ার্ড বলে উঠেছিল, চেষ্টা করে একবার দেখো না, একটা সিঁধেল চোর মারতে পারো কিনা?

হেনরিয়েটা তার হাত থেকে রিভলবার তুলে নিল এবং গুলি ছুঁড়ে বসল।

স্যার হেনরি বলে উঠলেন, জাদা, তুমি না হয় করে দেখো।

মিসেস ক্রিস্টো, এগিয়ে আসুন, এটা খুবই সোজা ব্যাপার।

চোখ বুজে গুলি ছোঁড়ে জার্দা, গুলি হেনরিয়েটাকে ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে যায়।

মিডগে বলে ওঠে, আমি একবার চেষ্টা করে দেখি।

পরপর বেশ কয়েকটা গুলি ছোঁড়ে, তারপর মুখ খোলে, তোমরা যা ভাবছ গুলি ছোঁড়া মোটেই সহজ কাজ নয়, তবে কৌতুক করার অভিপ্রায়ে এরকম এলোমেলো গুলিবর্ষণ চলতে থাকে।

লুসি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, তার পেছনে পেছনে লম্বা দেহের একজন লোক। লুসি বলে ওঠেন, এই ডেভিড।

মিডগের হাত থেকে রিভলবার তুলে নেন তিনি, এবং গুলি ভর্তি করে লক্ষ্যস্থলের পাশে ঠিক তিনটি ছিদ্র মুহূর্তের মধ্যে করে ফেললেন। উচ্ছ্বসিত প্রশংসার সুরে মিডগেবলে ওঠে, সত্যি খুব ভালো হয়েছে লুসি, আমি জানতাম না যে, গুলি ছোঁড়ার ব্যাপারে তুমি একেবারে সিদ্ধহস্ত।

গুরুগম্ভীর কণ্ঠে স্যার হেনরি বলে ওঠেন, লুসি তার নিজের লোককেই মেরে বসে।

মিডগে জিজ্ঞাসা করে ওঠে, কেন লুসি কী করেছিল?

ঝাকের মধ্যে দুটো গুলি ছুঁড়ে বসেছিল। আমার জানা ছিল না যে, তার কাছেও একটা পিস্তল আছে, খারাপ-স্বভাবের একটা লোক পায়ে আঘাত পেয়েছিল এবং আর একজন কাঁধে, অল্পের জন্য আমি সে-যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলাম। ভাবতেই অবাক লাগে আমি কী ভাবে মুক্তি পেয়ে গেলাম–স্যার হেনরি বলে চলেন।

লেডি এ্যঙ্গক্যাটেল মুচকি হাসি হেসে ওঠেন এবং বলেন, আমার মনে হয় সকলকেই একবার করে বিপদের ঝুঁকি নিতে হয় এবং যা কিছু করণীয় ভাবনা-চিন্তা না করেই চটপট সেরে ফেলাই ভালো।

স্যার হেনরি সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, সত্যিই প্রশংসনীয় মনোবৃত্তি। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারই আলাদা। কারণ ক্ষোভ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আমার আছে, সেবারে অনায়াসেই গুলিবিদ্ধ হয়ে তোমার পাগলামির শিকার হতে পারতাম।

.

০৮.

চা পানের পর জন হেনরিয়েটার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, এসো, একটু না হয় কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসি। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন যে, জার্দাকে নিয়ে তিনি রক-গার্ডেন দেখাতে যাবেন, রক্-গার্ডেন দেখার উপযুক্ত সময় এটা নয়।

জনের সঙ্গে পথ চলতে চলতে হেনরিয়েটা ভেবে নেয় যে, জনের সঙ্গে বেড়ানো আর এডওয়ার্ডের সঙ্গে বেড়ানো মোটেই এক কথা নয়। জন্মের সময় থেকেই সে কুমোর, এডওয়ার্ডের সঙ্গে বেড়ানো কুমোরের সঙ্গে বেড়ানোরই সামিল। কিন্তু জনের সঙ্গে বেড়ানো সত্যিই ভীষণ কষ্টসাধ্য, যে-কোনো লোক খুব সহজেই হাঁফিয়ে উঠবে। জন যেন মারাথন দৌড়ে নাম লিখিয়েছে!

হেনরিয়েটার মুখে ম্যারাথন দৌড়ের নাম শোনা মাত্র জন হেসে ফেলে এবং হঠাৎ করে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। জন সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করে ওঠে, তোমার কী কষ্ট হচ্ছে?

হেনরিয়েটা–না, আমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না বটে, তবে এত দ্রুতবেগে হাঁটার প্রয়োজনটাই বা কী? আমাদের তো গাড়ি ধরতে হচ্ছে না। তোমার মনে এত উৎসাহ আসছে কোথা থেকে? তুমি কি তোমার সব শক্তি ক্ষয়ের প্রচেষ্টায় উঠে পড়ে লেগেছ নাকি?

জন একদম থেমে যায়, এবং বলে ওঠে, তুমি এরকমভাবে কথা বলছ কেন?

উৎসুক নেত্রে হেনরিয়েটা তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

হেনরিয়েটা বলে ওঠে, কিছু ভেবে আমি এ কথা বলিনি।

জন আবার চলতে শুরু করে দেয় তবে তার গতিবেগ অনেক ধীর। জন বলে ওঠে, সত্যি আমি বড় ক্লান্ত, ভীষণই ক্লান্তি অনুভব করছি। জনের কণ্ঠে ক্লান্তির আভাস পেয়েই হেনরিয়েটা জিজ্ঞাসা করে ওঠে, ক্যাবট্রি এখন কেমন আছে?

এই সবেমাত্র কাজে হাত দিয়েছি, এখনও অনেকদিন লাগবে, শুধু কেবল পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, আমাদের পথ যদি নির্দিষ্ট থাকে এবং আমরা যদি কৃতকার্যের শিখরে পৌঁছতে পারি তবে নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী পরিবর্তন সংঘটিত হবে–

হেনরিয়েটা বলে, তবে তো রিজওয়ে ব্যাধিমুক্ত হয়ে উঠবে? তাহলে তো জগতে আর লোক মরবে না?

জন বলে ওঠে, অনেকটা প্রায় সেইরকমই।

হেনরিয়েটা নিজের মনে ভাবতে থাকে, এরা কী বলতে চাইছে।

বিজ্ঞানসম্মত পথ ধরেই আমরা এগিয়ে চলেছি, কৃতকার্য যদি হই তবে সুযোগের সকল দরজাই খুলে যাবে।

এসো, আমরা এখানে এসে একটু বসি, বসে বসে মুক্ত বাতাস সেবন করা স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই ভাল–সেই সঙ্গে বসে থেকে–তোমার দর্শন মেলা আরও উত্তম–বলা শেষ হতেই জন আবার হাসতে শুরু করে দেয়, কিছুক্ষণ বাদে আপনমনেই বলতে থাকে, এমন মুক্ত হাওয়া সেবন করলে জার্দার বরং উপকারই হবে, হোতে আসার জার্দার বেশ প্রবণতাও আছে, কিন্তু বেড়াতে তার মন একদম চায় না।

জন বলে ওঠে, আসতে আসতে এ্যাঙ্গক্যাটেলের দিকে আমার একবার দৃষ্টি চলে গিয়েছিল।

হেনরিয়েটা সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, না, তুমি তাকে বার দুই দেখেছ।

জন–আমি ঠিক মনে করতে পারছি না।

হেনরিয়েটা–এডওয়ার্ডকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। এডওয়ার্ড বরাবরই আমার খুব প্রিয়।

জন–যাকগে, এডওয়ার্ডের গল্প করে আমাদের সময় নষ্ট করা একেবারেই উচিত নয়। এরা আমাদের গণনার মধ্যে পড়ে না।

হেনরিয়েটা–জন, অনেক সময় তোমার জন্য আমার ভয় হয়।

জন–আমার জন্য ভয়? তুমি কী বলতে চাইছ?

হেনরিয়েটা–তুমি যেন সত্যি বিস্মৃতিপরায়ণ–অত্যন্ত–হ্যাঁ, অন্ধ।

জন–অন্ধ?

হেনরিয়েটা-তুমি জান না, চেয়ে দেখতে পাও না–ভাবপ্রবণতার লেশমাত্র তোমার মধ্যে নেই! তুমি বোধহয় জানো না, অন্য লোকে কী অনুভব করে এবং ভাবতে পারে।

জন–আমি ঠিক বিপরীত।

হেনরিয়েটা–তুমি যার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাক শুধু তাকেই তুমি দু’চোখ ভরে দেখো, একটা অনুসন্ধানী আলো ঠিক পেছনের দিকে, এপাশ-ওপাশ সবই অন্ধকারে ঘেরা সেখানে তোমার চোখে কিছুই পড়ে না।

জন–প্রিয় বান্ধবী আমার, হেনরিয়েটা, তুমি কী বলে চলেছ?

হেনরিয়েটা–সত্যিই এটা বিপজ্জনক, জন! তুমি ভাব সকলে তোমাকে ভালবাসে। লুসির কথাই নাও, তুমি কী মনে কর লুসি তোমাকে ভালো চোখে দেখে?

জন-লুসি আমাকে পছন্দ করে না? আমি তো তাকে একটু বেশি বোধহয় পছন্দ করি।

হেনরিয়েটা–তুমি পছন্দ করা বলে এটাই ভেবে নিয়েছ যে সেও তোমাকে পছন্দ করে। তবে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত নই, তবে জিজ্ঞাসা না করে পারি না জার্দাকে, এডওয়ার্ড, মিডগে এবং হেনরি তোমার সম্পর্কে কী ভাবে একবার বলতে পার?

জন–আর হেনরিয়েটা? সে কী ভাবে তাই কী আমার অজানা? কথা বলতে বলতে জন হেনরিয়েটার হাত চেপে ধরে এবং বলে ওঠে, তোমার সম্পর্কে আমি একেবারে নিশ্চিত।

হাত সরিয়ে নিয়ে হেনরিয়েটা বলে ওঠে, পৃথিবীতে কারো সম্বন্ধেই পুরোপুরি ভাবে নিশ্চিত হওয়া যায় কী?

জনের মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে। পরে বলে ওঠে, না তা একেবারেই বিশ্বাস করি না, আমি তোমার সম্পর্কে নিশ্চিত এবং নিজের সম্বন্ধেও নিশ্চিত। অন্তত–তার মুখের চেহারা, রঙ মুহূর্তের মধ্যে পরিবর্তন হয়ে যায়।

–কি হল জন?–হেনরিয়েটা জিজ্ঞাসা করে। জন বলে, তুমি জান, আমি নিজের সম্পর্কে কী বলি? সত্যি এটা একটা হাস্যকর উক্তি–আমি বাড়ি যেতে চাই। হ্যাঁ, এই কথার পুনরাবৃত্তি আমি আজও করছি। কিন্তু আমি নিজে হয়তো জানি না, যা বলছি তার মানে কী?

হেনরিয়েটা এবারে খুব ধীর-শান্ত কণ্ঠে বলে ওঠে, তোমার মনে হয়তো কোনো ছবি আছে?

সে তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, কিছুই না, একদম সব শূন্য।

সেদিন রাতে ডিনার টেবিলে হেনরিয়েটাকে ডেভিডের পরের আসনে বসানো হয়েছিল, টেবিলপ্রান্ত থেকে লুসির যেন টেলিগ্রাফ পাঠাল–আদেশ নয়–অনুরোধ। হেনরি জার্দার সঙ্গে বসে তার না-বলা কথা বলেই চলেছে। লুসির ছাড়া-ছাড়া মনের সঙ্গে যতটা সম্ভব পাল্লা দিয়ে হাসিমাখা মুখে হাসি নিয়ে জন এগিয়ে চলেছে। মিডগের বলার ভঙ্গী ঠিক স্বাভাবিক নয়। এডওয়ার্ডকে অন্যদিনের চাইতে আজকে যেন একটু বেশি অন্যমনস্ক লাগছিল। কম্পিত হাতে রুটি নিয়ে মুখে তুলে ধরছিল ডেভিড।

ডেভিড অনিচ্ছাসত্ত্বেও হলোতে এসে হাজির হয়েছিল। হেনরি এবং লুসির সঙ্গে ভালো করে কথা পর্যন্ত সে বলেনি। এ্যাঙ্গক্যাটেল-সাম্রাজ্যকে যেমন অস্বীকার করে তেমনিভাবে তাদের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্বন্ধও সে স্বীকৃতি দিতে মানসিক দিক থেকে একদম প্রস্তুত থাকে না।

এডওয়ার্ড তার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত, ললিতকলার অনুরাগী বলে সে তাকে বরাবর অবজ্ঞার চোখে দেখে আসছে। অবশিষ্ট চারজন অতিথিকে সে সমালোচনার চোখ দিয়েই দেখে। আত্মীয়তা তার কাছে ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং তাদের সঙ্গে দু’দণ্ড কথা বলতেও তার মনে ঘৃণার উদ্রেক করে।মিডগে এবং হেনরিয়েটাকে সে কোনোদিন পাত্তা দেয় না। সে মনে করে ওদের মস্তকে কোনো বস্তু আছে বলে মনে হয় না। ডাক্তার ক্রিস্টোও তার কাছে হার্লি স্ট্রিটের হাতুড়ে ডাক্তারদের অন্যতম। তার অবশ্য কেতাদুরস্ত ভাব আছে–কিন্তু তার স্ত্রী সব গণনার বাইরে।

কলারের মধ্যে থেকে ডেভিড ঘাড় নাড়ে এবং সকলকে সে এটাই বোঝাতে চায় যে, সে । কাউকে গ্রাহ্য করে না। তারা সকলেই খুব অকিঞ্চিৎকর।

তিনবার সকলের উদ্দেশ্যে নিজের মনে গালিগালাজ বর্ষণ করে মনটা যেন একটু হালকা হয়। তবু কটাক্ষ চোখে নিয়েই সবার দিকে তাকিয়েছিল। এক এক করে সকলের ব্যাপারেই নানা ধরনের ইঙ্গিতপূর্ণ সমালোচনা সে করে যাচ্ছিল। বহুক্ষণ হয়ে গেল হেনরিয়েটা নীরবে শুনে যাচ্ছিল, কিন্তু শেষে নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে অসহ্য হয়েই ভিন্ন রাস্তা ধরল।

হেনরিয়েটা জানত যে, সঙ্গীত শিল্পে যথেষ্ট দক্ষতা রাখে ডেভিড। তাই ডেভিডকে অকারণে উত্যক্ত করার লোভেই সে তার সুরকার সম্পর্কে অবান্তর মন্তব্য করে বসে। রঙ্গ করে সে বলার পরই লক্ষ্য করল, ওষুধ ধরেছে। ডেভিড নড়েচড়ে বসে। এবং খাওয়া অর্ধ-সমাপ্ত রেখে খুব দীপ্ত কণ্ঠে বলে ওঠে, যে, হেনরিয়েটা এ বিষয়ের অগ্র-পশ্চাৎ কিছুই বোঝে না। ডিনার শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে তার বক্তৃতা থামাল না এবং নির্বাক শ্রোতার মতোই হেনরিয়েটা তার আসনে নীরব রইল।

বক্র দৃষ্টিতে লুসি এ্যাঙ্গক্যাটেল ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত সকলের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন, মিডগে নিজেকে আর সামলাতে না পেরে ভ্র-কুঞ্চিত করে বিরক্তি প্রকাশ করে ফেলল। খাওয়া শেষ হলে বসবার ঘরের দিকে যাবার সময় লেডি এ্যাকাটেল হেনরিয়েটার হাত ধরে বলে ওঠেন, মাথায় কিছু না থাকলে এই হাতে আর কত বেশি কাজ করা যায়! তুমি কী মনে কর হরতন অথবা ব্রিজ পাশবিক জোরের ফল?

হেনরিয়েটা–আমার কিন্তু মনে হয় পাশবিক জোরের সঙ্গে তুলনা করলে অপমানটা ডেভিডকেই করা হবে।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল–তুমি বোধহয় ঠিকই বলেছ, তাহলে ব্রিজের সঙ্গে তুলনা করা চলতে পারে কারণ ডেভিড মনে মনে এটাই ভেবে বসবে যে, ব্রিজের মধ্যে বাজে জিনিষ আর নেই, তাহলে ওটার দ্বারাই তাকে অবজ্ঞা করা চলে।

তারা দুটো টেবিল অধিকার করে নিল এবং টেবিলে বসে তাস খেলতে শুরু করে দিল। জার্দার সঙ্গে খেলার সঙ্গী হল হেনরিয়েটা এবং তাদের প্রতিপক্ষ হন জন ও এডওয়ার্ড। গ্রুপিংটা যদিও ভালো হলো না তবে হেনরিয়েটা একান্ত মনেই চেয়েছিল জার্দাকে লুসির কবল থেকে রক্ষা করতে এবং সম্ভব হলে জনের হাত থেকেও। জন কিন্তু ছাড়ার পাত্র নয়, সেই সঙ্গে এডওয়ার্ডও এসে যোগ দেয়। হেনরিয়েটার মতো আবহাওয়াটা যে তেমন সুখপ্রদ ছিল না এটা সে জানতে পারেনি, কোনদিক থেকে শান্তিভঙ্গের কারণ এসে হাজির হবে। যাইহোক, এইসব ভেবে আর কী লাভ, তাস যদি সাহায্য করে তবে জাদা জিতে যেতে পারে। কারণ জাদাকে খুব খারাপ ব্রিজ খেলোয়াড় বলা যায় না। তবে জাদার দোষ এটাই সে অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে খেলে। জন কোনো রকমে খেলাটা চালিয়ে যেতে পারে, ভালো খেলোয়াড় সেও নয়, মনে সাহস আছে এবং নিজের ওপর আস্থা আছে, তবে ভালো খেলোয়াড় হিসাবে যথেষ্ট সুনামের অধিকারী এডওয়ার্ড।

কোথা থেকে সময় এগিয়ে চলে, হেনরিয়েটার টেবিলে তারা সেই রাবারই খেলে যাচ্ছে। স্কোর লিখে লিখে দুই দিক বেশ ভারী হয়েছে। জোর তালে প্রতিযোগিতা চলছে, কিন্তু একজন লোক এ সম্বন্ধে একেবারেই অজ্ঞ।

জাদারা এইমাত্র রাবার করল, এইজন্য সে মনের দিক থেকে অত্যন্ত খুশী এবং ভেতরে একটা উত্তেজনা অনুভব করছে।

জাদার ডাকের ওপর জার্দার রঙেরই হেনরিয়েটা ডাক বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য সমস্যার সমাধান একনিমেষে হয়ে যায়।

জন তেমন সুবিধা করতে না পেরে জার্দার মনোবল ভেঙে দেওয়ার অভিপ্রায় নিয়েই চিৎকার করে। বলে ওঠে, জাদা তুমি হঠাৎ করে ক্লাব লিড দিতে গেলে কেন?

হেনরিয়েটা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়, বাজে বকা বন্ধ করো জন। ক্লাব ছাড়া লিড দেওয়ার মতো জাদার কাছে আর কিছুই নেই, সে ঠিকঠাক ভাবে তার খেলা খেলে চলেছে।

অবশেষে হেনরিয়েটা তার দিক করে স্কোর করে এবং জার্দাকে বলে, গেইম এ্যান্ড রাবার হলো, আমরা বোধহয় খুব বেশি লাভবান হলাম না।

জন হাসিমুখে বলে ওঠে, লাকি গ্রুপ।

হেনরিয়েটা চট করে জনের দিকে তাকায়, কারণ একমাত্র সেই পারতো জনের ভাষা বুঝতে। জন আর কথা বাড়াল না।

হেনরিয়েটা ধীর কণ্ঠে বলে ওঠে, দেখো, খেলাতে দিয়ে লাভ করার পেছনে তেমন কোনো বাহাদুরি নেই।

জন বলে, জার্দাকে জেতাবার জন্য তুমি উঠে পড়ে লেগেছ, লোককে আনন্দ দেবার পরিবর্তে তোক ঠকানোর পথটাই তুমি বেছে নিয়েছ।

হেনরিয়েটা আর চুপ থাকতে পারে না, তুমি তোককে এরকম বাজে কথা বলে ক্ষেপিয়ে তোল কেন? তুমি কি একেবারে সাধু?

জন বলে, তোমাকে পার্টনার করা বোধহয় সার্থক হয়েছে, পার্টনারের মতোই তুমি বুলি আওড়াচ্ছ।

হেনরিয়েটা একটা জিনিষ লক্ষ্য রেখে চলেছে যে, এডওয়ার্ডকে হারানো মোটেই সহজ ব্যাপার নয়।

ভুল ডাক ফেলেও কেমন সুন্দরভাবে এডওয়ার্ড গেইম করে নেয়। অনেক সময় লিড দিতে গিয়ে ভুল কিছু হয়ে গেলেও খেলা ঠিক করে নেয়। এই ব্যাপারে হেনরিয়েটা সত্যিই বিব্রত বোধ করে। নিয়মমতো খেলা খেলে না এডওয়ার্ড। এলোমেলো ভুল পন্থা অনুসরণ করে হেনরিয়েটাকে হারিয়ে দিচ্ছে। হেনরিয়েটা এটা ভেবেই নিশ্চিত হয় যে, জন ক্রিস্টোর এটা আর এক কিস্তি সাফল্য ডেকে আনল। লুসির খেলাও তার পছন্দ হয় না।

হঠাই নাটকীয়ভাবে জানলা দিয়ে ভেরোনিকার মঞ্চে আবির্ভাব ঘটল। জানালা ফরাসি কায়দাতেই ভেজানো ছিল, তবে আটকানো ছিল না, কারণ সন্ধ্যের দিকটা বড্ড গরম পড়েছিল। জানালা ঠেলে ভেতরে এল ভেরোনিকা এবং গরাদে ঠেসান দিয়ে দাঁড়িয়ে আপন মনে হাসতে থাকে। কোনো কথা না বলে নীরবে শুধু ঘরের পারিপার্শ্বিক আবহাওয়াটা নিরীক্ষণ করছিল।

আমাকে ক্ষমা করবেন। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল–আমি আপনার প্রতিবেশী ডাভকোট বাড়ির অধিবাসী–মহা বিপদে পড়েই আপনার শরণাপন্ন হতে হয়েছে!–ভেরোনিকা বলে চলে।

তার হাসি এখন যেন আরও জোরে কানে আসতে লাগল, কৌতুক করেই সে বলে উঠল, একটা দেশলাই পর্যন্ত নেই–আমার ঘরে এখন অভাব পড়েছে দেশলাইয়ের। আপনার কাছে একটা দেশলাই ধার নিতেই হাজির হয়েছি। একমাইলের মধ্যে আমার প্রতিবেশী বলতে এক আপনারাই তো আছেন।

মুহূর্তের জন্য হলেও কারো মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না, সকলেই যেন অভিভূত, বধির শ্রোতার দল, ভেরোনিকা নিঃসন্দেহে সুন্দরী, তবে অপরূপা নয়, তাছাড়া চোখ ধাঁধানো রূপের ছটাও ভেরোনিকার ছিল না। তবে সব মিলিয়ে তাকে সুন্দরী বলা চলে। চুলের ঢেউ, মুখের বক্রতা, কাঁধের গড়ন এবং নিতম্বের সৌষ্ঠব তাকে সুন্দরী রমণীর তালিকায় এনে দাঁড় করিয়েছে। সকলেই তাকে দেখে একবাক্যে বলে উঠবে, হ্যাঁ, চমৎকার রূপ বটে।

একটু চুপ থাকার পর ভেরোনিকা আবার বলে ওঠে, আমি প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধূমপান করি–চিমনীর মতো করে ধোঁয়া ছাড়ি, তবে আমার লাইটারটাও এখন অকেজো হয়ে পড়ে আছে–কাজে আসছে না। তাছাড়া স্টোভ জ্বালার ব্যাপার আছে–আমার এমন নীরেট মাথা যে, দেশলাইয়ের কথা আগে মনেই হয়নি, আমার ঘরে বলতে গেলে যে একটি দেশলাইও নেই একথা আগে জানতে পর্যন্ত পারিনি।

আভিজাত্যের ভঙ্গিমায় লুসি এগিয়ে এলেন, চোখেমুখে মৃদু হাসির ছাপ।

-কেন, অবশ্য–দেশলাই দিয়ে লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল সবে মুখ খুলেছে, কিন্তু মাঝপথে ভেরোনিকা বাধা দেওয়ায় তিনি নীরব থাকলেন।

জন ক্রিস্টোকে দেখা মাত্র ভেরোনিকা অবাক হয়ে যায় এবং তার নিকট এগিয়ে এসে আলাপ জমিয়ে দেয়। মুখে তার অটুট রয়েছে অবিশ্বাস্য খুশীর ছাপ।

করমর্দনের জন্য এগিয়ে এসে সে হাত বাড়িয়ে দেয়।

জন ক্রিস্টো যে! কতদিন হল তোমার দেখা মেলেনি! তোমাকে হঠাৎ করে এখানে দেখতে পেয়ে কী যে আনন্দ হচ্ছে তা বলে বোঝাতে পারছি না!

ক্রিস্টো এবং ভেরোনিকা গভীর আনন্দের সঙ্গে করমর্দন করে ফেলে। আর লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের দিকে চোখ যেতেই বলে ওঠে, এখানে আসার পর জীবনের সবচাইতে বড় আশ্চর্যের জিনিষটা দেখলাম, জন আমার বহুদিনের পুরোনো বন্ধু অথচ তাকে কতদিন হলো চোখের দেখা পর্যন্ত দেখিনি! শুধু পুরোনো বন্ধু বললে বোধহয় ভুল বলা হবে, আমার জীবনে সেই প্রথম ব্যক্তি যাকে আমি ভালোবেসেছিলাম, প্রেমে আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি জনকে এখনও মনে মনে ভালোবাসি।

ভেরোনিকার মুখে মৃদুমন্দ হাসি লেগেই ছিল–একজন স্ত্রীলোক তার জীবনের প্রথম প্রেমিককে পেয়ে যেমন সুখী হয় তেমন রূপের ছটাও তার চোখেমুখে।

পরে বলে উঠল, আমি ভাবতাম, জন সত্যিই অত্যাশ্চর্য!

স্যার হেনরি যেমন ভদ্র তেমন মার্জিত স্বভাবের। ভেরোনিকার দিকে তিনি গুটিগুটি পদক্ষেপে এগিয়ে এসেছিলেন। মদের গ্লাস বাড়িয়ে ধরলেন, গ্লাসে চুমুক দেবার জন্য আহ্বান করলেন। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলকে মিডগে বলে ওঠেন, বোনটি, ঘন্টা বাজাও।

গাজন আসতেই লুসি বলে উঠলেন, এক বাক্স দেশলাই নিয়ে এসো, পাঁচকের কাছে চাইলে অনেকগুলো পেয়ে যাবে।

–আজ নতুন একডজন এসেছে মহাশয়া,-গাজন বলে ওঠে।

–তাহলে বরং নতুনগুলোর মধ্যে থেকে আধডজন নিয়ে এসো।

ভেরোনিকা মৃদু হেসে প্রতিবাদ জানাতে চায়, না না, লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল, আর তো মাত্র একটা দিন। ভেরোনিকা মদ্যপান করতে করতে হাসিমাখা মুখ নিয়ে প্রত্যেকের দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে হেসে সকলকে সম্ভাষণ জানাচ্ছিল।

জন ক্রিস্টো জাদাকে দেখিয়ে একবার বলে ওঠে, এই আমার স্ত্রী, ভেরোনিকা। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে ভেরোনিকা বলে ওঠে, ও, তোমাকে দেখে কী যে ভালো লাগছে! হতবুদ্ধির ন্যায় বধির হয়ে নীরবে রইল জার্দা। গাজন দেশলাইটা এনে একটা রুপোর ডিসের ওপর রাখল। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল দেশলাইয়ের ডিসটা এনে এবার ভেরোনিকার সামনে রেখে দিল।

ভেরোনিকা বলে ওঠে, প্রিয় লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল, এতগুলো দেশলাই আমার কোন প্রয়োজনে আসবে না।

রাজকীয় ভঙ্গিতে লুসি জবাব দেয়, শুধু একটা কেমন অস্বস্তি হয়, আপনি ইচ্ছে করলে সবগুলোই নিয়ে যেতে পারেন, আমাদের কোনো অসুবিধে হবে না। ছটা দেশলাই দেওয়া আমাদের কাছে কোনো ব্যাপার নয়।

স্যার হেনরি অমায়িকভাবে বলে ওঠেন, ডাভকোটে থাকতে আপনার এখন কেমন লাগছে?

ভেরোনিকা–আমার বেশ ভালোই লাগছে। লন্ডন শহর থেকে এত নিকটে এমন সুন্দর নিঝুম নিরিবিলি জায়গা। এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে আমার চোখ জুড়িয়ে গেছে।

ভেরোনিকা, প্ল্যাটিনাম ফক্সেস শরীরের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে শক্ত করে এঁটে নেওয়া হলে সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে হাসিমুখে বিদায় নিল।

ভেরোনিকা বলে ওঠে, আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ, আপনারা আমার অনেক উপকার করেছেন। স্যার হেনরি ও লেডি এ্যঙ্গক্যাটেলের মধ্যে কথাগুলো যেন হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। এডওয়ার্ড চুপচাপ কথাগুলো শুনে যাচ্ছিল। ভেরোনিকা বিদায় নিয়ে যাবার সময় জনকে একবার লক্ষ্য করে বলে উঠল, জন, তুমি কিন্তু আমার সাথে অবশ্যই একবার দেখা করবে। আমাদের সেই শেষ সাক্ষাতের পর তুমি এতদিন ধরে কী করছিলে, আমার সব জানতে ইচ্ছে করছে। যদিও সেগুলো এখন অনেক বাসি হয়ে গেছে, তবু আমি শুনতে চাই।

সে জানালার দিকে এগিয়ে গেল এবং জন তাকে অনুসরণ করে এগিয়ে চলল। ভেরোনিকা সকলের দিকে তাকিয়ে এবার বিদায়ের হাসি হেসে ওঠে। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ জানাব, এমন বোকার মতো অসময়ে আপনাকে উত্ত্যক্ত করার জন্য সত্যি আমি দুঃখিত।

জনের সঙ্গে ভেরোনিকাও বেরিয়ে যায়। জানালায় দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টে তাদের দিকেই তাকিয়ে রইলেন স্যার।

তিনি বলে ওঠেন, চমৎকার এক উষ্ণরাত্রি!

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল হাই তোলেন। তিনি বলেন, ওগো, আমাদের এখন শুতে যাবার সময়। হেনরি, আমরা ওর একটা ছবি দেখতে যাব, আমার মনে হয় আজ থেকেই ওর অভিনয় শুরু। তারা উপরে চলে আসেন। তাদের বিদায় জানাতে এসে মিডগে, লুসিকে জিজ্ঞাসা করলেন, খুব ভালো অভিনয় করে বুঝি।

লুসি–তুমি কী তা মনে করো না, প্রিয় বোন?

মিডগে–তোমার কী মনে হয় লুসি, যে, প্রায়ই তার দেশলাইয়ের অভাব দেখা দেবে এবং নিরুপায় হয়েই সে এখানে উপস্থিত হবে?

লুসি–তা কেন হতে যাবে? তবে আধডজন দেশলাই কিছু কম নয় বোনটি। বদান্যতা না দেখিয়েও তো পারি না। তাছাড়া, শুনে এসেছি চমৎকার অভিনয় গুণও তার আছে।

নিচের এবং অলিন্দের সবকটা দরজা একসাথে বন্ধ হওয়ার শব্দ কানে এলো। স্যার হেনরি সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, জানলাটা আমি ক্রিস্টোর কথা ভেবেই খুলে রেখেছিলাম। বলা শেষ হলে নিজের ঘর বন্ধ করলেন। হেনরিয়েটা জার্দার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, অভিনেত্রীরা কত রঙ্গই না জানেন। তাদের প্রবেশ এবং প্রস্থান দুটোই ভীষণ চমৎকার।

জার্দা হাই তুলে বলে ওঠে, ঘুমে আমার চোখ জুড়িয়ে আসছে।

বাদামগাছের বনের মধ্যে দিয়ে সরু পথ ধরে ধীর পদক্ষেপে চলছিল ভেরোনিকা ক্রে। সাঁতারের জলাশয়ের ধার দিয়ে সে ভোলা জায়গাটাতে এসে দাঁড়াল। এই জায়গাটায় ছোট একটা তাবু। দিনে সূর্যের আলোয় ঠান্ডা বাতাস প্রবাহিত হতে থাকলে এ্যাঙ্গক্যাটেলগণ এখানে বাস করতেন।

ভেরোনিকা ক্রে নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘাড় ঘোরাতেই চোখ গেল জনের ওপর, কিছু পরেই সে হাসিমুখে ঝরাপাতায় পরিপূর্ণ সুইমিং পুলের দিকে ইঙ্গিত করে বলে, দেখো, ঠিক ভূমধ্যসাগরের মতো নয়, কি বল জন?

সে জানত যে, কেন সে তার প্রতীক্ষায় বসে আছে–সে জানত যে, একটা দুটো বছর নয়, দীর্ঘ পনেরোটা বছর। ভেরোনিকার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলেও সে তার সঙ্গেই আছে–এখনও আছে। নীল সবুজ, মিমোত্মার গন্ধ, উত্তপ্ত ধূলিকণাচলে গিয়েছে, কোন্ দূরে সরে গেছে, দৃষ্টির অন্তরালে চলে গিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছে–তবু মন থেকে যায়, অন্তরের কোনো এক স্থানে রয়ে গেছে। প্রাকৃতিক দৃষ্টি, ফুলের গন্ধ, আবহাওয়ার মাদকতা–সবকিছুর মূলেই ঐ ভেরোনিকা, সবকিছুর লক্ষ্য কিন্তু একমাত্র সেই। জন চব্বিশ বছরের তখন এক যুবা, কোনো এক সময় ভেরোনিকাকে সে তার মন দিয়েছিল, তার প্রেমের জোয়ারে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছিল, সমস্ত মন-প্রাণ দিয়েই তাকে ভালোবেসেছিল, কিন্তু তাদের ভালোবাসার ঘর বেশিদিন টিকল না, তাই বিচ্ছেদ হয়ে গেল, জন পালিয়ে বেঁচেছিল।

কিন্তু আজ আবার এতদিন পরে তাকে সে ফিরে পেয়েছে, তাকে ছেড়ে যেতে মনের দিক থেকে কিছুতেই সাড়া পাচ্ছে না–আজ আর জন পালিয়ে যাবে না।

.

০৯.

জন ক্রিস্টো বাদামগাছের বন থেকে সবুজ ঘাসের মুক্ত প্রাঙ্গণে ঘরের ঠিক পাশটাতে এসে উপস্থিত হল। আকাশজুড়ে তখন চাঁদের আলো। জ্যোৎস্না-সাত বাড়িটাকে তখন অদ্ভুত লাগছিল। জানলায় পর্দা ঝোলানো ছোট বাড়িটার রূপমুগ্ধকর অপূর্ব সৌন্দর্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর! হাত ঘড়ির দিকে জন সময়টা দেখে নিল।

ঘড়িতে তখন ঠিক তিনটে। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে জন ক্রিস্টো। তখন দেখে মনে হচ্ছিল ভেতর ভেতর সে বড় উদ্বিগ্ন। সে এখন আর প্রেমে অন্ধ চব্বিশ বছরের যুবক নয়। এখন সে একজন বিচক্ষণ বিষয়ী লোক, তার বয়স এখন চল্লিশ ছুঁই-ছুঁই। তার মনে এখন জলের মতো স্বচ্ছ এবং শান্ত স্থির।

জনের মনের হলল, সে খুব বোকা, সত্যি খুব বোকা ছিল। এই জন্য তার কোনো অনুতাপ নেই। অতীতে ভালো-মন্দ যা কিছু ঘটে গেছে তার কোনো সমাধান বোধহয় হয়নি, জন নিজের কাছে হেরে গিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে এসেছে–তাই ভেরোনিকাকে মন থেকে সম্পূর্ণ ভাবে মুছে ফেলতে পারেনি। ভেরোনিকা আজ এসে উপস্থিত হয়েছিল যেন স্বপ্নের মতোইজন কিন্তু সেই স্বপ্নকে মেনে নিয়ে তাকে অনুসরণ করেই পথ চলতে শুরু করেছে। এখন কি রাত তিনটে, ভেরোনিকার সঙ্গে সে তিনঘন্টা কাটিয়ে এসেছে। সে যেন তার দল থেকে পালিয়ে এসেছে, ভেরোনিকাই যেন তার সম্পূর্ণ মূল্য আদায় করে নিল। জন সম্বন্ধে সকলের ধারণা কোথায় নেমে গেল! জার্দা কী ভাবল? আর হেনরিয়েটা? হেনরিয়েটাকে সে কোনোদিন গ্রাহ্য করেনি। একনিমিষে তাকে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতে বোধহয় অসুবিধা হবে না। কিন্তু জাদা? জার্দাকে বোঝনোর ক্ষমতা তার নেই।

জন কিন্তু কিছুতেই হারতে চায় না। জীবনের সব সুযোগই সে হাত পেতে নিতে চায় এইজন্য সে সব ঝুঁকি নিতেও প্রস্তুত। রোগীদের চিকিৎসার ব্যাপারে সে সব ঝুঁকি নিয়ে এক, পায়ে খাড়া-গবেষণায় কোনো ঝুঁকি নেই, আবিষ্কারের ক্ষেত্রেও বোধহয় এই ঝুঁকিটা নেই। তবে সে কিন্তু খুব বড় মাপের ঝুঁকি নিতে চায় না–নিরাপত্তা যাতে বিঘ্নিত না হয়, আবার সুবিধেও খুব সহজে মিলে যায়–এমন ঝুঁকিরই সে পক্ষপাতিত্ব করে আসছে বরাবর। জাদা যদি কিছু অনুমান করে থাকে? জার্দার যদি বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ থেকে থাকে তবে তো সবই জার্দাকে মুখ ফুটে সে কি কিছু বলবে? জার্দাকে সে আর কতটুকু জানে? তার সম্বন্ধে কোন ব্যাপারে সে কি কোনোদিন আগ্রহ প্রকাশ করেছে? সহজ কথাটা জাদা ভালোই বোঝে। জন যদি জার্দাকে বলেও থাকে যে, সাদাকালো হয়ে গিয়েছে–সেটা সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করবে, কিন্তু এরকম জিনিষকে সে কী বলে বোঝাবে..সে যখন বিজয়িনীর পেছন পেছন পরাজিতের মতো অনুসরণ করে উপস্থিত। এখন সকলে কী মনে করবে?

ভেরোনিকা তার সুডোল উচ্চ শরীরী গঠন ও সুঠাম দেহসৌন্দর্য নিয়ে জনকে মোহিত করেছিল, পরাস্ত করেছিল, তাকে জয় করে চুম্বকের ন্যায় আকর্ষণী শক্তির টানে টেনে নিয়ে বসাল। জন ভেবে কোনো কিছুরই কুলকিনারা করতে পারল না। খেলার টেবিলে বসে কে কী মনে করল না করল। তারা কী জনের মধ্যে পনেরো বছরের সেই পূর্বের প্রেমে পাগল হওয়া যুবককে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছে? অথবা এমনও হতে পারে তার মধ্যে তারা এক কর্তব্যপরায়ণ ভদ্রলোকের দর্শন লাভ করেছে। এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র কোনো ধারণা নেই।

জন কিন্তু সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তার ভীতির কারণ হলো তার শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য, অসামাজিক আচরণের জন্য, নিজের জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে। সে যেন সম্পূর্ণ রূপে এক পাগল হয়ে উঠেছিল–সমস্ত শালীনতার বেড়াজাল টপকে উন্মাদের মতো ভেরোনিকাকে অনুসরণ করেছিল সে, মন্ত্রচালিতের মতো এখন তার দশা। সে যে এতটা পাগল হয়ে উঠতে পারে তাকে কী বিশ্বাস করতে চাইবে? এই গভীর রাতে সকলেই এখন নিদ্রায় আচ্ছন্ন, বসার ঘরের ফরাসি জানলা তার পথ চেয়েই আধখোলা অবস্থায় পড়ে রয়েছে–জন ফিরে যাবে এই জন্যই ভোলা রাখা হয়েছে। সে আবার মুখ তুলে নিরীহ নিদ্রিত বাড়িটার দিকে একবার তাকাল। বাড়িটাকে দেখে আরও যেন নিরীহ এবং নির্দোষ বলে মনে হতে লাগল।

সে আবার পথ চলতে শুরু করে দেয়। সে শুনতে পেল অথবা কল্পনার জগৎ থেকেই সে শুনতে পেল বাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে-দরজা বন্ধ হবার স্পষ্টধ্বনিও তার কানে এসে বাজল।

সে মুখ ঘুরিয়ে সুইমিং পুলের দিকে একবার চেয়ে দেখল, কেউ যদি তাকে অনুসরণ করে সেখানে এসে থাকে। কেউ হয়তো তাকে অনুসরণ করে এসেছিল এবং পরে গিয়ে বাগানের দরজা দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। হয়তো দরজা বন্ধ হবার শব্দটাই তার কানে এসেছে।

সে তাড়াতাড়ি করে জানলার দিকে তাকায়। পর্দার ফাঁক দিয়ে কেউ কি তাকে প্রত্যক্ষ করছিল, পরে হয়তো জানলা বন্ধ করে দিয়েছে। ঐ ঘরটা কি হেনরিয়েটার?

জনের একবার ইচ্ছে হল, কতকগুলো পাথরকুচি জানলায় ছুঁড়ে মারে, তারপর চিৎকার করে হেনরিয়েটাকে ডাক দেয়।

হেনরিয়েটা! জনের প্রাণ হঠাৎ করে কেঁদে ওঠে। কোনো অবস্থাতেই সে হেনরিয়েটাকে হারাতে পারবে না।

তার চিৎকার করে বলতে মন চাইছিল, এসো হেনরিয়েটা, ঘরে না থেকে বেরিয়ে এসো, আমার সঙ্গেই না হয় বেড়াতে চলল! বেড়াতে বেড়াতে শো ভোনডাউন পর্যন্ত চলে যাব। আমার মনের সব কথা তোমার কাছে উজাড় করে দেব–আমার যত কথা তোমাকে আজ ধৈর্য ধরে শুনতে হবে। আমার কথা তোমার বোধগম্য হবে কিনা জানি না, আমার জীবনের কোনো কথা তোমার অজানা নয়–যদি কিছু তোমার অজানা থেকেও থাকে, তবে এসো সব খুলে বলবো।

জন হেনরিয়েটাকে তার মনের না-বলা যে কথা বলতে চেয়েছিল : আমি আবার প্রথম থেকেই শুরু করছি। আজ থেকে আমার নতুন জীবন শুরু হল। সে জিনিষটার আকর্ষণ আমাকে পেছনে টেনে নিয়ে চলছিল, পঙ্গু অবস্থায় আমাকে ফেলে রেখেছিল, বর্তমানে সেটা এখন পড়ে গিয়েছে। আজ বিকেলে তুমি আমায় ঠিক কথাই বলেছিলে। নিজের কাছ থেকেই আমি পালিয়ে বাঁচতে চাই। বছরের পর বছর ধরে আমি সেটাই করে আসছিলাম। আমি এখনও উপলব্ধি করতে পারিনি, যে এটা শক্তি, না দুর্বলতা, যা আমাকে ভেরোনিকার কাছ থেকে সরিয়ে এনেছিল। নিজেকে দেখেই আমি ভয় পেয়ে যেতাম, জীবনকে ভয় পেতাম, তোমাদের কাছ থেকেও ভয় পাবার আশঙ্কা মনে থেকেই যেত।

যদি সে হেনরিয়েটাকে একবার জাগাতে পারতো, তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারতো বনের মধ্যে গিয়ে তাকে নিয়ে যদি কোথাও বসতে পারতো, যেখানে একত্র হয়ে প্রত্যক্ষ করতে পারতো পৃথিবীর বুকে সূর্যের নেমে আসার দৃশ্য।

নিজেকে সে নিজেই পাগল ভাবতে লাগল। থরথর করে কাঁপছিল। সেপ্টেম্বরের শেষের শীত, ভালো ঠান্ডা, তাই সে কাঁপছিল, জন নিজের উদ্দেশ্যেই নিজেকে প্রশ্ন করে, তোমাকে কোনো ভূতে পেয়েছে নাকি? নেহাতই পাগল তুমি! একটা রাত তুমি পাগলের মতোই ব্যবহার করেছ। তুমি যদি অক্ষত থাকতে পার, জানবে তুমি সত্যিই ভাগ্যবান।

সারাটা রাত বাড়ির বাইরে কাটিয়ে ভোরের আলো ফুটতে তাকে বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখে জার্দা কিছু ভাবলেও ভাবতে পারে?

এ ব্যাপারে এ্যাঙ্গক্যাটেলদের মনের ধারণা কী হবে বা হতে পারে? এ্যাঙ্গক্যাটেলদের জন্য জনের তেমন মাথাব্যথা নেই, কারণ গ্রীনউইচ্ টাইম মেনে তারা চলেন। তাছাড়া, লেডি এ্যঙ্গক্যাটেলের কাছে অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার যুক্তিযুক্ত বলে মনে হতে পারে। কিন্তু জার্দা তো আর লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল নয়। জার্দাকে একটু অন্যরকম ভাবে বোঝাতে হবে এবং যত শীঘ্র জার্দাকে বোঝানো যায় ততই মঙ্গলের।

জাদা স্বয়ং যদি তাকে অনুসরণ করে থাকে?

না, ভালো লোকেরা সাধারণত এমন করে না। একজন চিকিৎসক হিসেবে সে শুধু এটাই জানে যে, উচ্চমনা, ভাবপ্রবণ এবং সম্মানিত ব্যক্তিরা কীভাবে চলে। তারা ডাক্তারের কথাও শোনে আবার পরের চিঠি খোলার ব্যাপারেও অসীম উৎসাহ এবং মাঝেমধ্যে প্রয়োজন পড়লে গোয়েন্দাগিরিও করে থাকে–এই কাজ যে তারা কিছুক্ষণের জন্য মনের দিক থেকে সমর্থন জানায় তা নয়, তীব্র দৈহিক যাতনা বা মনস্তাপও তাদের দুঃসাহসী হয়ে ওঠার ব্যাপারে সাহায্য করে।

শয়তান বেচারা! জন মনে মনে ভাবে যে, শয়তানরূপী মানুষ এরা! ডাক্তার ক্রিস্টো মানুষদের বহু দৈহিক যাতনা ও মানসিক যন্ত্রণার কথা জানে। দুর্বলতার জন্য তার মোটেও দয়ামায়া নেই, মানুষের যন্ত্রণায় সে মোহিত হয়। কারণ সে মনেপ্রাণে এই সত্যে বিশ্বাসী যে, জগতে সবলরাই বেশি যন্ত্রণা ভোগ করে থাকে।

জাদা যদি জেনে থাকে?

মূর্খ! সে নিজেকেই নিজের মুখে তিরস্কার করে। জার্দা কেন জানতে যাবে? গভীর ঘুমে সে এখন আচ্ছন্ন। তার কোনো কল্পনা নেই, কোনো কালে অবশ্য ছিলও না।

ফরাসি জানলা দিয়ে সে আবার ঢুকে পড়ল, একটা আলো জ্বেলে ভালো করে জানলা বন্ধ করে দিল। তারপরে ঘরের আলো নিভিয়ে চলে গেল। হলে তখন আলো জ্বলছে–সে তাড়াতাড়ি করে অথচ ধীর পদক্ষেপে উপরে উঠে এল। দ্বিতীয় একটা বোতাম টিপে হলের আলো নিভিয়ে দিয়ে সে শোবার ঘরের দরজায় হাতলের ওপর হাত রেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। পরে হাতল ঘুরিয়ে ঘরে প্রবেশ করে।

সারা ঘর গুমোট অন্ধকার, ঘুমন্ত জার্দার নিশ্বাসের শব্দ তার কানে এসেছিল। জন ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতেই জার্দা নড়েচড়ে ওঠে। ঘুমের মধ্যে তার অস্পষ্ট স্বর শুনতে পেল।–কে জন?

হা।

এত দেরি হলো কেন? এখন ক’টা বাজল?

সহজ ভঙ্গিতেই জন উত্তর দেয়, ক’টা বাজছে ঠিক বলতে পারবো না, তবে তোমার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটালাম বলে আন্তরিক ভাবেই আমি দুঃখিত। ঐ স্ত্রীলোকটির সঙ্গে গিয়ে আমাকে মদ ছুঁতে হয়েছে।

সে নিজের স্বরকে নিদ্রাচ্ছন্ন এবং বিরক্তিকর করেই তোলে।

জার্দা বলে ওঠে, শুভরাত্রি জন!

জন বিছানাটা পাতার সঙ্গে সঙ্গেই স্প্রিং-এর শব্দটা কানে বাজল।

সব ঠিকঠাক আছে। বরাবরই তার ভাগ্য তাকে সব ব্যাপারে সহযোগিতা করে আসছে। মাঝেমধ্যে সে খুব বিপদে পড়ে যায়। এবং প্রতিবারই তার মনে হয়, খারাপ যদি কিছু ঘটে যায়? কিন্তু প্রতিবারই সে বেঁচে গেছে, কোনোবারই কিছু খারাপ হয়নি। ভাগ্যই সবসময় তার পাশে থেকে তাকে রক্ষা করে এসেছে।

তাড়াতাড়ি করে পোষাক পাল্টে নিজেকে বিছানায় এলিয়ে দিল। মনে মনে ভাবে, কী ভাগ্য! এটা তারই করুণা, যিনি তোমার মাথার ওপর অবস্থান করছেন…আর ভেরোনিকা! আমার ওপরে তার প্রভাব ক্রমেই বিস্তার করে চলেছে, একথা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই।

কিন্তু আর নয়, বালিকা! একটা অন্ধ আবেগে অভিভূত হয়ে সে যেন বলেই চলে, সব শেষ হয়ে গেল, আমি তোমাকে ত্যাগ করলাম।

.

১০.

পরের দিন সকাল দশটা নাগাদ জন নিচে নেমে আসে। পাশের টেবিলে তখন প্রাতঃরাশ পর্ব চলছে। জার্দা বিছানাতেই ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়েছে–তাকে সেখানেই তার খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। সে নিচে আসেনি, কারণ তার ব্যবহার কাউকে যদি অপ্রস্তুত করে তোলে এই ভয়েই সে আরো ভেতরে ভেতরে বিব্রত বোধ করছিল।

জন ভাবে, এ্যাঙ্গক্যাটেলদের মতো লোকের দল যারা এখনও খানসামা, পাঁচক, চাকর প্রভৃতি পুষে চলেছে তারা ইচ্ছে করলেই তাদের কিছু কাজ দিতে পারেন।

আজ সকাল থেকে জার্দার জন্য জনের খুব মায়া হচ্ছিল। মনে যে দুর্বলতা এতক্ষণ ধরে তাকে পীড়া দিচ্ছিল, এখন তা মরে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

স্যার হেনরি এবং এডওয়ার্ড কেনাকাটা করার উদ্দেশ্যে বাইরে গেছেন, লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের মুখ থেকেই তিনি প্রথম শোনেন। তিনি নিজে বাগানের বাস্কেট এবং গাছ নিয়ে ব্যস্ত। জন তার সঙ্গে কথা বলে কিছুক্ষণ কাটিয়ে দিল, এই সময়ে গাজন একটা রেকাবে করে একটা চিঠি এনে হাজির হলো, সে বলে ওঠে, স্যার লোক মারফত এই চিঠিটা এসে পৌঁছেছে।

জন তাকিয়ে দেখে, চিঠিটা খোলে, ভেরোনিকার কাছ থেকেই এসেছে। জ্ব যুগল ঈষৎ কুঞ্চিত করে লাইব্রেরির মধ্যে এসে চিঠিটা খোলে, ভেরোনিকা লিখেছে : আজ সকালের দিকে একবার এসো, তোমার সঙ্গে বিশেষ প্রয়োজন। ভেরোনিকা।

সে ভাবে, প্রভুত্বব্যাঞ্জক এই চিঠি। তার যাওয়ার একদম ইচ্ছে নেই, কিন্তু চিন্তা করে দেখেছে যে এই ব্যাপারের নিষ্পত্তি হওয়া দরকার, এক্ষুনি তাকে যেতে হবে।

লাইব্রেরির জানলার ঠিক বিপরীতমুখী রাস্তা ধরে সুইমিং পুলের পাশ দিয়ে সে এগিয়ে চলল, সুইমিং পুলটা ঠিক যেন একটা শাঁস, এর থেকে অসংখ্য রাস্তা বের হয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে, একটা পাহাড়ের ওপর বনের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে, একটা ঘরের ওপর দিককার ফুলের বাগান থেকে, একটা গোলা থেকে, একটা এসে সরাসরি লনের সঙ্গে মিশেছে–এই রাস্তা ধরেই সে এগিয়ে চলেছে। এই লন ধরে কয়েক গজ এগোলেই ‘ডাভকোট’। ‘ডাভকোট’ নামের বাড়িটা।

আধা-কাঠের বাড়ির জানালা থেকে ভেরোনিকা সেইকথাই ভাবছিল। সে অবশ্য আগে থেকেই জনের প্রতীক্ষায় বসেছিল। ভেরোনিকার বাড়িটা দেখতে সত্যিই সুন্দর, শিল্পীমনের পরিচয় ফুটে উঠেছে তার সর্বাঙ্গে। জনের মনে হল, শিল্পসৌন্দর্যের থেকে বিশেষভাবে দাম্ভিকতা যেন আত্মপ্রচারে সদা ব্যস্ত।

ভেতরে এসো জন, আজ সকালটায় বড্ড শীত পড়েছে।

বসার ঘরে আগুন জ্বালানো ছিল। ঘরটা ঈষৎ সাদা রঙের, সারা ঘর পাংশু বর্ণের সোফায় সজ্জিত। তার দিকে তাকিয়ে বিচারের চোখ নিয়ে আজ দিনের আলোতে ভোেনিকাকে ভালোভাবে দেখল। কাল হয়তো এত ভালো করে দেখার সুযোগ হয়নি। যে ভেরোনিকাকে সে একদিন জানতো সে ভেরোনিকা আর নেই। তার মধ্যে এখন আমূল পরিবর্তন এসে গেছে। সপ্তদশী বালিকাকে আজ বত্রিশ বছরের ভেরোনিকার মধ্যে কোন্ মিল চোখে পড়বে।

সত্যি বলতে কী, জনের মনে হয় যে, ভেরোনিকার রূপের ছটা আগের থেকে অনেক বেশি সুন্দর। সে নিজেও সে ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন এবং সর্বদা সে নিজের সৌন্দর্য বাড়াতে সচেষ্ট। নিজের দেহের কিসে দেহজ সৌষ্ঠব বাড়ে এবং কী কী পন্থায় তার দেহের যত্ন নিতে হবে তা সে ভালোভাবেই বোঝে। তার গাঢ় সোনালি রঙের কেশ এবং রুপোলি প্লাটিনাম রঙে রাঙিয়ে উঠেছে। তার –যুগলও অন্যরকম ছিল, এখন তাতে প্রকাশের তীব্রতা অনেক বেশি। কোনোদিনই সে নির্বোধ সৌন্দর্যের অধিকারী ছিল না। তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্না অভিনেত্রী হিসেবেই তার সুনাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ডিগ্রিও সে অর্জন করেছিল ও স্ট্রিন্ডবার্গ ও সেক্সপীয়ারের ওপর গবেষণাও করেছিল। তার ব্যাপারে একটা জিনিষ বড্ড খারাপ লেগেছিল যে, সে একজন স্ত্রীলোক হয়ে একগুয়ে প্রকৃতির ছিল–জনের কাছে যেটা সত্যিই অস্বাভাবিক বলে মনে হয়েছিল।

ভেরোনিকা নিজের পথেই চলতে অভ্যস্ত এবং মাংসের মসৃণ সুন্দর সীমারেখার মধ্যে তার লৌহসঙ্কল্প জনের কাছে বড়ই কুৎসিত ঠেকে।

ভেরোনিকা বলে ওঠে, আমি তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি, কারণ আমাদের কিছু কথা হওয়ার আছে, বলতে বলতে সে বাক্স-ভরা সিগারেট জনের দিকে এগিয়ে ধরে। সে বলে ওঠে, আমাদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে পরিকল্পনা করার কথা ভেবেই তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি।

জন একটা সিগারেট তুলে ধরায় এবং বেশ ভদ্র ভাবেই তার বক্তব্য শুরু করে, কিন্তু আমাদের সত্যি কোনো ভবিষ্যৎ আছে কি?

ভেরোনিকা তার প্রতি কটাক্ষ দৃষ্টিতে তাকায়, বলে ওঠে…, তুমি কী বলছ জন? আমাদের নিশ্চয়ই একটা ভবিষ্যৎ আছে। পনেরোটা বছর আমরা হেলায় নষ্ট করেছি, এরপর সময় নষ্ট করা বোধহয় উচিত হবে না।

জন নীরব থাকে।

একটু পরে আবার বলে ওঠে, সত্যি আমি দুঃখিত, ভেরোনিকা তুমি আজ যা কিছু বকে যাচ্ছ আমার মনে হয় তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। তোমাকে দেখার পর আমি খুশী আর চেপে রাখতে পারিনি। তোমাকে দেখার আনন্দে আমি আবার পূর্বের জীবনে ফিরে গেছি, আগের মতো অধীর হয়ে পড়েছি। কিন্তু তোমার আর আমার জীবনের চলার পথ এখন একদম পাল্টে গেছে, কোথাও কোন মিল নেই, তারা পরস্পর বিরোধী।

ভেরোনিকা সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, তুমি কী আবোল-তাবোল বকে যাচ্ছে জন। আমি তোমাকে ভালোবাসি এবং তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমরা পরস্পর পরস্পরের কাছ থেকে দুরে সরে গেলেও আমরা উভয়েই এখনও প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ। অতীতে তুমি ভীষণ একগুঁয়ে স্বভাবের ছিলে, কিন্তু সেকথা ভেবে এখন আর লাভ নেই! আমাদের জীবনে সংঘাত হবার কোনো আশঙ্কা নেই, আমি তোমাকে আমেরিকা যাবার জন্য অনুরোধ করছি না, আমি যে ছবিতে কাজ করেছিলাম তা এখন সমাপ্তির পথে, তাই সোজা লন্ডনের মঞ্চে অভিনয় করার জন্য যেতে চাইছি। আমার আশ্চর্যজনক একটা নাটক আছে–এল্ডারটন–আমার কথা ভেবেই এটা রচনা করেছেন। এই নাটকে আমি অতুলনীয় কৃতকার্যতা লাভ করবো–আমার কথা মিলিয়ে নিও।

সে ভদ্রতার সঙ্গে বলে ওঠে, তুমি যে তোমার কাজে সাফল্য পাবে এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।

ভেরোনিকা–তুমিও তোমার ডাক্তারি চালিয়ে যেতে পারো, আমি তো শুনেছি যে নামকরা চিকিৎসক হিসেবে তোমার এখন যথেষ্ট হাঁকডাক।

জন–কিন্তু প্রিয় বান্ধবী, আমি বিবাহিত, ছেলেমেয়েও আছে।

ভেরোনিকা–আমিও বিবাহিত হয়ে যেতে পারি। এসব ব্যাপার খুব সহজেই হয়ে যায় এবং একজন ভালো উকিল সবকিছু ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। বরাবরই তুমি আমার প্রিয়, তোমাকে বিবাহ করার জন্য আমার মন সবসময়ের জন্যই প্রস্তুত ছিল। আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না, তোমার প্রতি আমার এই উগ্র আকর্ষণের কারণটা কি? এখন সব দিক ভেবে এই সত্যটাই উপলব্ধি করতে পেরেছি যে, একমাত্র বিবাহেই এই সমস্যার সমাধান হতে পারে।

জন–আমি সত্যিই দুঃখিত, ভেরোনিকা, কোনো ভালো উকিল এলেও বোধহয় কিছু করতে পারবে না। আমাদের আবার নতুন করে ঘর বসানো যায় না, কারণ দু’জনের মধ্যে মনের মিলের বড়ই অভাব।

ভেরোনিকা–গত রাতের ঘটনার পরেও না?

জন–তুমি শিশু নও ভেরোনিকা। তোমার কমপক্ষে একজোড়া পতিদেবতা এবং কম করে একাধিক প্রেমিক আছে। গতরাতের ঘটনায় এমন কি আর ঘটেছে? কোনো অঘটন যে ঘটেনি তা তোমার থেকে আর ভালো কে জানবে।

ভেরোনিকা–হে আমার প্রিয় জন, সেই গুমোট ঘরে তুমি যদি নিজের মুখটা স্বচক্ষে একবার দেখতে পেতে। তবে তোমার বুঝতে অসুবিধে হতো না যে, তুমি পুনরায় সান মিগুয়েলে ফিরে গেছ কিনা!

জন (দীর্ঘশ্বাস ফেলে)–সান মিগুয়েলে আমি ফিরে গিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু তুমি একটু বোঝার চেষ্টা করো ভেরোনিকা, আমার জীবনে তোমার সঙ্গে এভাবে দেখা হওয়া সুদূর অতীতে টেনে নিয়ে গিয়েছিল, তুমিও যেন সেই অতীতের এক বাসিন্দা। কিন্তু আজ আজ একেবারেই অন্যরকম। আজ আমি সে সময়ের চেয়ে পনেরো বছরের বড়। আজকে আমার সম্পূর্ণ পরিচয় পেলে তোমার বোধহয় ভালো লাগবে না, পরিচয় না পেলে তুমি হয়তো আমাকে মানুষ বলেই জ্ঞান করতে।

ভেরোনিকা–আমার থেকে তুমি তোমার স্ত্রী এবং সন্তান সন্ততিদের ব্যাপারে বেশি উৎসাহী এবং তাদেরই তুমি প্রাধান্য দিচ্ছ।

জন–তোমার অসুবিধে হচ্ছে না তো?

ভেরোনিকা–কিন্তু জন, তুমি তো আমাকে ভালোবেসেছ?

জন–সত্যি আমি দুঃখিত ভেরোনিকা।

ভেরোনিকা–তুমি আমাকে আগের মতো আর ভালোবাসো না?

জন–এই বিষয়ের একটা নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। তুমি নিঃসন্দেহে অপরূপা, অনিন্দ্যসুন্দরী রমণী তুমি, কিন্তু আমি তোমায় ভালোবাসি না।

ভেরোনিকা নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো এমনভাবে বসে রইল যে, দেখলে হঠাৎ করে মোমর পুতুল ভেবে ভ্রম হলেও হতে পারে। তার এই ধৈর্য জনকেও বিচলিত করে তুলল।

ভেরোনিকা যখন তার মুখ খুলল, তার মুখ দিয়ে এমন বিষ ঝরতে লাগল যে, জন ভয়ে দু-পা পিছিয়ে গেল।

ভেরোনিকা-কে সে?

জন–সে? তুমি কার কথা বলতে চাইছ?

ভেরোনিকা–গতরাতে অগ্নিকুণ্ডের ওপরের তাকের পাশে যে স্ত্রীলোকটি বসেছিল?

জন ভাবতে থাকে, হেনরিয়েটা হবে হয়তো? কিন্তু সে ভেরোনিকার কি ক্ষতি করতে চাইবে?

উচ্চকণ্ঠে বলে ওঠে, তুমি কার কথা বলছ? মিডগে হার্ডক্যাসল? ভেরোনিকা-মিডগে? চৌকো দেহের সেই মহিলাটির কথা বলছ?

-না, আমি তার কথা বলিনি, তোমার স্ত্রীর প্রসঙ্গেও কিছু বলছি না। আমি সেই উদ্ধত শয়তানিটার কথা বলছি, শুধু তার মুখ চেয়েই তুমি আমাকে আজ খালি হাতে ফিরিয়ে দিচ্ছ। তোমার স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে অন্তত নৈতিকতার কোনো ভান কোরো না। তুমি ঐ স্ত্রীলোকটার জন্যই আমার প্রতি বিমুখ হচ্ছ।

ভেরোনিকা উঠে এসে জনের খুব কাছে তার গা ঘেঁষে বসে পড়ল। আঠারো মাস আগে ইংল্যান্ডে আসার সময় থেকেই তোমার কথা ভেবে চলেছি, তুমি এ সবের কিছুই জান না। আমি বাড়ি করার জন্য এই বিশ্রী স্থানটা বেছে নিলাম তুমি কোনোদিন কল্পনা করতে পারবে? আমি জেনেছিলাম যে, তুমি মাঝেমধ্যেই এ্যাঙ্গক্যাটেলদের সঙ্গে ছুটি কাটাতে এখানে উপস্থিত হও। এখানে থাকলে তোমার সান্নিধ্য পাব এই আশা নিয়েই এই জায়গায় আমার বাড়ি করা।

জন–গতরাতে তাহলে পরিকল্পনা করেই এখানে হাজির হয়েছিল?

ভেরোনিকা–জন, তুমি আমার! তুমি চিরকালই আমার ছিলে!

ভেরোনিকার সুন্দর মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়েছিল অপূর্ব রূপের এক দ্যুতি, অফুরন্ত খুশি জনকে সে আলিঙ্গন করে বসে। বুকের মধ্যে সজোরে টেনে এনে চুম্বন করে।

জন–আমি কারুর নই ভেরোনিকা। জীবনে কি এখনও সে শিক্ষা তুমি পাওনি যে, মানুষের দেহ ও মনের অধিকারী কেউ হতে পারে না? আমি যখন বয়সে যুবা ছিলাম, সেই সময় তাকে ভালোবেসেছিলাম। আমার জীবনের সঙ্গে তোমাকেও কাছে পেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি তখন ফিরিয়ে দিয়েছিলে!

ভেরোনিকা–আমার জীবন এবং জীবিকা তোমার থেকে অনেক বেশি মূল্যবান ছিল। যে কেউ ইচ্ছে করলেই ডাক্তার হতে পারে!

জন একথা শোনার পর ক্রুদ্ধ হয়। তুমি নিজেকে যতটা অত্যাশ্চর্য মনে করো ভেরোনিকা, তুমি আসলে কি তাই?

ভেরোনিকা–তুমি বলতে চাইছ যে, আমি এখনও বৃক্ষের চূড়ায় আরোহণ করতে পারিনি। হয়তো এখনও পারিনি। কিন্তু এবার করব! নিশ্চয়ই করব!

জন বিতৃষ্ণার দৃষ্টি নিয়ে ভেরোনিকার দিকে তাকাল।আমি মনেপ্রাণে একথা বিশ্বাস করতে পারি না যে, তুমি বৃক্ষচূড়ায় আরোহণ করবে। তোমার মধ্যে একটা জিনিষের বড় অভাব ভেরোনিকা। আমার মনে কী হয় জানতোমার পাশবিক এবং ছিনিয়ে নেওয়ার শক্তি হয়তো আছে–নেই শুধু প্রকৃত উদারতা।

ভেরোনিকা আর বসে থাকতে পারে না, উঠে পড়ে। শান্তকণ্ঠে সে বলে ওঠে–আমাকে তুমি পনেরো বছর আগের ‘আমিতে’ ফিরিয়ে দিয়েছিলে। আজকে আবার তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছ। তোমার এই কর্মের জন্য তুমি একদিন আপসোস করবে–দুঃখও পেতে পার, তবে তোমাকে আমি দুঃখ দিয়েই ছাড়ব, জন।

জন উঠে দরজার দিকে এগিয়ে চলে। সে বলে, আমি যদি তোমার অন্তরে ব্যথা দিয়ে থাকি তার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত ভেরোনিকা। তুমি সত্যিই সুন্দর, তুমি আমার যথেষ্ট প্রিয়, তোমাকে আমি আরও একবার ভালোবাসতাম! তার বলা শেষ হলে জন ভেরোনিকাকে চুম্বন করে। ভেরোনিকার হাত ধরে মিনতির সুরে বলে ওঠে, মনে কিছু কোরো না লক্ষ্মীটি, আমরা কি আমাদের ভালোবাসাকে এই সীমা পর্যন্ত রেখে দিতে পারি না?

ভেরোনিকা–বিদায় জন, আমরা আমাদের ভালোবাসাকে ঠিক এই জায়গাতেই ছেড়ে দিচ্ছি না। একদিন ওটাকে তোমায় গ্রহণ করতে হবে। আমার মনে হয়, এই জগতে আমি যদি সব থেকে কাউকে বেশি ঘৃণা করি সে তুমি–মানুষ বোধহয় কোনো মানুষকে এমন ঘৃণা করতে পারে না।

জন নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ে। সে বলে, আমি দুঃখিত, বিদায় ভেরোনিকা।

বনের মধ্যে দিয়ে জন আবার ফিরে গেল। সুইমিং পুলের কাছে এসে সে একটা বেঞ্চের ওপর বসে পড়ল। ভেরোনিকার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে তার জন্য সে মোটেই অনুতপ্ত নয়। সে আপন মনেই ভাবতে থাকে, পক্ষপাতশূন্য ভাবে বলতে গেলে ভেরোনিকা মোটেই ভালো স্বভাবের নয়। বরাবরই তার হাবভাবটা এইরকম। এখন তার মন তৃপ্ত এই ভেবে যে, ভেরোনিকার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করে এসেছে, তার জীবনে এটাই বোধহয় সব থেকে ভালো কাজ যা সে করতে পেরেছে। সময় থাকতে থাকতে সে যদি সম্পর্ক ছেদ না করে তো, ভগবান জানেন অদৃষ্টে কি ঘটতো! তবে একটাই সুখ, অতীতের নাগপাশ থেকে এখন সে পুরোপুরি মুক্ত। তাই নতুন ভাবে। জীবন শুরু করার ব্যাপারে তার আর কোনো বাধা থাকতে পারে না। এখন সে মুক্ত বিহঙ্গ। কয়েকটা বছর তাকে কতই না দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। মনে কখনো শান্তি পায়নি। কিন্তু জাদা নিঃস্বার্থভাবে তাকে খুশী করতে, তার মনোরঞ্জন করার আশায়, কত না আপ্রাণ চেষ্টাই সে দিনের পর দিন করে চলেছে। জার্দার ব্যাপারে সে তাহলে আগের থেকে অনেক বেশি সদয় হবে।

হেনরিয়েটাকে সে আর নির্যাতন করবে না। শাসন করা যায় বলেই কি তাকে শাসন করা উচিত?-হেনরিয়েটা তো সেরকম স্বভাবের মেয়ে নয়। তার ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেলেও নিশ্চল-নিথর হয়েই সে দাঁড়িয়ে থাকে, বিস্ফারিত নেত্রে সে একথাই ভাবতে থাকে।

জন ভাবে, আমি গিয়ে হেনরিয়েটার কাছে সব কথা খুলে বলব। হতচকিত হয়ে সে তাকাল, অপ্রত্যাশিত কোনো ছোট্ট শব্দে সে বিব্রত বোধ করল। বনের মধ্যে থেকে গুলির শব্দ কানে আসছিল, সেই সঙ্গে ছিল বনের স্বাভাবিক শব্দ, পাখির কাকলি, পাতা-ঝরার মৃদু ঝঝর শব্দ, বাতাসের শ-শন্ আওয়াজ। কিন্তু এই শব্দের আওয়াজটা ছিল অন্য ধরনের–ক্ষীণ প্রণালীবদ্ধ একটি টিকটিক ধ্বনি।

হঠাৎ করে বিপদের আশঙ্কায় জন সচকিত হয়ে ওঠে। কতক্ষণ সে এভাবে বসেছিল? আধঘণ্টা? কেউ হয়তো তাকে লক্ষ্য করেছে। কেউ হয়তো

আবার সেই প্রণালীবিদ্ধ টিকটিক্ আওয়াজহা, সেই শব্দ–কিন্তু সে কী করবে কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিল না, তাই সে দ্রুততার সঙ্গে কোনো ভূমিকা নিতে পারল না।

বিস্ময়ে তার চোখ বড় হয়ে গেল, কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের করার মতো শক্তি তার ছিল না।

গুলির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে জন মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হাত-পা এলিয়ে সুইমিং পুলের কিনারে এসে তার দেহ অবিন্যস্ত ভাবে পড়ে রইল।

তার বুকের ঠিক বাম দিকের একটা কালো দাগ থেকে ধীরে ধীরে রক্ত নিঃসৃত হয়ে সুইমিং পুলের কংক্রিটের কিনারা থেকে বিন্দু বিন্দু করে নীল জলে এসে মিশতে লাগল।

১১. হারকিউল পৈরট

১১.

হারকিউল পৈরট জুতো থেকে সর্বশেষ ধুলোকণাটি ঝেড়ে ফেলে দিল। সে খুব যত্নসহকারে লানচন-পার্টির জন্য পোষাক চড়িয়েছে, তার বেশভূষা ভালো হওয়ায় মনের দিক থেকে সেও খুশী। সে জানত, ইংল্যান্ডের গ্রামে রবিবারে কেমন পোষাক ব্যবহার করা হয়, কিন্তু ইংরেজি ধারণার বশবর্তী সে নয়। তার কাছে শহরতলীর চতুরতা অনেক বেশী পছন্দের। ইংল্যান্ডের পল্লীর ভদ্রলোক সে নয়। সে হারকিউল পৈরট! সে অবশ্য এটাই স্বীকার করে যে, পল্লীগ্রাম তার কোনোদিন পছন্দের ছিল না। কিন্তু বন্ধুদের অনুরোধ সে উপেক্ষা করতে পারেনি বলেই বিশ্রামাগার কিনতে সে দ্বিধা বোধ করেনি। এই বিশ্রাম আশ্রয়ের আকারটাই তার খুব পছন্দ, আর কোনো বিষয়ে তার আসক্তি নেই। চৌকো বাক্সের মতোই এই বাড়িটা, পারিপার্শ্বিকের দৃশ্যও খুব মনোরম, হারকিউল জানতো যে, প্রাকৃতিক দৃশ্য যখন ভালো তো হবেই–তাতেও তার মন ওঠে না, কারণ গাছপালার বিন্যাসে তার রুচি কোনোদিনই ছিল না–কেমন যেন বুনো-বুনো। গাছের পাতা ঝরানোকে সে ভাবে নোংরা স্বভাব–এই জন্যই সে গাছ তেমন কোনোদিনই পছন্দ করে না, পপলার গাছকে সে বরদাস্ত করতে পারে। এই অবসর বিনোদনের পোতাশ্রয়ের মধ্যে তার কাছে সব থেকে আকর্ষণীয় হলো–ছোট সবজির বাগানটি–বেলজিয়ামের মালী ভিক্টরের নিপুণ হস্তের পরিচ্ছন্ন কাজ। ইতিমধ্যে ফ্রাঙ্কয়েস, মালীর স্ত্রী, সযত্নে মালিকের পাকস্থলির সেবায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করেছে।

হারকিউল পৈরট সদর দরজা পেরিয়ে যায়, দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর একবার নিজের চকচকে জুতোজোড়ার দিকে তাকাল, পাংশু-ধূসর হমবর্গের হ্যাঁটের সঙ্গে কোনো মিল হচ্ছে কিনা পুনরায় আরও একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিল, এবং রাস্তার এদিকে-ওদিকে তাকাতে থাকল।

ডাভকোট দেখার পর সে চমকে ওঠে। ডাভকোট এবং রেস্টহেভন প্রতিদ্বন্দ্বী দুই নির্মাতার তৈরি। একটা বাক্সে ছাদ দিয়ে নানাধরনের আধুনিক কলাকৌশলে বানানো হয়েছে রেস্টহেভন। অর্ধেক কাঠ ব্যবহার করে প্রাচীন যুগের সব কারুকার্য যেন একত্র করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ছোট ডাভকোট বাড়িটাতে। ন্যাশনাল ট্রাস্ট আর তার বেশি কিছু করতে দেয়নি, তার কারণ, তাদের মনে ভয় ছিল, পল্লীর শ্রী এতে বিঘ্নিত হতে পারে। দুটি বাড়ি যেন চিন্তাশীল দুই ব্যক্তিবিশেষের সৃষ্টির ফল।

হারকিউল পৈরট আপন মনেই মহড়া দিতে শুরু করে দেয়, সে কীভাবে ‘হলোতে গিয়ে উপস্থিত হবে। তার অজানা ছিল নামে, একটু উপরের দিকে একটা গেট এবং একটা পথও আছে। এই পথ সদর রাস্তার চাইতে অন্তত আধমাইল দূরত্ব কমিয়ে দিতে পারে। আদবকায়দায় পটু হারকিউল পৈরট দীর্ঘপথটা ধরেই এগিয়ে চলল এবং সদর দরজা দিয়েই অন্দরমহলে প্রবেশ করল।

স্যার হেনরি এবং লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের বাড়ি পৈরটের এটাই বোধহয় প্রথম আগমন। যেভাবে নিমন্ত্রিত বিশিষ্ট অতিথিদের সদর দরজা দিয়ে আসাটাই আধুনিক কালের ফ্যাশন।

নিমন্ত্রিত হয়ে পৈরট মনে মনে বেশ খুশীই হয়েছিল। তাছাড়া, বাগদাদ থেকে এ্যাঙ্গক্যাটেলদের ওপরই বরাবরই তার ধারণা খুব ভালো ছিল, বিশেষ করে লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের ওপর।

ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় সময় মিলিয়ে পৈরট এসে হাজির হল। সে যখন সদর দরজার ঘন্টায়। হাত রাখল, ঘড়িতে তখন একটা বাজতে এখনও এক মিনিট বাকি। মনে মনে সে খুবই খুশী কারণ সময় বুঝেই সে উপস্থিত হতে পেরেছে। এতটা পথ হেঁটে আসার জন্য শরীরটা একটু ক্লান্ত লাগছিল, হাঁটার ব্যাপারে কোনোদিনই অভ্যাস নেই।

সুসজ্জিত পোষাকে গাজন এসে দরজা খুলে দিল, পৈরট মনে মনে বেশ খুশীই হয়। কিন্তু যেমন অভ্যর্থনা সে মনে মনে আশা করেছিল, অভ্যর্থনাটা তেমন ভাবে না পেয়ে সে একটু মুষড়ে গেল।

গৃহকত্রী সুইমিং পুলের কাছে একটা তাবুতে আছেন, আপনি কী স্যার কষ্ট করে এদিকে একবার আসবেন? গাজন বলে ওঠে!

ইংরেজদের বাড়ির বাইরে বসে থাকার প্রবৃত্তি দেখে হারকিউল পৈরট বরং ক্ষুব্ধই হয়। গ্রীস্মাধিক্যের সময় এই খেয়াল সহ্য করা গেলেও এই সেপ্টেম্বরের শেষে সে সুযোগ কোথায়! দিনটায় ঠান্ডার আমেজ থাকলেও হাওয়ায় যেন একটা আর্দ্রতা–শরতে প্রায়ই এমনটা দেখা যায়। এই সময়টা অগ্নিকুণ্ড মুক্ত বসবার ঘরটাই যথেষ্ট আরামদায়ক। কিন্তু ফরাসি জানলা দিয়ে একটা মুক্ত জায়গার ভেতর দিয়ে রকারি পেরিয়ে একটা ছোট দরজার মধ্যে দিয়ে বাদাম গাছের ভেতর দিয়ে যে রাস্তাটা গিয়েছে তাকে সেই পথেই নিয়ে যাওয়া হল।

এ্যাঙ্গক্যাটেলদের বরাবরই অভ্যাস একজন অতিথিকেই নিমন্ত্রণ করা এবং আবহাওয়া ভালো থাকলে ককটেল পার্টিও সুইমিং পুলের পাশের তাবুতেই অনুষ্ঠিত হয়। লাঞ্চ টাইমের সময় অবশ্য একটা তিরিশ মিনিটে, তাই এ সময়ের মধ্যে অনিয়মানুবর্তী অতিথিও এসে উপস্থিত হবে।

হারকিউল পৈরটের কাছে ব্যবস্থা বেশ ভালো বলেই মনে হয়। নিমেষের মধ্যে তার মনে হল যে, যেখান থেকে সে শুরু করেছে সেখানে আবার ফিরে যাবে।

নিজের জুতোর প্রতি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সে গাজনকে নিঃশব্দ অনুসরণ করল।

ঠিক এই সময়ে সামনের দিক থেকে একটা চিৎকার শোনা গেল। এরজন্য পৈরটের বিরক্তি বোধহয় আরও বহুগুণ বেড়ে গেল। এই ব্যাপারটা তার কাছে খুবই অযৌক্তিক অনুচিত মনে হতে থাকল। পরে যখন সে এই অবস্থার কথা ভাবল, সেই সময়ে ভয়, হাতাশা আর বিস্ময়ে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে পরিবেষ্টিত করে রেখেছিল। সে শুধু এইটুকু বলতে পারে যে, এই ব্যাপারটা সত্যিই অপ্রত্যাশিত।

হারকিউল পৈরট সুইমিং পুলের চতুর্দিকের মুক্ত স্থানে পা রাখতেই চমকে ওঠে। ক্রোধে সে তখন শক্ত কাঠ হয়ে গেছে। পৈরটের মনে হয়, বাড়াবাড়ির মাত্রাটা বোধহয় একটু বেশি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে–হ্যাঁ, খুব বেশিই মনে হচ্ছে। এ্যাঙ্গক্যাটেলদের সে এত সস্তা মনের ভাবে না। অনেকদূর হেঁটে আসা-বাড়িতে বিমুখ হওয়া–এখন আবার সেই একইরূপের বাহার। ইংরেজদের সত্যিই কী অশোভন কৌতুক।

সে এত ভীষণভাবে রেগে গিয়েছিল এবং এমনভাবে একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে এই কৌতুকের মাধ্যমেই।

সে যেন একটা কৃত্রিম হত্যাকাণ্ডের পৈশাচিক দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছে। পুলের পাশে কৃত্রিমভাবে সজ্জিত হয়ে পড়ে আছে একটি প্রাণহীন দেহ, বাইরে থেকে হাতটা এলিয়ে পড়েছে এবং লাল প্রসাধন যেন কংক্রিট থেকে পুলের নীল জলে গড়িয়ে পড়েছে। মৃতদেহটা এক সুদর্শন পুরুষের যার মস্তকে সুন্দর চুলের কেশরাজি। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে মধ্যবয়সী বেঁটে সুডোল এক স্ত্রীলোক যার হাতে ধরা রিভলবার। তার মুখ জুড়ে বিরাজমান অদ্ভুত উদাস এক অভিব্যক্তি।

আরও তিনজন অভিনেতা ছিলেন। দূরে পুলের ঠিক ধারে দাঁড়িয়েছিল এক যুবতী, যার মাথার কেশ গাঢ় বাদামী রঙা শরতের পাতার সাদৃশ্য টেনে আনছিল, তার হাতে ধরা ছিল ঝুড়ি ভরা ডালিয়া ফুল। একটু দূরত্বে লম্বা দেহের একজন ভদ্রলোককে চোখে পড়েছিল, পরনে ছিল শিকারীর কোট। বন্দুক হাতে সে দাঁড়িয়েছিল। তার ঠিক বামদিকে দাঁড়িয়ে আছে এক বাস্কেট ডিম হাতে গৃহকত্রী, লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল। হারকিউল পৈরটের কাছে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, সুইমিং পুলের চতুর্দিক থেকে অনেক রাস্তা এসে সেখানে মিশেছিল। ব্যাপারটা ছিল কিছুটা গাণিতিক এবং কিছুটা কৃত্রিম। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে এখন কী করবে? তারা তার কাছ থেকে কি আশা নিয়ে এসেছিল? সে কি এই অপরাধ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করবে না বিশ্বাসের ভান করবে? সে কি হতাশা না ভয় প্রকাশ করবে? সে কি তার গৃহকর্তাকে বলবে, আঃ, ইহা খুব রমণীয়, আমার জন্য আপনারা কী ব্যবস্থা নিয়েছেন?

আসলে, সমস্ত ব্যাপারটা ঘটেছে অনেকটা নির্বোধের মতোই। রানী ভিক্টোরিয়া নাকি বলেছিলেন, আমরা হাসি-তামাসা-আনন্দটুকু পর্যন্ত করতে পারলাম না। পৈরটের মুখে ঠিক ঐ ভাষাই এসে উপস্থিত হয়েছিল, আমি পৈরট, কৌতুক বা আনন্দ বোধ অনুভব হয় না।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল মৃতদেহের দিকেই এগিয়ে গেলেন। তাকে অনুসরণ করতে করতে গাজন জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে এগিয়ে যাচ্ছিল। পুলের অন্যদিক থেকে দুজন লোক এগিয়ে আসছিল, তারা এখন নিকটে এসে দাঁড়ায়।

পৈরটের একবার মনে হলো, সে যেন ছায়াচিত্রের ছবি দেখানোর উদ্দেশ্যে এখানে হাজির হয়েছে। কিন্তু তবু সে উপলব্ধি করল, কৃত্রিমতার মধ্যেও একটা সত্য লুকিয়ে আছে।

নিচে পড়ে থাকা লোকটির দিকে তার চোখ গেল, সে ভালোভাবে তাকে প্রত্যক্ষ করল মৃত, না হলেও মৃতের সমান।

রিভলবার হাতে যে লোকটি মৃতদেহের পাশটিতে এসে দাঁড়িয়েছিল, পৈরট একবার তার দিকে তাকাল। তার মুখে অনুভূতির লেশমাত্র নেই–সম্পূর্ণ উদাস দৃষ্টি। নেহাতই এক নির্বোধের মতন মুখ করে সে দাঁড়িয়েছিল।

সে ভাবে, সত্যি কী অদ্ভুত!

গুলি ছুঁড়ে সে কি সবকিছু হারিয়ে বসেছে? সমস্ত আবেগ এবং অনুভূতি কি নিঃশেষ হয়ে গেল? বর্তমানে তার অবস্থা কি একটা গুলির মতোই মূল্যহীন ও অসাড়? এখন হয়তো তার হাবভাব ঐরকমটাই হয়ে গিয়েছে।

পরে সে গুলিবিদ্ধ লোকটার দিকে একবার দৃষ্টি দিল। মৃত্যুপথযাত্রীর হা-হা করছিল চোখগুলো। তার সুগভীর নীল চোখে অভিব্যক্তির এমন বিচিত্র রূপ ফুটে উঠেছিল যেটা পড়তে পৈরটের মতো লোকেরও অসুবিধে হচ্ছিল, কিন্তু তাকে সে গভীর সতর্কতা বা অবগতি বলেই বর্ণনা করেছিল।

কিন্তু হঠাৎ করে পৈরটের মনে হলো যে, এখানে উপস্থিত সব লোকের মধ্যে একজনকে দেখেই জীবন্ত বলে মনে হচ্ছিল–যে লোকটি মৃতপ্রায় তাকে এই মুহূর্তে প্রকৃত জীবন্ত বলেই মনে হচ্ছিল পৈরটের। জীবনের এমন সুন্দর অভিব্যক্তি, এমন নিখুঁত প্রকাশ এর আগে আর কোনো লোকের মধ্যে পৈরট প্রত্যক্ষ করেনি। অন্যসব অভিনেতা যেন বিবর্ণ, শ্রীহীন এবং ছায়ার মতো। কিন্তু প্রকৃত লোক বলতে ছিল এই ব্যক্তিই।

জন ক্রিস্টো মুখ খুলল এবং কথা বলল। তার স্বর ছিল সবল, বিস্ময়হীন এবং দরকারী। সে বলে ওঠে-হেনরিয়েটা

এই কথা বলার পরে তার চোখের পাতা বুজে গেল, তার মাথা পাশে ঝুলে পড়ল।

হারকিউল পৈরট হাঁটু গেড়ে বসল, নিশ্চিত হওয়ার পরেই উঠে দাঁড়াল। যন্ত্রচালিতের মতো নিজের পোযাকের ধুলো ঝেড়ে সে বলে ওঠে, হা, সে আর বেঁচে নেই।

ছবি ভেঙে গেল, কেঁপে উঠল এবং নতুন রশ্মিসম্পাতে পুনর্গঠিত হল। এখন তার মধ্যে প্রস্ফুটিত হল ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া–খুব সাধারণ তুচ্ছ ঘটনাসমূহ। পৈরট নিজের সম্বন্ধে যথেষ্ট সজাগ ছিল। কান আর চোখ খোলা রেখেছে–এই দুটোর সাহায্যেই সে সবকিছু লিপিবদ্ধ করছে।

একটা ব্যাপার সে লক্ষ্য করছিল যে, লেডি এ্যাক্যাটেলের হাত থেকে ডিমের ঝুড়িটা পড়ে যাচ্ছিল–তাড়াতাড়ি করে এগিয়ে এসে গাজন ধরে নেয়। যন্ত্রচালিতের মতো গাজনকে ধন্যবাদ জানিয়ে ইতস্তত হয়ে বলে ওঠেন, জার্দা

রিভলবার হাতে স্ত্রীলোকটি নড়ে চড়ে বসল। সে তার চারপাশে সকলের দিকে একবার তাকিয়ে নিল। সে কথা বলছিল–কিন্তু ভাষা কিছুই বোধগম্য হল না–অবিন্যস্ত কতগুলো বিক্ষিপ্ত আওয়াজ শুধু শোনা গেল।

সে বলে ওঠে, জন মারা গেছে, জন আর বেঁচে নেই।

তড়িৎগতিতে কটা চুলের লম্বা যুবতীটি আভিজাত্যের ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে বলে ওঠে, জার্দা, ওটা আমার কাছে দাও।

পৈরট কোনোরকম বাধা দেবার আগেই জার্দা ক্রিস্টোর হাত থেকে রিভলবারটা নিয়ে নিল।

পৈরট তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নেবার আশায় অগ্রসর হল। সে বলে ওঠে, আপনার এমন করা মোটই উচিত নয় মহাশয়া।

যুবতীটি তার কণ্ঠস্বরে হঠাৎ চমকে যায়, তার হাত থেকে রিভলবারটা সোজা এসে পুলের জলে পড়ে।

অত্যন্ত অপ্রস্তুতের সঙ্গেই সে ওঃ!’ বলে পৈরটের দিকে ক্ষমাপ্রার্থীর মতোই তাকিয়ে রইল। পরে শুধু বলল, আমি কি এতই বোকা! আন্তরিকভাবে অমি দুঃখিত!

কিছুক্ষণের জন্য কোনো কথা বলার ভাষা খুঁজে পেল না পৈরট। সে একজোড়া জলভরা চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল এবং ভেবেও নিল, তার সাময়িক সন্দেহ অমূলক কিনা। সে আস্তে আস্তে ধীরে সুস্থে কোনোরকমে উচ্চারণ করে, কোনো জিনিস স্পর্শ করা বোধহয় উচিত হবে না। সবকিছু যেমন আছে, ঠিক তেমনি ভাবে রেখে দিতে হবে–পুলিস এসে স্বচক্ষে দেখবে।

সবার মধ্যে তখন চাপা উত্তেজনা দেখা দিল–একটা অস্বস্তি যেন চারিদিকে ঘুরে বেড়াতে লাগল।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল মৃদুস্বরে বলে ওঠেন, অবশ্য–আমার মনে হয়, হা, পুলিসই

শিকারীর কোট পরনে লোকটা বলে ওঠে, আমার ভয় হচ্ছে, লুসি, এই ঘটনাটা হয়তো ঘটতই।

সেই নীরবতার মধ্যেও পদশব্দ এবং গোলমাল কানে এল। সেই পথ ধরে সার হেনরি এ্যাঙ্গক্যাটেল এবং মিডগে হার্ডক্যাসল হাসতে হাসতে এদিকেই এগিয়ে আসছিলেন।

পুলের ধারে লোকদের দেখামাত্র তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন ব্যাপার কি? কী হয়েছে?

তার স্ত্রী বললেন, জার্দা–পরে তাড়াতাড়ি করে বলে ফেললেন, আমি বলছি–জন—

হতবুদ্ধির মতো মুখ করে বলে ওঠে, গুলি করে জনকে মারা হয়েছে। সে আর বেঁচে নেই।

সকলে বিব্রত হয়ে তার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল তাড়াতাড়ি করে বলে ওঠেন, আমার মনে হয়–এই সময়ে জার্দার গিয়ে শুয়ে পড়া উচিত। এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে আমাদের সকলেরই উচিত বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া। হেনরি তুমি আর পৈরট এখানে হাজির থেকে পুলিসের জন্য অপেক্ষা করতে পার।

সেটাই বরং একপক্ষে ভালো হবে। গাজন, তুমি বরং পুলিসকে একটা ফোন করে দাও, যা যা ঘটেছে তা বলে দিও, পুলিসকে এখানেই নিয়ে আসবে।

লম্বা দেহের লোকটি সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, এসো জাদা, এই বলেই সে অন্য স্ত্রীলোকদের সঙ্গে নিয়ে চলে গেল। জার্দা যেন স্বপ্নের ঘোরে তাদের অনুসরণ করে এগিয়ে চলেছে। গাজন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সকলকে যাবার নির্দেশ দিয়ে ডিমের ঝুড়ি হাতে নিঃশব্দে তাদের অনুসরণ করল।

স্যার হেনরি স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে ওঠেন, এসব কী ব্যাপার? আসলে কী ঘটেছে?

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল মিছিমিছি হাত-পা নেড়ে অসহায়ের ভঙ্গি করলেন। হারকিউল পৈরট মাধুর্য এবং আবেদন উপভোগ করছিল।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, ঠিক কী ঘটেছে আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়, কারণ মুরগী নিয়ে আমি কাজে ব্যস্ত ছিলাম। বেশি দূরে, নয় খুব কাছ থেকেই একটা গুলির আওয়াজ কানে এসেছিল, তখন আমি এই ব্যাপারটা সম্বন্ধে কিছুই ভাবতে পারিনি, পরে পুলের কাছে আসতে চোখে পড়ল জনের নিথর দেহ এবং জার্দা রিভলবার হাতে পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। এইসময় হেনরিয়েটা এবং এডওয়ার্ড সেখানে এসে উপস্থিত হল।

পুলের অন্য প্রান্তে যেখানে বনের রাস্তা দুটো এসে এক হয়েছে, সেই স্থানটা তিনি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।

হারকিউল পৈরট এবার মুখ খোলে। সে জানতে চায়, এরা কারা? জন এবং জার্দা? আমি . কি জানতে পারি?

-হা, হা নিশ্চয়ই। এই দুর্ঘটনার জন্য কারো সঙ্গেই আর পরিচয় হয়ে ওঠেনি। জন হল ক্রিস্টো, ডাক্তার ক্রিস্টো। জাদা ক্রিস্টো তার স্ত্রী, জবাবে বলে ওঠেন লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল।

যে স্ত্রীলকোটি মিসেস ক্রিস্টোর বাড়ি গেলেন, তবে উনি কে?

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, আমার খুড়তুতো বোন, হেনরিয়েটা স্যাভারনেক।

পৈরটের বাঁ-দিক থেকে একটা গোলমাল কানে আসতে লাগল। পৈরট ভেবে নেয়, হেনরিয়েটার এটা বলা বোধহয় উচিত নয়, সে অবশ্য ভবিতব্য রূপেই জেনে ফেলেছে।

মুমুর্মু লোকটা ‘হেনরিয়েটা’ কথাটা কোনোক্রমে উচ্চারণ করেছিল। তার বলার কায়দাটা ছিল সত্যিই অদ্ভুত…বলার ভঙ্গিটা এমন ছিল যে পুরোনো অনেক কথা পৈরটকে স্মরণ করিয়ে দেয়…এই সময়ে একটা ঘটনার কথা তার মনে পড়ে যায়…একথার অর্থ কী? মৃত্যুপথযাত্রী কী বলতে চেয়েছিল?..হেনরিয়েটাকে জন কি কিছু বলতে চেয়েছিল?…লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, ইনি আমাদের এক খুড়তুতো ভাই এডওয়ার্ড এ্যাঙ্গক্যাটেল এবং মিস হার্ডক্যাসেল।

পৈরট মাথা নত করে তাদের সঙ্গে পরিচয় পর্ব সারলেন। বিকারের মতো হাসি হাসছিল মিডগের মুখে, সে কোনোরকমে অতিকষ্টে হাসি দমন করে। স্যার হেনরি বলে ওঠেন, আমার মনে হয়, আমার পরামর্শ অনুযায়ী তোমাদের এখন বাড়ি যাওয়াই উচিত। আমার মিস্টার পৈরটের সঙ্গে দু-একটা বিষয়ে আলোচনায় বসা প্রয়োজন।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল চিন্তিতমুখ নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি বলে ওঠেন, জার্দা বোধহয় শুয়ে পড়েছে। এর থেকে বেশি আর কী বলা যেতে পারে তাকে? আমার কিছুতেই মাথায় আসছে না। এরকম একটা ঘটনা সত্যি বড় একটা ঘটে না। যে স্ত্রী লোক ঠান্ডা মাথায় এইমাত্র তার স্বামীকে খুন করেছে, তাকে আর কী বলা যায়?

প্রশ্নের জবাবের আশায় তিনি তার দিকে উদগ্রীব নয়নে তাকিয়ে রইলেন। পরে অবশ্য বাড়ি ফিরে গেছেন। মিডগে তাকে অনুসরণ করেছে।

পৈরট স্যার হেনরির সঙ্গেই থেকে গেল।

হেনরি সর্বপ্রথম কথা বললেন, তিনি কিছুতেই ভেবে উঠতে পারলেন না, কী বলা তার উচিত। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, ক্রিস্টো নিঃসন্দেহে উপযুক্ত ব্যক্তি–খুবই ভালো এবং অত্যন্ত উপযুক্ত…।

পৈরট আরও একবার মাটিতে পড়ে থাকা প্রাণহীন দেহটার দিকে তাকাল। তার এখন মনে হচ্ছে যে, মৃতলোকটি এখনও জীবন্ত লোকদের থেকে অনেক বেশি জীবন্ত। সে এই ভেবে অবাক হয় যে, তার মানে কেন এমন ধারণা হল! ভদ্রমুখেই সে হেনরিকে বলে, এমন একটা ঘটনা সত্যিই বড় মর্মান্তিক।

স্যার হেনরি বলে ওঠেন, এসব ব্যাপার সম্পূর্ণ আপনার লাইনে পড়ে, আমার লাইনের নয়। আমার তো কেবলই মনে হচ্ছে এরকম একটা হত্যাকাণ্ডের এত কাছে এসে এর আগে কোনোদিন বোধহয় আসিনি। আশা করি, এতক্ষণ ধরে আমি যে পথে হেঁটে চলেছি, সেটা ঠিক পথই ছিল। কি বলেন?

পৈরট বলে ওঠে, হা, নিয়মানুসারে ঠিক ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছে। পুলিসকে খবর দেওয়া হয়েছে, যতক্ষণ না পুলিস এসে পৌঁছচ্ছে, আমাদের কিছুই করণীয় নেই–শুধু একটা বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, কেউ যেন মৃতদেহটার নিকটে না যেতে পারে বা সাক্ষ্য প্রমাণের অবলুপ্তির কোনো কারণ না ঘটে।

শেষ শব্দটা উচ্চারণ করার সময়ই পৈরট একবার মৃতদেহটার দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল, রিভলবারটা ঠিক জলের নিচে কংক্রিটের ওপর পড়ে আছে, নীল জলে কিছুটা হয়তো বিকৃত হয়েছে।

সে ভাবে, সে বাধা দেবার আগেই পূর্বের প্রমাণাদি সব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু না–সেটা একটা নিছক দুর্ঘটনা।

স্যার হেনরি বিরক্তির সুরে মৃদুকণ্ঠে বলে ওঠেন, তাহলে একবার ভেবে দেখুন, আমাকে কী ব্যাপার না সামলাতে হচ্ছে? ঠান্ডা বোধহয় একটু বেশি পড়েছে, আসুন এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে তাঁবুর মধ্যে গিয়ে বরং বসি। হাঁড় কাঁপানো ঠান্ডা বহুক্ষণ ধরে পায়ে এসে ঠেকায় অত্যধিক শীতে সে কাঁপছিল, এই প্রস্তাবে তাই সে সানন্দেই রাজী হয়ে যায়।

তাবুটা পুলের ঠিক পাশেই ছিল এবং তাবু থেকে পুল, মৃতদেহটা এবং বাড়ি যাওয়ার রাস্তা–যে পথ দিয়ে পুলিস আসবে, সবই চোখে ধরা পড়ছিল।

তাবুটা সুন্দরভাবে চেয়ার-টেবিল দিয়ে সজ্জিত এবং মদ্যপানের সুবন্দোবস্তও এখানে মজুত ছিল। সুচিত্রিত টেবিলে ট্রেতে গ্লাস রাখা এবং তার পাশেই ছিল শেরি ইত্যাদি মদের বোতল। ককটেল হওয়ার এটাই ছিল উপযুক্ত স্থান, এখানে ককটেল হওয়ার কথা ছিল।

স্যার হেনরি বলে ওঠেন, একটু পান করলে কেমন হয়? না থাক, পুলিস না আসা পর্যন্ত আমাদের এখানকার কোনো জিনিষই স্পর্শ করা উচিত নয়। অবশ্য এই কনকনে ঠান্ডায় একটু কিছু পান না করলে পুলিসের খুব অসুবিধার কারণ কিছু ঘটবে না, তবু কিছু না করাই সবদিক থেকে নিরাপদ। গাজনের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে যে এখনও ককটেলের ব্যবস্থা করে উঠতে পারেনি। সে বোধহয় আপনাদের প্রতীক্ষাতেই বসে ছিল।

দু’জনে দুটো কঞ্চির চেয়ার অধিকার করে দরজার কাছে এসে বসলেন, পুলিসের আবির্ভাবের দৃশ্যটা যাতে তাদের চোখে ধরা না পড়ে।

তারা নীরবে বসে রইলেন। এমনও অনেক সময় আসে, কোনো কিছু বলার মতো ক্ষমতা যখন মানুষের থাকে না।

পৈরট তাবুর সর্বত্র খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছে, তার কাছে অস্বাভাবিক ধরনের কিছু নজরে পড়ে কিনা। হঠাৎ তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে, একটা চেয়ারের পেছন দিককার পোষাকের গলদেশের অংশে–একটা প্ল্যাটিনাম ফক্স। সে এই ভেবে অবাক হয়ে যায় যে, এটা কার হতে পারে। বাহ্যাড়ম্বরপ্রিয়, আত্মপ্রচারকারি, জাঁকজমকপ্রিয় লোকদেরই এই জিনিস থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু এতক্ষণ পর্যন্ত সে যাদের দর্শন করেছে এ জিনিষ তাদের থাকার কথা নয়। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের কাঁধে এমন পদার্থ সে কল্পনাতেও আনতে পারে না।

এই জিনিষটা হাতে লাগার পর থেকে পৈর ভেতরে ভেতরে বিব্রত বোধ করে। আত্মপ্রচারে নেমে যাদের সুখ একমাত্র তাদের কাছেই এই জিনিষটা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু যাদের সে দেখছে, তাদের কারোরই এমন স্বভাবের থাকা সম্ভব নয়।

হেনরি বলে ওঠেন, আমরা নিশ্চয়ই ধুমপান করতে পারি। তিনি তার সিগারেটের কেসটা পৈরটের দিকে এগিয়ে ধরলেন।

সিগারেট নেওয়ার আগে পৈরট একবার নিঃশ্বাস টেনে দেখল–ফরাসি সুগন্ধ–দামী মূল্যের ফরাসি সৌরভ। সে যাদের এতক্ষণ ধরে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করেছে তাদের কারো পোষাক থেকেই এমন সুগন্ধ আসছিল না।

পৈরট চেয়ারে হেলান দিয়ে সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করার সময়েই তার দৃষ্টি চলে যায় চেয়ারের ঠিক পাশেই একটা ছোটমাপের টেবিলের ওপর। কতগুলো দেশলাই–মোট ছটা দেশলাই।

পৈরট খুব অবাক হয়–তার ধারণা এগুলো থেকেই সে হয়তো কোনো অজানা ব্যাপার জেনে যাবে।

.

১২.

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, ঘড়িতে এখন আড়াইটে। বসার ঘরে মিডগে এবং এডওয়ার্ডকে সঙ্গে নিয়েই বসেছিলেন। পেছন থেকে যার হেনরির পড়ার ঘর থেকে কথাবার্তার আওয়াজ কানে আসছিল। হারকিউল পৈরট, স্যার হেনরি এবং ইনসপেক্টর গ্র্যাঞ্জ সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল সঙ্গে সঙ্গে এক দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলে ওঠেন, আমি এখনও এটাই ভেবে চলেছি লাঞ্চের জন্য এ ব্যাপারে কারো উদ্যোগ নেওয়া উচিত। কিছুই ঘটেনি, এই মনে করে ডাইনিং টেবিলে লাঞ্চ খেতে বসে গেলে বড় নিষ্ঠুরতা হবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।

কিন্তু অন্য দিকটা দেখারও প্রয়োজন আছে। পৈরটকে তো লাঞ্চের জন্য এখনই নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল–সে হয়তো ক্ষুধার্ত পেটেই বসে থাকবে। তাছাড়া, জনের নিহত হওয়ার ঘটনা আমাদের নিকট যতটা হৃদয়বিদারক তার কাছে ততটা নাও হতে পারে। আমি অবশ্য নিজের আহার নিয়ে ভাবছি না, কিন্তু সারাটা বিকাল শিকার করে হেনরি এবং এডওয়ার্ডের ক্ষুধার্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক।

এডওয়ার্ড এ্যাঙ্গক্যাটেল সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, লুসি আমার জন্য অযথা চিন্তা কোরো না।

তুমি তো বরাবরই বিচার-বিবেচনা করে কাজ করো, এডওয়ার্ড, তোমার কথা না হয় ছেড়ে দিলাম–কিন্তু ডেভিড–আমি গতরাতে ডিনারের সময় লক্ষ্য করেছি যে, সে ভালোই খেতে পারে। যাদের মস্তিষ্কের কাজ বেশি হয় তাদের বেশি পরিমাণ খাদ্যেরও প্রয়োজন হয়। হা। হ্যাঁ, ভালো কথা, ডেভিড কোথায়? দেখছি না তো।

মিডগে বলে ওঠে, সে এই ঘটনা শোনার পর সোজা নিজের ঘরে চলে গেছে।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, হ্যাঁ, তার চিরকালই হাভভাবটা এইরকম, এসব ব্যাপারে সে বড্ড বিরক্ত হয়। অবশ্য হত্যাকাণ্ড বিরক্তিকর ব্যাপারও বটে–এই ব্যাপারে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে চাকরের দল, সব কাজে অগোছালো ভাব! আমাদের লাঞ্চে হাঁসের মাংসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল –সৌভাগ্যের বিষয় এটাই যে, ওটা ঠান্ডা খেতেও সুস্বাদু লাগবে। জার্দার জন্য কী ব্যবস্থা করেছ? একটা কিছুর স্ট্রং স্যুপ?

সত্যিই, লুসি বড়ই অমানুষ।–মিডগে মনে মনে ভাবতে থাকে। কিছুক্ষণ পর সে আপনমনেই মুক্তির অনুসন্ধানে নেমে পড়ে নয়তো লুসি সবই ভাবে সব জিনিষ গ্রহণে ব্যথিত হয়েও সকলের কথাই ভেবে চলেছে। চাকরদের কাজে ত্রুটি-বিচ্যুতি, খাওয়ার জন্য চিন্তা, ক্ষুধার উদ্রেক ইত্যাদি সকল বিষয়ে উপস্থিত সবাই মনে মনে ভাবছে–কিন্তু লুসি সবার মনের ভাবকে ভাষায় রূপান্তরিত করছে। এই মুহূর্তে সে নিজের ক্ষুধার্ত এবং ভেতরে ভেতরে অসুস্থ বোধ করছে।

আসলে যে সমস্যাটা এখন স্ত্রীলোকদের নিকট সম্মুখীন হয়েছে যারা তাকে বেচারী জার্দা বলে ভাবত, আজ সে খুনে-আসামী! সত্যিই বিপজ্জনক-বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি। একবাক্যে সকলেই বিব্রত।

মিডগে ভাবে, অন্য লোকের ক্ষেত্রে যদি এমনটা ঘটতে পারে, তবে আমাদের মতো মানুষের জীবনে এই ঘটনা ঘটতে পারে না?

সে এডওয়ার্ডের ঘরের দিকে একবার তাকাল। সে ভাবে, এডওয়ার্ডের মতো মানুষের এমনটা কখনোই হতে পারে না। এডওয়ার্ডকে তার মায়া হয়। সে কত শান্ত, বিচার-বুদ্ধিশীল, দয়ালু এবং ভদ্র।

গাজন ঘরে প্রবেশ করে গৃহকত্রীর উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, মহাশয়া খাবার টেবিলে আমি স্যান্ডউইচ এবং কফি রেখে দিয়েছি।

ওঃ, তোমাকে ধন্যবাদ গাজন!

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, গাজন সত্যিই অবাক করে দেয়। আমি ওকে ছাড়া এক মুহূর্ত চলতে পারি না, সে না থাকলে আমার যে কী উপায় হবে। গাজন ঠিক সময় মতো তার কাজ করে যায়। স্যান্ডউইচ-লাঞ্চের-ইত্যনুরূপ এবং এতে হৃদয়হীনতারও কোনো কারণ ঘটতে পারে না। আমার বক্তব্য কি তোমাদের বোধগম্য হয়েছে?

মিডগে হঠাৎ করে কেঁদে ওঠে, তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে বিন্দু বিন্দু অশ্রু।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল অবাক হয়ে আপন মনেই বিড়বিড় করতে থাকেন, তিনি বলেন, প্রিয় বোনটি, তুমি বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলছ।

এডওয়ার্ড সোফায় এসে মিডগের পাশে বসে তার কাঁধে হাত রাখে। সে সান্ত্বনার সুরে বলে ওঠে, ধৈর্য হারিও না, মিডগে। এডওয়ার্ডের কাঁধে মুখ লুকিয়ে হাপুস নয়নে অবিরাম ধারায় চোখের জল ফেলতে থাকে মিডগে। তার মনে পড়ে যায় একবার আইন্সউইক-এ বড়দিনের ছুটিতে তার শশক মারা গেলে এডওয়ার্ড তাকে কতই না প্রবোধ দিয়েছে।

এডওয়ার্ড ধীরে ধীরে বলে ওঠে, একটা বড় আঘাত সে পেয়েছে। তাকে একটু ব্র্যান্ডি দেওয়া যায় কি, লুসি?

বোধহয় খাবার টেবিলে পাওয়া যাবে। আমি ঠিক করতে…হেনরিয়েটা ঘরে পা রাখতেই কান্নায় সে ভেঙে পড়ে। মিডগে চুপচাপ বসেছিল। তার মনে হল, এডওয়ার্ড কাঠ হয়ে শান্ত মনে নীরবে বসে আছে। মিডগে ভাবে, হেনরিয়েটার মনের কী অনুভব? সে ভেবেছিল যে, সে তার দিদির মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারবে না–কিন্তু সেরকম কোনো কিছুই দৃষ্টিতে পড়ল না। হেনরিয়েটার মুখে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন দেখা গেল না। সে দীপ্তকণ্ঠে মাথা উঁচু করে এসে প্রবেশ করল, তার মুখে বিবর্ণতার চিহ্ন মাত্র নেই, বরং চাতুর্যের ছাপটাই পরিস্ফুট। তাকে দেখে লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, ওঃ তুমি এসেছ, হেনরিয়েটা? তোমার কথাই বসে আমি ভাবছিলাম। পুলিস, হেনরি আর পৈরটের সঙ্গে বসে কথা বলছে। জার্দাকে তুমি কি দিতে পেরেছ? ব্র্যান্ডিং অথবা চা এবং অ্যাসপিরিন?

আমি তাকে একটু ব্র্যান্ডি এবং গরম জলের একটা বোতল দিয়ে এসেছি।

সম্মতির সুরে লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, ভালো কাজ করেছ–এই জন্যই তোমাকে ফাস্ট-এইড ক্লাসের বলা যেতে পারে। আঘাতের জন্য গরম জলের বোতল–ব্র্যান্ডি নয় কারণ এতে একটা প্রতিক্রিয়া হয়–তবে জাদার কাছে ওটা কোনো আঘাত নয়–আমি ঠিক বলতে পারি, না, স্বামীকে হত্যা করার পর স্ত্রী-মনের যে কী অনুভূতি হয়–এটা এমনই একটা মনের ব্যাপার যা কেউ ভাষা দিয়েও ব্যক্ত করতে পারে না–তবে আর যাই হোক–এটা তেমন কোনো আঘাত নয়, এতে অবাক হবার কিছু নেই।

হেনরিয়েটার স্বর বরফের মতোই শান্ত হিম শীতল, ঘরের গুমোট ভাব যেন এক লহমায় দূর করে দেয়।

সে বলে ওঠে, তোমরা সকলে এতটা জোর দিয়ে কী করে বলছ যে জার্দাই জনকে হত্যা করেছে?

ক্ষণকালের জন্য সবাই চুপচাপ। পরিস্থিতির পরিবর্তনটাও যেন মিডগের দৃষ্টিতে এড়ায় না। হতবুদ্ধি–অস্পষ্টতা–সন্দেহ এবং অনুসন্ধিৎসা সবগুলোই যেন সম্মিলিত হয়ে ঘরময় বিরাজ করেছে।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, আমাদের তো দেখেশুনে তাই মনে হচ্ছে। তোমার মনে কী হচ্ছে?

হেনরিয়েটা সমবেদনার সুরে এটাই বোঝাতে চাইছে যে, এমনটা কি অসম্ভব নয় যে, জাদা পুলের কাছে এসে দেখে জন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, রিভলবারটা সেই সময়েই হয়তো সে মাটি থেকে তুলে হাতে নিয়েছে। অথবা তখনই হয়তো সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে?

পূনরায় ফিরে আসে সেই নীরবতা। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, জাদার কি ঐ একই বক্তব্য?

হেনরিয়েটা শুধু বলে, হ্যাঁ।

ওটা সরল স্বীকৃতি কখনোই নয়। তার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো শক্তি লুকিয়ে আছে। ঠিক রিভলবারের গুলির মতো। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল উপরে তোলেন, পরে স্পষ্ট অসঙ্গতির সঙ্গেই অবশ্য বলে ওঠেন, খাবার ঘরে স্যান্ডউইচ এবং কফি দুই আছে।

খোলা দরজা দিয়ে প্রবেশ করে জাদা অনুনয়ের স্বরে বলে ওঠে, আমি আর ঘরে শুয়ে থাকতে পারছি না–আমার ভেতর একটা অস্থিরতা–আমি ভয়ানক…

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, বেচারা প্রিয় জার্দা। তিনি জোর দিয়ে দীপ্তকণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন বটে, তবে কথাগুলো অর্থহীন মনে হল।

এডওয়ার্ড কপালের উপরের অবিন্যস্ত চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে উদভ্রান্তের মতো বিড়বিড় করতে লাগল।

–আমি–আমি একটু একটু হয়তো উপলব্ধি করতে পারছি। আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না–এখনও ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারিনি যে ব্যাপারটা কি সত্যি?–জন মৃত? সে একটু কেঁপে ওঠে, কে তাকে মেরেছে? কে তাকে এমন নিষ্ঠুরভাবে মারতে পারে?

স্যার হেনরির ঘরের দরজা খুলে যায়। ইন্সপেক্টর গ্র্যাঞ্জকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ঘরে ঢুকলেন। লম্বা-বলিষ্ঠ সুগঠিত মজবুত দেহের অধিকারী গ্র্যাঞ্জ। তার গোঁফ জোড়া নিচের দিকে বাঁকানো– অর্থাৎ ঠিক যেন দুঃখবাদী গোঁফ।

হেনরি লুসিকে দেখিয়ে বলে ওঠেন, এই আমার স্ত্রী ইন্সপেক্টর গ্র্যাঞ্জ। ইন্সপেক্টর গ্র্যাঞ্জ নত মুখে নমস্কার জানিয়ে বলে ওঠে, লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল, আমি মিসেস ক্রিস্টোর সঙ্গে দুটো কথা বলতে পারি কী-লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল সোফায় উপবিষ্ট জাদাকে দেখিয়ে দিলেন। মিসেস ক্রিস্টো?

জার্দা উৎসাহের সঙ্গে বলে ওঠে, হ্যাঁ, মিসেস ক্রিস্টো আমি।

–আপনাকে ব্যথা দেবার কোনো বাসনা আমার নেই, তবে চাকরি-টাই এমন, আমি আপনাকে এই ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন করতে চাই। আপনি চাইলে সলিসিটারকে উপস্থিত রাখতে পারেন–

স্যার হেনরি সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, সেটা বোধহয় একপক্ষে ভালো হয় জার্দা—

–সে তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বলে ওঠে, সলিসিটার? সলিসিটার আবার কেন। সলিসিটার কেমনভাবে জানবে যে জনের মৃত্যু কীভাবে হয়েছে?

ইন্সপেক্টর গ্র্যাঞ্জ একটু কাশলেন। স্যার হেনরি কিছু বলতে চাইছিলেন। হেনরিয়েটা এই সময়ে বলে ওঠে, আজ সকালে কী ঘটেছে, ইন্সপেক্টর সেটা জানতে চাইছেন।

জাদা তার দিকে ফিরে বিস্ময়ের সুরে বলে ওঠে, আগাগোড়াই এটা একটা নিছক দুঃস্বপ্ন–বাস্তব নয়! আমি–আমি–আমি একবিন্দু চোখের জল ফেলতে পারছিলাম না বা অন্য কিছু করার মতো ক্ষমতা তখন ছিল না। কারো পক্ষেই বোধহয় এই অবস্থায় কিছু করা সম্ভব নয়..

গ্র্যাঞ্জ সান্ত্বনার সুরে বলে ওঠে, আঘাত দেবার জন্যই বোধহয় এটা ঘটেছে মিসেস ক্রিস্টো।

জাদা-হ্যাঁ, হ্যাঁ, বোধহয় তাই। এটা সত্যিই খুব আকস্মিক, আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পথ ধরে সুইমিং পুলের দিকে…।

গ্র্যাঞ্জ–কটার সময়, মিসেস ক্রিস্টো?

জাদা–একটার আগে হবে হয়তো–একটা বাজার মিনিট দুই আগে, ঘড়িটা তখন আমি দেখেছিলাম। সেখানে পৌঁছে সত্যিই চোখে পড়ে জনের নিপ্রাণ দেহ, কংক্রিটের ধারে রক্তে ভেসে যাচ্ছে…

গ্র্যাঞ্জ–গুলির শব্দ কি আপনার কানে এসেছিল?

জার্দা-না-না–আমি জানি না। আমি শুনেছিলাম, স্যার হেনরি এবং মিস্টার এ্যাঙ্গক্যাটেল শিকারের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছেন…আমি…আমি শুধুমাত্র জনকে দেখেছি

গ্র্যাঞ্জ–হ্যাঁ, মিসেস ক্রিস্টো?

জার্দা–জন, রক্ত এবং পাশে পড়ে থাকা একটা রিভলবার। রিভলবারটা আমি মাটি থেকে তুলে নিজের হাতে নিয়েছিলাম।

গ্র্যাঞ্জ-কেন?

জাদা–আমাকে মাপ করবেন।

গ্র্যাঞ্জ–মিসেস ক্রিস্টো, আপনি রিভলবারটা তুলতে গেলেন কেন?

জাদা–আমি নিজেও ঠিক বলতে পারব না।

গ্র্যাঞ্জ–ওটাতে হাত ঠেকানো আপনার বোধহয় উচিত হয়নি।

জার্দা–আমার উচিত হয়নি? উদাস চোখের দৃষ্টি মুখের বিমূঢ় ভাব জার্দার। কিন্তু আমি ধরেছিলাম। ওটা আমি আমার নিরাপদ আশ্রয়ে হাতের মধ্যে রেখেছিলাম। জার্দা নিজের হাতের দিকে একবার তাকাল, এখনও যেন-রিভলবারটা তার হাতের মধ্যেই ধরা আছে।

সে তাড়াতাড়ি ইন্সপেক্টরের দিকে তাকাল, তার কণ্ঠস্বর হঠাৎ করে কেমন যেন তীব্র হয়ে উঠেছে–তবে নিদারুণ মনস্তাপপূর্ণ। জনকে কেই বা মারতে পারে? কেউ তাকে মারতে চাইবে না। সে ছিল–নিতান্তই সাধাসিধে ভালো মানুষ। এত দয়ালু–এত–এত স্বার্থশূন্য অন্যের জন্য সে নিজেকে উজাড় করে দিতে পারত। সকলে তাকে ভীষণ ভালোবাসত ইন্সপেক্টর। সে একজন অদ্ভুত প্রকৃতির চিকিৎসক ছিল। সকল স্বামীদের মধ্যে সর্বোত্তম এবং দয়ার অবতার। এটা একটা নিছক দুর্ঘটনা–নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই!

সে একটা হাত ছোড়। যে-কোনো লোককে একবার জিজ্ঞাসা করে দেখুন ইন্সপেক্টর। জনকে কেউ মারতে চায়নি। চেয়েছে কি? সকলের কাছে সে আবেদন জানায়।

ইন্সপেক্টর গ্র্যাঞ্জ তার নোটবই বন্ধ করল। শুধু বলে, সহযোগিতা করার জন্য সত্যি ধন্যবাদ, মিসেস ক্রিস্টো। গ্র্যাঞ্জ আবেগহীন কণ্ঠে বলে ওঠে, আপাতত এতেই কাজ চলে যাবে।

হারকিউল পৈরট এবং গ্র্যাঞ্জ বাদাম বনের মধ্যে দিয়ে সুইমিং পুলের দিকে ধীর পদব্রজে অগ্রসর হল। জন ক্রিস্টোর প্রাণহীন-নিঃসাড় দেহের ফোটো তোলা হল, মাপ-জোক করা হল, পরক্ষা-নিরীক্ষা করে বিস্তারিত সবকিছু লিপিবদ্ধ করা হল। এই সবকিছুই পুলিস সার্জেন করে গেছে, পরে মৃতদেহ মর্গের উদ্দেশ্যে পাঠানো হল। পৈরটের সুইমিং পুলটাকে দেখে সত্যি কী নির্দোষ মনে হচ্ছিল! তার মনে হল, এখানকার সবকিছুই আজ তরল, একমাত্র জনকেই তরল-এ ফেলা যায় না। যে মৃত্যুর মধ্য দিয়েও উদ্দেশ্য-নিষ্ঠ এবং বাস্তুতান্ত্রিক। সুইমিং পুল আজ আর নেহাতই এক পুল নয়–সেটা আজ এমন একটা নামে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে যে এইস্থানে জন ক্রিস্টোর দেহ শায়িত আছে, তার দেহ থেকে রক্ত নির্গত হয়ে পুলের ধারে কংক্রিটকে ভিজিয়ে দিয়েছে এবং সবশেষে পুলের নীল জলে এসে মিশেছে। পুলের কৃত্রিম নীল জল। কৃত্রিমতা সর্বত্রই পরিব্যাপ্ত।

কৃত্রিমতা শব্দটাকে পৈরট যেন আঁকড়ে ধরে। স্নানের পরে স্যুট পরা একজন লোক এসে রিভলবারটা পুল থেকে তুলে ইন্সপেক্টরের হাতে জমা করে।

সে বলে ওঠে, আঙুলের ছাপ পরীক্ষার আর কোনো সুযোগ নেই, অবশ্য এখানে তার প্রয়োজনও নেই বললেই চলে। মিসেস ক্রিস্টো নিজের হাতে এটা ধরেছিলেন, তাই না মিস্টার পৈরট?

পৈরট-হ্যাঁ।

গ্র্যাঞ্জ–রিভলবারটা সনাক্তকরণ করা হলো দ্বিতীয় কাজ। আমার মনে হয় হেনরি, আমাদের জন্য ইচ্ছে করলে তাই করতে পারেন, তার কাছ থেকেই ওটা সংগ্রহ করেছে। জিনিষটা এখন পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। পুলের নীচ থেকে যে পথটা এসেছে সেটা সোজাসুজি ফার্ম থেকে। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল ঐ পথ ধরেই এসেছিলেন। অন্য দু’জন মিস্টার এডওয়ার্ড এবং মিস স্যাভারনেক–বন থেকে এসেছিলেন ঠিকই কিন্তু একত্রে আসেননি। এডওয়ার্ড এসে উপস্থিত হয়েছিলেন বাঁ-দিকের পথ ধরে এবং এই পথটাই উপরের দিকে ফলের বাগানের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে। কিন্তু আপনি যখন এখানে এলেন তখন তারা পুলের ধার ঘেঁষে একটু দূরে উভয়েই দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাই না মিস্টার পৈরট?

পৈরট-হ্যাঁ।

গ্র্যাঞ্জ–এই পথটা তাবুর পাশে পোদ্দার লেন বরাবর চলে গিয়েছে। ঠিক আছে–আসুন, আমরাও না হয় ঐ পথেই যাই। পথ চলতে চলতে গ্র্যাঞ্জ নির্লিপ্ত ভাবে নিজের অভিজ্ঞতা এবং দুঃখবাদ নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন।

ঠিক এরকমটা না হলেও প্রায় ঐ ধরনের একটা ঘটনা গত বছর ঘটে গিয়েছিল আশারিজের কাছে। ভদ্রলোক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বিভাগের একজন–উল্লেখযোগ্য চাকরি জীবনের কৃতিত্ব স্ত্রী খুব ভালো, শান্ত, সুন্দরী, পুরোনো ভাবধারার মানুষবয়স প্রায় পঁয়ষট্টির মতো। একদিন স্ত্রী ভদ্রলোকের চাকরি করার সময়কার রিভলবারটা নিয়ে এসে বাগানে ভদ্রলোককে গুলি করে মেরেছেন ঠিক এমনটি ভাবে। অবশ্য এই ঘটনার পেছনে অনেক কিছু রহস্য লুকিয়ে ছিল, এটা অবশ্য আমাদের খুঁজে বার করতে হয়েছে। প্রথমে অবশ্য ভাওতা দেবার উদ্দেশ্যে নানা গল্প শোনানো হয়েছিল–আমরাও সেটা বাহ্যত বিশ্বাস করে ভেতরে ভেতরে অনুসন্ধান চালিয়ে আসল ব্যাপারের সন্ধান পেয়ে গেলাম।

পৈরট–আপনারা কি তাহলে এটাই মেনে নিয়েছেন যে, মিসেস ক্রিস্টোই তার স্বামীকে হত্যা করেছেন?

গ্র্যাঞ্জ—(অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে) আপনি কি তাহলে এটা মন থেকে মানতে পারছেন না?

পৈরট–অবশ্য অসম্ভব কিছুই নয়! আবার মিসেস ক্রিস্টো নিজের মুখে যা বলছেন তা সত্য হলেও হতে পারে।

গ্র্যাঞ্জ নিঃশব্দে ঘাড় নাড়েন। হ্যাঁ, তা হতে পারে। কিন্তু গল্পে সে-রকম কোনো জোর নেই–বড়ই ক্ষীণ। তাছাড়া সেখানে উপস্থিত একবাক্যে সকলেই স্বীকার করেছেন যে, তিনি হত্যা করেছেন। আমাদের থেকে তাদের পক্ষেই বেশি জানা সম্ভব।

গ্র্যাঞ্জ সাথীর মুখের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো। জিজ্ঞাসা করল, আপনি যখন এলেন, মিসেস ক্রিস্টোকে দেখে আপনার কী মনে হয় না যে, নিজের কাজ তিনি ভালোভাবেই সমাপ্ত করতে পেরেছেন?

পৈরট আপন মনেই জাল বুনতে থাকে…পথ ধরে এসে…পাশে পাশে এগিয়ে চলেছে গাজন..জার্দা ক্রিস্টো স্বামীর মৃতদেহের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে…হাতে রিভলবার, চোখে উদাস করা দৃষ্টি..হা হতে পারে…মিস্টার গ্র্যাঞ্জ যা ভাবছেন তা ঘটলেও ঘটে থাকতে পারে..প্রাথমিক ধারণা অবশ্য তাই…হ্যাঁ, কিন্তু পুরোটা নয়…আবার আসল ব্যাপার ঢাকবার চেষ্টাও হতে পারে… সবই হয়তো সম্ভব…।

ইন্সপেক্টর গ্র্যাঞ্জ এটাই জানতে চান যে, জার্দা ক্রিস্টোর মুখের চেহারা সে সময় ঠিক কেমন হয়েছিল।

পৈরটের এবারে সত্যিই অবাক হবার পালা। তার এতদিনকার অপরাধ শাখার কাজের অভিজ্ঞতায় সে কোনোদিন এমন অদ্ভুত স্ত্রীলোকের মুখোমুখি হয়নি যে, সবে মাত্র তার স্বামীর প্রাণ নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছে। এমন অবস্থায় একজন স্ত্রীলোকের মুখের ভাব কেমন হওয়া উচিত? বিজয়িনী, ভীতা, আত্মতৃপ্তা, হতবুদ্ধি, শূন্য দৃষ্টি? হয়তো এগুলোর যে-কোনো একটা হবে।

ইন্সপেক্টর গ্র্যাঞ্জ কথা বলে যাচ্ছিল, পৈরট কথার শেষাংশে নিজের বক্তব্য জুড়ে দেয়।

পৈরট–ঘটনার পেছনের সব কথা জানতে হবে এবং চাকরদের কাছ থেকেও সব জানা যেতে পারে।

গ্র্যাঞ্জ–মিসেস ক্রিস্টো কি শেষ পর্যন্ত তাহলে লন্ডনেই ফিরে যাবেন?

পৈরট–হ্যাঁ, তার দুটো সন্তান, তাই তাকে যেতে দিতেই হবে। আমরা অবশ্য তার প্রতি দৃষ্টি রেখেছি, তাকে এ বিষয়ে কিছু জানতে দেওয়া যাবে না। সে ভাবে, সে ভালোভাবেই মুক্তি পেয়ে যাবে..আমার কিন্তু তাকে খুব বোকা স্বভাবের স্ত্রীলোক বলেই মনে হয়…।

জার্দা ক্রিস্টো কি বুঝতে পারে যে তার সম্বন্ধে পুলিসের মতামতটা কি? পুলিস কী ভাবছে? এ্যাঙ্গক্যাটেলরা মনে মনে কী ভাবছে?

সে এমন একটা ভাব দেখাচ্ছে, সে যেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। সে এমন এক স্বভাবের স্ত্রীলোক যাদের প্রতিক্রিয়া হয় অনেক দেরিতে, এখন সব গুলিয়ে ফেলেছে, স্বামীর মৃত্যুতে তার হৃদয় এখন ভেঙে গেছে।

তারা লেনের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। পৈরট তার দরজার কাছে এসে থেমে যায়। গ্র্যাঞ্জ বলে ওঠে, এই ছোট্ট বাড়িটা আপনার? সুন্দর এবং নিরিবিলি! আচ্ছা, এখনকার মতো বিদায়! আপনার সহযোগিতার জন্য অনেক ধন্যবাদ মিস্টার পৈরট। আবার যে-কোনো সময়ে এসে হাজির হয়ে যাব এবং আমরা কীভাবে অগ্রসর হচ্ছি, আপনাকেও সে কথা জানাব। তার চোখ লেনের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে লাগল। আপনার প্রতিবেশী কে?

পৈরট–মিস ভেরোনিকা ক্রে, অভিনেত্রী, সপ্তাহান্তিক ছুটিতে বোধহয় এসে উপস্থিত হয়েছে।

স্যার হেনরির সম্মুখে ডেস্কের ওপর রিভলবারটা রেখে দিয়ে ইন্সপেক্টর গ্র্যাঞ্জ নিঃশব্দে মাথা নাড়ে।

গ্র্যাঞ্জ–এটা পুলের মধ্যেই ছিল। আঙুলের ছাপ যা কিছু ছিল সবই বোধহয় নষ্ট হয়ে গেছে। এটা বড়ই দুঃখের যে, মিস স্যাভারনেকের হাত থেকে জলে পড়ে গিয়েছিল।

হেনরি-হা, হা-কিন্তু সে-সময়টা আমাদের সবার কাছেই একটা উত্তেজক মুহূর্ত ছিল, বিশেষ করে স্ত্রীলোকেরা দুর্বল চিত্তের হন বলেই একটু অল্পেই ঘাবড়ে যান এই অবস্থায় তাদের হাত থেকেই সেইজন্যই হয়তো পড়ে যাওয়া সম্ভব।

গ্র্যাঞ্জ–(মাথা নেড়ে) কিন্তু মিস স্যাভারনেক তত বেশ শান্ত ধীর এবং যথেষ্ট ধৈর্যশালী চতুর এক মহিলা। কথাগুলোর মধ্যে তেমন জোর না থাকলেও এমন একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল যার জন্য স্যার হেনরি মুখ না তুলে পারলেন না।

-এটা কী চিনতে পারলেন স্যার?

স্যার হেনরি রিভলবারটা পরীক্ষা করে নম্বরটা টুকে নিয়ে নিজের চামড়ায় বাঁধানো একটা নোটবইয়ে লেখা নম্বরের সঙ্গে মেলাতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পরে বই বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ওঠেন, হ্যাঁ ইন্সপেক্টর, এটা আমার সংগ্রহেরই অন্যতম।

গ্র্যাঞ্জ–আপনি শেষ এটাকে কখন দেখেছিলেন?

হেনরি–গতকাল বিকেলে, আমরা একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য বুঝে বাগানের মধ্যে গুলি ছুঁড়েছিলাম এবং আমরা যতগুলো রিভলবার ব্যবহার করেছিলাম এটাও তাদের মধ্যে একটা।

গ্র্যাঞ্জ–আসলে এটা তাহলে কে ব্যবহার করেছিল?

হেনরি–আমার মনে হয় প্রত্যেকেই একটা করে গুলি ছুঁড়েছিল।

গ্র্যাঞ্জ–মিসেস ক্রিস্টোও কি সেখানে উপস্থিত ছিলেন?

হেনরি-হ্যাঁ।

গ্র্যাঞ্জ–গুলি ছোঁড়ার পর কী করেছিলেন?

হেনরি–যথাস্থানের জিনিষ যথাস্থানেই রেখে দিলাম।

স্যার হেনরি একটা ডেস্কের দেরাজ খুলে দেখালেন। দেরাজের অর্ধেক স্থান জুড়ে রাখা আছে বন্দুক।

গ্র্যাঞ্জ–আপনার আগ্নেয়াস্ত্রের বেশ বড় সংগ্রহ দেখছি স্যার হেনরি।

হেনরি–এটা আমার বহুদিনের শখ।

ইন্সপেক্টর গ্রাঞ্জের দু’চোখের দৃষ্টি হলোয়েন দ্বীপের ভূতপূর্ব গভর্নরের দিকেই নিবিষ্ট হল! সুদর্শন, নামজাদা বিখ্যাত পুরুষ, এমন লোকের অধীনে কাজ করতে তার বড়ই ভালো লাগে–নিজের চিফ কনস্টেবলের স্থানে হেনরি থাকলে তার বরং ভালোই লাগত। এইসব ছেড়ে চকিতে সে নিজের উপস্থিত কাজেই মন দিল।

গ্র্যাঞ্জ–স্যার হেনরি, আপনি যখন তুলে রাখলেন, গুলিভর্তি তো ছিল না?

হেনরি–নিশ্চয় না।

গ্র্যাঞ্জ–আপনি গুলি ঠিক কোথায় রাখেন?

হেনরি–এখানে (স্যার হেনরি চাবি দিয়ে ছোট একটা কুঠরি খুলে গ্র্যাঞ্জকে দেখালেন)।

গ্র্যাঞ্জ ভেবে নেয়, কোথাও কোনো জটিলতা নেই, খুব সহজ ব্যাপার। ক্রিস্টো স্ত্রীলোকটি নিশ্চয়ই দেখে থাকবে কোথায় গুলি রাখা হয়। সে শুধু এসে তুলে নিয়েছে। সে ভাবে ঈর্ষা শয়তানিবুদ্ধির স্ত্রীলোকদের সঙ্গেই খেলায় মেতে ওঠে। দশটার মধ্যে একটা কেস ঈর্ষার জন্য। সব জিনিষটা একেবারে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে। এখানকার গতানুগতিক কাজ সারা হলে হার্লি স্ট্রিটে গিয়ে না হয় অনুসন্ধানে নামবে। কিন্তু সব ব্যাপারটাই নিয়মতান্ত্রিক ভাবেই সারতে হবে।

সে উঠে পড়ে আর বলে ওঠে, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, স্যার হেনরি। অনুসন্ধানের খবর আপনাকে জানাতে ভুলব না।

.

১৩.

নৈশভোজনের জন্য হাঁসের মাংসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, ঠান্ডা মাংস। সেই সঙ্গে ছিল ক্যারামেল কাস্টার্ড। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের মতে মিসেস মেডওয়ের মনোভাবের প্রতিফলন প্রস্ফুটিত হয়েছিল তাদের ব্যবস্থাপনায়। তার মতে রাঁধুনীর সদিচ্ছার প্রতিফলন থাকে রন্ধনে।

ক্যারামেল কাস্টার্ড সাধারণভাবে বেশ উপভোেগ্য, কিন্তু তেমন মনের মতো প্রিয় খাদ্য নয়।

কোনো বন্ধুবান্ধব মারা গেলে প্রিয় আহারগুলো খাওয়া যায় না, তাই এগুলো ব্যবহৃত হয়।

দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে তিনি বলে ওঠেন, জাদাকে বাড়িতে বাড়িতে পাঠিয়ে একদিকে ভালো। কাজই করা হয়েছে।

হেনরির সঙ্গে ওর যাওয়া বোধহয় ঠিক কাজই হবে।

স্যার হেনরি নিজে গাড়ি চালিয়ে জার্দাকে হার্লি স্ট্রিটে পৌঁছে দেবার জন্য অযথা জিদ ধরেন।

ক্যারামেল কার্ড খেতে খেতে তিনি বলে ওঠেন, তাকে অনুসন্ধানের জন্য এখানে একবার আসতেই হবে। সে তার সন্তান-সন্ততিদের কাছে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলতে চায়–কারণ কাগজ দেখামাত্র তারা ভেতর ভেতর অস্থির হয়ে পড়বে–তাদের সান্ত্বনা জানাবার মতো কেউ নেই। ফরাসি এক মহিলা এবং ঘরকন্নার পরিচারিকা ছাড়া। হেনরি ঠিকঠাকভাবেই ব্যবস্থা নেবে এবং আমার মনে হয় জার্দা তার মনের ব্যাধি কাটিয়ে সম্পূর্ণভাবে ভালো হয়ে উঠবে। সে বোধহয় তার আত্মীয়দের–বোধহয় দিদিদের সংবাদ পাঠাবে। জাদার নিশ্চয়ই তিন-চার বোন থেকে থাকবে–খুব সম্ভব তারা টুমব্রিন ওয়েলস্-এ থাকে।

মিডগে–তুমি অত্যন্ত দরকারী কথাগুলো বলেছ, লুসি।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল-হা প্রিয় বোন, টর্কওয়েও হলে হতে পারেন, না টকওয়ে নয়।

টর্কওয়েতে উপস্থিত থাকলে তাদের বয়স অন্ততপক্ষে বছর পঁয়ষট্টি তো হবেই। ইস্টবোর্ন বা সেন্টলিওনার্ডসও হতে পারে। ডেভিড শুধু সুস্বাদু আহার খাবারেই বেশি ভক্ত, বিষণ্ণ মন নিয়ে সে তার খালি প্লেটের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল উঠে পড়েন। তিনি আবার বলতে শুরু করেন, আমার মনে হয় আজ সকাল সকাল শুতে যাওয়া উচিত।

অনেক কিছুই ঘটে গেছে, তাই না? কাগজ দেখে এই খবর চোখে পড়লে সত্যি বড় খারাপ লাগে-খবরের কাগজগুলো সত্যি বড় একঘেয়ে। আমার মন বলে কিছু না করে মাইল পনেরো হাঁটাও বোধহয় একপক্ষে ভালোতবে বসে থাকা মোটেই ভালো কথা নয়–অবশ্য এটাও বিরক্তিকর, কিন্তু খবরের কাগজ পড়া বা বইপড়া–অনেকের কাছেই সুখের নয়–এটা বড়ই নির্দয়। আমি যদিও মনে করি যে, অবজার্ভার-এর প্রবন্ধ ঠিকই, কিন্তু ‘নিউজ অব দি ওয়ার্লড’-এ ঠিক নয়। আমার সঙ্গে তোমার মনের মিল নাও হতে পারে, ডেভিড? আমার জানতে বড় ইচ্ছা হয় তরুণেরা এ সম্বন্ধে কীভাবে এর সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে।

রুক্ষকণ্ঠে ডেভিড বলে ওঠে যে, ‘নিউজ অব দি ওয়ার্ড’ সে পড়ে না।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, আমি সর্বদাই তার করে যাই, ভান করে বলে থাকি, চাকরদের জন্যই ঐ কাগজ রাখা হয়। গাজন অবশ্য এটা বোঝে, চায়ের পর ছাড়া এটাতে হাত লাগায় না। এই কাগজটা মেয়েদের কাছে বড় মজার–তাদের কথাতেই ওটাতে থাকে গ্যাসচুল্লীতে যারা মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে–তাদের সংখ্যা অবিশ্বাস্য হলেও সংখ্যাও একটু বেশি।

এডওয়ার্ড এ্যাঙ্গক্যাটেল মুচকি হাসি হেসে রহস্যের কণ্ঠে বলে উঠে, গ্যাস উঠে গিয়ে সর্বত্রই যদি বিদ্যুতের প্রসার হয়ে থাকে তবে ঐ স্ত্রীলোকরা ঘরের অন্য কী কাজে লাগবে?

ডেভিড-আমি এ বিষয়ে কিছুতেই একমত হতে পারছিলাম না, বিদ্যুতের প্রসার সর্বত্র হবেই বা কেন? কেন্দ্রের সরবরাহ থেকে সর্বত্র সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য উত্তাপের ব্যবস্থা হতে পারে। প্রত্যেক শ্রমজীবীর গৃহ বাঁচানোর প্রচেষ্টাও হতে পারে।

এডওয়ার্ড–আমি এই বিষয়ে একটু কাঁচা।

ডেভিডের ঠোঁট ব্যাঙ্গের ভঙ্গিতে বেঁকে যায়।

গাজন ট্রেতে কফি এনে ধীরে ধীরে পরিবেশন করে যাচ্ছে শাকপ্রকাশের আশায়।

লেডি এ্যঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, ওহে গাজন, সেই ডিমগুলোর কী ব্যবস্থা করলে, আমি বলি কি ডিমের গায়ে পেনসিল দিয়ে তারিখটা লিখে রাখতে বলবে মিসেস মেডওয়েকে।

গাজন বলে ওঠে, মহাশয়া, আপনি এ নিয়ে কিছু ভাববেন না, সন্তোষজনকভাবেই সবকিছু করা হচ্ছে, পুরো ব্যাপারটা আমি নিজে লক্ষ্য রেখে চলেছি।

–তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ গাজন।

গাজন যেতে যেতে এ্যাঙ্গক্যাটেল আপনমনেই বিড়বিড় করে বকতে শুরু করে দেন, গাজন অত্যাশ্চর্য। সব চাকররাই বেশ ভালো, পুলিস এসে যাওয়ায় একে অপরের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তাদের কাছে আতঙ্কের বিষয় হল পুলিস। ভালো কথা, কেউ থেকে গেল নাকি?

মিডগে জিজ্ঞাসা করে, তুমি পুলিসের কথা বলছ?

–হ্যাঁ, তাঁরা সর্বদাই একজন-না-একজনকে হলে দাঁড় করিয়ে রেখে যায়। অথবা ঝোঁপের আড়াল থেকে কেউ হয়তো সামনের দরজায় পাহারায় বসে যায়–লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন।

মিডগে–সামনের দরজায় পাহারা দিচ্ছে কেন?

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল–আমি নিজেও জানি না। তবে রাতে যদি আর কারো প্রাণহানি ঘটে এই আশঙ্কায়।

মিডগে–লুসি, এমন কথা মুখেও এনো না।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল অদ্ভুতভাবে তার দিকে তাকালেন। বলে উঠলেন, আমি সত্যিই অনুতপ্ত বোন, বোকার মতোই বলে চলেছি আমি। তবে আর কারো নিহত হবার সম্ভাবনা নেই। আমি বলছি জার্দা বাড়ি চলে গেছে–ওঃ হেনরিয়েটা, আমি সত্যিই দুঃখিত, সেকথা বলার কোনো ভাষা আমার ছিল না।

হেনরিয়েটা কোনো জবাব দেয় না। সে গোলটেবিলের দিকে তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে, গত রাতে সে ঐ টেবিলটাতেই ব্রিজ খেলায় স্কোর করেছিল।

সে যেন তার মধ্যে হঠাৎকরে সম্বিত ফিরে আসে এবং বলে ওঠে, কী যেন বলছিলেন, লুসি?

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল–আমি এটাই জানতে চেয়েছিলাম যে পুলিস এখনও আছে কী?

হেনরিয়েটা-নীলামের ঝড়তি-পড়তির মতোই। আমার তো মনে হয় তারা সব থানায় চলে গেছে। আমরা সারাদিন ধরে যে সব কথা বলেছি তা পুলিসী ভাষায় রূপান্তরের জন্য তারা চলে গেছে।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল–তোমার চোখে কী পড়েছে হেনরিয়েটা?

হেনরিয়েটা–না, কিছুই নয়। হেনরিয়েটা অগ্নিকুণ্ডের উপরের কারুকার্য করা তাকের কাছাকাছি চলে গেল। সে জিজ্ঞাসা করে ওঠে, আজ রাতে ভেরোনিকা ক্রে কী করছে বলে তোমার অনুমান?

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের মুখের ওপর বিষাদের করুণ ছায়া নেমে আসে। তিনি বলেন, তোমার কী মনে হয় বোন, সে কি এখানে থাকতে চাইবে? এতক্ষণে হয়তো তার কানে সব পৌঁছে গিয়ে থাকবে।

হেনরিয়েটা–আমারও তাই মনে হয়। সে নিশ্চয়ই সব শুনে থাকবে।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল–আচ্ছা, আমি যদি ক্রের কাছে টেলিফোনে আগামীকাল লাঞ্চের জন্য নিমন্ত্রণ করি, কিছুই যেন হয়নি এই ভেবে, তবে কেমন হয়?

ঘর ছেড়ে তিনি চলে যান।

আত্মীয়রা ডেভিডের চোখে ঘৃণার পাত্র। বলে, সে গিয়ে হয়তো এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা দেখবে। সে ভেবে নেয় লাইব্রেরিটা সত্যিই শান্তিপূর্ণ স্থান।

হেনরিয়েটা ফরাসি জানলার কাছটায় এগিয়ে যায় এবং জানলা খুলে চলে যায়। মিনিট কয়েক ইতস্তত করে এডওয়ার্ড তাকে অনুসরণ করল। সে দেখল, হেনরিয়েটার দৃষ্টি এখন বাইরের আকাশপানে। সে বলে, গতরাতের মতো গরমের প্রকোপ নেই, তাই না?

সান্তনার সুরে এডওয়ার্ড বলে ওঠে, না বেশ ঠান্ডা!

হেনরিয়েটা একদৃষ্টে বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে, তার দুচোখের দৃষ্টি এক ছুটে জানলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, পরে সে দৃষ্টি রাখে বনের পানে। তার মন কি ভাবে, সে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। সে খোলা জানলার দিকে একবার চলতে শুরু করে দেয়।

এডওয়ার্ড বলে ওঠে, ভেতরে চলো, বাইরে বেশ শীত।

হেনরিয়েটা নিঃশব্দে মাথা নাড়ে। সে বলে, আমি সুইমিং পুলের ধার থেকে একবার না হয় ঘুরে আসি। এডওয়ার্ড এক পা এগিয়ে গিয়ে বলে ওঠে, আমি সঙ্গে আসব নাকি?

হেনরিয়েটা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়, না কোনো দরকার নেই, তোমাকে অজস্র ধন্যবাদ এডওয়ার্ড। আমি মৃতের সঙ্গে একাকী থাকতে চাই।

-হেনরিয়েটা! আমি কিছু বলিনি। তুমি তো জান আমার কাছে এটা কত বড় একটা আঘাত হয়ে এসেছে।

হেনরিয়েটা–দুঃখিত! জন ক্রিস্টো ইহজগৎ ত্যাগ করেছে বলে? তার স্বরে সেই পুরোনো কথা বেশ।

এডওয়ার্ড-আমি বলছি, তোমার জন্য আমি আন্তরিকভাবেই দুঃখিত হেনরিয়েটা–আমি বুঝি এটা তোমার কাছে কত বড় একটা আঘাতের বিষয়।

হেনরিয়েটা–আঘাত? আমি মনের দিক থেকে যথেষ্ট শক্ত এডওয়ার্ড। আঘাত সহ্য করার মতো ক্ষমতা আমার আছে। তোমার কাছে এটা কোন আঘাত? তুমি যখন জনকে ঐভাবে পড়ে থাকতে দেখলে তোমার মনে তখন কী হয়েছিল? আমার কেন জানি না, মনে হচ্ছে তুমি খুশি হয়েছিলে, কারণ তুমি তাকে একদম সহ্য করতে পারতে না।

এডওয়ার্ড আপন মনে বিড়বিড় করতে থাকে, আমাদের মধ্যে অনেক জিনিষেরই বেশ মিল।

হেনরিয়েটা–তুমি কী সুন্দর সুন্দর করে কথা বলতে পার। তবে একটা জিনিষ কিন্তু তোমাদের দুজনের মধ্যেই বর্তমান ছিল, সেটা আমি। তোমরা দুজনেই আমাকে ভালোবাসতে, তাই না? কিন্তু তোমাদের মধ্যে কোনো বন্ধনই হয়নি তাতে, বরং তার বিপরীতটাই ঘটে গেছে।

চাঁদ মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছিল। এডওয়ার্ড চমকে ওঠে, সে যখন লক্ষ্য করল যে, হেনরিয়েটা একদৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আইন্সউইকে যে হেনরিয়েটাকে সে দর্শন লাভ করেছে তার অভিক্ষেপণ হিসাবে সে অজ্ঞাতসারে হেনরিয়েটাকে দেখেছে। সে চিরদিনই তার কাছে হাস্যময়ী এক বালিকা ছিল যার নৃত্যচঞ্চল চোখে যেন অফুরন্ত প্রত্যাশা! যে স্ত্রীলোকটিকে এখন সে দেখতে পাচ্ছে সে যেন তার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিতা। তার সেই উজ্জ্বল চোখ এখনও বর্তমান কিন্তু তার প্রীতিহীন দৃষ্টি এবং তার প্রতি যেন শত্রুভাবাপন্ন।

এডওয়ার্ড আগ্রহ সহকারে বলে ওঠে, হেনরিয়েটা, প্রিয়তমে, আমার ওপর বিশ্বাস রাখো, আমি তোমার প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীলতোমার দুঃখে, তোমার শোকে এবং তোমার ক্ষতিতে আমি বরাবরই সংবেদনশীল।

–এটাকে কি দুঃখ বলা যায়?

প্রশ্নটা তাকে সচকিত করে তোলে। হেনরিয়েটা বোধহয় প্রশ্নটা তাকে নয়, নিজের কাছেই নিজেই জবাবদিহি করছে।

হেনরিয়েটা ধীরেসুস্থে বলে ওঠে, এত তাড়াতাড়ি–এত তাড়াতাড়ি ওটা ঘটে যেতে পারে। এখন জীবন্ত, নিশ্বাস ফেলছে এবং পরমুহূর্তে-মৃত–গত–খালি। ও শূন্যতা। এইটুকুই যা পার্থক্য!

আমরা সকলেই এখন ক্যারামেল ক্যাস্টার্ড খেতেই ব্যস্ত এবং আমাদিগকে প্রাণবন্ত বলছি–আর জন, যে আমাদের থেকে বেশি জীবন্ত ছিল, সে আজ মৃত। কথাটা বার বার আমি নিজেকেই বোঝাতে চাইছি। মৃত-মৃত-মৃত তার কোনো অর্থ নেই–একটা গাছের পচা ডাল ডাঙার মতোই কৌতুকভরা বিষয়–এ যেন ঠিক জঙ্গলে ঢোল বাজানো, তাই না? মৃত-মৃত-মৃত-মৃত।

-হেনরিয়েটা, থামো! ঈশ্বরের দোহাই, থামো! এডওয়ার্ডের দিকে সে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়।

হেনরিয়েটা–তুমি কি জানতে না যে, আমার চিন্তাধারাটাও একইরকম? তুমি কি ভেবেছিলে? তুমি ভেবেছিলে, একখানা রুমাল চাপা দিয়ে আমি চোখের জল মুছব এবং তুমি আমার হাত ধরে থাকবে? সেটা হয়তো খুব সুখের হবে এবং তাকে খুব সহজে ভুলেও যাওয়া যায়–অর্থাৎ দুঃখের ভাবটা কাটিয়ে ওঠা যায় এবং তাতে হয়তো সান্ত্বনাও মিলে যায়। তুমি খুব ভালো এডওয়ার্ড। তুমি খুব ভালো, একটু বেশি–অত্যন্ত অপ্রতুল।

এডওয়ার্ড পিছু হটতে শুরু করে, তার মুখও কঠিন হয়ে যায়। শুষ্ক কণ্ঠে সে শুধু বলে ওঠে, হা, আমি তা জানতাম।

হেনরিয়েটা তিক্ত কণ্ঠে বলে ওঠে, তোমরা এত কী ভাবছ? অন্যান্য সন্ধ্যার মতো আজকের সন্ধ্যাতেই সবাই একত্র হয়েছে, জনের মৃত্যুতে কেউ তাদের হিসেবের মধ্যে আনতে চাইছে না, ব্যতিক্রম শুধু আমি আর জার্দা। তুমি খুশী, ডেভিড বিব্রত, ব্যথিত মিডগে, আর লুসি ‘নিউজ অব দি ওয়ার্ড’-এর সংবাদ উপভোগ করছে! তোমার স্বপ্নে আসতে শুরু করে দিয়েছে নাকি আজগুবি-ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন?

এডওয়ার্ড মুখে কিছু না বলে এক পা এগিয়ে ছায়ার মধ্যে মিলিয়ে গেল। তার দিকে তাকিয়ে হেনরিয়েটা বলে ওঠে, আজ রাতে আমার কাছে কোনো কিছুই বাস্তব নয়–কেউই বাস্তব নয়, শুধু একজন ছাড়া।

এডওয়ার্ড শান্ত কণ্ঠে বলে ওঠে, আমি জানি..বাস্তবের সঙ্গে আমার কোনো মিল নেই।

হেনরিয়েটা–আমি কী তাহলে পাষণ্ড, এডওয়ার্ড। কিন্তু আমি না বলে পারছি না যে, জন এত বেশি জীবন্ত ছিল–আজ সে মৃত?

এডওয়ার্ড–আমি সে অর্ধমৃত, সে জীবন্ত।

হেনরিয়েটা–আমি ঠিক সেভাবে বলতে চাইছি না এডওয়ার্ড।

এডওয়ার্ড–তুমি সেই কথা বলতে চেয়েছ হেনরিয়েটা এবং সেটাই বোধহয় ঠিক।

কিন্তু হেনরিয়েটা পুরোনো রেশ টেনে বলতে থাকে, এটা মোটেই দুঃখের নয়, আমি বোধহয় একটু বেদনা অনুভব করছি না, কোনোদিন হয়তো পারবও না–জনের কথা আলাদা, তার জন্য শোকপ্রকাশ করতে আমার মন চাইছে।

হেনরিয়েটার কথা এডওয়ার্ডের কাছে অবাস্তবই মনে হয়, সে আরও বেশি অবাক হয়, হেনরিয়েটা যখন বলে ওঠে, সুইমিং পুলের কাছে নিশ্চয়ই যাব।

হেনরিয়েটা গাছের মধ্যে মিলিয়ে যায় এবং ভোলা জানালার মধ্যে দিয়ে স্বমহিমায় ফিরে আসে এডওয়ার্ড।

মিডগে এডওয়ার্ডের দিকে তাকায়। তার মুখ ফ্যাকাসে, এবং গম্ভীর ও মিডগের দীর্ঘশ্বাস তার কানে পৌঁছয় না। এডওয়ার্ড যন্ত্রচালিতের মতো একটা চেয়ার দখল করে বসে পড়ে এবং বলে ওঠে, আজ বড্ড ঠান্ডা।

–তোমার কি খুব শীত করছে, এডওয়ার্ড? আমরা কি–আমরা কি তাহলে আগুন জ্বালাব?

এডওয়ার্ড–কি?

মিডগে একটা দেশলাইয়ের বাক্স নিয়ে অগ্নিকুণ্ড ধরিয়ে দেয়। সে আরো বলে, আগুন বেশ আরামদায়ক, শরীরও গরম হয়। তাকে দেখে মনে হয় যেন সে শীতার্ত। মিডগে ভাবে, তাকে এমন দেখাচ্ছে, হেনরিয়েটা কি তাকে এ বিষয়ে কিছু বলছে? তোমার চেয়ারটা বরং আরও কাছে এগিয়ে আনো, আগুনের একদম কাছে নিয়ে এসো এডওয়ার্ড।

এডওয়ার্ড–কি?

মিডগে–তোমার চেয়ারটা আগুনের কাছে নিয়ে এসো, সে এত জোরে জোরে কথা বলছিল শুনে মনে হবে সে হয়তো কোনো বধির লোকের সঙ্গে আলাপ করছে।

সে যেন হঠাৎ করে নিজের মধ্যে ফিরে আসে। এডওয়ার্ড, বাস্তবের এডওয়ার্ড যেন পুনরায় ফিরে এল। মৃদু হেসে বলে ওঠে, তুমি আমার সঙ্গে কথা বলছিলে মিডগে? আমি সত্যিই দুঃখিত, আমি হয়তো অন্য কোনো চিন্তায় মগ্ন ছিলাম, তাই হয়তো তোমার কথা আমার কানে প্রবেশ করেনি।

মিডগে–কিছু নয়, আগুন।

এডওয়ার্ড-খুব ভালো আগুন।

মিডগে–আমাদের আইন্সউইকে সর্বদা আগুনের ব্যবস্থা থাকত। মিডগে অর্ধনিমীলিত চোখে এই স্থানে এডওয়ার্ডের কথা কল্পনা করছে। বাড়ির পশ্চিম পাশের লাইব্রেরি ঘরে এডওয়ার্ড বসত। একটা ম্যাগনেলিয়া একটা জানলা প্রায় ঢেকে দিয়েছিল, সারাটা সোনালি সবুজ রঙে ঘরটাকে ভরিয়ে দিত। অন্য জানলাটা দিয়ে যে-কেউ বাইরে মুক্ত প্রাঙ্গণের দিকে তাকাতে পারত ওয়েলিঙ্গটনিয়া প্রহরীর মতো সেখানে দাঁড়িয়েছিল, তার ডান দিক করে ছিল বড় একটা কপার বী। ওঃ আইন্সউইক–আইন্সউইক!

মিডগে যেন তার কল্পনা জগৎ থেকে আইন্সউইকের সুগন্ধি ঘ্রাণ নিচ্ছে, এই সেপ্টেম্বরেও মোমের মতো শ্বেত-শুভ্র ম্যাগনোলিয়া ফুল ফোটে। আগুনে পাইনের কাঠিগুলো জ্বলছিল, তার গন্ধের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল এডওয়ার্ডের পুঁতির গন্ধ। পেছনের গদি আঁটা চেয়ারে সে বসেছিল। মাঝে মধ্যে বই থেকে মুখ তুলে সে আগুনের দিকে তাকাচ্ছিল এবং একমনে ভেবে যাচ্ছিল হেনরিয়েটার প্রসঙ্গ। মিডগে জিজ্ঞাসা করে, হেনরিয়েটা এখন কোথায়?

এডওয়ার্ড-সুইমিং পুলের ধারেই সে গেছে।

মিডগে-কেন?

এডওয়ার্ড–প্রিয় মিডগে, তোমার নিশ্চয়ই অজানা নয় যে, ক্রিস্টো কতখানি তার মন জুড়ে ছিল।

মিডগে–একটা ব্যাপার আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না যে, যেখানে গুলি করা হয়েছে সেখানে বসে থাকার কী কারণ থাকতে পারে? হেনরিয়েটার ক্ষেত্রে এটা শোভা পায় না। রঙ্গ-নাটকীয়তা তো কোনোকালেই তার মধ্যে ছিল না।

এডওয়ার্ড-কী করে জানবে কার মধ্যে কী আছে? হেনরিয়েটাকে দেখে বুঝতে পারছ না?

ভ্রূ কুঞ্চিত করে মিডগে বলে ওঠে, এডওয়ার্ড, তুমি আর আমি তো সারাটা জীবন ধরেই হেনরিয়েটাকে জেনে আসছি।

এডওয়ার্ড–তারও পরিবর্তন হয়েছে।

মিডগে–আমার কিন্তু সেটা একবারের জন্যেও মনে হয় না। সত্যি কি আশ্চর্যভাবেই না মানুষের পরিবর্তন ঘটে যায়?

এডওয়ার্ড-হেনরিয়েটাও আর আগের হেনরিয়েটা নেই, তার মধ্যেই পরিবর্তন এসেছে।

মিডগে অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

এডওয়ার্ড-তোমার আর আমার তুলনায় তাদের মধ্যে বোধহয় একটু বেশি পরিবর্তন এসেছে।

মিডগে–আমি কিন্তু একদম বদলাইনি, আগের মতোই আছি, আর তুমি?

এডওয়ার্ড-মিডগে, তোমার দর্শন যদি প্রায়ই মিলত।

মিডগে–(সহাস্যে) আমি জানি, আমি বুঝি, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগ রেখে চলা আজকাল সত্যিই বড় মুস্কিল হয়ে পড়ে।

এডওয়ার্ড-লুসির কথাই ঠিক, দিনটা কী খারাপ ভাবেই না শুরু হয়েছে, হত্যার মধ্যে দিয়েই যদি দিন শুরু হয়, তবে আর ভালো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি! আমার এখন শুতে যাবার সময়, আচ্ছা, শুভরাত্রি।

এডওয়ার্ড বেরিয়ে যাবার পরেই হেনরিয়েটা জানলা দিয়ে এসে প্রবেশ করে। মিডগে তার দিকে একবার তাকাল।

মিডগে–এডওয়ার্ডের সঙ্গে তুমি কী করেছ?

কপালে ভাঁজ পড়ে হেনরিয়েটার, সে যেন একটু বেশি ভেবে ফেলেন।

মিডগে–হ্যাঁ, এডওয়ার্ড যখন ঘরে প্রবেশ করেছিল তাকে দেখে মনে হয়েছিল সে যেন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে এবং চোখমুখও কেমন যেন ফ্যাকাসে।

হেনরিয়েটা–এডওয়ার্ডের জন্য তোমার মনে যখন এতই সহানুভূতি, তবে তার জন্য কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছ না কেন তুমি?

মিডগে–কিছু করব? তুমি বলতে কী চাইছ?

হেনরিয়েটা–আমি কিছুই জানি না। একটা চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করে তোমার বক্তব্য বলতে পার। নিজের দিকে একটু দৃষ্টি দাও। তোমরা কি বোঝো না যে, সেটাই এডওয়ার্ডের মতো লোকের একমাত্র আশা?

মিডগে–তুমি ছাড়া আর কাউকে সে বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য করতে পারে না হেনরিয়েটা।

হেনরিয়েটা–তাহলে তো এটা তার পক্ষে বড় নির্বোধের মতোই কাজ হল।

মিডগের দিকে চকিত দৃষ্টিতে হেনরিয়েটা একবার দেখে নিয়ে বলে উঠল, আমি সত্যিই খুব দুঃখিত, নিজের অজান্তে যদি তোমার মনে দুঃখ দিয়ে থাকি তার জন্য আমাকে ক্ষমা করো। আজ রাতে আমি এডওয়ার্ডকে এই ব্যাপারটা খুব ভালো বুঝিয়ে দিয়েছি যে, মনে মনে আমি তাকে কতটা ঘৃণা করি।

মিডগে–ঘৃণা? এডওয়ার্ডকে? তোমার পক্ষে এটা কখনোই সম্ভব নয়।

হেনরিয়েটাওঃ হ্যাঁ, আমি সব পারি। তুমি জান না—

মিডগে–কি?

হেনরিয়েটা–এমন কিছু জিনিষ আছে যেগুলো আমার মনকে বড় নাড়া দেয়, সে আমাকে বারংবার সেই জিনিষগুলো স্মরণ করিয়ে দেয়, যা আমি মনে রাখতে চাই না, ভুলে যেতে চাই।

মিডগে–কি জিনিষ?

হেনরিয়েটা–ধরে নাও না–আইন্সউইকের কথা।

মিডগে–আইন্সউইক? তুমি আইন্সউইককে ভুলে যেতে চাও?

হেনরিয়েটা–হ্যাঁ, হা, হা! আমি সেখানে বেশ সুখী ছিলাম, এই মুহূর্তে সে আনন্দের কথা সহ্য পর্যন্ত করার ক্ষমতা আমার নেই।

তুমি কি কিছুই বুঝতে পার না? এমন অনেক সময় এসে দাঁড়ায় যখন সে জানতেও পারে না ভবিষ্যতে কি হবে? আবার এমনও অনেক সময় আসে যখন সবকিছুই বেশ ভালো লাগে, সবকিছুই তখন ভীষণ অপরূপ, রমণীয় রূপেই চোখের সম্মুখে ধরা দেয়। এ জগতে জ্ঞানী লোকের সংখ্যাও খুব কম নয়, যারা কখনও সুখের স্বপ্ন দেখে না, আশা করে না তাদের জীবনে সুখের।

কিন্তু আমি করেছিলাম।

হেনরিয়েটা তাড়াতাড়ি করে বলে ওঠে, আইন্সউইকে ফিরে যাবার বাসনা আমার নেই, আশা করি ভবিষ্যতেও হবে না।

মিডগে ধীরে ধীরে শান্ত কণ্ঠে শুধু বলে, আমার সত্যি বড় অবাক লাগছে।

.

১৪.

সোমবার সকালে মিডুগের একটু তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু বিছানা ত্যাগ করার আগে কিছুক্ষণ আচ্ছন্নের মতো শুয়ে থাকল, চোখে তখনও ঘুমের রেশ। কিন্তু তার দৃষ্টি বার বার চলে যেতে লাগল দরজার দিকে। কারণ সে ভেবে রেখেছিল লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল হয়তো এসে দাঁড়াবে। প্রথম দিন সকালে লুসি এসে কী বলে গিয়েছিল?

দুঃসহ সাপ্তাহান্তিক একটি ছুটি? সে ভেতর ভেতর যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিল–তার যেন কেবলই মনে হচ্ছিল অপ্রীতিকর কিছু ঘটবে। হ্যাঁ তার আশঙ্কা মিথ্যে ছিল না–অপ্রীতিকর কিছু তো ঘটেই ছিল–এমন কিছু ঘটল, যা এখনও মিডগের অন্তর বিদ্ধ করছে এবং তার মনের সব আশা-আকাঙ্ক্ষাকে কালো মেঘের মতো আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সে এইসব ভাবতে চায় না, এইসব চিন্তা থেকে সে দূরে থাকতে চায়, স্মরণ করতেও তার মনের প্রবৃত্তি হয় না। যা ঘটেছিল সে সত্যিই ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। শুধু সেই নয়, এডওয়ার্ডের মতো মানুষকেও ঘটে যাওয়া সব কিছু স্পর্শ করতে পেরেছিল।

স্মৃতি খুব দ্রুত মনের পর্দায় এসে ভেসে ওঠে। কুৎসিত-ভয়ঙ্কর একটা শব্দ–হত্যা।

মিডগে ভাবে, ওঃ না, ওটা বোধহয় সত্য নয়। ওটা কখনোই সত্য হতে পারে না। আমি যেন স্বপ্নরাজ্যে বিচরণ করছি! জন ক্রিস্টো নিহত–গুলিবিদ্ধ তার প্রাণহীন দেহটা পুলের ধারে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, রক্ত এবং নীল জল যেন হয়ে উঠেছে গোয়েন্দা কাহিনীর জ্যাকেট। কাল্পনিক, অসহ্য। এরকম ঘটনা বোধহয় সচরাচর খুব কমই ঘটে। এই সময়ে যদি আমরা আইন্সউইকে উপস্থিত থাকতাম, তাহলে এরকম অঘটন আইন্সউইকে নাও ঘটতে পারত।

ওটা স্বপ্ন-বাস্তব-সত্য ঘটনা–’নিউজ অব দি ওয়ার্ল্ড’-এ একটা ঘটনা বটে। সে, এডওয়ার্ড, লুসি, হেনরি এবং হেনরিয়েটা সকলেই এই ঘটনার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।

অন্যায়-নিঃসন্দেহে অন্যায়-কারণ কারো সঙ্গে ওর তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না, জার্দা যদি সত্যি সত্যিই ওর স্বামীকে হত্যা করে থাকে।

মিডগে অস্থিরভাবেই নড়ে-চড়ে বসে।

শান্ত, মূর্খ, আংশিক করুণ জার্দা–জাদাকে এরকম একটা হাস্যকর নাটকের সঙ্গে জড়াতে পার না-উৎপীড়নের সঙ্গে তাকে জড়ালেও জড়ানো যেতে পারে।

সত্যি সত্যি কাউকে গুলি করে মারা জার্দার পক্ষে সম্ভব নয়।

আবার সেই অন্তঃস্থ অস্থিরতার তাগিদ। না, না, এভাবে ভাবাটা বোধহয় কারো উচিত নয়। আর কেই বা জনকে গুলি করে মারতে পারে? জনের মৃতদেহের পাশেই দাঁড়িয়েছিল জার্দা তার হাতেই ধরা ছিল রিভলবার।

রিভলবারটা সে হেনরির পড়ার ঘর থেকেই সংগ্রহ করেছিল। জার্দা নিজের মুখেই এই বিবৃতি দিয়েছিল যেজনকে সেই প্রথম মৃতরূপে আবিষ্কার করে, রিভলবারটা সে তার পাশ থেকে মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়েছিল। ভালো, এর থেকে আর কী বা সে বলতে পারে? নিরুপায় হয়েই মুখ খুলতে হয়েছে-নেহাতই অনুর্বর দুর্বল কথা। হেনরিয়েটাই জার্দাকে একমাত্র সমর্থন করতে পেরেছে। সেই শুধু প্রথম থেকে বলে যাচ্ছে জার্দার কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তার বক্তব্য সত্য হতেও পারে। অন্য কোনো বিকল্প বা কোনো পন্থা হেনরিয়েটা এখনও পর্যন্ত খুঁজে পায়নি। গতরাতে হেনরিয়েটা খুব মুষড়ে পড়েছিল, মুষড়ে পড়ার একমাত্র কারণ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু।

বেচারা হেনরিয়েটা–জনের জন্য আজ সে কত কিছুই না ভাবছে।

সময় কারো জন্যই থেমে থাকে না, সময়ান্তরে সে হয়তো সামলে উঠতে পারবে–সকলেই সব সামলাতে পারে, সব শোকই মানুষের সয়ে যায়। সবাই তার অতীত ভুলেও যায়। হেনরিয়েটা এডওয়ার্ডকে বিবাহ করবে এবং আইন্সউইকে গিয়ে বসবাস করবে। এডওয়ার্ডের মন খুশীতে ভরে উঠবে।

হেনরিয়েটা বরাবর এডওয়ার্ডকে ভালোবাসত। জন ক্রিস্টোর ব্যক্তিত্বই মাঝখানে পড়ে বাধ সাধল। এডওয়ার্ডকে বরং নিষ্প্রভ এবং অপদার্থ করে তুলল।

সেদিন সকালে প্রাতঃরাশের সময় মিডগের মনে হতে লাগল যে, জন ক্রিস্টোর আধিপত্যের রেশ ছিন্ন করে এডওয়ার্ড নিজের ব্যক্তিত্ব বিস্তারের যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছে। সে নিজের সম্বন্ধে বরাবরই একটু বেশি সচেতন। কোনো ব্যাপারেই সে আর বিন্দুমাত্র ইতস্তত করে না, বা থেমেও থাকে না। অল্পভাষী ডেভিডের সঙ্গে সে খুশী মনেই কথা বলে যাচ্ছিল।

–ডেভিড, তুমি মাঝে মধ্যে আইন্সউইকে আসবে। সেখানে আমি তোমার জন্য বাড়ির মতোই পরিবেশ সৃষ্টি করব এবং সেখান থেকে তুমি ঐ স্থান সম্পর্কে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারবে।

কমলালেবুর আচার খেতে খেতে ডেভিড নিরাসক্ত কণ্ঠে বলে ওঠে, এই বড় এস্টেটগুলো সত্যি বড় হাস্যকর। এগুলোকে ছোট-ছোট করে ভাগ করাও উচিত।

এডওয়ার্ড সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, আমি আশা করছি আমার জীবনে আর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না, আমার প্রজারা সন্তুষ্ট।

ডেভিড বলে, তাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত নয়, কারোরই সন্তুষ্ট মনে থাকা বোধহয় উচিত নয়।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, এপ যদি তার লেজ নিয়ে খুশী থাকতে পারত।

কিডনির একটা ডিমের দিকে তাকিয়ে এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, নার্সারিতে থাকাকালীন এই সম্পর্কে একটা কবিতাও আমি পাঠ করেছিলাম, কিন্তু কবিতাটা ঠিক কেমন ছিল, মনে করতে পারছি না। আমি তোমার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে প্রস্তুত ডেভিড এবং সেইসঙ্গে বোধহয় শিখে নেব নতুন চিন্তাধারা। যতদূর আমার চোখ যাচ্ছে, একের অপরকে ঘৃণার চোখেই দেখা উচিত–বিনামূল্যে চিকিৎসা এবং শিকার ব্যবস্থাও করা উচিত।

মিডগের মনে হয় লুসির আচার-ব্যবহারে স্বাভাবিকতার ছাপই স্পষ্ট। জাদা চলে যাবার পরে হলের মধ্যে সেই পূর্বেকার স্বাভাবিক পরিবেশটা স্বমহিমায় ফিরে এসেছে। জার্দা ক্রিস্টোর ব্যাপারটা যেন নিছক স্বপ্ন। বাইরে থেকে গাড়ির শব্দ এল এবং গাড়ি থেকে নেমে এলেন স্যার হেনরি। লুসি বলে ওঠেন, প্রিয় হেনরি, সব ঠিকঠাক আছে তো?

হেনরি সঙ্গে সঙ্গে জবাবে বলে, হ্যাঁ, সেক্রেটারি সেখানেই উপস্থিত ছিল–বেশ বুদ্ধিমতী উপযুক্ত মেয়ে। সে নিজের তাগিদে সমস্ত জিনিষের ভার নিয়ে নিল। মনে হল, একটা বোনও আছে। সেক্রেটারি তাকে টেলিগ্রাম করে দিয়েছে।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, আমি তো জানতাম, টুনব্রিজওয়েবস-এ থাকে।

স্যার হেনরি বলেন–বেক্সিল হবে বোধহয়?

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলেন–হ্যাঁ, খুব সম্ভব বেক্সিলই হবে।

গাজন এসে বলে ওঠেন যে, ইন্সপেক্টর গ্রাঞ্জের টেলিফোন এসেছিল, বুধবার বেলা এগারোটা নাগাদ বিচারের মাধ্যমে অনুসন্ধান শুরু হবে।

স্যার হেনরি নীরবে মাথা নাড়েন। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলেন, মিডগে, তুমি তোমার দোকানে একটা ফোন করে দাও। বাধ্য সন্তানের মতো মিডগে ধীর পদক্ষেপে টেলিফোনের কাছে এগিয়ে যায়।

তার জীবন এখন এমনি একটা অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলেছে যে, সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না, কিভাবে তার মালিককে সে বুঝিয়ে বলবে যে, চারদিন ছুটি নেবার পর আজও সে কাজে যেতে পারবে না কারণ সে একটা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নিজের অজান্তে জড়িয়ে পড়েছে। সবকিছু শোনার পরেও এটাকে ঠিক বিশ্বাসযোগ্য রূপে মানা যাচ্ছিল না, মনে হচ্ছিল না। বক্তব্যের মধ্যে সত্যিকারের কোন আসল সত্য লুকিয়ে আছে কিনা।

ম্যাডাম আলফ্রেজ এমনই এক মহিলা কোনো কিছু বোঝানো যাকে সত্যি খুব কষ্টকর। মিডগে দৃঢ়চিত্তে টেলিফোনের রিসিভার তুলল।

ইহুদী মহিলাটিকে মিডগে বুঝিয়ে বলল যে, সে কিছুতেই কিছু বোধগম্য করে উঠতে পারছে না। সে কেবলই একটা বুলি আওড়ে চলেছে, তুমি কী জান না আমার লোকবল কম? তোমার এমন কি হয়েছে যে, আরও দুটো দিন তোমার টিকি মিলবে না, সব ঝামেলা এসে পড়বে আমার ঘাড়ে? মৃত্যু? কবর দেওয়া? তুমি কী বিশ্বাস কর যে, আমি তোমার সাজানো এইসব বাজে অজুহাত মেনে নেব?

মিডগের কণ্ঠস্বরে এতটুকু জড়তা নেই, সে মুক্ত কণ্ঠেই এই কথা বলে ওঠে।

আলফ্রেজ–কি? পুলিস? তুমি পুলিসের হাতে পড়েছ নাকি?

মিডগে পুনরায় বোঝতে শুরু করে দেয়। সে ধৈর্যের সীমা হারিয়েছে, আর সে চিৎকার করে উঠেছে। ভাবে, মিডগে একটা খারাপ ব্যাপারে পুলিসের হাতে ধরা পড়েছে। একটা খারাপ পুলিস কেস!

এডওয়ার্ড দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে কিন্তু মিডগের জন্যই তাকে থেমে যেতে হয়।

এডওয়ার্ডের উপস্থিতি তার মনে অনেক সাহস এনে দেয়। অনুনয় বিনয় করে ইহুদী রমণীর উদ্দেশ্যে সে বলে ওঠে, আমি সত্যিই খুব দুঃখিত মহাশয়া, কিন্তু দেখুন এ ব্যাপারে আমার কোনো দোষ নেই।

ইহুদী রমণীর ক্রুদ্ধ আর্তচিৎকার যেন কিছুতেই থামে না। সে বলে, ওরা তোমার বন্ধু? ওরা কেমন অদ্ভুত চরিত্রের লোকরে বাবা, একটা লোককে গুলি করে নিজেরাই পুলিসে খবর দেয়? আমি বহুক্ষণ চিন্তা করার পর একটা সিদ্ধান্তেই পৌঁছতে পেরেছি যে, তোমাকে আর কোনোভাবেই নেওয়া যায় না, আমি কিছুতেই আমার নিজের সংস্থার মান ডোবাতে পারি না।

মিডগে এবারও তাকে অনুরোধের সুরে কাকুতি-মিনতি করে আসলে ব্যাপারটা কী ঘটেছিল সেটাই বোঝাতে সক্ষম হল, রিসিভারটা যথাস্থানে রেখে দেবার পর সে যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচল।

দেখো, এমন স্থানে আমি কাজ করি। আমাকে বলতে হল যে, বৃহস্পতিবারের আগে আমার পক্ষে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না-পুলিস এবং বিচারের মাধ্যমে অনুসন্ধানের জন্য–মিডগে বলে ওঠে।

এডওয়ার্ড–আমার মনে হয় এরা লোক হিসেবে প্রত্যেকই বেশ ভালো। এই পোষাকের দোকানটা তোমার কেমন লাগে? যে মহিলার দোকান, তিনি তোমার প্রতি সহানুভূতিশীল?

মিডগে–এই মুহূর্তে সেভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। সে একজন হোয়াইট চ্যাপেল ইহুদী স্ত্রীলোক, কলপ করা কেশ, কণ্ঠস্বরও বেশ কর্কশ।

এডওয়ার্ড–কিন্তু প্রিয় মিডগে–এডওয়ার্ডের বলার ভঙ্গিমা এমন ছিল যে, মিডগে হেসে ফেলে।

এডওয়ার্ড আবার বলে–কিন্তু প্রিয় বোন–খুব ভালোভাবে এইটুকু সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছি যে এমন আচার-আচরণ তুমি মোটেই সহ্য করতে পার না। তোমাকে যদি কোনোদিন অন্যের অধীনে চাকরি করতেই হয়, তবে এমন জায়গায় চাকরি নেবে যেখানকার পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে সামঞ্জস্য রেখে চলতে পারবে, যাদের সঙ্গে তোমাকে একসঙ্গে বসে চাকরি করতে হবে তারা তোমার পছন্দমতোই হবে।

মিডগে তার মুখের দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু কোনো জবাব দেয় না। একটা চিন্তাই তাকে বড় উতলা করতে থাকে, এডওয়ার্ডের মতো লোককে কী করলে বোঝানো সম্ভব? শ্রমের বাজার, চাকরি প্রভৃতি সম্বন্ধে সে কতটুকুই বা জানে?

তার মধ্যে হঠাৎ করে একটা বিরক্তির জোয়ার দেখা দেয়। সে অনুভব করতে পারে, লুসি, হেনরি, এডওয়ার্ড এবং এমনকি হেনরিয়েটাও তার থেকে পৃথক। তার মধ্যে এবং ওদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে যেন এক দুস্তর ব্যবধান। যে উপসাগরের ব্যবধান–যে উপসাগর পার হওয়া কোননামতেই সম্ভব নয়–যে উপসাগর চাকুরিজীবী মানুষ আর আরামে-বসে-থাকা মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করতে পেরেছে এক ব্যবধান। একটা চাকরি পাবার এবং তা বজায় রাখা যে কত কষ্টের, সে সম্বন্ধে তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। কেউ হয়তো বলবে যে, জীবনধারণের জন্য তার চাকুরী করার কোনো প্রয়োজন নেই। লুসি এবং হেনরি খুশিমনেই তাকে একটা বাড়ি দেবেন সেই সঙ্গে কিছু ভাতাও। এডওয়ার্ড হয়তো স্বেচ্ছার সঙ্গেই কিছু ভাতা দিতে রাজী হবে।

কিন্তু মিডগের মধ্যে একটা শক্তি বিদ্রোহ ঘোষণা করে ধনী আত্মীয়দের এই দানের বিরুদ্ধে। কালেভদ্রে লুসির এই শৃঙ্খলাবোধ প্রাচুর্যের মধ্যে দিন কয়েক কাটাতে বেশ ভালোই লাগে মনের সুখে আনন্দও করা যায়। কিন্তু অপরের দয়া-দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর করে চিরটাকাল এইভাবে বেঁচে থাকা তার আত্মসম্মানে আঘাত করে। সেই একই অনুভূতি তাকে ধনী আত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা ধার করে স্বাধীনভাবে কোনো ব্যবসায় নামতে বাধা দিয়েছে। এমনটি তার জীবনে বহুবার ঘটেছে। মিডগে টাকা ধারও করে না–কোননা প্রভাব বিস্তার করার মতো প্রবৃত্তিও তার নেই। সে নিজের কথা ভেবে সপ্তাহে চার পাউন্ড বেতনের একটা চাকরিও জোগাড় করেছে।

ম্যাডাম আলফ্রেজ তাকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন এই মনে করে যে, মিডগে তার চতুর বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হবে তার দোকানে এবং যাতে করে হয়তো তার ব্যবসাতেও উন্নতি হবে, কিন্তু মিডগে তাকে সম্পূর্ণভাবে নিরাশ করেছে। সে কখনও তার বন্ধুদের দোকানে হাজির হবার জন্য উৎসাহ প্রদান করত না। চাকরি করার ব্যাপারে তার তেমন কোনো আগ্রহ নেই। দোকান সে কোনোদিনই পছন্দ করত না, ম্যাডাম আলফ্রেজও তার পছন্দের তালিকায় পড়ে না, বদমেজাজী এবং অভদ্র-খরিদ্দারের দল বরাবরই তার চোখের বিষ, কিন্তু তার মনে একটাই সন্দেহ উঁকি দিতে থাকল যে এই চাকরি সে ছেড়ে দিলে আরও একটা নতুন চাকরি সে আদৌ যোগাড় করতে পারবে কি না সন্দেহ। কারণ অন্য চাকরির উপযুক্ত যোগ্যতা তার কোনোদিনই ছিল না।

এডওয়ার্ড অনুমান করে যে, পছন্দ অপছন্দের যথেষ্ট সুযোগ তার আছে–সকাল বেলা এই কথাটাই তাকে অত্যন্ত উত্তপ্ত করে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। বাস্তবতার স্পর্শবর্জিত এই জগতে বসবাস করার কোনো অধিকার এডওয়ার্ডের আছে কি?

তারা সকলেই এ্যাঙ্গক্যাটেল! কেবল সেই অর্ধ এ্যাঙ্গক্যাটেল!

কখনো কখনো, যেমন আজ সকালেই, তার মনে হয়েছিল যে সে মোটেই এ্যাঙ্গক্যাটেল নয়। সে পরিপূর্ণরূপেই তার পিতার কন্যা। তার পিতার কথা মনে হতেই মনের অজানা এক ক্ষতই বেদনামিশ্রিত স্নেহ জেগে ওঠে। পিতার সেই ধূসর রঙের কেশ এবং মধ্যবয়সী চেহারার শান্ত মুখশ্রী সত্যি বড় করুণ!

একজন লোক বছরের পর বছর ধরে ছোটখাটো একটা পারিবারিক ব্যবসা চালাতে তার দেহের সর্বশক্তি, প্রচেষ্টা এবং নিজের মতো করে দেখা এই সব জিনিষগুলো একত্র হলেও যেটা ঢিমেতালে চলার সেটা সেভাবেই চলত। এটা তার অক্ষমতা নয়–এটা ছিল তার উন্নতির অগ্রগতি।

বড়ই আশ্চর্যের বিষয় যে, মিডগের শ্রদ্ধাভক্তি যিনি এতটাকাল ধরে পেয়ে এসেছেন তিনি কিন্তু তার দীপ্তিমতী এ্যাঙ্গক্যাটেল মাতা নন, বরং তার পরিচয় হল শান্ত এবং ক্লান্ত তার পিতারূপে। মিডগে প্রতিবারই আইন্সউইকে যেতই-সেখানে গিয়ে সে জীবনের উদ্দাম আনন্দ অনুভব করত।

প্রতিবার সে বাবার গলা জড়িয়ে আদর করে বলে উঠত, বাড়ি ফিরে আসার আনন্দই আলাদা–এখানে আসতে পেরে আমার সত্যি কী ভালো যে লাগছে।

মিডগে যখন তেরো বছর বয়সের তখন তার মা মারা যান। অনেক সময় তার মনে হয়েছে যে, সে তার মায়ের সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানে না। তিনি ছিলেন অস্পষ্ট, লাবণ্যময়ী এবং প্রফুল্ল স্বভাবের। তার বিবাহ হয়েছিল এ্যাঙ্গক্যাটেল আভিজাত্যের পরিধির একেবারে বাইরে। তিনি এই বিবাহে মনের দিক থেকে অসুখী ছিলেন কিনা, মিডগের সে সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র কোনো ধারণা নেই। স্ত্রীর মৃত্যুতে তার বাবা যেন আরও চুপচাপ এবং ধূসর হয়ে গেলেন। ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রমের বিরুদ্ধে তার অবিরাম সংগ্রাম যেন কোনো কাজেই এল না। মিডগের যখন মাত্র আঠারো তখন তার বাবা নিঃশব্দে নীরবে এই ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে চলে যান।

মিডগে বিভিন্ন এ্যাঙ্গক্যাটেল আত্মীয়দের কাছেই থাকত, তাদের হাত থেকে সে উপহার গ্রহণ করত, তাদের সঙ্গে মনের সুখে আনন্দ করত, তবে তাদের সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল হতে সে বরাবরই অস্বীকার করত। সে তাদের খুবই ভালোবাসত, কিন্তু এমনও অনেক সময় এসে উপস্থিত যখন সে নিজেকে তাদের থেকে পৃথক বলেই মনে করত।

সে তীব্র ঘৃণার সঙ্গে ভাবত, তারা বোধহয় কিছুই জানে না।

আভিমানী এডওয়ার্ড তার দিকে হতবুদ্ধির মতো অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকে, জিজ্ঞাসা করে, আমি কি তোমাকে কোনোভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছি? কেন?

কথার মাঝে লুসির প্রবেশ ঘটে।

মিডগে উদাস ভরা নেত্রে একবার তার দিকে আর একবার এডওয়ার্ডের দিকে তাকাতে থাকে।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন,এডওয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে আর কী হবে মিডগে, বাস্তবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তুমি চল তাই বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী তোমার আছে, সেইজন্যেই হয়তো তোমার কথা সে বুঝবে না।

বাধা দিয়ে এওয়ার্ড তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, লুসি তুমি যে কী বল তোমার কথাও আমার বোধগম্য হয় না।

লুসির চোখে মুখে অবাক বিস্ময়।

লুসি বলল-বিচারের মাধ্যমে অনুসন্ধানের কথা আমি বলতে চাইছি। এইজন্য জার্দাকে এখানে একবার হাজিরা দিতে হবে। আমি জানতে চাইছি, সে কি এখানে থাকবে, না ‘হোয়াইট হার্ট’-এ চলে যাবে? এখানকার সংসর্গ তার মন আরও ভারাক্রান্ত করে তুলবে। হোয়াইট হার্ট’-এর লোকেরাও তাকে ভালো চোখে দেখবে না বরং কুটি করেই তাকাবে। সেইসঙ্গে থাকবে সাংবাদিক বন্ধুদের ভিড়। বুধবার এগারোটা কি এগারোটা তিরিশে বোধহয় হবে (একটা মৃদু হাসির রেখা লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের ঠোঁটে ভেসে ওঠে)।

–জুরির বিচারের অনুসন্ধান আজ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য তার জীবনে ঘটেনি। আমার গায়ে অবশ্য ধূসর রঙের পোষাক, গির্জার উপযোগী টুপিও আছে–নেই শুধু দস্তানা।

ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে টেলিফোনের রিসিভারটা তুলতে তুলতে লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলে ওঠেন, বাগান করার দস্তানা ছাড়া আমার কাছে আর কোনো দস্তানা নেই। আগে অবশ্য ছিল, তখন গভর্মেন্ট হাউসে থাকতাম। কিন্তু যাই বলা, দস্তানা পরা সত্যিই বোকামির লক্ষণ, কি বলো তাই না?

এডওয়ার্ড মৃদু হাসি হেসে বলে ওঠে, অপরাধ করার পেছনে একটা সুবিধা কিন্তু থেকে যায়, কারণ দস্তানা পরে কোনো অপরাধ করলে আঙুলের ছাপের ভয় থাকে না।

লুসি বলে ওঠে–বেশ মজার কথা বলেছ কিন্তু এডওয়ার্ড। টেলিফোনের রিসিভারটা কেন তুলেছিলাম বলতে পারবে?

এডওয়ার্ড-বোধহয় কাউকে ফোন করার উদ্দেশ্যে! ফোনের দিকে এগিয়েছিলে!

লুসি–না, তেমন ভাবে তো কিছু মনে পড়ছে না (রিসিভারটা রেখেছিলেন)।

এডওয়ার্ড-প্রিয় লুসি, মিডগের কাজের জায়গার কথা চিন্তা-ভাবনা করছিলাম। সেখানকার সব কিছুই আমার খারাপ লাগে।

মিডগে–এডওয়ার্ড মনে মনে আশা করে যে, আমার একজন সহানুভূতিসম্পন্ন মালিক পাওয়া উচিত, যে আমার সঠিক মূল্য বুঝতে পারবে, আমার প্রতি দয়া-পরবশ!

লুসি–প্রিয় এডওয়ার্ড। আমি তোমার অভিমতের সঙ্গে একমত।

এডওয়ার্ড–আমি ভেতরে ভেতরে সত্যি বড় উদ্বিগ্ন–গভীর ভাবে ব্যাপারটা নিয়ে একটু চিন্তাভাবনা করছি।

মিডগে-অভদ্র মহিলার কাছ থেকে বেতন রূপে মাত্র চার পাউন্ড আমার হাতে এসে ঠেকে–সমস্ত অসুবিধার মুখ্য কারণ কিন্তু এটাই।

বলা না থামিয়ে বাগানের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করে মিডগে।

স্যার হেনরি নিচু দেয়ালের ওপর তার সেই নির্দিষ্ট স্থানটিতে বসে। সেদিকে দৃষ্টিপাত না করে মিডগে ফুলের বাগানের মধ্যে দিয়ে চলে গেল। তার আত্মীয়দের মধ্যে একটা আকর্ষণ করার ক্ষমতা আছে, কিন্তু আজ সকালে তাদের সে আকর্ষণের কোনো মূল্যই তার নেই।

ডেভিড এ্যঙ্গক্যাটেল পথের শেষ প্রান্তে একটা আসনের ওপর বসেছিল। বিশেষ ভাবে আকর্ষিত হবার মতো কোনো জিনিষ তার মধ্যে ছিল না, মিডগে এসে তার পাশে বসে পড়ে। হতাশা ভরা মুখের দিকে ঈর্ষা-পরায়ণ দৃষ্টি নিয়েই সে তাকিয়ে রইল।

ডেভিড মনে মনে ভাবে, লোকের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানো সত্যি খুব কঠিন! শোবার ঘর থেকে ঝি তাকে ঠেলে পাঠিয়ে দিয়েছে ন্যাতা, বুরুশ এবং ঝাড়ন দিয়ে ঘর মুছতে এবং ঘর পরিষ্কার করার বাসনা নিয়ে। লাইব্রেরি ঘরটিও মোটেই নিরিবিলি নয়, যেমনটি সে কল্পনা করে রেখেছিল। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল সেখানে দু’বার প্রবেশ করে দয়া-পরবশ হয়ে এমন উপদেশ দিলেন যে প্রকৃতঅর্থে যার কোনো সদুত্তর হয় না। এখানে সে উপস্থিত হয়েছিল নিজের ব্যাপারে একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা ভাবনা করার আশায়। ইচ্ছার বিরুদ্ধেই সে সাপ্তাহান্তিক ছুটি কাটাতে এসেছিল, কিন্তু হত্যাকাণ্ডের রহস্যজালে জড়িয়ে পড়ার জন্য ছুটি আরও দীর্ঘমেয়াদী হচ্ছে।

শিক্ষাগত অতীত এবং লেফটউয়িং-এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনায় বসতে এবং ভাবনা-চিন্তা করতে বরাবরই ডেভিড ভালোবাসে। বাস্তব এবং অস্থির চঞ্চল এই বর্তমানকে সে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের উদ্দেশ্যে সে বলেছে যে, নিউজ অব দি ওয়ার্ড’ সে খুলেও দেখে না, কিন্তু এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে যে নিউজ অক্ দি ওয়ার্লড ‘হলো’তে এসে সে হাজির হয়েছে।

হত্যা! ডেভিড যেন অজানা এক ঘৃণায় শিউরে ওঠে। তার বন্ধুবান্ধবরাই বা কী ভাববে? ‘হত্যা’ কথাটাকে লোকেরাই বা কী মনে গ্রহণ করবে? এ সম্বন্ধে অভিমত কী দাঁড়াবে? একঘেয়ে, বিরক্তি? হালকা খুশির ছোঁয়া?

এইসব সমস্যা মনে মনে সমাধানের প্রচেষ্টায় সে উঠে পড়ে লেগেছিল। মিডগের উপস্থিতি এই মুহূর্তে তার কাছে বড় বিরক্তিকর লাগল। মিডগে তার পাশের আসনে বসতে যাচ্ছিল তখন সে তার দিকে বক্রদৃষ্টিতে একবার তাকাল।

মিডগে ডেভিডের বক্রদৃষ্টিতে নির্ভীক চাহনির সাহায্যে প্রত্যুত্তর দিয়ে দিল–ডেভিড সঙ্গে সঙ্গে আরো সচকিত হয়ে ওঠে। তার মনে হতে লাগল মিডগের মতো বালিকা সত্যি বড় বিরক্তিকর আর বুদ্ধির লেশমাত্র নেই।

মিডগে–তোমার আত্মীয়দের ঠিক কেমন মনে হয়?

ডেভিড-কেউ তার আত্মীয়-বন্ধুদের ব্যাপারে কি কোনো চিন্তা-ভাবনা করে?

মিডগে–প্রকৃতপক্ষে কোনো জিনিষ সম্পর্কে কারো মাথা-ব্যথা আছে কি?

ডেভিড-তুমি বোধহয় কারো না! আমি হত্যাকাণ্ডকে বিশ্লেষণ করছিলাম।

মিডগে–এটা সত্যি বড় বিরক্তিকর!

ডেভিড–শুধু বিরক্তিকর নয় সেই সঙ্গে ক্লান্তিকরও বটে! গোয়েন্দা কাহিনীর মতো সকল রহস্যের জট পাকিয়ে আছে!

মিডগে–তুমি কি এখানে এসে দুঃখ পেয়েছ?

ডেভিড-হ্যাঁ, আমি লন্ডনে আমার এক বন্ধুর সঙ্গেই থাকতাম। তার লেফটউইং’-বইয়ের দোকান আছে।

মিডগে–আমার কিন্তু মনে হয় এখানে একা থাকার আনন্দই আলাদা সেই জন্য কথাটাও বেশ আরামদায়ক।

ডেভিড–(অবজ্ঞার সুরে) আরামের জন্য কেউ যে এতটা লালায়িত হয় তা আগে শুনিনি।

মিডগে–আমার জীবনে এমনও অনেক সময় এসেছে যখন কিছুই আমি গ্রাহ্য করি না।

ডেভিড–তুমি যদি শ্রমের মাধ্যমে জীবিকা উপার্জন করে থাকো তবে তোমার জীবনের প্রতি এটা হয়ে উঠবে প্রশ্রয়ের এক অনন্যভঙ্গী।

মিডগে–চাকরি করে দুমুঠো অন্নের সংস্থান আমাকেই করতে হয়, তাই ভোগবিলাসের ওপর আমার এত লোভ। বাক্সবিছানা, নিচু বালিশ, দিনের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে বিছানার পাশে চা–চীনামাটির স্নানাগারে গরম জলের সুবন্দোবস্ত–তৃপ্তিকর বাথটব। সে আরামকেদারায় বসতে তোমার মন নেচে উঠবে…

মিডগে তার তালিকা আর দীর্ঘ করে না।

ডেভিড-শ্রমজীবী মানুষের জীবনে এসব থাকার যথেষ্ট প্রয়োজন আছে। কিন্তু খুব ভোরে বিছানার পাশে চা-রাখা সত্যি অসম্ভব বলেই আমার মনে হয়। এটা নিছকই ভোগসুখপরায়ণতা। তাই বর্তমান বিশ্বে এর কোনো স্থান থাকতেই পারে না।

মিডগে–আন্তরিকভাবে আমি তোমার মতকে সমর্থন করতে পারলাম না ডেভিড।

.

১৫.

সকাল বেলা হারকিউল পৈরট যখন চকোলেট পানে ব্যস্ত সেই সময়ে টেলিফোনের ঘণ্টা বেজে ওঠে।

পৈরট তাড়াতাড়ি গিয়ে রিসিভারটা তুলে বলেন, হ্যালো। সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তরও এল-পৈরট?

–কে? লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বলছেন? আপনার কণ্ঠস্বর আমি ঠিক চিনতে পেরেছি, তাই না?

উত্তর এল–আপনাকে বোধহয় একসময়ে বিরক্ত করলাম।

পৈরট–একটুও নয়।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল–আমি আপনার কাছে জানতে চাইছি যে, আপনি যদি দয়া করে এখানে একবার আসতে পারেন তবে বড়ই ভালো হয়। আপনার কোনো অসুবিধা হবে না তো?

পৈরট–আপনি কি এক্ষুনি যাবার জন্য বলছেন?

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল-হা, আমি এক্ষুনি একবার আপনাকে আসার জন্য অনুরোধ করছিলাম। আপনার পক্ষে যত তাড়াতাড়ি আসা সম্ভব।

পৈরট–তাহলে আমি বনের পথটাই ধরব?

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল-নিশ্চয়ই, ওটাই তো সবচেয়ে সোজা পথ।

পৈরট কোটে লেগে থাকা ধুলো আলতো করে বুরুশ দিয়ে তুলে পাতলা ওভার কোট গায়ে চাপিয়ে লেন পার হয়ে বাদাম বনের মধ্যে দিয়ে পথ চলতে শুরু করে দিল। সুইমিং পুলটা বেশ পরিত্যক্ত, ফাঁকা নির্জন–পুলিশ তার কাজ গুছিয়ে চলে গিয়েছে। এটাকে দেখে বেশ শান্ত এবং শান্তিপূর্ণ বলেই মনে হয় কুয়াশাচ্ছন্ন শরতের আবছা আলো এসে পড়েছে তার জলে।

পৈরট তাবুর দিকে একটা তড়িৎ-দৃষ্টি ফেলে দেখল যে, প্ল্যাটিনাম ফক্স মুক্ত গলাবন্ধটি নেই কিন্তু দেশলাই ছ’টা এখনও সেই আগের মতোই পড়ে আছে। এটা তো দেশলাই রাখার উপযুক্ত জায়গা নয়, এই স্যাঁতসেতে স্থানে কি দেশলাই রাখা যায়। হয়তো একবাক্স থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু ছ’বাক্স! চিত্রিত লোহার টেবিলের দিকে একবার সে তাকাল।

গ্লাসের ট্রে-টা নিয়ে গেছে। কে যেন টেবিলের ওপর পেনসিল দিয়ে দুঃস্বপ্নের মতো একটা গাছের ছবি এঁকেছে–পৈরট সত্যি খারাপ লাগল–তার পরিষ্কার মনে এই ব্যাপারে আঘাত পায় সে। ঘাড় নেড়ে, জিভের শব্দ করে, লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের হঠাৎ করে ডেকে পাঠানোর কারণ মনে মনে চিন্তা-ভাবনা করতে করতে দ্রুত পথ চলতে শুরু করে দিল।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল ফরাসি জানলায় চুপচাপ নীরবে বসেছিলেন এবং পৈরটকে দেখামাত্রই নিঝুম-নির্জন বসার ঘরে নিয়ে গেলেন। তিনি বললেন, আপনাকে কাছে পেয়ে সত্যি বড় ভালো লাগছে। কথা বলতে বলতে তিনি পৈরটের সঙ্গে করমর্দন করলেন।

পৈরট এ্যাঙ্গক্যাটেল বলেন, দেখুন, কি মুস্কিলে না পড়া গেল, পুলিস ইন্সপেক্টর প্রশ্ন করছেন–বিবৃতিও নিচ্ছেন–কিসব পুলিসী-ভাষা বর্ষণ করছেন, সবশেষে এখন গাজনকে নিয়ে পড়েছেন। গাজনকে না হলে একমুহূর্ত আমাদের চলে না। পুলিসের প্রশ্ন শুনে সে মনে মনে বেশ ঘাবড়েই গেছে। ইন্সপেক্টর গ্র্যাঞ্জ অবশ্য ভালো, আমার মনে হয়, তিনি বেশ সংসারী -ছেলেপুলে-স্ত্রী নিয়েই তার বাস, স্ত্রীর সব কাজই বেশ টিহীন

ইন্সপেক্টর গ্রাঞ্জের পারিবারিক জীবনেরকল্পিত চিত্র লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের মুখে নীরবে শুনে যাচ্ছিল পৈরট বিনাপ্রতিবাদে এবং বিনামন্তব্যে। আপনার দয়ার শরীর, আপনি আমাদের পরম হিতাকাঙ্ক্ষী। আমি অবশ্য পুলিসকে গ্রাহ্য করি না। আমার কাছে পুরো ব্যাপারটাই খুব হাস্যকর। মিস্টার গ্র্যাঞ্জকে বলে রেখেছি–আপনার পক্ষে যতটা সম্ভব সাধ্যমতো সাহায্য করে যাব।

গ্র্যাঞ্জ যেন একেবারেই বিমূঢ় হয়ে গেছেন। তবু তিনি নিয়মমাফিক তার কাজ করে যাচ্ছেন। অনেকদিন আগে একটা ব্যাপার কানে এসেছিল যে জন ক্রিস্টো এবং হাসপাতালের এক নার্সের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে, ব্যাপারটা বহু পুরোনো বলে এ বিষয়ে পুলিসের তেমন কোন আগ্রহ নেই বললেই চলে। কেউ অবশ্য এর বিন্দুবিসর্গ জানে না। জার্দাকে তাহলে কত না ঝামেলার সম্মুখীন হতে হতো। স্ত্রী হিসেবে সে যথেষ্ট বিশ্বাসী, তাই না? আবার অনেকের মুখ থেকে এও বলতে শোনা গেছে যে, জার্দার মাথায় কোনো বুদ্ধি নেই বলেই তার আজ এই হাল।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল পড়ার ঘরের দরজা খুলে পৈরটকে নিয়ে হঠাৎ করে ঢুকে পড়লেন। ইন্সপেক্টর গ্র্যাঞ্জ এবং গাজন দুজনেই সেখানে উপস্থিত ছিল। ঘরের এককোণে এক তরুণ একটা নোটবই হাতে নিয়ে কি সব লিখে যাচ্ছে। লুসি ও পৈরটকে দেখে গাজন সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায়। পৈরট তাড়াতাড়ি করে ক্ষমা চেয়ে নেয়। সে বলে ওঠে, আমি এক্ষুনি চলে যাচ্ছি, আমার জানা ছিল না যে, লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল…

গ্রাঞ্জের গোঁফ যেন আরো বিকট এবং দুঃখবাদী রূপেই চোখের সামনে ফুটে উঠল। পৈরট, লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের গ্র্যাঞ্জ সম্বন্ধে কল্পিত গল্পে সে খুব ক্রুদ্ধ হয়। গ্র্যাঞ্জ বলেন, বসুন, পৈরট, আমার এখানকার কাজ প্রায় শেষ বললেই চলে। আমার আপনাকে কিছু জিজ্ঞাস্য আছে।

গাজনের দিকে তাকিয়ে গ্র্যাঞ্জ বলে ওঠেন, তাহলে এই পর্যন্তই তোমার স্মরণে আছে?

গাজন–হ্যাঁ স্যার, সবকিছুই বেশ স্বাভাবিক ছিল। অপ্রীতিকর কোনো ঘটনাই ঘটেনি।

গ্র্যাঞ্জ–লোমের তৈরি একটা জিনিস আমাদের হাতে এসেছে। সেটা হয়তো এখানে উপস্থিত কোনো মহিলার হবে।

গাজন–আপনি স্যার প্ল্যাটিনাম ফক্সের কথা বলছেন? ওটা আমি গতকাল তাঁবু থেকে গ্লাসগুলো নিয়ে আসার সময় পাই। কিন্তু স্যার, ওটা এখানকার কোনো মহিলার হবে না।

গ্র্যাঞ্জ–তাহলে এটা কার হতে পারে?

গাজন–ওটা খুব সম্ভব মিস ক্রের হবে। মিস ভেরোনিকা ক্রে, এক সিনেমা অভিনেত্রী, ওনার হলেও হতে পারে স্যার। আমার যতদূর মনে আছে ওরকম একটা জিনিষ তার গায়ে চাপানো ছিল।

গ্র্যাঞ্জ–কখন?

গাজন–গতরাতের আগের রাতে তিনি হঠাৎ এখানে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন স্যার।

গ্র্যাঞ্জ–তিনি এখানকার অতিথি ছিলেন না। মিস ক্রে ‘ডাভকোট’-এ বাস করতেন, ঐ দিকে লেনের মধ্যে। সে রাতে ডিনারের পর তিনি এখানে এসেছিলেন একটা দেশলাই নিতে।

পৈরট বলে ওঠে–তিনি কি ছটা দেশলাই নিয়েছিলেন?

গাজন–পৈরটের দিকে একবার তাকিয়ে) আপনার অনুমানই ঠিক স্যার। আমাদের গৃহকত্রী অনেক অনুসন্ধান করার পর জানালেন যে, আমাদের কাছে অনেক দেশলাই আছে, তখন তিনি ক্রে’কে ছ’টা দেশলাই বাক্স নিয়ে যাবার জন্য অযথা জিদ ধরে বসলেন।

পৈরট–তাবুতে তিনি সেগুলো ফেলে চলে গেলেন।

গাজন-হ্যাঁ স্যার, গতকাল সকালের দিকেই সেগুলো আমি তাবুতে স্বচক্ষে দেখে আসছি।

গাজন চলে যাবার পর দরজা বন্ধ করতে করতে পৈরট বলে ওঠে, এমন কিছু আছে বলে তো মনে হয় না যে, ঐ লোকটার দৃষ্টিতে কিছু এড়িয়েছে বলে।

ইন্সপেক্টর গ্র্যাঞ্জ শুধু বলেন, চাকরেরাই সব শয়তানির মূলে। প্রফুল্ল মনেই গ্র্যাঞ্জ বলে ওঠে, রান্নাঘরের ঝিও-তো আছে, তার কথাবার্তার ধরন-ধারণ এমন উঁচুদরের চাকরদের মতো নয়।

গ্র্যাঞ্জ আবার তার বক্তব্য শুরু করে, হার্লি স্ট্রিটে অনুসন্ধানের জন্য অমি সেখানে একজন লোক নিযুক্ত করেছি, আমি পরে একদিন সময় করে চলে যাব। আমাদের সেখানে অবশ্য কিছু না কিছু পাওয়া খুবই প্রয়োজন। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, ক্রিস্টোর স্ত্রীকে নাকি অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। মুখ বুজে সেগুলো তাকে সহ্য করতে হয়েছে..

এমন সব কায়দা-দুরস্ত ডাক্তারদের তাদের রোগিণীবৃন্দের সম্পর্কে এমন সব মুখরোচক ঘটনা শুনলে আপনি আশ্চর্য না হয়ে পারবেন না। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল অবশ্য বলেছিলেন যে, হাসপাতালের এক নার্সের সঙ্গে ডাক্তার ক্রিস্টোর কি সব গোলমাল নাকি হয়েছিল। যদিও তিনি সঠিক কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি, বা নাম, ধাম ইত্যাদির বিবরণও তাঁর কাছে অজ্ঞাত। গুজবের মতো এই কথাটা তার কানে ভেসে এসেছিল।

ঈর্ষাপ্রণোদিত হয়ে বা অন্য কোনো সুচারুরূপে গঠিত এক সুন্দর চিত্র…ডাক্তার এবং হাসপাতালের নার্স…ডাক্তারের জীবনের সুযোগ…জার্দা ক্রিস্টোর ঈর্ষার যথেষ্ট কারণ…তার শেষ পরিণতি…হত্যা…হ্যাঁ, এই হত্যাকাণ্ডের পটভূমি…হার্লি স্ট্রিট হতে পারে…হলো থেকে দূরে…কিছু মুহূর্ত দূরে বা অন্যত্র হেনরিয়েটা স্যাভারনেকের জার্দার কল্পিত হস্ত থেকে রিভলবার নেবার অভিনয়…রিভলবার সুইমিং পুলের জলে ফেলে দেওয়া বা পড়ে যাওয়া থেকেও একটু পৃথক ধরনের হতে পারে…জন ক্রিস্টোর শেষ কথা…হেনরিয়েটা…অনেক কিছু হতে পারে… কোথায়…কেন..বা কে হত্যাকারী?…আধবোজা চক্ষুজোড়া হঠাৎ খুলে পৈরট জিজ্ঞাসা করে ওঠে, আপনার ছেলেরা কি মোনো বাজায়?

–এ্যা, কি? ভ্রুকুটি করে গ্রাঞ্জের চোখ চলে যায় পৈরটের দিকে। একথা কেন জিজ্ঞাসা করছেন? গ্রাঞ্জের কণ্ঠে পূর্বের মতোই বিস্ময়ের সুর। আসলে ব্যাপারটা কী হয়েছে জানেন, ওরা সবাই বেশ ছোট। কিন্তু আমার ইচ্ছা আছে বড়দিনের ছুটিতে টেডিকে এক সেট মোনো উপহার দেবার। এবারে বলুন তো আপনার জিজ্ঞাসা করার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? গ্র্যাঞ্জ সহজ কণ্ঠেই বলে যায়।

পৈরট নিঃশব্দে মাথা নাড়ে, জবাবে কিছু বলে না। সত্যি কী সাংঘাতিক চরিত্রের স্ত্রীলোক লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল। আপন মনে কী সুন্দরই না গল্প ফেঁদেছেন। এই সর্বনাশা কাহিনীর যদি এক অংশ সত্য হয় তবে অপর অংশটাও সত্য হতে বাধ্য…আপনি অনায়াসেই সত্য বলে মেনে নেবেন।…

ইন্সপেক্টর গ্র্যাঞ্জ বলে ওঠে, একটা কথা আপনাকে আমার জিজ্ঞাস্য আছে, পৈরট, এই মিস ক্রে–পেশায় অভিনেত্রী, তার দেশলাইয়ের প্রয়োজন পড়লে তিনি আপনার কাছে গেলেন না কেন? কয়েক পা গেলেই যখন আপনার বাড়ি। কিন্তু আপনার বাড়ি না গিয়ে আধমাইল দূরে যাবার কি প্রয়োজন ছিল?

হারকিউল পৈরট শুধু মাথা নাড়েন।

কারণ অবশ্যই একটা আছে। আমার বাড়ি আকারে বেশ ছোট, তাই চোখে না পড়াটাই স্বাভাবিক, আমি হপ্তাহান্তের আগন্তুক মাত্র–কিন্তু, লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল এবং স্যার হেনরি নামজাদা ব্যক্তি, এখানেই তাদের বাস, তারা পল্লীর অধিবাসী। এই মিস ভেরোনিকার হয়তো বাসনা ছিল যে, তাদের সঙ্গে পরিচিত হবার এটাই আসল পন্থা।

ইনসপেক্টর গ্র্যাঞ্জ এবার উঠে পড়ে।

সে বলে, তা হয়তো হতে পারে, কিন্তু কোনো ব্যাপারকে এড়িয়ে যাওয়া চলে না এবং উচিতও নয়। আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই যে, সবকিছুই বেশ সহজ ভাবে ঘটে গেছে। স্যার হেনরি তাঁর বন্দুক সনাক্ত করতে পেরেছেন। যতদূর মনে হয়, আগের দিন ঠিক বিকেলে তারা এই নিয়ে অনুশীলনও করেছিলেন। জাদা ক্রিস্টোর চোখে সবকিছুই ধরা পড়েছে এবং শুধু বন্দুক আর টোটা তাকে তুলে আনতে হয়েছে, খুবই সহজ সাদাসিধে কাজ। হা পৈরট, সত্যিই সহজ কাজ।

এটাও কী সম্ভব? এক স্ত্রীলোক, আবার জাদা ক্রিস্টোর মতো সরল স্বভাবের একজন স্ত্রীলোকের পক্ষে এমন অপরাধ করা কি সম্ভব? হঠাৎ করে ঈর্ষান্বিত হয়ে পতিদেবতাকে, যাকে সে সমস্ত অন্তর দিয়ে ভালোবাসে, যার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, যাকে নিয়ে সে মনে মনে গর্ব অনুভব করে, তাকে সে নিজের হাতে শাস্তি দিতে পারে?

আত্মরক্ষার প্রস্তুতিও তত থাকবে–অথবা সে কি অন্ধের মতোই এই কাজ করে ফেলেছে? ভালো-মন্দ, হিতাহিত কিছুই সে একবারের জন্যেও চিন্তা করে দেখেনি?

পৈরটের স্মৃতির পর্দায় এবার ভেসে ওঠে, জার্দার চোখের সেই উদাস দৃষ্টি এবং হতভম্ব বধির অবস্থা। সে জানত না–সহজভাবে কথা বলতে গেলে বলতে হয়–সে কিছুই জানত না। কিন্তু এবারে তার মনে হলো যে তার জানা হয়তো উচিত ছিল। কেন সে জানতে পারল না? বহুদিন ধরেই সে অপরাধ বিভাগের কাজের ব্যাপারে যুক্ত ছিল, কিন্তু জাদাকে দেখেও তার মনে এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন জাগেনি কেন?

জার্দা কি তাহলে সত্যি-সত্যি খুনী? অথবা জার্দা কি জনকে হত্যা করেনি? তবে? আসলে হত্যাকারী কে? প্রকৃত খুনীর সন্ধান করাই কি তার একমাত্র কাজ নয়?

১৬. করুণ চোখের দৃষ্টি

১৬.

জাদা ক্রিস্টো পোষাকের পেছন দিকটা তুলে মাথার ওপর দিয়ে একটা চেয়ার এসে দখল করল। অনিশ্চয়তায় ভরা তার করুণ চোখের দৃষ্টি। সে বলে, আমি ঠিক জানি না, আমি জানি না, সত্যি আমার কাছে সবই অজানা। কিছুই যেন ঘটেনি।

মিসেস প্যাটারসন দয়ালু মনের, তবে স্বভাব বেশ দৃঢ়চেতা। তিনি বলেন, আমি জানি, আমি সব জানি বোন। তিনি জানতেন শোকের মুহূর্তে কীভাবে সান্ত্বনা দিতে হয়। বিপদে-আপদে এলসি সহযোগীদের কথা তুলনা করে তার বাড়ির লোকজনদের এই অভিমত।

হার্লি স্ট্রিটে জার্দার শোবার ঘরে তিনি এখন বসে আছেন। সেখানে বসেই তিনি চমৎকার সান্ত্বনা দিতে পারেন। লম্বা গড়নের এলসি প্যাটারসন বেশ হাসিখুশি স্বভাবের এবং উদ্যমশীল। জাদার এই ব্যাপারটাকে তিনি বিরক্তি এবং সহযোগিতার দৃষ্টি দিয়েই দেখছিলেন।

বেচারা জার্দা–স্বামী এইভাবে হারানোয় তার পক্ষে কতটা ভয়ানক শোকাবহ। আসলে এখন তিনি ব্যাপারটাকে সম্পূর্ণভাবে ঠিকঠাক ভাবে বুঝে উঠতে পারেননি! মিসেস প্যাটারসন অবশ্য জানতেন যে, জাদার সবকাজই বেশ ধীরস্থির। তাই এই শোকের সময়েও তার সবক্ষেত্রেই সময় একটু বেশি লাগাটাই স্বাভাবিক।

ব্যস্তকণ্ঠে তিনি বলে ওঠেন, আমার মনে হয় যে, কালো রঙের পোষাকটা আমি বারো গিনিতেই কিনে নিতে পারব। জাদা নীরব এবং নির্বিকার চিত্তেই দাঁড়িয়ে রইল, শুধু তার যুগল আন্দোলিত হল মাত্র। সে বলে ওঠে, আমি সত্যি এই সত্য জানি না যে, শোক এই ব্যাপারটা জনের পছন্দের তালিকায় পড়ত কিনা, আমার যতদূর মনে আছে, তিনি একবার নিজের মুখে বলেছিলেন যে, শোকের সময় কালো পোষাক ব্যবহার করা মোটেই তিনি পছন্দ করতেন না। জন বেঁচে থাকলে একমাত্র সেই আমাকে বলে দিতে পারত আমার এখন কী করণীয়।

কিন্তু জন আর কোনোদিনের জন্যই এখানে আসতে পারবে না…কখনও না-কোনোদিন না …ভেড়ার মাংস টেবিলের ওপর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে–রোগী দেখার ঘরের দরজার শব্দ…জন ছুটে ছুটে উপরে আসছে…সর্বদাই ব্যস্ত পদক্ষেপ…এত জীবন্ত, এত স্বাভাবিক…

জীবন্ত…চিৎ হয়ে সুইমিং পুলের পাশে শায়িত বুকের থেকে ঝরা রক্ত পুলের কিনারা থেকে জলে এসে পড়ছে…হাতে রিভলবারের স্পর্শ..

একটা দুঃস্বপ্ন একটা খারাপ স্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙে গেছে। কিন্তু কেউ তার স্বপ্নের কথা বিশ্বাস করতে প্রস্তুত নয়। তার দিদির কর্কশ কণ্ঠস্বর কানে আসতেই জাদার চিন্তাজাল মাঝপথেই ছিন্ন হয়ে যায়…।

তিনি বলে ওঠেন, কিন্তু বিচারের মাধ্যমে অনুসন্ধান করতে গেলে কালো পোষাকের প্রয়োজন হতে পারে, তুমি যদি উজ্জ্বল পোষাক গায়ে চড়িয়ে সেখানে হাজির হও তবে খুব দৃষ্টিকটু দেখাবে।

জাদা সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, ভীতিপ্রদ গোছের এই বিচার! জার্দা চোখ বন্ধ করে। এলসি প্যাটারসন তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন, তোমার পক্ষে এককথায় সাংঘাতিক বটে! তবে আমার মনে হয়, তুমি স্বমহিমায় আবার আমাদের কাছে ফিরে আসবে এবং আবার আমরা তোমাকে আগের মতো আতিথেয়তা করতে পারব।

জার্দা ক্রিস্টোর নীহারিকার মতো চিন্তার রেখা ক্রমেই কঠিন হতে থাকে। সে শুধু বলতে পারে, তার স্বর সত্যি খুব ভয়ার্ত এবং শুনে মনে হয় প্রায় ভীতসন্ত্রস্তও বটে–আমি কী করার জন্য ক্ষেপে উঠেছি, জনকে ছাড়া আমার পক্ষে কী বা করা সম্ভব?

এলসি প্যাটারসনের কাছে এ কথার জবাব তৈরিই ছিল। তিনি বলে ওঠেন, তোমার সন্তান আছে, তাদের মুখ চেয়েই তোমাকে জীবনের বাকি ক’টা দিন বেঁচে থাকতে হবে।

বিছানায় মুখ গুঁজে জেনা চিৎকার করে চোখের জল ফেলছে, আমার বাবা মারা গেছেন, আমার বাবা আর বেঁচে নেই।

পাণ্ডুর মুখে জিজ্ঞাসু নেত্রে বধিরের মতো বসে আছে টেরি। রিভলবার নিয়ে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। এই কথা বলেই তাদের শুধু সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে, তারা এইটুকু সত্যই জানতে পেরেছে যে, এক দুর্ঘটনায় তার বাবা মারা গেছে।

বেরিল কলিন্স সকালের কাগজটা লুকিয়ে ফেলেছিল, তাই ছেলেমেয়েদের দৃষ্টি পড়েনি। চাকরদের সে বারংবার সাবধান করে দিয়েছে, বেরিল যেমন দয়াবতী তেমনি চিন্তা করেই কাজ করেন।

টরেন্স আবছা অন্ধকারে বসার ঘরে মায়ের কাছে এগিয়ে এসে পাংশু মুখেই জিজ্ঞাসা করল, বাবাকে কেন গুলি করা হল?

এটা নিছক একটা দুর্ঘটনা বাবা, এ ব্যাপারে কিছুই আমি বলতে পারি না।

এটা শুধুই এক দুর্ঘটনা নয় মা, যা সত্যি নয় তা বলছ কেন? বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। এটা খুন। খবরের কাগজে বড় বড় হরফে অবশ্য তাই উল্লেখ করেছে।

সে শুধু মাথা নাড়ে, বুড়ো মানুষের মতো অদ্ভুতভাবে মাথা নাড়তে থাকে। আমি বাইরে থেকে একটা কাগজ কিনে এনেছিলাম। আমার মনে সন্দেহ দানা বেঁধে ছিল যে, এমন কিছু আছে যা তোমরা আমাদের কাছ থেকে লুকোতে চাইছ, তাই যদি না হয় তবে মিস কলিন্স খবরের কাগজ লুকিয়ে রাখতে গেল কেন?

টরেন্সের কাছে কোনো জিনিষ লুকিয়ে বোধহয় রেহাই নেই। সেই অদ্ভুত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর ছেলেটি যতক্ষণ না সন্তুষ্ট হবে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে আসল কথা ঠিক পেট থেকে বার করে ফেলবে।

বাবাকে কেন হত্যা করা হল মা?

জাদা এখন বিকারগ্রস্ত রুগীর মতো কান্নায় ভেঙে পড়ে। আমাকে এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করো না বাবা–এ বিষয়ে কোনো কথা তুলো না–এ বিষয়ে কোনো কথা বলার ক্ষমতা আমার নেই…সত্যি এই ঘটনাটা খুব ভীতিপ্রদ।

কিন্তু আমার মনে হয় আসলে ঘটনাটা কী ঘটেছিল সেটা কি সামনে বেরিয়ে আসবে, ঘটনাটা ঘটার পেছনে যে কারণ কাজ করেছে, সেটা জানারও প্রয়োজন আছে।

জাদা মনের দিক থেকে এতটাই যুক্তিবাদী নিস্পৃহ স্বভাবের যে চিৎকার করে কাঁদতে এবং হাসতেও তার মনে সাধ জেগেছিল। জাদা মনে মনে ভাবে, ছেলে কাউকে গ্রাহ্য করতে পারে না–সে কিছুই গ্রাহ্য করে না–প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে সে লোককে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। সে একটি বারের জন্যেও চোখের জল ফেলেনি, চোখ দিয়ে নিজের অজান্তে এক ফোঁটা জলও গড়িয়ে পড়েনি। পিতার এইভাবে মৃত্যুটা সে মেনে নিতে পারেনি, সে ঠিক যেন এক প্রস্তর মূর্তি।

টরেন্স তার মাসী এলসির প্রবোধবাণীকে ব্যঙ্গ করে উড়িয়ে দেয়, একটা ছোট্ট বালকের মনও যে এমন কঠোর মনোভাবের হতে পারে, কেউ বোধহয় সেটা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। টরেন্সের মনে সর্বদা একটা চিন্তাই ঘুরপাক খেত যে, সে বড় একা। তার মনের সঙ্গে কারো মিল ছিল না। কিন্তু সেটা ছিল তার নিছক এক কল্পনা। আজ বাবাকে হারিয়ে তার মনে সত্যিই এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেল যে, এই জগতে সে বড়ই একা।

কিন্তু আজ সে একটু অন্যরকম ভাবে চিন্তা করার চেষ্টা করছে। কোনো প্রশ্নের সদুত্তর দেবার মতো তার কাছে আর কেউ রইল না, বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তার প্রশ্নের জবাবও কেউ দিতে পারবে না–তাই প্রশ্নের জবাবও অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

আগামীকাল, মঙ্গলবার সে এবং নিকোলাস নাইট্রোগ্লিসারিন তৈরির জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। অত্যন্ত আগ্রহ এবং উৎসাহের সঙ্গে সে কাজে অগ্রসর হয়েছিল এবং আজ তার মধ্যে সেই পূর্বের উৎসাহ আর নেই। সে নাইট্রোগ্লিসারিন তৈরি করল কি করল না, তাতে কিছু যায় আসে না।

টরেন্স নিজে এই বিষয়ে যথেষ্ট শোকাহত। এই বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সে আর ভয় পায় না, একটি ছেলের বাবাকে যখন নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়…সে ভাবে, আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে..

কিছু একটা যেন তার মনকে নাড়া দিয়ে উঠল–শেকড় গজাল-ধীরে ধীরে ক্রোধে মাথা তুলে দাঁড়াল।

বেরিল কলিন্স শোবার ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল, তার চোখমুখ ফ্যাকাসে রক্তশূন্য হয়ে গিয়েছিল, নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলে উঠল, ইন্সপেক্টর গ্র্যাঞ্জ এসেছেন। জার্দা যেন হাঁফাতে হাঁফাতেই করুণ দৃষ্টিতে কলিন্সের মুখের দিকে একবার তাকাল। বেরিল সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, তিনি বলেছেন যে, তিনি আপনাকে খুব বেশি বিরক্ত করবেন না, এই অকারণে ভয় পাবার মতো কিছু হয়নি। তার গতানুগতিক প্রশ্নের বাণ তিনি এবার ছুঁড়তে শুরু করে দেবেন, ডক্টর ক্রিস্টোর চিকিৎসার পসার সম্বন্ধে এবং আর যদি বাকি থেকেও থাকে সবই আমি জবাব দিতে পারব। শুধুমাত্র যাবার আগে আপনার সঙ্গে হয়তো একবার দেখা করতে পারেন।

তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, আচ্ছা চলি।

মিসেস তাড়াতাড়ি প্রস্থান করে। জার্দা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে শুধু বলে ওঠে, কলিন্স বরাবরই সাহায্য করে আসছে, সে যথেষ্ট বাস্তব!

মিসেস প্যাটারসন সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, নিশ্চয়, চমৎকার সেক্রেটারী সাদাসিধে গরীব ঘরের মেয়ে, নয় কী? জনের মতো আকর্ষণীয় পুরুষের কাছে এই রূপটাই আকর্ষণীয়।

জার্দা তার দিকে তাকিয়ে মুহূর্তের মধ্যে যেন দপ করে জ্বলে ওঠে।

তুমি কি বলে চলেছ এলসি? তুমি ভাবছ সুন্দরী সেক্রেটারি হলে জন তাকেই মন দিয়ে বসত, প্রেম করত তার সঙ্গে? না কখনও না, কখনও না–জন কোনদিন সেই চরিত্রের লোক ছিল না।

একথা তো নিঃসন্দেহে বলা যায় বোন, জন সে ধরনের লোক কোনোদিনই ছিল না, কিন্তু এই কথাটা অত্যন্ত সাধারণের ভাষায় বলা হয়ে গেল–সাধারণ লোক তো ঐরকম স্বভাবেরই হয়ে থাকে। মিসেস প্যাটারসন বলে যান।

রোগী দেখার ঘরে ইন্সপেক্টরের দৃষ্টি চলে গেল বেরিল কলিন্স-এর যুদ্ধং দেহী’ ভাবের দিকে। এটাই তো স্বাভাবিক। সে ভাবে, ডাক্তার এবং কলিন্স-এর মধ্যে যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি নেই–এই ব্যাপারটা স্পষ্ট। ডাক্তারের কাছে কলিন্স মিষ্টি স্বভাবের হলেও হতে পারে, কিন্তু তাতে করে খুব বেশি জল ঘোলা হবে না এটাও ঠিক।

বেরিল কলিন্স গ্রাঞ্জের প্রশ্নের সরাসরি জবাব দিয়ে দেয় এবং ডাক্তারের পেশার খুঁটিনাটি সবকিছুই তার নখদর্পণে। গ্র্যাঞ্জ বিষয়ান্তরের দিকে গমন করল। তার বাসনা এখন জন এবং জাদার সম্পর্কের মধ্যে নাক গলানো।

বেরিল বলল, তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল এককথায় ভীষণ ভালো।

ইন্সপেক্টর খুব গোপন একটা কথা জিজ্ঞাসা করে ওঠে, আচ্ছা, তারা স্বামী-স্ত্রী উভয়েই নাকি আর দশটা বিবাহিত যুগলের মতো সর্বদা কিছু-না-কিছু নিয়ে ঝগড়া করে যেত?

এমন ঝগড়ার কথা আমি কল্পনাতেও আনতে পারি না।–মিসেস ক্রিস্টো নিঃসন্দেহে স্বামীর প্রতি অনুরক্তা ছিলেন, অনেকটা ঠিক ক্রীতদাসীর মতোই বিশ্বস্তা এবং অনুগতা।

গ্র্যাঞ্জ–নিজের জন্য কিছু করতেন না?

বেরিল–না, সবকিছুতেই ডাক্তার ক্রিস্টোকে কেন্দ্র করে ঘুরে বেড়াত।

গ্র্যাঞ্জ–অত্যাচারী, এ্যা?

বেরিল ভাবতে থাকে।

-না, তা বলা বোধহয় উচিত হবে না আমার, তবে তিনি নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু ভাবতে পারতেন না। তিনি মনে মনে সবসময়ে এটাই প্রত্যাশা করতেন যে, মিসেস ক্রিস্টো–ক্রিস্টোর ইচ্ছামতোই চলবেন।

গ্র্যাঞ্জ–রোগীদের নিয়ে কোনো অসুবিধা ছিল না? আমি বলতে চাইছি, রোগিণীদের সঙ্গে কোনোরকম…আপনি সহজ করেই বলতে পারেন, মিস কলিন্স। লোকেরা অবশ্য ভাবে, ডাক্তারের সেইদিক থেকেও অসুবিধার কারণ ঘটতে পারে…

ঘৃণায় বেরিলের নাসিকা সঙ্কুচিত হয়ে যায়, সে বলে ওঠে, ওঃ, সেইরকম জিনিষ! ডাক্তার ক্রিস্টো এমন একজন চিকিৎসক ছিলেন যে সে লাইনের যে-কোনো অসুবিধা দূর করার ক্ষমতা তার ছিল। রোগী বা রোগিণীদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার ছিল অত্যন্ত মধুর। আসলে তিনি যে একজন অত্যাশ্চর্য চিকিৎসক ছিলেন এ বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।

গ্র্যাঞ্জ–কোনো স্ত্রীলোকের সঙ্গে কোনো ব্যাপারে কি তিনি কখনো জড়িয়ে পড়েছিলেন? আনুগত্যর মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে জবাব দেবেন, এগুলো জানার সত্যি খুব প্রয়োজন আছে মিস কলিন্স।

বেরিল–হ্যাঁ, আমি সেটা ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারি। না, এমন কোনো ঘটনা সত্যি আমি জানি না।

গ্র্যাঞ্জ–হেনরিয়েটা স্যাভারনেকের ব্যাপার কি? বেরিলের মুখ বন্ধ হয়ে যায়।

বেরিল–এই পরিবারের তিনি ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।

গ্র্যাঞ্জ–ডাক্তার ক্রিস্টো এবং মিসেস ক্রিস্টোর মধ্যে মিস হেনরিয়েটাকে নিয়ে তার মনে কী অশান্তি ছিল?

বেরিল– কখনও না

গ্র্যাঞ্জ–মিস ভেরোনিকা ক্রে-র কি খবর?

বেরিল–ভেরোনিকা ক্রে! বেরিলের কণ্ঠস্বরে নির্ভেজাল বিস্ময়ের সুর।

গ্র্যাঞ্জ–ডাক্তার ক্রিস্টোর বান্ধবীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।

বেরিল–আমি তার সম্বন্ধে কোনোদিন কিছু শুনিনি। তবে নামটা খুব শোনা শোনা লাগছে।

গ্র্যাঞ্জ-সিনেমার অভিনেত্রী।

বেরিল–হ্যাঁ, হা, মনে পড়েছে। এইজন্যই নামটা শুনে মনে হচ্ছিল খুব চেনা চেনা। তবে আমি জানতাম না যে, ডাক্তার ক্রিস্টোর সঙ্গে তার কোনো পরিচয় ছিল কিনা!

বেরিলের বলার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল তার প্রত্যুত্তরে দেওয়া জবাবও খুব স্পষ্ট, তাই এ্যাঞ্জের পক্ষে কোনো প্রশ্ন তোলা সত্যি সম্ভবপর ছিল না।

গত শনিবারে ডাক্তার ক্রিস্টোর আচার-ব্যবহারে কোনো ব্যতিক্রম চোখে পড়েছিল কি? শুধু এই প্রসঙ্গে এসেই তার গোপনীয়তা ভেঙে গেল এবং জবাবও একটু আলাদা ধরনের শোনাল।

বেরিল–তার হাবভাব মোটেই প্রতিদিনের মতো ছিল না।

গ্র্যাঞ্জ–কোনো পরিবর্তন নজরে পড়েছিল কি?

বেরিল–সাধারণ কোথাও যাবার থাকলে একটু তাড়াতাড়ি রোগী দেখার ব্যাপারটা সেরে রাখতেন। কিন্তু এবার ঘটনাটা হল একটু আলাদা, শেষ রোগীণীকে দেখার আগে বহুক্ষণ এভাবে কেটে গেল, রোগী দেখার ঘন্টা বাজানোর কথা তার মনেও এল না। আমার মনে হয় তিনি হয়তো কোনো গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন। এর বেশি কিছু বলা আমার পক্ষে সত্যি সম্ভব নয়।

ইন্সপেক্টর গ্র্যাঞ্জ নিজের অনুসন্ধানে মনের দিক থেকে মোটেই খুশী হতে পারছিল না। এমন কিছু সে উদ্ধার করতে পারল না। যার ভিত্তিতে সে একটা মামলা দাঁড় করাতে পারে। সরকারী উকিলের কাছে কোনো কেসের জন্য দ্বারস্থ হলেই কেসের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আইনের যুক্তিতে সেগুলো আগে প্রমাণ করতে হবে। সে মনে মনে এই সত্যটা ভালোভাবেই বুঝে গিয়েছিল যে জনের হত্যাকারী স্বয়ং জার্দা ক্রিস্টো। তার মনে সন্দেহ জেগেছিল এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কোনো উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই আছে–ঈর্ষাই হয়তো এই হত্যার সেই মোটিভ, সে মনের দিক থেকে এই যুক্তি গ্রহণ করলেও এই পথে অগ্রসর হওয়ার মতো সাহায্যকারী কোনো প্রমাণ তার হাতে এসে ঠেকল না। সারজেন্ট কুম্বসের দায়িত্ব ছিল চাকরানীদের জেরা করার, কিন্তু তারাও সেই একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি করল। তারা সবাই একই কথা বলে গেল। মিসেস ক্রিস্টো সেই মাটিকে তার দেবতার আসনে বসে পুজো করে, যে মাটির ওপর দিয়ে তার স্বামী হেঁটে যায়।

গ্রাঞ্জের মনে হল, যা কিছু ঘটার সব হলোতেই ঘটে গেছে। কিন্তু সেখানকার পরিস্থিতিও হতাশাব্যঞ্জক। সেখান থেকেও কোনো সূত্রের সন্ধান করা যায়নি!

ডেস্কের ওপর রাখা টেলিফোনটা শব্দ করে বেজে ওঠে, মিস কলিন্স এগিয়ে এসে রিসিভার তোলে।

সে বলে ওঠে, টেলিফোনে আপনাকে ডাকছে, ইন্সপেক্টর।

–হ্যালো, গ্র্যাঞ্জ বলছি। কি?–বেরিল কৌতূহলের সঙ্গে গ্রাঞ্জের মুখের দিকে একদৃষ্টে অপলক নয়নে তাকিয়ে উভয়ের কথোপকথন নীরবে শুনে যাচ্ছিল। কাঠের তৈরি মুখের মতো এ্যাঞ্জের মুখও পূর্বের মতোই আবেগ-বহির্ভূত।

হ্যাঁ, হা..আমি তা পেয়েছি। তা তো ঠিকই! না, ভুলের কোনো অবকাশ থাকার কথা নয়। হা…হা…আমি, এক্ষুনি যাচ্ছি। আমি প্রায় সব শেষ করে এনেছি। হা..

রিসিভারটা রেখে দিয়ে সে নির্বাক শ্রোতার মতোই নিশ্চল হয়ে বসে থাকল। বেরিলের দৃষ্টি জুড়ে উৎসুকতার ছটফটানি। নিজেকে বিন্যস্ত করে সম্পূর্ণ নতুন এক স্বরে সে জানতে চাইল, এ বিষয়ে আপনার কোনো ব্যক্তিগত মতামত আছে কি, মিস কলিন্স?

বেরিল বলল–আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন?

গ্র্যাঞ্জ–আমার বলার উদ্দেশ্য হল যে ডাঃ ক্রিস্টোর হত্যাকারীর সম্পর্কে আপনার নিজস্ব কোনো ব্যক্তিগত ধারণা আছে কি?

বেরিল–এ বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই, ইনসপেক্টর।

গ্র্যাঞ্জ–ডাঃ ক্রিস্টোর মৃতদেহের পাশে রিভলবার হাতে মিসেস ক্রিস্টো দাঁড়িয়েছিলেন..

বেরিল–আপনি যদি ভেবে থাকেন যে, মিসেস ক্রিস্টো ডাঃ ক্রিস্টোর হত্যাকারী, তবে আমি বলব আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। মিসেস ক্রিস্টো তেমন চরিত্রের স্ত্রীলোক নন। তিনি অত্যন্ত ধীর-স্থির-বিনীত-নম্র স্বভাবের এবং ডাঃ ক্রিস্টো যে তাকে পরিচালনা করতেন তিনি নীরবেই চালিত হতেন। কেউ যদি ভেবে থাকে যে, তার স্বামীকে তিনি নিজের হাতেই শাস্তি দিয়েছেন, আমার কাছে সত্যি এটা বিদ্রুপের মতোই শোনাবে, বর্তমান পরিস্থিতি যতই তার বিপক্ষে থাক-না-কেন?

গ্র্যাঞ্জ–তিনি যদি খুন না করে থাকেন তবে কার পক্ষেই বা সম্ভব, বলুন?

বেরিল–আমার এ ব্যাপারে কোন ধারণা নেই।

গ্র্যাঞ্জ যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েই দরজার দিকে এগিয়ে যায়।

বেরিল–যাবার আগে আপনি কি একবার মিসেস ক্রিস্টোর সঙ্গে দেখা করবেন?

গ্র্যাঞ্জ–হ্যাঁ, হা, মুখোমুখি কথা হওয়া বোধহয় একবার দরকার! বেরিলের এবার অবাক হওয়ার পালা, টেলিফোন বাজার আগে যে লোক তাকে প্রশ্ন করেছিল সে কখনোই এই লোক হতে পারে না! এমন কি খবর সে পেয়েছে যে এই অল্পসময়ের মধ্যেই তার এত পরিবর্তন?

ভীতসন্ত্রস্ত পদক্ষেপে জাদা ঘরে এসে উপস্থিত হয়। তার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছিল মনের দিক থেকে সে কতটা অসুখী এবং হতবদ্ধিসম্পন্ন হয়ে পড়েছে। সে অত্যন্ত নিচু এবং কাঁপা কাঁপা-কণ্ঠে কোনোরকমে বলে উঠল, জনের হত্যাকারী হিসেবে আর কারো আপনারা সন্ধান করতে পেরেছেন কি?

গ্র্যাঞ্জ–না, এখনও পারিনি, মিসেস ক্রিস্টো।

জাদা নিঃশব্দে মাথা নাড়ে এবং নিচের দিকে তাকিয়ে একখানা ছোট রুমালকে পাকিয়ে বলের মতো বানাচ্ছে।

গ্র্যাঞ্জ–আপনার স্বামীর কোন শত্রু ছিল কিনা, জানেন মিসেস ক্রিস্টো?

জার্দা—জনের শত্রু? না, না, সত্যি সে অত্যাশ্চর্য ভাবের এক পুরুষ। সকলে তাকে পুজো করত।

গ্র্যাঞ্জ–তার বিরুদ্ধে কোনো আক্রোশ ছিল এমন কারো কথা আপনার স্মরণে আসে কি? –অথবা আপনার বিরুদ্ধে কোনো আক্রোশ পুষে রাখে এমন কোনো লোক?

জাদা–আমার বিরুদ্ধে আক্রোশ? না, না, ইনসপেক্টর।

গ্র্যাঞ্জ–মিস ভেরোনিকা ক্রে’র কি খবর?

জাদা–ভেরোনিকা ক্রে? ওঃ, যে দেশলাই ধার করতে সেই রাতে এখানে উপস্থিত হয়েছিল, আপনি তার কথা বলছেন তো?

গ্র্যাঞ্জ–হ্যাঁ, হা আপনি চেনেন নাকি তাকে?

জাদা–আমি তাকে সেইদিনের আগে কখনও দেখিনি। তবু বহু বছর আগে জনের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল–একথা শুনেছিলাম।

গ্র্যাঞ্জ–আমার মনে হয় আপনার স্বামীর ওপর তার মনে সুপ্ত কোনো আক্রোশ ছিল–যা আপনি জানতে পারেননি।

জাদা–আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না যে জনের বিরুদ্ধে কারো মনে কোনো আক্রোশ থাকতে পারে!

তাঁর ছিল দয়ার শরীর এবং নিজের স্বার্থ সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন–মানুষ হয়েও এমন ব্যক্তি বোধ হয় কমই জন্মায়।

গ্র্যাঞ্জ–হুম, হ্যাঁ হতে পারে। আচ্ছা, বিদায়, মিসেস ক্রিস্টো। বিচারের মাধ্যম দিয়ে অনুসন্ধানের কথা জানেন তো? বুধবার ঠিক এগারোটা নাগাদ, মার্কেট ডিগ্লিস-এ। খুব মামুলি ব্যাপার, ঘাবড়ানোর মতো কারণ আপনার দেখছি না–হয়তো আমাদের ঘাড়ে আরও অনুসন্ধানের বোঝা চাপিয়ে যথাযথ সুযোগ দেওয়ার জন্য এক সপ্তাহের জন্য মুলতুবি হতে পারে।

জাদা–ওঃ আচ্ছা, আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গ্রাঞ্জের চলে যাওয়ার দৃশ্যটাই লক্ষ্য করছিল। সে এখনও পুরোপুরি ভাবে সব ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পেরেছে কিনা সন্দেহ–অথচ পুরো ঘটনাটার সেই একমাত্র সাক্ষী।

গ্র্যাঞ্জ একটা ট্যাক্সি ডেকে এনে তাতে উঠে পড়ে টেলিফোনে যে খবরটা সে পেয়েছে তার জন্য খরচটাও বোধহয় যুক্তিযুক্ত হয়ে উঠবে। সে অবশ্য জানত না যে, খবরটা তাকে কোথায় নিয়ে এগিয়ে চলেছে। বাইরে থেকে দেখে ওটা অত্যন্ত অবাস্তব, পাগলামি বলেই মনে হবে।

এর কোনো মানেই খুঁজে পাওয়া যায় না, তা সত্ত্বেও মনে করতে হবে এর হয়তো সঠিক একটা অর্থ আছে, যতক্ষণ পর্যন্ত জিনিষটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে।

ব্যাখ্যার শুরু বা শেষে একটা কথাই বলা যায় যে কেসটা দেখে যতটা সোজা এবং সরল সাধা-সিধে মনে হয় আসলে কিন্তু কেসটা মোটেই তা নয়।

.

১৭.

স্যার হেনরি ইনসপেক্টর গ্রাঞ্জের দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে রইলেন। তিনি ধীরজ কণ্ঠে শুধু বলে ওঠেন, আমি মনের দিক থেকে পুরোপুরি ভাবে এখনও নিশ্চিত হতে পারিনি যে ইনসপেক্টর, আমি আপনার কথা সব বুঝে উঠতে পেরেছি কিনা সন্দেহ।

গ্র্যাঞ্জ–এটা খুবই সহজ ব্যাপার, স্যার হেনরি। আমি আপনাকে আগ্নেয়াস্ত্রের মজুত পরীক্ষা করে দেখতে বলছি। আমার মনে হয়, সবগুলো ক্যাটলগ করা এবং ইনডেক্স করা আছে।

হেনরি–তা বোধহয় আছে, আমি তো রিভলবারটা আমার সংগ্রহের অংশ বলেই সনাক্ত করেছি।

গ্র্যাঞ্জ–যে রিভলবারটা আপনি আজ সকালে সনাক্ত করে এসেছেন, রিভলবারের এই গুলিতে ডাঃ ক্রিস্টোর মৃত্যু হয়নি।

হেনরি–আশ্চর্য!

গ্র্যাঞ্জ আশ্চর্যরকমভাবে ঘাবড়ে যায়। স্যার হেনরি বেশি কথা না বলে নিজের আগ্নেয়াস্ত্রের স্টক পরীক্ষা করতে রাজী হওয়ায় সে হেনরির কাছে আন্তরিকভাবেই কৃতজ্ঞ। ব্যাপারটা সত্যি খুব আশ্চর্যের–কারণ পরীক্ষা করার কোনো অর্থই হয় না।

হেনরি–আপনার একথা বলার পেছনে কোনো কারণ আছে কি, যে গুলিতে জনের মৃত্যু হয়েছে সেটা আমার স্টক থেকেই প্রাপ্ত?

গ্র্যাঞ্জ–কারণ অবশ্যই কিছু নেই, তবে আমি পুরোপুরি ভাবে স্থির সিদ্ধান্তে আসতে চাই-গুলিটা আপনার স্টকের, না অন্য কোনো স্থান থেকে সংগৃহীত করা হয়েছে।

হেনরি-হ্যাঁ, আপনার যুক্তি অবশ্যই ঠিক, সেকথা আমি মেনেও নিচ্ছি। আচ্ছা, দেখাই যাক, তবে একটু সময়সাপেক্ষ।

তিনি ডেস্ক খুলে চামড়ার বাঁধাই একটা খাতা বার করে আনলেন এবং খাতার মধ্যে দেখতেও লাগলেন। হেনরিকে দেখে বড় ক্লান্ত লাগছিল। গ্র্যাঞ্জ এবার ঘড়ির দিকে দৃষ্টি দিল তিরিশ মিনিট। হেনরি বললেন, মনে হয় আরও একটু সময় লাগবে।

গ্র্যাঞ্জ–হ্যাঁ, স্যার।

হেনরি–একটা ৩৮ স্মিথ এবং ওয়েসন পাওয়া যাচ্ছে না। ওটা একটা বাদামী রঙের আবরণের মধ্যে ছিল এবং র‍্যাকের শেষ প্রান্তে।

গ্র্যাঞ্জ–এটাকে আপনি শেষ কখন দেখেছিলেন?

হেনরি–এই মুহূর্তে সেটা বলা সম্ভব হচ্ছে না ইন্সপেক্টর। এক সপ্তাহ আগে আমি একবার ড্রয়ারটা খুলেছিলাম, সেই সময়ে চুরি গিয়ে থাকলে শূন্য জায়গাটা আমার নজরে পড়ার কথা ছিল। তবে আমি জোর দিয়ে বলতে পারি না যে, ওটা আমার নজরে এসেছিল।

গ্র্যাঞ্জ–আপনাকে অনেক ধন্যবাদ স্যার, দেখি আমি কতটা কী করতে পারি।

বহুক্ষণ নিশ্চল মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকার পর হেনরি জানলা দিয়ে বাগানের দিকে চলে গেলেন। সেখানে তার স্ত্রী দস্তানা ইত্যাদি নিয়ে বাগানের কাজে ব্যস্ত। তিনি মনে মনে এটা ভাবতে থাকেন, ইনসপেক্টর কী চান? তিনি আবার চাকরদের নিয়ে পড়বেন নাকি? হেসে শুধু বলে ওঠেন, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি বড় ক্লান্ত হেনরি।

হেনরি–হত্যাকাণ্ড এই বিষয়টাই খুব চিন্তার, লুসি!

লুসি–তা তো বটে! কিন্তু সব মৃত্যুর রূপই তো এক। ক্যানসার বা অন্য কোনো রোগে মারা গেলেও মৃত্যুর চিত্রটা একইরকম হবে। যতদিন রোগে ভোগে ততদিন আত্মীয়স্বজনেরা উদ্বিগ্ন হয়ে ডাক্তার-বদ্যির জন্য ছোটাছুটি করে, টাকা বার করে এবং সবশেষে মারা গেলে আবার সেই ইত্যাদি…

হেনরি–কিন্তু আমাদের কাছে এই ব্যাপারটা ক্রমেই ঘোলা হয়ে যাচ্ছে। যতটা সহজ ভাবে বিষয়টাকে নিয়েছিলাম, এখন সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে ততটা সহজ বোধহয় নয়।

লুসি–এছাড়া আর উপায়ই বা কী, আমাদের সহ্য করা ছাড়া তো কিছু করার নেই! বর্তমান নিয়ে ভাবা বোধহয় উচিত হবে না, অসুবিধাটা কোনোভাবে দূর হলেই আমরা না হয় বাইরে চলে যাব। খৃস্টমাসে বা ইস্টারের ছুটিতে চলো না আমরা বেড়িয়ে আসি আইন্সউইক বা অন্য কোনো জায়গা থেকে, কি বলো, ভালো হবে না?

হেনরি–খৃস্টমাস আসতে এখনও অনেক দেরি তার জন্য না হয় পরেও ব্যবস্থা নেওয়ার সময় পাওয়া যাবে।

লুসি–তা অবশ্য আছে, আমি আগে থাকতে ভেবেও রেখেছি…তাছাড়া, সে বোধহয় এর মধ্যে মনস্থির করার সময়ও পেয়ে যাবে…

হেনরি–কে?

লুসি হেনরিয়েটার কথা বলছি। আমার মনে হয়, তারা অক্টোবরে–আগামী বছরের অক্টোবরে বিবাহটা সেরে ফেলতে পারে…তখন আমরা সেখানে গিয়ে হাজির হতে পারি…

হেনরি–তুমি সবসময় একটু বেশি ভেবে নাও, লুসি।

লুসি–তুমি বার্নবেস? সেখানে একটা ভালো দেখে স্টুডিও হতে পারে এবং হেনরিয়েটার একটা স্টুডিওর খুব প্রয়োজন। হাজার হোক তার প্রতিভা আছে একথা তো অস্বীকার করা যায় না। তার জন্য এডওয়ার্ডের গর্ববোধ হবে। দুটো ছেলে একটি মেয়ে–অথবা দুটো ছেলে দু’টো মেয়ে–চমৎকার হবে।

হেনরি–তুমি কতদুর কল্পনা করে নিয়েছ লুসি? আগে বিবাহ তো হতে দাও, তবে তো ছেলেমেয়ের কথা উঠছে।

হেনরি-বেচারা শয়তানী।

লুসি–কেন, শুধু শুধু শয়তানী কেন বলছ? সকলেই তো একদিন-না-একদিন মারা যাবে। মৃত্যুর যখন কোনো অবধারিত কাল নেই। মৃত ব্যক্তির জন্য শোক করে চোখের জল ফেলা আমার কুষ্টিতে নেই, ভালো লাগে না…

হেনরি লুসির দিকে কেমন অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন। কেবল বলে ওঠেন, আমি সর্বদাই ভাবতাম যে, তুমি বোধহয় জন ক্রিস্টোকে মনে মনে পছন্দ কর। ঠিক বলিনি কি?

লুসি-হা, তাকে আমার সত্যি ভালো লাগত। তার আকর্ষণও এড়িয়ে যাওয়া যেত না ঠিকই, তবে ব্যক্তি বিশেষের ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা আমার কোনোদিনই ধাতে সয় না।

.

১৮.

হারকিউল পৈরট জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই চোখে পড়ল হেনরিয়েটা স্যাভারনেক রাস্তা দিয়ে তার বাড়ির দোরগোড়ার দিকে এগিয়ে আসছে। জন ক্রিস্টো যেদিন নিহত হয় সেদিন তার গায়ে সবুজ টুইডের যে পোষাকটা ছিল আজও তার গায়ে উঠেছে সেই পোষাক। তার সঙ্গে রয়েছে একটা স্প্যানিয়াল কুকুর। পৈরট তাড়াতাড়ি গিয়ে সদর দরজা খুলে দাঁড়িয়ে পড়ে। হেনরিয়েটা তার দিকে তাকিয়ে মৃদুমন্দ হাসতে থাকে।

হেনরিয়েটা–আমি ভেতরে গিয়ে আপনার বাড়িটা একবার ঘুরে দেখতে পারি কি? বাড়ি দেখতে আমার বরাবরই খুব ভালো লাগে। আমি সর্বদাই কুকুর নিয়ে বেড়াই।

পৈরট–ইংরেজদের বোধহয় এই স্বভাব।

হেনরিয়েটা–আমি জানি, সেকথা আমি ভেবেও ছিলাম। সেই জগৎবিখ্যাত কবিতাটা জানেন আপনি? দিনগুলো একে একে কোথা দিয়ে যেন পার হয়ে যাচ্ছে, হাঁসকে খাওয়াই, স্ত্রীকেও ভর্ৎসনা করি, বাঁশীতে হ্যাঁন্ডেলের লায়গো বাজাই এবং ইচ্ছে হলে কুকুরের সঙ্গেও এক ছুট লাগাই আমি।

হেনরিয়েটার মুখে আবার হাসি ফুটে ওঠে, অত্যুজ্জ্বল অহেতুক হাসি। পৈরট তাকে নিয়ে বসবার ঘরে গিয়ে বসায়। হেনরিয়েটা ঘরের চারিদিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়–ঘরের পরিচ্ছন্নতা দেখে সে বিস্ময়ে মূক হয়ে যায়।

চমৎকার! সব জিনিষই দুটো করে। আমার স্টুডিও ঘুরে দেখার পর আপনি আমায় ভালো চোখে দেখার পরিবর্তে ঘৃণাই করবেন।

পৈরট-ঘৃণা করতে যাব কেন?

হেনরিয়েটা–ওঃ সেখানকার সব জিনিষে কাদার ছাপ।ওখানে একটি করে জিনিষও মজুত আছে–সংখ্যায় যদি দুটো থাকত তবে বোধহয় নষ্ট হয়ে যেত।

পৈরট–আমি তা ভালোভাবেই বুঝতে পারি। আপনি নিজে একজন শিল্পী।

হেনরিয়েটা-আপনি কি একজন শিল্পী নন পৈরট?

পৈরট–এই প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে, কিন্তু আমি বলব, না। অপরাধ কী জিনিস সেটা আমি বুঝি–সেগুলো কল্পনাশক্তির সর্বোচ্চ চর্চা। তাই সমাধান করার জন্যেও কোনো সৃজনী শক্তির কাছে দ্বারস্থ হতে হয় না। প্রয়োজন হয় শুধু সত্য উদঘাটনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা।

হেনরিয়েটা–সত্যের জন্য প্রবল ইচ্ছা–এই প্রয়াস আপনাকে হয়তো বিপজ্জনক পথে চালিত করতে পারে। এই সত্য কি আপনাকে সন্তুষ্ট করতে পারবে?

পৈরট–আপনি কী বলতে চাইছেন, মিস স্যাভারনেক?

হেনরিয়েটা–আমার বলার উদ্দেশ্য হল এই যে, আপনি সত্য জানার জন্য উদগ্রীব। কিন্তু জানাই কি সব? আপনি যদি সত্য জানতেই চান তবে আপনার সুপ্ত জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে?

পৈরট-আপনি বলছেন যে, ক্রিস্টোর মৃত্যুর সব রহস্য আমার কাছে মোটেই অজানা নয়–যে জ্ঞান আমার মধ্যে সঞ্চিত আছে সেটা নিজের মধ্যে রাখাই ভালো–তাই না? আচ্ছা আমি আপনাকে পাল্টা প্রশ্ন করি যে, জনের মৃত্যুর ব্যাপারে আপনি কতটুকু জানেন?

হেনরিয়েটা–সম্ভাব্য উত্তর–জাদা, সন্দেহের প্রথম পাত্র বা পাত্রী, স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন–সত্যি কী ঘৃণ্য ব্যাপার।

পৈরট–কিন্তু আপনি তো তা মেনে নিতে একেবারেই মনের দিক থেকে প্রস্তুত নন? কী উদ্দেশ্যে আপনার এখানে আগমন সেটা বললেন না তো?

হেনরিয়েটা–আমি এ ব্যাপারে স্থির নিশ্চিত যে, আপনার মতো সত্য উদঘাটনের প্রবল বাসনা আমার নেই। কুকুর নিয়ে বেড়াতে আসা ইংরেজপল্লীর রেওয়াজ, ওটা নিতান্তই বাজে অজুহাত। তাছাড়া এ্যাঙ্গ্যাটেলদের কুকুরও নেই, এদিকটা আপনি হয়তো লক্ষ্য করে থাকবেন।

পৈরট-হ্যাঁ, আমার দৃষ্টি গেছে সেদিকে।

হেনরিয়েটা–মালীর কাছ থেকে তাই আমি কুকুরটা বার করে এনেছি। আমি সর্বদাই সত্যের আশ্রয় নিই না, পৈরট।

আবার সেই উজ্জ্বল, উচ্চকণ্ঠে খান-খান হয়ে ভেঙে পড়া সেই অট্টহাসি।

পৈরট-না, আপনার সাধুতা সম্পর্কে আমি কোনো কথা তুলতে চাই না।

হেনরিয়েটা– কী করে বুঝলেন?

পৈরট-কারণ এটাকে সত্য বলে আমার মন মেনে নিয়েছে।

হেনরিয়েটা-সাধুতা, আমার এখনও ঠিক ভালোভাবে বোধগম্য হয় না যে কথাটার প্রকৃত অর্থ কী?

কার্পেটের দিকে তাকিয়ে নিশ্চল হয়েই বসে রইল সে, ধীরে ধীরে মাথা তুলে পৈরটের দিকে তাকাল।

হেনরিয়েটা–আপনি কি জানতে চান না যে, কোন উদ্দেশ্যে আমি এখানে হাজির হয়েছিলাম?

পৈরট-আপনি হয়তো কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছেন, কিন্তু মুখ ফুটে বলা সাহসে কুলোচ্ছে না।

হেনরিয়েটা-হা, ঠিকই বলেছেন, বিচারের মাধ্যমে অনুসন্ধান এবং পৈরট, আগামীকাল, তার জন্য মনস্থির করার ব্যাপারেও সময় লাগবে

হেনরিয়েটা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না, একেবারে ভেঙে পড়ে। সে উঠে ঘরময় পায়চারি করতে শুরু করে দিল। ঘরের জিনিষগুলো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়, একটা ফুলদানির স্থান পরিবর্তন করে প্রৈটকে জিজ্ঞাসা করে ওঠে, ব্যবস্থাটা আপনার পছন্দ হয়?

পৈরট–মোটেই না মিস।

হেনরিয়েটা–আমি আগে থাকতেই জানতাম যে, আপনি এ ব্যাপারটা কখনও মেনে নেবেন না।(সে তাড়াতাড়ি করে জিনিষগুলোতে আবার যথাস্থানে রেখে দিলে) আচ্ছা লোকের যদি বলার মতো কিছু থেকেই থাকে এবং সে যদি নিজের মুখে কিছু বলতে চায় তবে আপনার মতো লোকের কাছে বলতেই পারে, কিন্তু পুলিসের এটা জানার কোনো প্রয়োজন আছে কি, আমি জন ক্রিস্টোর মিসট্রেস ছিলাম।

পৈরট–তাই নাকি? আপনারা প্রেমিক-প্রেমিকা ছিলেন?

হেনরিয়েটা–একথা বলে যদি আপনার মনে সুখ হয়, তাহলে বলতে কোনো বাধা নেই।

পৈরট–আপনি যেভাবে কথাটা বলছেন, আসলে ব্যাপারটা কি তাই ছিল?

হেনরিয়েটা–না।

পৈরট–কেন নয়?

হেনরিয়েটা নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ে। সে উঠে গিয়ে পৈরটের পাশে এসে বসে পড়ে এবং ধীর কণ্ঠে শুধু বলে ওঠে-পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে নির্ভুল ভাবে সব জিনিষ ব্যক্ত করার সবার মধ্যেই একটা প্রয়াস থাকে।

হেনরিয়েটার ব্যাপারে জানার আগ্রহ পৈরটের উৎসাহ যেন দ্বিগুণ হয়ে যায়। সে বলে ওঠে, আপনি জন ক্রিস্টোর মিসট্রেস ছিলেন? আপনাদের এই সম্পর্ক কতদিনের?

হেনরিয়েটা–প্রায় ছ’মাসের মতো হবে।

পৈরট–এই ব্যাপারটা আবিষ্কার করতে পুলিসের খুব অসুবিধা হবার কথা নয়।

হেনরিয়েটা–আমার মনে হয় তারা এদিক দিয়ে যাচ্ছে না। অর্থাৎ তারা যদি কিছুর সন্ধান করতেই চায়, তবে হয়তো একদিন আবিষ্কার করলেও করে উঠতে পারে।

পৈরট-হ্যাঁ, তারা এদিকে খোঁজ নেবে।

হেনরিয়েটা–আমি কিন্তু ভেবেছিলাম তারা এদিকের ব্যাপারেও খবর সংগ্রহ করবে। আচ্ছা, পৈরট লোকেরা কী করে? এ্যাঞ্জের কাছে গিয়ে কী বা বলে? এমন অদ্ভুত গোঁফের কাছে গিয়ে তাদের কী বা বলার থাকতে পারে। ওটা নেহাতই একটা পারিবারিক গোঁফ।

পৈরট–যেমন আমার?

হেনরিয়েটা–আপনার গোঁফ এবং পৈরট? আপনার গোঁফের সঙ্গে কারো তুলনাই চলে না, এককথায় এটা অতুলনীয়।

পৈরট–সত্যিই।

হেনরিয়েটা–এই জন্যই আমি আপনার সঙ্গে এমন ধারায় বলছি। আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে পুলিসের আমার এবং জনের মধ্যে সম্পর্কটা জানা দরকার। কিন্তু তোক জানাজানি হওয়ার এটার কি কোনো প্রয়োজন আছে।

পৈরট–সেটা সম্পূর্ণ অন্য জিনিষের ওপর নির্ভরশীল। পুলিস যদি মনে করে থাকে যে, এই ঘটনার সঙ্গে মামলার কোনো সম্পর্ক নেই তবে চেপে যেতে পারে। কিন্তু এই ব্যাপারটা প্রকাশে আপনি কি খুব উদগ্রীব?

হেনরিয়েটা–আপনি হয়তো এটাকে কপটতা ভাবছেন। আপনি মনে মনে ভাবছেন যে, জাদার মানসিক শক্তির কথা ভাবছি বলেই হয়তো জনের মিসট্রেস হবার কোনো সম্ভাবনাই আমার মধ্যে নেই। তার বিবাহিত জীবনের যা ক্ষতি হবার ছিল তা হয়ে গেছে। এর চাইতে আরও অতিরিক্ত বোঝা তাকে সারাজীবন টেনে নিয়ে যেতে হবে কেন?

পৈরট–আপনি মিসেস জার্দার জন্যই এমনটি বোধহয় ভাবছেন?

হেনরিয়েটা–আপনি হয়তো এটাকে কপটতা ভাবছেন। আপনি মনে মনে ভাবছেন যে জাদার মানসিক শক্তির কথা ভাবছি বলেই হয়তো জনের মিসট্রেস হবার কোনো সম্ভাবনাই আমার মধ্যে নেই। তার বিবাহিত জীবন আমি ভেঙে দিইনি, আমি ছিলাম মিছিলের অন্যতম যাত্রী।

পৈরট-আঃ, এটাও ঠিক এইরকম?

হেনরিয়েটা–না, না, না, আমার আপত্তি ঠিক এই জায়গাতেই–আপনি আমার মতো করে ব্যাপারটা ভাবছেন না। জন সম্পর্কে লোকে যে ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে, আমি তাতেই মনে বড় ব্যথা পাই। এইজন্যেই আমি আপনার কাছে ছুটে এসেছি। আমি হয়তো আপনাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে উঠতে পারছি না। আমার কাছে এই ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, কাগজে শিরোনাম ছাপা হবে, এক চিকিৎসকের, ভালোবাসার জীবনকাহিনী, জার্দা, আমি ভেরোনিকা ক্রে। জন কিন্তু কোনোদিনই তেমন স্বভাবের ছিল না, সে কিন্তু স্ত্রীলোকের ব্যাপারে কোনোদিনই বেশি মাথা ঘামাত না, তার কাছে স্ত্রীলোকই সবকিছু ছিল না, তার কাজের জগৎ নিয়েই সে ব্যস্ত থাকত। হ্যাঁ, কাজের মধ্যে তার উৎসাহ, উদ্দীপনা, উত্তেজনা এবং দুঃসাহস মুখ লুকিয়ে আছে। অসতর্ক কোনো মুহূর্তে জনকে যদি জিজ্ঞাসা করা হতো, তার মনে কোনো স্ত্রীলোকের ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা সবসময়ের জন্য ঘুরপাক খেত, সে কার নাম উল্লেখ করবে জানেন কি? মিসেস ক্যাবট্রি ছাড়া আর কার নামই বা সে বলত।

পৈরট–(বিস্ময়ের সঙ্গে) এই মিসেস ক্যাবট্রির আসল পরিচয় কি? কে সে?

হেনরিয়েটা–তিনি এক বৃদ্ধা। কুৎসিত-নোংরা স্বভাবের এই বৃদ্ধার সমস্ত শরীরে এখন বার্ধক্য নেমে এসেছে, দেহের মাংস সব কুঁচকে গেছে, ক্রিস্টোফার হাসপাতালের সেও এক রোগিণী, তার রিজওয়ের রোগ কালেভদ্রে দেখা দিত। আপনি যদি এই রোগের শিকার হন, আপনি অবশ্যই মারা পড়বেন, কারণ এই রাগের কোনো ওষুধ নেই, তাই আরোগ্য লাভেরও নেই কোনো উপায়। ক্যাবট্রির শরীরেও রোগ আছে তবু সে বাঁচতে চায়। জন সেই ওষুধ বার করবে, হরমোন ক্ষরণের প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। জন বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চলেছে, মিসেস ক্যাবট্রি জনের খুব ভক্ত, জন এবং সে রোগের বিরুদ্ধে যেন সংগ্রাম করে যাচ্ছে, মাসের পর মাস ধরে রিজওয়ের ব্যাধি এবং মিসেস ক্যাবট্রি, সর্বদাই জনের মধ্যে উপস্থিত এবং তাদের আবেদন জনের মনে যে অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে, এমন আর কিছু নেই যা তার মনে নিজের একটা স্থান দখল করে রেখেছে। জন এমনই এক চিকিৎসক ছিল, পুরো হার্লি স্ট্রিটের মধ্যে এবং সকল ধনী মানুষের কাছের মানুষ ছিল তাদের প্রিয় ডাক্তার জন, আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পাচ্ছি না যে, আপনাকে এই সত্য কেমন ভাবে বোঝাব যে, নতুন ওষুধ একদিন জন ক্রিস্টোর হাত দিয়েই আবিষ্কৃত হবে, এই ছিল তার একমাত্র সাধনা।

পৈরট–আপনি বোধহয় ঠিকমতো চিনতে পেরেছিলেন।

হেনরিয়েটা-ওঃ, হ্যাঁ, জন আসত এবং একথাই সে বলত। আমার কাছে অবশ্য সংক্ষিপ্ত করেই বলত, কারণ সে নিজের মনেই সব কথা বলে যেতে পারত। অন্য রোগীর রোগ সম্পর্কে যে আপনমনেই আলোচনা করত, বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসার কথাও বলত, প্রতিটি রোগের বিরুদ্ধে কেন সে ঝাঁপিয়ে পড়ত, কী ভীষণ একাগ্রতা, অনেক সময়ই খুশী, অনেক সময় আক্রোশ, কখনও থাকত ক্লান্তির অবসাদ…

পৈরট-আপনার নিশ্চয়ই প্রায়োগিক জ্ঞান আছে?

হেনরিয়েটা-হা, জন যা বলত, আমি তা মনোযোগ দিয়ে শুনতাম এবং শিখতাম, বই পড়েও জানা যেত।

পৈরট–কিন্তু আপনি তো দেখছেন?

হেনরিয়েটা– না দেখে থাকলে হয়তো ভুল বলা হবে। লোকেরা শুনলে হয়তো ভেবে বসতে পারে যে, আমার জনের ওপর একটা প্রভাব ছিল এবং জনের কাছ থেকে আমি অনেক কিছুই শিখতে পেরেছি। গ্র্যাঞ্জকে বোঝানোবোধহয় ততটা সহজ হবে না।

পৈরট–কিন্তু আপনি তো দেখেছেন?

হেনরিয়েটা–তা বোধহয় হবে না। সে তার ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যক্ষ করবে তারপরে বিচার করবে।

হেনরিয়েটা–কেউ যদি জনের কোনো ক্ষতি করে থাকে সে অন্য কেউ নয় স্বয়ং আমি। জন এবং তার চিন্তার মাঝখানে আমি এসে পড়েছিলাম। আমার জন্যই সে তার সাধনায় পুরোপুরিভাবে মনঃসংযোগ করতে পারছিল না। সে ভীত মন নিয়েই ভাবতে থাকল যে, সে আমাকে তার নিজের মনে করে ভাবতে শুরু করেছে তাই সে অন্য কাউকে আর ভালোবাসার কথা মনেও আনতে পারছিল না। আমার কাছে সে প্রেম নিবেদন করল, কারণ সে আমার ব্যাপারে কোনোদিনই বেশি চিন্তা করতে একেবারেই চাইত না। ব্যাপারটাকে সে একটু হালকা করতে চাইল, সহজ করতে চাইল, তার আর ঠিক দশটা ব্যাপারের মতোই।

পৈরট–আর আপনি? আপনি সেটা খুশী মনেই মেনে নিলেন?

হেনরিয়েটা–না, আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি–হাজার হোক–মানুষ তো…

পৈরট–কেন?

হেনরিয়েটাকেন আবার, আমার মনোগত বাসনা ছিল জনকে খুশী দেখার। আমি চেয়েছিলাম জন যা চায় তাই নিয়েই সে যেন পথ চলতে পারে। তার ধ্যানজ্ঞান বলতে সে একটা জিনিষই জানত, সেটা তার কাজ। এবং এই কাজের মধ্যেই সে নিজেকে মগ্ন রাখতে চেয়েছিল–আমি সেইদিক থেকেই তার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম।

পৈরট–এইমাত্র আপনি ভেরোনিকা ক্রেরও নাম উল্লেখ করেছিলেন; সেও কি ডাঃ ক্রিস্টোর বন্ধু ছিল?

হেনরিয়েটা–শনিবারের আগে তাদের মধ্যে শেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল আজ থেকে পনেরো বছর আগে।

পৈরট–সেও তাকে পনেরো বছর আগে দেখেছিল?

হেনরিয়েটা–তাদের বিবাহের সব প্রায় পাকা হয়ে গিয়েছিল। জন ভেরোনিকার প্রেমে অন্ধ ছিল–কিন্তু ভেরোনিকাকে এক নম্বরের কুকুরী বলে সম্বোধন করলেও বোধহয় ভুল বলা হবে না, সে নিজের স্বার্থ এবং আত্মঅহমিকা ছাড়া আর কিছুই বুঝত না। তার মনের বাসনা ছিল জনকে সে নিজের কথামতো ওঠাবে-বসাবে। এককথায় তাকে পোষা-স্বামী হয়ে স্ত্রীর আঁচলের তলায় থাকতে হবে। কিন্তু জন একেবারে বেঁকে বসল, তাই বিয়েটাও ভেঙে গেল, জনের অবশ্য এই বিবাহ না হওয়ায় মনে কোনো দুঃখ ছিল না। সে জাদাকে বিবাহ করল, জার্দা অবশ্য এই ঘটনার কিছুই জানত না। দেখতে দেখতে পনেরোটা বছর কেটে গেল–এর মধ্যে তাদের আর দেখাসাক্ষাৎহয়নি, কিন্তু জন ভেরোনিকার স্মৃতি মন থেকে পুরোপুরি ভাবে মুছে ফেলতে পারেনি।

পৈরট–এত বছর বাদে দু’জন দু’জনের মুখোমুখি হল এবং জন তার সঙ্গেই বেরিয়ে গেল। জন হলোতে ফিরে এল রাত প্রায় তিনটে নাগাদ।

হেনরিয়েটা–আপনি একথা কী করে জানলেন?

পৈরট–বাড়ির এক ঝি’র দাঁতে ব্যথা হয়েছিল, তাই সে না ঘুমিয়ে জেগেই ছিল। জনের ফিরে আসা তার চোখে পড়েছিল।

হেনরিয়েটা-হ্যাঁ।

পৈরট-আপনি কী করে জানতে পারলেন?

হেনরিয়েটা–(কিছুক্ষণ নীরব থেকে) আমি জানলার দিকে তাকিয়ে বসেছিলাম, তাই তার ফিরে আসাটা চোখে পড়া খুব স্বাভাবিক ছিল।

পৈরট–আপনারও কী দাঁতে ব্যথা হয়েছিল মিস?

হেনরিয়েটা এবার হেসে ফেলে, সে হাসিমুখে শুধু বলে, ব্যথা হয়েছিল ঠিকই তবে এই ব্যথা সেই ব্যথার মতো নয় পৈরট।

তারা রাস্তা পার হয়ে এবার বনের মধ্যে প্রবেশ করল।

হেনরিয়েটা–আমাদের পুলের পাশ দিয়ে যাওয়াটা বোধহয় উচিত হচ্ছে না। বাম দিকে গিয়ে, উপরের পথ বরাবর ফুলের বাগানে বরং আমরা যেতে পারি।

একটা পথ খাড়াভাবে পাহাড়ের দিকে বনের মধ্যে চলে গেছে। কিছুক্ষণ পর তারা এসে থামল সীমান্তবর্তী একটা সমকোণের মতো রাস্তায়। হেনরিয়েটা একটা বেঞ্চে এসে বসে এবং পৈরট এসে তার পাশেই বসে পড়ে। তাদের ওপরে ও পেছনে শুধু বন আর নিচে ঘন বাদামগাছের ঝোঁপ। সামনের দিককার একটা বাঁকা পথ নিচের দিকে চলে গেছে, যেখান থেকে নজরে আসছিল নদীর জলের ঝিকিমিকি।

পৈরট নীরবে হেনরিয়েটার দিকে তাকিয়েছিল। তার মুখের ভাবে এখন একটু পরিবর্তন এসেছে, তবে উত্তেজনা নেই বললেই চলে। তার মুখের চেহারা দেখে তার আসল বয়স বোঝা দায়।

পৈরট–আপনি কী এত ভাবছেন মিস?

হেনরিয়েটা–আইন্সউইকের কথা।

পৈরট–আইন্সউইক কি?

হেনরিয়েটা–আইন্সউইক একটা জায়গার নাম। ওটা একটা স্বপ্নের জগৎ, সাদা ছিমছাম বাড়ি, ম্যাগনোলিয়ার বড় সমারোহ, পাহাড়ী বনভূমি

পৈরট-ওটা কি আপনার বাড়ি?

হেনরিয়েটা–না, আমার বলে কিছু নয়। আমি আয়ারল্যান্ডের বাসিন্দা। ছুটিতে আমরা সকলেই এখানে হাজির হয়েছিলাম–এডওয়ার্ড, মিডগে এবং আমি। আসলে বাড়িটা লুসির, বাড়িটার কর্তা ছিল লুসির বাবা কিন্তু তার মৃত্যুর পরে এই বাড়ির উত্তরাধিকারী এখন এডওয়ার্ড।

পৈরট–ঐ পথ ধরেই তো আপনি কাল সুইমিং পুলে গিয়েছিলেন?

হেনরিয়েটা–না, এ পথ মাড়াইনি, এর কাছাকাছি কোনো পথ দিয়ে। সুইমিং পুল আমার চোখে ঘৃণার বস্তু, সেই সঙ্গে হলোকেও চোখে পড়ার পর আমার চোখে ঘৃণাই ফুটে ওঠে।

পৈরট গুন গুন করে বলে ওঠে–”ঘৃণা করি আমি পশ্চাৎপটে ভয়ের গহুর, ঊর্ধ্ব মাঠে অধর তাহার রক্তে রাঙা উষর প্রান্তর, লোহিত শৈলের স্তর নীরব ভীতির মতো নামে, বিন্দু বিন্দু করে রক্তের ক্ষরণ, নিস্তব্ধ মাঝে জাগে যত প্রশ্ন, প্রতিধ্বনির জবাবে তাহারে করিছে মরণ।”–হেনরিয়েটা অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়, পৈরট কবিতার অংশবিশেষ আবৃত্তি করে চলে।

পৈরট–টেনিসন, আপনাদের সবার প্রিয় লর্ড টেনিসনের কবিতা বলছি।

হেনরিয়েটা কবিতার শেষ লাইন আওড়াতে থাকে। আপন মনে বলে ওঠে হ্যাঁ, এটা প্রতিধ্বনিই বটে!

পৈরট–প্রতিধ্বনির মানে কী বোঝাতে চাইছেন?

হেনরিয়েটা–এই স্থানটা হল নিজেই নিজের প্রতিধ্বনি! গত শনিবার আমি এডওয়ার্ডের সঙ্গে পাহাড়ের স্তর পর্যন্ত চলে গিয়েছিলাম। এই স্থানটা আইন্সউইকের প্রতিধ্বনিরই সমতুল্য। আসলে আমরা তো আর এ্যাঙ্গক্যাটেল নই, এ্যাঙ্গক্যাটেলের প্রতিধ্বনি।

আমরা আসল নই, যেমন জন আসল ছিল। আপনি যদি জনকে একবারও জানতে পারতেন পৈরট। সে ছিল জীবন্ত আসল। জনের মতো আমরা কেউ জীবন্ত নই, তার তুলনায় আমরা সব ছায়া। জন সত্যিকারের জীবন্ত মূর্তি ছিল।

পৈরট–আমি জানতাম। তার মৃত্যুর সময় আমি তার দর্শন লাভ করেছি।

হেনরিয়েটা–আমরা সব প্রতিধ্বনিরা শুধু বেঁচে আছি, আর যে আসল; সে আজ মৃত।

হেনরিয়েটার মুখমণ্ডল থেকে তারুণ্য যেন অপসৃত হচ্ছে, হঠাৎ বেদনায় তার ঠোঁট একেবারে তিক্ত এবং বিকৃত।

পৈরট–আপনার কাকীমা লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল, ডাঃ ক্রিস্টোকে কি পছন্দ করতেন?

হেনরিয়েটা–লুসি? সে ছিল আমার খুড়তুতো বোন, কাকীমা নয়। হ্যাঁ, সে তাকে ভীষণ পছন্দ করত।

পৈরট–মিস্টার এডওয়ার্ড এ্যাঙ্গক্যাটেলও আপনার খুড়তুতো ভাই? সেও কি ডাঃ ক্রিস্টোকে পছন্দ করত?

হেনরিয়েটা–বিশেষভাবে করত সেটা বোধহয় বলা যায় না, তখন সে তাকে ভালোভাবে জেনে উঠতে পারেনি।

পৈরট–আপনার এক খুড়তুতো ভাই ডেভিডও কি জন ক্রিস্টোকে পছন্দ করত?

হেনরিয়েটা–ডেভিড আমাদের সকলকেই ঘৃণার চোখে দেখে। লাইব্রেরি ঘরে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা পড়ে সে সময় কাটায়। ডেভিডের কথা চিন্তা করলে আমার বড় দুঃখ হয়। তার বাড়ির আবহাওয়া ছিল একদম সঙ্কটপূর্ণ। তার মায়ের অস্থিরচিত্তই ছিল এই সঙ্কটের মূলে–তাছাড়া এককথায় তিনি ছিলেন অথর্ব। নিজে রক্ষা করার ব্যাপারে ডেভিড সকলের থেকে নিজেকেই সব থেকে বেশি প্রাধান্য দিত, এই ভাবে যতদিন সম্ভব চালিয়ে যাচ্ছে।

পৈরট-সে কি নিজেকে ক্রিস্টোর থেকে উৎকৃষ্টতর মনে করত?

হেনরিয়েটা–সেই প্রচেষ্টাও সে করেছিল, কিন্তু সফলতার মুখ দেখেনি। আমার সন্দেহ হয়, ডেভিড জনের মতো একজন হয়ে উঠতে চেয়েছিল। তাই সে মনে মনে তাকে অপছন্দ করত।

বাদামবনের মধ্যে দিয়ে পৈরটের দৃষ্টি চলে যায় একেবারে সুইমিং পুলের ধারে, সেখানে একজন তোক কী যেন খুঁজছে–নুয়ে নুয়ে গভীর মনোযোগে কিসের যেন সন্ধানে ঘুরে ফিরছে। পৈরট বলে ওঠে, এরা সকলেই ইন্সপেক্টর এ্যাঞ্জের লোক।

হেনরিয়েটা–সূত্র। আমার মনে হয় কোনো সূত্র তারা হাতে পেতে চাইছে। সিগারেটের ছাই, পায়ের দাগ, পোড়া দেশলাই খুঁজছে, তাই না?

পৈরট–হ্যাঁ, পুলিস এইসবের কোনো একটা বোধহয় পেতে চাইছে। এইসব জিনিষের সুত্র ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে নিজেকে আড়াল করে থাকে।

হেনরিয়েটা–আমার মনে হয়, আমি বোধহয় আপনার কথা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।

পৈরট–খুবই ছোট কথা। অর্থাৎ এইসব ক্ষেত্রে সিগারেটের ছাই প্রভৃতির প্রয়োজন নেই বলে, এখানে প্রয়োজন একটা জিনিষের অপ্রত্যাশিত কাজ..

হেনরিয়েটা–আপনি কি বিশেষ কোনো বিষয়ের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করছেন?

পৈরট–আমি শুধু একটা কথাই ভাবছি, আপনি কীভাবে এগিয়ে গিয়ে জার্দার হাত থেকে রিভলবারটা নিলেন এবং জলে ভাসিয়ে দিলেন।

হেনরিয়েটা–পৈরট, জার্দা নিঃসন্দেহে কৌশলহীনা রমণী, শোকের মুহূর্তে রিভলবারে গুলি থেকে থাকলে সে হয়তো অন্য কাউকে মেরে বসবে, এই ভয়েই তার হাত থেকে রিভলবারটা আনতে ছুটে গিয়েছিলাম।

পৈরট–কিন্তু আমার তো ধারণা, রিভলবারটা সবার অলক্ষ্যে জলে দিয়ে কৌশলহীনার মতো কাজ করেছেন স্বয়ং আপনি!

হেনরিয়েটা–যা আঘাত পাবার ছিল সেটা তো বুকেই নিয়েছিলাম আমি। আচ্ছা, পৈরট, এবার আপনি কি উপদেশ দিতে শুরু করলেন?

পৈরট-হাতে যদি থাকত তবে জানা যেত, মিসেস ক্রিস্টোর আগে কে এই বন্দুকটা ব্যবহার করেছিল। কিন্তু এখন আর সেটা জানার কোনো উপায়ই রইল না!

হেনরিয়েটা–আপনার মনে হয় এই সন্দেহই জাগছে যে, সে ছাপ আমার আঙুলের?

আপনারা হয়তো ভাবছেন জনকে গুলি করে রিভলবারটা আমি তার পাশে ফেলে রেখেছি এবং জাদা এসে সেটা নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। তাই না? কিন্তু আমি যদি সেই কাজ করেই থাকব, তবে আঙুলের ছাপ রিভলবারে রেখে দিতাম এমন বোকা আমি নই। এইটুকু বুদ্ধি আমার আছে একথা নিশ্চয়ই আপনারা মনে করেন?

পৈরট-হ্যাঁ, আমি বিশ্বাস করি, বুদ্ধি আপনার আছে।

হেনরিয়েটা–তাই হয়তো আপনারা ভেবে বসে আছেন, জনকে আর কেউ নয়, আমি হত্যা করেছি?

পৈরট–ডাঃ ক্রিস্টো মৃত্যুর পর শুধু ‘হেনরিয়েটা’ উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন?

হেনরিয়েটা–আপনারা ভেবে নিচ্ছেন, জন আমার ওপর দোষ চাপিয়ে চলে গেছে? তাই নয় কি?

পৈরট-তা হলে কী?

হেনরিয়েটা–কেন, আপনি কি এর মধ্যে ভুলে গেলেন? এই কিছুক্ষণ আগে আপনাকে আমি বলেছিলাম, আমার আর জনের মধ্যে কী সম্পর্ক ছিল।

পৈরট–আঃ, হ্যাঁ, তিনি আপনার প্রেমিক ছিলেন, তাই মৃত্যুর সময়ে হেনরিয়েটা’ বলা বড়ই হৃদয়বিদারক।

হেনরিয়েটা–জন হেনরিয়েটা’ বলে আমাকে তার মৃত্যুর জন্য দায়ী করে যায়নি। আপনাদের বোঝা উচিত ছিল যে, আমার মতো লোকের কাউকে মেরে ফেলা মোটেই সম্ভবপর নয়। আমার নামটা জনের মুখে শুনে আমাকে আপনারা দায়ী করতে উঠে পড়ে লেগেছেন।

পৈরট–আপনি আগে থাকতে প্রস্তুতি নিয়েই ছক কষে জন ক্রিস্টোকে এই পৃথীবী থেকে সরিয়ে ফেলেছেন একথা আমাদের মনেও আসেনি। তবে ঝোঁকের মাথায় বা আক্রোশে অন্ধ হয়ে এমনটা যদি করেও ফেলতেন, তবে নিজেকে বাঁচিয়ে করতেন।

হেনরিয়েটা এবার উঠে পড়ে। সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, বিবর্ণ এবং চিন্তাক্লিষ্ট মুখে। শুষ্ক হাসি হেসে শুধু বলে ওঠে, আমি এই ভেবে এখানে এসেছিলাম আপনার মনের কোনো এক জায়গায় আমার স্থান আছে।

হারকিউল পৈরট প্রত্যুত্তরে বলে, সেটা বোধহয় আমার দুর্ভাগ্য।

.

১৯.

হেনরিয়েটা চলে যাবার পরেও পৈরট চুপচাপ বসে থাকে। তার চোখে পড়ে নিচের রাস্তা দিয়ে ইন্সপেক্টর গ্র্যাঞ্জ দৃঢ় পদক্ষেপে পুলের পাশ দিয়ে পাশের রাস্তাটা এখন ধরেছে। ইন্সপেক্টর উদ্দেশ্য ছাড়া একটা পাও চলে না। সে হয় রেস্টহ্যাভেন-এ না হয় ডাভকোট যাবে। পৈরট শুধু ভাবছে কোথায় সে যাবে?

সে উঠে পড়ে যে রাস্তা ধরে এসেছিল সেই পথ ধরেই চলতে শুরু করে দেয়। গ্র্যাঞ্জের সাথে মুখোমুখি হবার পরেই জানতে পারবে ব্যাপারটা কতদূর এগিয়েছে।

রেস্টহ্যাভেন-এ পৌঁছে কোনো আগন্তুক তার নজরে এল না। যেদিকে ‘ডাভকোট’ সেই দিকেই পৈরট তাকায়। সে জানতো যে লন্ডনে এখনও ভেরোনিকা ক্রে ফিরে যায়নি। সে লক্ষ্য করে যে ভেরোনিকা ক্রে সম্পর্কে তার উৎসাহ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সেই লোমশ শেয়াল, দেশলাইয়ের বাক্সগুলো, হঠাৎ করে শনিবার রাতে অতর্কিতে আক্রমণ এবং পরিশেষে হেনরিয়েটা স্যাভারনেকের জন ও ভেরোনিকার সম্পর্কের রহস্য উদঘাটনের সাবলীল স্বীকারোক্তি তার উৎসাহ আরও বাড়িয়ে দেয়। তার কাছে এটা একটা চমৎকার প্যাটার্ন বলেই মনে হয়।

জার্দা ক্রিস্টো কি তার স্বামীকে গুলি করেছে? দেখেশুনে মনে হয় ব্যাপারটা মোটেই তেমন সহজ নয়? হয়তো খুবই জটিল? হেনরিয়েটার সঙ্গে কথা বলে তার মনে এই উপলব্ধি হচ্ছে যে, ব্যাপারটা জটিল না হলেও খুব সহজও নয়। হেনরিয়েটার প্রতি তার সন্দেহ জাগায় সে নিজের ওপরেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল। তবে হেনরিয়েটাকে সে কখনোই জনের হত্যাকারিণী বলে মেনে নেয়নি। সে শুধু এই ভেবেছিল যে, হেনরিয়েটা হয়তো কিছু জানে বা সে হয়তো কোনো কিছু গোপন করছে বা আড়াল করতে চাইছে? কিন্তু লুকোনোর মতো কী থাকতে পারে?

সুইমিং পুলের দৃশ্যটা আবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সত্যি সাজানো গোছানো এক দৃশ্য। ঠিক যেন একটা মঞ্চ! কিন্তু মঞ্চস্থ কে করছে? কার জন্যই বা এই মঞ্চস্থ করা হচ্ছে? দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর তার কানেই যেন খট করে লাগে। সে ভাবে, এটা ধৃষ্টতা–নিছক একটা কৌতুক। এটা এখনও ধৃষ্টতা ঠিকই–তবে কৌতুক নয়। আর প্রথম প্রশ্নের উত্তর? সে নীরবে মাথা নাড়ে। সে জানে না, বিন্দুমাত্র অনুমান করার মতোও তার জ্ঞান নেই।

আধবোজা চোখে পৈরট তার কল্পনার জগতে চলে যায়, মানসচক্ষে সকলেই তার কাছে স্পষ্ট। স্যার হেনরি–পক্ষপাতশূন্য, দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন, বিশ্বাসী, সাম্রাজ্যের শাসক। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল–অস্পষ্ট ছায়ার মতো-প্রগভা-মোহময়ী অসম্ভব কাহিনী তৈরির ক্ষমতা বিশিষ্ট এককথায় মূল্যহীন এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনা। হেনরিয়েটা–যে নিজের থেকেও জন ক্রিস্টোকে বেশি ভালোবেসেছিল। শান্ত, ধীর এবং ঋণাত্মক এডওয়ার্ড এ্যাঙ্গক্যাটেল। ঋণাত্মক কালো মেয়েটা মিডগে হার্ডক্যাসল, অর্ধচেতন উদাস মনোভাবাপন্ন জার্দা ক্রিস্টো রিভলবার হাতে দণ্ডায়মান। তারুণ্যের ব্যক্তিত্ব বিশিষ্ট ডেভিড এ্যাঙ্গক্যাটেল। এই হত্যাকাণ্ডে সকলেই যে ভীষণভাবে বিব্রত। প্রত্যেক মানুষেরই ব্যক্তিগত দুঃখ, তার অর্থ এবং গল্প আছে। এই পরস্পর সম্পর্কশূন্য চরিত্রগুলোর মধ্যে কোথায় যেন আসল সত্য মুখ লুকিয়ে আছে। পৈরটের কাছে একটা জিনিষ ভীষণ মূল্য রাখে–সত্য, সত্যের সন্ধান। জন ক্রিস্টোর মৃত্যুর রহস্য তাকে জানাতেই হবে। সে আবিষ্কার করে জনসমক্ষে আনতে চায় হত্যাকারী কে? কার অদৃশ্য হস্ত এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কলকাঠি নেড়ে চলেছে? এই হত্যাকাণ্ডের পেছনেও কোনো উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই কাজ করেছে। এটা কোনো স্বার্থান্বেষীরই কাজের নমুনা।

.

ভেরোনিকা বলে ওঠে–অবশ্যই ইন্সপেক্টর, আমি আপনাকে সাহায্য করার ব্যাপারে সবসময়ে উগ্রীব।

গ্র্যাঞ্জ বলল–ধন্যবাদ, জেনে খুশী হলাম মিস ভেরোনিকা। শনিবার সন্ধ্যার পরে আপনি হলোতে এসেছিলেন?

ভেরোনিকা–হ্যাঁ, আমার দেশলাই ফুরিয়ে গিয়েছিল। আমি ভুলে গিয়েছিলাম গ্রামে ওটার কী মূল্য দাঁড়ায়।

গ্র্যাঞ্জ–আপনি এতটা পথ হেঁটে হলোতে এলেন কেন? পৈরট যখন আমাদের পাশেই থাকেন, তার কাছে গেলেই তো পারতেন?

ভেরোনিকা–আমি ঠিক জানতাম না, আমার পাশের ঘরে কে থাকেন। আমি ভেবেছিলাম তিনি হয়তো কোনো বিদেশী হবেন। তাঁর কাছে দেশলাই ধার করতে গেলে তিনি হয়ত মনে মনে একটু বিরক্তই হবেন।

গ্র্যাঞ্জ–আপনি দেশলাইও পেয়ে গেলেন এবং পুরনো বন্ধু হিসেবে ক্রিস্টোর দেখাও পেয়ে গেলেন?

ভেরোনিকা–হা, বেচারী জন, পনেরো বছর আমি তাকে চোখের দেখাও দেখিনি।

গ্র্যাঞ্জ-সত্যি? তাকে দেখার পর আপনার মন খুশীতে নেচে উঠল?

ভেরোনিকা-সত্যি, অস্বীকার করব না, তাকে দেখে ভীষণ আনন্দ পেয়েছিলাম। একজন পুরোনো বন্ধুর দেখা পেলে কোন্ লোক খুশী হয়ে থাকে ইন্সপেক্টর?

গ্র্যাঞ্জ–কোন কোন সময় হয়?

ভেরোনিকা–আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য জন আমার বাড়ি ছুটে এসেছিল, কিন্তু দেখা হওয়ার সঙ্গে তার নিহত হওয়ার কোনো সম্পর্ক তো দেখছি না।

গ্র্যাঞ্জ–আপনি কী বলছেন মিস ক্রে?

ভেরোনিকা–বহুদিন ধরেই আমাদের মধ্যে পরিচয় ছিল–আমাদের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে দক্ষিণ ফ্রান্সে। জনের বয়স হয়েছে, তাছাড়া আর কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমি শুনেছি যে, তাদের বিবাহিত জীবন খুব সুখের নয়, জার্দা জনের রোগিণীদের সম্বন্ধে মনে ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করত এবং ঈর্ষায় জ্বলে গিয়ে নানারকম অশান্তিরও সৃষ্টি করত।

গ্র্যাঞ্জ–না, না, তিনি তেমন ধরনের কোনো কাজ করেন না। আপনার কি মনে হয় মিস ক্রে, মিসেস ক্রিস্টো তার স্বামীকে হত্যা করেছেন?

ভেরোনিকা–আমি ঠিক বলতে পারি না। বিচারের আগে কারো সম্বন্ধে এ ধরনের মন্তব্য করা কখনোই উচিত হবে না। আমি খুব দুঃখিত ইন্সপেক্টর। আমার ঝি-র মুখ থেকে শোনা কথা যে, জার্দা জনের মৃতদেহের পাশে রিভলবার হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। আপনি তো জানেন ইন্সপেক্টর, এই গ্রাম্য দেশে কত ছোট ব্যাপারও অতিরঞ্জিত হয়ে নিজের রঙ বদল করে।

গ্র্যাঞ্জ–মিস ক্রে, চাকরেরা অনেক সময় উপকারও করে থাকে।

ভেরোনিকা–ব্যাপারটা সত্যি ভীষণ বেদনাদায়ক যে, স্বামীর হত্যাকারী রূপে সন্দেহের তালিকায় স্ত্রীর নাম প্রথম আসছে। কিন্তু এই ঘটনায় অন্য স্ত্রীলোকও তো হাজির থাকতে পারে! আপনার কী মনে হয়, থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।

ভেরোনিকা–একজন স্ত্রী ভাস্কর আছে, ক্রিস্টোর সঙ্গে তার বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। তার সম্পর্কে আপনি তো সবকিছুই জেনে ফেলেছেন।

গ্র্যাঞ্জ–আপনি বলতে চাইছেন যে, ডাঃ ক্রিস্টো আপনার সঙ্গে বাড়িতে এসেই দেখা করে গেছেন। সাক্ষাৎ হবার সময়টা আপনার স্মরণে থাকে?

ভেরোনিকা–কিছুক্ষণ আমরা কথাবার্তা বলেছি ঠিকই। কিন্তু সময় কত হবে সেটা বলতে পারছি না, তবে রাত তখন অনেক।

গ্র্যাঞ্জ–তিনি কি বাড়ির ভেতরেও এসেছিলেন?

ভেরোনিকা–আমি তাকে কিছু পান করতে দিয়েছিলাম।

গ্র্যাঞ্জ–আপনারা তো সুইমিং পুলের ধারে তাবুতে বসেও কথা বলেছিলেন?

ভেরোনিকা–আপনি তো মশাই গোয়েন্দা, তাই না? হ্যাঁ, আমরা সেখানেও কিছুক্ষণ বসেছিলাম এবং সিগারেটও খেয়েছিলাম। আপনি এত খবর পেলেন কোথা থেকে?

গ্র্যাঞ্জ-আপনি তো সেখানে ভুল করে আপনার নোমশ গলাবন্ধ ফেলে এসেছিলেন?

ভেরোনিকা–হ্যাঁ, তা ফেলে এসেছিলাম।

গ্র্যাঞ্জ–রাত তিনটে নাগাদ ডাঃ ক্রিস্টো হলোতে ফিরে এসেছিলেন।

ভেরোনিকা–হ্যাঁ, তা হবে হয়তো।

গ্র্যাঞ্জ–আপনি একটা চিঠি মারফৎ ক্রিস্টোকে ডেকে এনেছিলেন এবং আপনাদের মধ্যে ঝগড়াও হয়েছিল। কোন্ বিষয়কে কেন্দ্র করে আপনাদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছিল, কষ্ট করে সেটা একবার বলবেন কী মিস ক্রে?

ইন্সপেক্টর ব্যাটারি খুলে ভেরোনিকার ক্রোধের আগুনে জ্বলে ওঠার চিত্রটা তার ক্যামেরায় বন্দী করে ফেলেন, চোখমুখ জুড়ে ক্রোধের রেশ, ঠোঁটও কেঁপে কেঁপে উঠছে ইত্যাদি…

ভেরোনিকা–আমাদের মধ্যে ঝগড়া হয়নি।

গ্র্যাঞ্জ–নিশ্চয়ই করেছিলেন। আপনার কথার শেষ উক্তি ছিল, “আমাদের মনে হয় যে, আমি তোমাকে মনে মনে এতটাই ঘৃণা করি যে, দুনিয়ায় আর কাউকে তেমনভাবে ঘৃণার চোখে দেখি বলে বিশ্বাস হয় না।”

ভেরোনিকা–পুরো ব্যাপারটা ঝি-চাকরদের বানানো গল্পের মতো! আপনি জানেন একটা কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কতভাবে বলা যায়। যেভাবে আপনি ব্যাপারটাকে সাজাতে চাইছেন, সেভাবে কথাটা আমি বলিনি।

গ্র্যাঞ্জ–আপনার কথার মধ্যে তাহলে কোনো গুরুত্ব ছিল না?

ভেরোনিকা–নিশ্চয় না। তাছাড়া, পনেরো বছর পরে জনের মুখোমুখি হলাম আমি, আপনি এই বিষয়টা অনুসন্ধান করলেই জেনে যাবেন।

গ্র্যাঞ্জ এবার উঠে পড়ে, সে বলে ওঠে, আচ্ছা, আজ না হয় এই পর্যন্ত থাক মিস ক্রে। সে ডাভকোট ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে রেস্টহেভেন-এর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

গ্র্যাঞ্জকে দেখে পৈর সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, জার্দা ক্রিস্টোর হাতে যে রিভলবার ছিল তার গুলিতে নাকি জনের মৃত্যু হয়নি?

গ্র্যাঞ্জ–ঠিক তাই, পৈরট।

পৈরট–কিন্তু তাতে করেও সুবিধা কিছু হলো না ইন্সপেক্টর?

গ্র্যাঞ্জ–সুবিধা হয় এমন কিছু বার করলেই তো হতো! কিন্তু যতক্ষণ না আসল বন্দুকের সন্ধান মিলছে ততক্ষণ পর্যন্ত সুবিধা কিছু হবে বলে তো মনে হয় না। স্যার হেনরির স্টক থেকেই বন্দুকটা চুরি গেছে, কিন্তু এর বেশি তো আর কিছু করা যাচ্ছে না!

পৈরট-ব্যাপারটা খুব সহজ বলে তো মনে হচ্ছে না!

গ্র্যাঞ্জ–না, সত্যি খুব জটিল ব্যাপার, আগে অবশ্য ভেবেছিলাম, সোজা ব্যাপার। একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, জার্দাকে এই ব্যাপারে জড়ানোর প্রচেষ্টা চলছে। কিন্তু তাই যদি হয় তবে আসল বন্দুকটা ডাঃ ক্রিস্টোর পাশে ফেলে রাখা হলো নাই বা কেন? জার্দা তো সেটা অবশ্যই কুড়িয়ে রাখতে পারতেন?

পৈরট-জার্দা তো বন্দুকটা নাও কুড়োতে পারতেন?

গ্র্যাঞ্জ–না কুড়োলেও, আগের আঙুলের ছাপ যদি নষ্ট করা অবস্থাতেই না মিলত, তবে তো সন্দেহের তালিকায় জার্দার নাম উঠত। এটাই তো হত্যাকারীর মনোগত বাসনা ছিল, তাই নয় কী?

আচ্ছা আপনি যদি কাউকে খুন করেন তবে আপনি এটাই চাইবেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দোষটা অন্য কারো ঘাড়ে চাপাতে।নয় কি?হত্যাকারীর কাছ থেকে এরকম প্রতিক্রিয়াই স্বাভাবিক ছিল।

পৈরট–এটা যদি অস্বাভাবিক হত্যাকাণ্ড হয়ে থাকে, তবুও কি আমরা একই পদ্ধতিতে সমাধানের প্রচেষ্টায় লেগে থাকব?

গ্র্যাঞ্জ–সমাধান কি?

পৈরট–অস্বাভাবিক গোছের হত্যাকাণ্ড।

গ্র্যাঞ্জ– কিন্তু হত্যাকারীর উদ্দেশ্য তো একটা থাকবে?

পৈরট–আমার এই ব্যাপারে কোনো ধারণাই নেই। তবে মনে হচ্ছে, জনকে মারার বাসনা তার থাকলেও সে এটা কখনোই চায়নি জার্দা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ুক।

গ্র্যাঞ্জ–আমি দুটো কাজের জন্যই আপনার দ্বারস্থ হয়েছি। প্রথমত আপনি অনুসন্ধানের কাজে যথেষ্ট অভিজ্ঞ, আপনি একমাত্র বলতে পারেন রহস্য উদঘাটনের জন্য কোন পথে এগোতে হবে। দ্বিতীয়ত আপনি নিজে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আপনি এ ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী।

পৈরট–হ্যাঁ, আমার চোখের সামনেই ঘটনাটা ঘটেছে।

ইন্সপেক্টর–এই চোখ কখনও মিথ্যে কথা বলে না। আপনি জানেন আপনার একথা বলার অর্থ কী দাঁড়ায় পৈরট। আপনার কী মনে হয়, আগে থাকতে পরিকল্পনা করেই এইসব করা হয়েছে?

পৈরট–চোখ যা দেখে, তাকে দেখতে দেওয়া যায় পরম নিশ্চিন্তে। আমার মনে এই সন্দেহ দানা বাঁধে যে, মঞ্চের দৃশ্য যেন আমার চোখের সামনে অভিনীত হয়ে চলেছে। একজন মরে পড়ে আছে আর হত্যাকারী বন্দুক হাতে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। ভুলের মধ্যে এইটুকুই হয়েছিল যে, যে বন্দুকটার মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছিল সেটা এখানে ছিল না।

গ্র্যাঞ্জ–হুম।

পৈরট–আরও তিনজন লোক সেখানে উপস্থিত ছিলেন তারাও প্রায় একই সময়ে সেখানে হাজির হয়েছিলেন। কিন্তু জার্দা সেখানে হাজির হবার আগে ঐ তিনজনের একজন সেখানে এসেছিলেন এবং ক্রিস্টোকে গুলিবিদ্ধ করে আবার সবার সঙ্গে স্বমহিমায় ফিরে এসেছিলেন।

গ্রাঞ্জা–হ্যাঁ, তা সম্ভব।

পৈরট–আবার এমনও হতে পারে যে, অন্য একজন এসে সবার অলক্ষ্যে ক্রিস্টোকে গুলি করে নিজের আড়াল করে চলে গেছে।

গ্র্যাঞ্জ–আপনি বোধহয় ঠিকই বলেছেন। জার্দা ক্রিস্টো ছাড়া আরও দু’জন স্ত্রীলোকের এই ঘটনায় হাত থাকা খুবই সম্ভব। ক্রিস্টো ও ভেরোনিকার মধ্যে ঝগড়া হয়েছিল, ভেরোনিকা কী বলেছিল সেকথা আমরা জানি। এমনও হতে পারে তিনি তার লোমশ শেয়ালটা নিতে এসে জনকে গুলি করে সকলের অজ্ঞাতসারে গা ঢাকা দিয়ে পালিয়েছেন। নিজের বন্দুকের সাহায্যে গুলি করে স্যার হেনরির রিভলবারটা ফেলে রেখেছেন, উদ্দেশ্য হলো হলোয় উপস্থিত অতিথিদের ঘাড়ে দোষ চাপানো। কিন্তু এই ব্যাপারটা তার মাথায় আসেনি, রিভলবারটা আমরা শেষ পর্যন্ত সনাক্ত করতে পারব।…আরও একজনের কথা এই প্রসঙ্গে এসে যাচ্ছে, ‘হেনরিয়েটা’–ক্রিস্টোর মরার সময়ে শুধু মুখ দিয়ে এই শব্দটাই নির্গত হয়েছিল। এর প্রকৃত অর্থ একটাই হয় যে, তাকে অন্য কেউ নয়, হেনরিয়েটা গুলি করে মেরেছেন?

পৈরট–আমি সে সময় এমনটা ভেবে দেখিনি। কিন্তু আমার মনে হয়–তা হলেও হতে পারে। তিনি বিরক্তির স্বর্বেই বলে ওঠেন, এই ব্যাপারে কিছুই সন্তোষজনক বলে মনে হচ্ছে না। আগাগোড়া এটা হত্যাকাণ্ডের অভিনয় করে তাকে যেন ভোলানো হয়েছে, তাই সে নিজের প্রতি সবথেকে বেশি রুষ্ট।

এইসব কথাবার্তার মধ্যে ছুটে আসেন সার্জেন্ট ক্লার্ক। একটা খবর দেওয়ার ছিল। সে রান্নাঘরের এক ঝির কাছ থেকে শুনেছে যে, রবিবার বিকেলে খানসামা গাজনকে একটা রিভলবার নিয়ে হলঘরের মধ্যে হেঁটে যেতে দেখেছে। ক্লার্ক পৈরটকে দেখে কথাটা বলার ব্যাপারে একটু দ্বিধাবোধ করছিল, এ্যাঞ্জের কাছ থেকে অভয়ের আশ্বাস পেয়ে ব্যাপারটা খুলে বলে।

এই খবরে ইনসপেক্টর খুব খুশী হলেও, তবু একটা খবর তো বটে, এই ব্যাপারটা সে ভালোভাবে ভেবে দেখবে, যদি কোনো সূত্রের সন্ধান মিলে যায়। গ্র্যাঞ্জ ক্লার্ককে এইটুকুই সান্ত্বনা দিয়ে বলে যে, এই ব্যাপারে সে যথাশীঘ্র সম্ভব অনুসন্ধানে লেগে যাবে।

.

২০.

ইনসপেক্টর গ্র্যাঞ্জ এবার স্যার হেনরির পড়ার ঘরে এসে বসলেন, তার সামনে বিনয়ের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে গাজন। গাজন শুধু বলে যে, আমি সত্যি খুব দুঃখিত স্যার, কথাটা আপনাকে বলা আমার উচিত ছিল, কিন্তু একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম। ৫-৩০ নাগাদ হলঘরের মধ্যে দিয়ে যাবার সময়ে টেবিলের ওপর চোখ গেল, রিভলবারটা টেবিলেই পড়েছিল। সেটা তুলে আমি যথাস্থানে নিজের জিম্মায় রেখে দিলাম। তাকের যে খালি জায়গায় বন্দুকটা সে রেখেছিল, গাজন গ্র্যাঞ্জকে সেই জায়গাটা দেখিয়ে দেয়।

এইটা, স্যার গাজন আঙুল দিয়ে ছোটমাপের মজার একটি পিস্তল দেখিয়ে দিল এবং সেটা রাখা ছিল স্টকের একেবারে শেষ সারিতে। ওটা ২৫ অস্ত্র হিসেবে খুবই ছোট। যে অস্ত্রের সাহায্যে জন ক্রিস্টোকে হত্যা করা হয়েছে-এটা বোধহয় সেটা নয়।

এ্যাঞ্জের দৃষ্টি গাজনের মুখের দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে ছিল, এটা একটা স্বয়ংক্রিয় পিস্তল, রিভলবার নয়। গাজন একটু কেশে বলে ওঠে, স্যার মুখ্য মানুষ আগ্নেয়াস্ত্র সম্বন্ধে তেমন কোনো জ্ঞান নেই, আমি হয়তো ভুল করেই রিভলবার কথাটা উচ্চারণ করে ফেলেছি।

গ্র্যাঞ্জ–তুমি কি স্থির নিশ্চিত যে, এটা তুমি টেবিল থেকে কুড়িয়ে পেয়েছ?

গাজন–এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। গাজন পিস্তলটা হাত লাগাতে গিয়েছিল, গ্র্যাঞ্জ তাকে বাধা দিয়ে বলে ওঠে, সে একবার স্পর্শ করে দেখতে চায় গুলি ভরা আছে কিনা, পিস্তলের ওপর আঙুলের ছাপও পরীক্ষা করিয়ে নেবে।

গাজন এই সময়ে বলে ওঠে, হেনরির কোনো বন্দুক-ই গুলি ভরা নয়। তাছাড়া আমি রুমাল দিয়ে পিস্তলটা ভালো করে মুছে রেখেছি, তাই আঙুলের ছাপও ওটার মধ্যে থাকাটাই স্বাভাবিক। আমি ভেবেছিলাম অস্ত্রটার ওপর ময়লা পড়ে থাকতে পারে।

এই সময়ে দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করে লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল, ইনসপেক্টরের দিকে তাকিয়ে সে হাসতে থাকে।

সে বলে ওঠে, আপনাকে দেখে বেশ ভালোই লাগছে। কিন্তু রিভলবার, গাজন, এসব কী হচ্ছে?

গাজন রান্নাঘরে বসে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে যাচ্ছিল, মিসেস মিডওয়ে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল।

গাজন বিনীত কণ্ঠে ইনসপেক্টরকে কিছুক্ষণ আগে তার বলা-কওয়া কথাগুলো পুনরায় বলে চলে।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল মাথা নেড়ে বলে ওঠেন, তোমার বোধহয় এইসব কথা বলা মোটেই উচিত হয়নি, গাজন, ইনসপেক্টরের সঙ্গে আমি একবার কথা বলব।

গ্র্যাঞ্জ শুধু এইটুকুই জানতে চায়–তাহলে আমি কি এটাই বুঝব যে, লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল আপনি গাজনের থেকেও বোধহয় একটু বেশি জেনে গেছেন।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল প্রত্যুত্তরে জবাব দেয় যে, গাজন জলের মধ্যে থেকে এটা পায়নি, ডিম বার করতে গিয়ে সে এই পিস্তলটা উদ্ধার করেছে।

গ্র্যাঞ্জ– ডিম?

হেনরিও তাকে বুঝিয়ে বলার জন্য লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলকে অনুরোধ জানায়।

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল তার বলা শুরু করেডিমের যে বাক্সটা ফার্মে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে পিস্তলটা রাখা ছিল এবং তার ওপরেই সযত্নে ডিম রেখেছিলাম, পিস্তলটা তাই ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। জনকে পুলের ধারে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে আমি নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলাম। নিজের অজান্তেই হাত থেকে ঝুড়িটা পড়ে যাচ্ছিল, গাজন সেটা না ধরলে কুড়িটা জলেই পড়ে যেত। গাজন ঝুড়িটা বাড়ি নিয়ে আসে, ডিমের ওপর আমার আদেশে তারিখ লিখতে যাবার সময়েই ঝুড়ির মধ্যে তার পিস্তলটা চোখে পড়ে, কিন্তু পুলিসকে দেখতে তারা এত ঘাবড়ে যায় যে, সব কথা গুছিয়ে বলার মতো ক্ষমতা তারা হারিয়ে ফেলে। আমার কাছে পুরো ব্যাপারটাই কেমন গোলমেলে লাগছে। আমার তো মনে হয় না যে জার্দা জনকে গুলি করে মেরেছে, জার্দা বড়ই ভালো স্বভাবের মেয়ে। আপনারা যদি তাকে কারাগারে ভরেন তবে ছেলে মেয়েগুলোর কী হাল হবে একবারও ভেবে দেখেছেন।

গ্র্যাঞ্জ শুধু বলে, এই মুহূর্তে আমরা কাউকে গ্রেপ্তার করছি না লেডি, কারণ সত্যের অনুসন্ধান করাই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য, কোন্ পিস্তলটা আপনি দেখেছিলেন?

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল মজার ২৫ পিস্তলটা তাকে দেখিয়ে দিলেন।

গ্র্যাঞ্জ এবার লেডির উদ্দেশ্যে এটাই জিজ্ঞাসা করেন যে, পিস্তলটা এখান থেকে নিয়ে ডিমের বাক্সে রাখার কী প্রয়োজন ছিল?

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল শুধু বলেন, আমি জানি আপনার একথা জিজ্ঞাসা করার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার কিছুই স্মরণে আসছে না।

এ্যাঞ্জের মনে হয় হেনরি ভুল কিছু বলেনি, তার স্ত্রী বড্ড ভুলো মন, কখন যে কী করে কিছুই মনে রাখতে পারে না। লেডি তার কাছেই জানতে চাইছে পিস্তলটা সে কোথায় রেখেছে। তার অবান্তর কথার জবাব দিতে না পারায় গ্রাঞ্জের কপালে জুটে যায় কড়া মাপের বকুনি, তার আর এখানে বসে থাকার প্রবৃত্তি হল না।

হেনরি এই সময়ে বলে ওঠেন, লুসি, বাজে কথা বলে সময় নষ্ট না করে ইনসপেক্টরের প্রশ্নের জবাব দিয়ে তাকে ছেড়ে দাও। লুসি হাসি মুখে সবই যেন উড়িয়ে দিতে চান। তার মুখে সেই এক বুলি কেন যে ডিমের বাক্সে পিস্তলটা রেখেছিল। বিন্দুমাত্র লজ্জিত না হয়ে শুধু বলেন, আমার কিছুতেই মাথায় ঢোকে না, মালীর স্ত্রী শিশুকে কোলে নিয়ে কোন সাহসে টেলিফোনের রিসিভার তোলে?

গ্র্যাঞ্জ সেই সময়ে বলে ওঠে, আপনি তাহলে টেলিফোন করেছিলেন?

লেডি এই প্রশ্নের কোনো জবাব দেয় না, সব জিনিসটা গ্রাঞ্জের কাছে বানিয়ে বলার পেছনেও তার বেশ সাহস ছিল। নীরব থাকাটা এই পরিস্থিতির পক্ষে ভালো, সে এই পন্থাই কাজে লাগাল।

গ্র্যাঞ্জ বিরক্ত হয়ে উঠে পড়ে। মনে মনে ভাবে এই গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে সে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে।

২১. পড়ার সব জিনিষ

২১.

স্যার হেনরির পড়ার সব জিনিষগুলিকে লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেছিল হেনরি চেয়ারে বসেছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, লুসি পিস্তলটা কেন নিয়েছিলে?

লুসি–আমার ঠিক মনে নেই, তবে আমি দুর্ঘটনার কথা চিন্তা করছিলাম।

হেনরি–দুর্ঘটনা? কে দুর্ঘটনা ঘটাতে যাচ্ছে?

লুসি–জন ক্রিস্টো বোধহয়। আমি আইন্সউইকের কথা ভেবে উদ্বিগ্ন ছিলাম।

হেনরি–ওঃ! আইন্সউইক! এটা কি এমন কিছু বড় চিন্তার বিষয়?

লুসি–নিশ্চয়ই। আমি এডওয়ার্ডের জন্যই ভাবছি। এডওয়ার্ড হেনরিয়েটাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না। আমি ভেবেছিলাম জন যদি সরে যায় তবে হেনরিয়েটা এডওয়ার্ডকে বিয়ে করতে পারে। হেনরিয়েটা স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকার মেয়ে নয়। কাজেই শেষপর্যন্ত জনকে সরিয়ে দেবার পরিকল্পনাই হয়েছিল। তুমি ভেবো না যে, আমি জন ক্রিস্টোকে গুলি করেছি, তবে আমার মনে দুর্ঘটনার ভাবটা এসেছিল। জন আমাদের অতিথি কাজেই ইচ্ছে থাকলেও তাকে মারতে পারি না।

হেনরি–আমি সর্বদা উদ্বিগ্ন।

লুসি–উদ্বেগের কারণ নেই। আমাদের কিছু করার আগেই জন রাস্তা থেকে সরে গেছে।

রান্নাঘরে ডোরিস ইমট কাঁদছিল কারণ গাজন তাকে খুব তিরস্কার করেছে ঘরের কথা পুলিসের কাছে ফাঁস করে দেওয়ার জন্য।

.

২২.

দরজায় শব্দ হওয়াতে পৈরট জানালা দিয়ে দেখে বিস্মিত হল যে, ভেরোনিকা ক্রে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। সে হেনরিয়েটার মতো টুইডের পোশাক পরে এসেছিল।

ভেরোনিকা বলল–আমার প্রতিবেশীর সঙ্গে আমি পরিচিত হতে খুবই উদগ্রীব। আমি আপনার সঙ্গে একটা বিষয়ে আলোচনা করতে এসেছি। জনের মৃত্যু সম্পর্কে আগামীকাল বিচারের মাধ্যমে অনুসন্ধান, আপনি তা জানেন?

পৈরট–আমি জানি।

ভেরোনিকা-ইনসপেক্টর গ্র্যাঞ্জের মাথায় কে ঢুকিয়েছে যে আমি জনের সঙ্গে ঝগড়া করেছিলাম। আমি তাকে বলেছিলাম আমি জনকে পনেরো বছর দেখিনি। তিনি বিশ্বাসই করলেন না। কিন্তু ওটা সত্য।

পৈরট-সত্য হলে প্রমাণিত হবে। আপনার উদ্বেগের কারণ নেই।

ভেরোনিকা–কিন্তু আসল কথা আমি ইনসপেক্টরকে বলতে সাহস পাইনি। আপনাকে বলতে চাই। পনেরো বছর আগে জনের সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। সে আমাকে অভিনয় ছাড়তে বলে, কিন্তু আমি ছাড়িনি। তাতে সে রেগে গিয়ে সব ভেঙে দিয়ে চলে গেল। তারপরে তার সঙ্গে আমার দেখা হয় সেই শনিবার রাত্রে। সে তার স্ত্রীকে এবং সন্তানদের পরিত্যাগ করে আমাকে বিয়ে করতে চাইল এবং আমার স্বামীকে পরিত্যাগ করতে বলল। কিন্তু আমি তাকে প্রতিবাদ করলাম। সেইজন্য তাকে পরের দিন চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছিলাম। ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার জন্য।.সে এক গোঁ ধরে বসল। সে আমার কোনো কথাই শুনল না। আমি বললাম আমি তাকে অত্যন্ত ঘৃণা করি। তখন সে রেগে চলে গেল। এখন সে মৃত।

ভেরোনিক কাহিনীর একবর্ণও পৈরটের বিশ্বাসযোগ্য মনে হল না। তবু তার মধ্যে একটা সরলতা ছিল। ঘটনা একটা ঘটেছিল ঠিকই কিন্তু যেভাবে, ঠিক সেভাবে নয়, ভেরোনিকাই জনকে ভুলতে পারেনি। সে-ই ব্যর্থ প্রেমিকা, সে-ই জনের কাছে অন্যায় প্রস্তাব করেছিল এবং জন তাতে রাজী হয়নি। এটাই বিশ্বাসযোগ্য ঘটনা।

পৈরট-যদি জনের মৃত্যুর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক থাকে তবে প্রকাশ করতে পারেন, আর তা না হলে নিজের মনেই রেখে দেওয়া ভালো।

ভেরোনিকা তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল এব পৈরটের কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

.

২৩.

বিচারের মাধ্যমে অনুসন্ধান অল্পক্ষণের মধ্যেই শেষ হল। পুলিসের অনুরোধে একপক্ষকালের জন্য মুলতুবি হয়ে গেল। জার্দা ভাড়ার গাড়িতে চড়ে শোকের কালো পোশাক এবং একটা অদ্ভুত কালো টুপি পরে এসেছিল।

অসহিষ্ণুভাবে এডওয়ার্ড বলল, ক্রিস্টোর মধ্যে সকলে কি দেখে? সেই ভাগ্যহীনা স্ত্রীলোকটা একদম ভেঙে পড়েছে। সে অত্যন্ত স্বার্থপর ছিল কী, তুমি তার সম্বন্ধে কি ভাব?

মিডগে–আমি? আমি তাকে সম্মান করতাম।

এডওয়ার্ড–তাকে সম্মান করতে? কেন?

মিডগে–সে নিজের কাজ জানত।

এডওয়ার্ড–তুমি ডাক্তার হিসাবে তাকে ভালো ভাবতে?

আর বেশি সময় ছিল না। হেনরিয়েটা গাড়ি করে মিডগেকে লন্ডনে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। এডওয়ার্ড হলোতে চলে গেল। পরে সে হেনরিয়েটার দিকে এগিয়ে গেল, আমি তোমাকে ফোন করব, হেনরিয়েটা।

হেনরিয়েটা–তা কোরো, কিন্তু আমি অনেকদিন বাইরে থাকতে পারি।

এডওয়ার্ড-বাইরে?

হেনরিয়েটা–হ্যাঁ, আমার দুঃখ ভোলার জন্য। তুমি এটা আশা কোরো না যে, আমি ঘরে বসে বসে কাদব, করো কি?

এডওয়ার্ড-আমি আজকাল তোমাকে বুঝতে পারছি না। তুমি অন্য প্রকার হয়ে গিয়েছ।

সে একটু নরম হয়ে এডওয়ার্ডের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমি ইচ্ছা করলে ফিরে আসতে পারি, পারি না লুসি। যেখানে হেনরিয়েটা গাড়ি রেখেছে সেই মার্কেট স্কোয়ারে সে চলে গেল, তার এবং মিডগের স্যুটকেস আগেই গাড়িতে তোলা হয়েছিল। তারা গাড়িতে উঠে চলে গেল।

হেনরিয়েটা–মিডগে, তোমার কাঁধের উপর দিয়ে তাকাও। দেখো গাড়ি পেছনে যাচ্ছে।

মিডগে–হ্যাঁ?

হেনরিয়েটা–ইহা একটি ভেন্টর ১০।

মিডগে–তাই কি, তারা কি এখনও আমাদের দিকে নজর রাখছে?

হেনরিয়েটা–তাই তো মনে হয়। এই দ্বিতীয় বন্দুকের ব্যাপার বোঝ কি?

মিডগে-না। এটাও কি হেরির বন্দুক?

হেনরিয়েটা–জানি না, এখনও তো খুঁজে পাওয়া যায়নি।

মিডগে–না, তা সত্যি। হয়তো কোনো বাইরের লোকও হতে পারে হেনরিয়েটা, আমি কাকে জনের হত্যাকারী বলে সন্দেহ করছি জান? সেই স্ত্রীলোকটি।

হেনরিয়েটা-ভেরোনিকা কে?

মিডগে–হ্যাঁ। এটা সম্ভব নয় হেনরিয়েটা, তুমি ভাব না?

হেনরিয়েটা–ভেবে লাভ কি? আমাদের সকলের কথাই ভাবতে পারি।

মিডগে–আমাদের সকলের কথা?

হেনরিয়েটা–আমরা সকলেই এর মধ্যে আছি। তবে জনকে গুলি করার পেছনে একটা মতলব আবিষ্কার করতে হবে। আমার কিন্তু লুসির মতোই ভেরোনিকার অভিনয় দেখতে ভালো লাগবে।

মিডগে বলল–তুমি এত প্রতিহিংসাপরায়ণ কেন, হেনরিয়েটা?

হেনরিয়েটা যেহেতু আমি জনকে ভালোবাসতাম।

তারা তখন অ্যালবার্ট ব্রিজের উপর দিয়ে যাচ্ছিল। লন্ডনে শেষ বিকেলের আলো মিলিয়ে যাচ্ছে। তারা দুজনে স্টুডিওর দরজায় এসে দাঁড়াল। মিডগেএকা একা স্টুডিওর মধ্যে ঘুরে ঘুরে হেনরিয়েটার কাজ দেখছিল। নির্জন স্টুডিওতে কাঠ ও ব্রোঞ্জের মূর্তিগুলির মধ্যে তার কেমন যেন ভয় ভয় করছিল।

এসো এখন চা খাওয়া যাক–হেনরিয়েটার মুখে সেই সহৃদয় অভিব্যক্তি কিন্তু মিডগে দেশলাই দেখে সব ভুলে গেলে। সে বলল, এই দেশলাই ভেরোনিকা কে নিয়েছিল এবং লুসি তাকে ছটা নিতে জেদ করল। কেউ কি দেখেছে, তার ঘরে দেশলাই ছিল কিনা?

হেনরিয়েটা–আমার মনে হয় পুলিস খোঁজ নিয়েছে। এডওয়ার্ডকে প্রত্যাখ্যান করা হেনরিয়েটার পক্ষে নির্দয়তা। মিডগে চায় এডওয়ার্ড সুখী হোক। এডওয়ার্ডের কাছে মিডগে চিরদিনই ‘ছোট মিডগে’-এর বেশি কিছু নয়। ভালোবাসতে পারা যায় এমন স্ত্রীলোক সে কোনোদিনই এডওয়ার্ডের কাছে হতে পারল না। শরতের হিমেল সন্ধ্যায় তারা বেরিয়ে পড়ল। মিউস পেরিয়ে যেতেই, একটা গাড়ি পাশাপাশি যেতে লাগল।

হেনরিয়েটা বলল–একটা ভেন্টর ১০, আমাদের ছায়া। দেখো, সে আমাদের অনুসরণ করবে। কী পাশবিক সব ব্যাপার।

-তোমার কি তাই মনে হচ্ছে, আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না–মিডগে বলল।

হেনরিয়েটা মিডগেকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে মিউস-এ ফিরে এসে গ্যারেজে গাড়ি রেখে দিল। আর একবার সে স্টুডিওতে ঘুরে বেড়াল, তারপর সে মনে মনে বলল–কাজ করাই ভালো। সময় নষ্ট করা উচিত নয়।

হেনরিয়েটা ওভারঅল পরে নিল, প্রায় দেড়ঘণ্টা কাজ করার পর সে লক্ষ্য করল, যে-মডেলটা সে তৈরি করেছিল তা তার পছন্দমতো হয়েছে। এটা একটা ঘোড়ার আকৃতির মতো। এলোমেলো কাদা লাগানো হয়েছে। অশ্বারোহী বাহিনীর ঘোড়ার মতো রক্তমাংসের ঘোড়া নয় যেন।

.

২৪.

শ্যাফটেসব্যারি এভিনিউর ঘোরানো ফুটপাথের উপর দাঁড়িয়ে এডওয়ার্ড এ্যাঙ্গক্যাটেল ইতস্তত করছিল। বাইরে সোনালি অক্ষরে লেখা রয়েছে ‘ম্যাডাম অ্যালফ্রেজ।

এডওয়ার্ড অতীত যুগে বাস করতে চায় এবং বর্তমানকে সে অনাস্বাদিত রূপে গ্রহণ করে। মিডগে তার কাছে খেটে খাওয়া সাবালিকা। তার কাছে সব যেন ওলোটপালট হয়ে গেল–তার মনে হল আইন্সউইকের বহুমূল্য অংশটিই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সে যেন হঠাৎ মোহাচ্ছন্নের মতো বলে ফেলেছিল, তোমাকে আরও বেশি দেখতে ইচ্ছে হয়, ছোট মিডগে…

সেই থেকে সে এই ভেবে কষ্ট পাচ্ছে যে, সে কোনোদিন মিডগের সুখদুঃখের কথা ভাবেননি। ম্যাডাম আলফ্রেজের দোকানে অত্যন্ত কষ্টের চাকরির কথা শোনা থেকে সে আকাশ পাতাল ভেবে ভেবে অবশেষে ঠিক করেছে নিজে গিয়ে একবার দেখে আসবে।

কোনোরূপে এডওয়ার্ড একটু নিচু হয়ে সোজা ভেতরে ঢুকে গেল এবং দেখতে পেল দুটি কর্কশ স্বরের স্ত্রীলোক শো-রুমে তাদের পোষাক পরীক্ষা করছিল এবং একটি কালো মেয়ে তাদের পোষাক দেখছিল। দোকানের পেছনে মোটা নাকের একটা বেঁটে স্ত্রীলোক তার খদ্দেরের সঙ্গে তর্ক করছিল। ক্রেতা অত্যন্ত মোটা ছিল; একটা ইভনিং গাউন ছিল তাদের তর্কের বিষয়।

পাশ থেকে একটা ভীতিপ্রদ স্ত্রীলোকের কণ্ঠস্বর ভেসে এল। আপনি ভালো কিছু একটা দেখাতে পারেন না, যা পছন্দ হওয়ার মতো? উত্তরে সে মিডগের শান্ত স্বরের অনুনয় বিনয় ও পোষাক পছন্দ করানোর জন্য দু-একটা আবেদনের কথা শুনতে পেল।

ইতিমধ্যে ম্যাডাম আলফ্রেজ মোটা ক্রেতার কাছ থেকে চলে এসে এডওয়ার্ডের দিকে জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকাল। এডওয়ার্ড জিজ্ঞাসা করল, আমি মিস হার্ডক্যাসলের সঙ্গে কথা বলতে পারি কি?

একটা বদমেজাজের স্ত্রীলোক কতগুলি পার্শেল নিয়ে বেরিয়ে গেল, মিডগে তার জন্য দরজা খুলে দিল। ইতিমধ্যে মিডগে কোট পরে প্রস্তুত হয়ে এসে হাজির হল, এডওয়ার্ড তার সঙ্গে বেরিয়ে গেল। যেতে যেতে এডওয়ার্ড বলল, এইসব জিনিষের সঙ্গে তুমি মানিয়ে চল? সহ্য কর কি করে, ফ্রকগুলি ক্রেতার মুখের উপর ছুঁড়ে মারতে পার না? কিন্তু তোমার এখানে থাকা উচিত নয়। আমি নিজে সব দেখতে পেয়েছি, অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। এই সব ছাড়িয়ে ট্যাক্সি করে তোমাকে আইন্সউইকে নিয়ে যাই।

মিডগে–তুমি জান দুটো পনেরোর ট্রেনে আইন্সউইকে যাওয়ার অর্থ কী? বলতে হয় তাই বলে যাচ্ছো; কিন্তু চিন্তা করে কিছু বলছ না।

ঠিক এই সময় একটা ট্যাক্সি ডেকে দুজন তাতে উঠে পড়ল। ট্যাক্সিতে চুপচাপ বসেছিল। তারা বার্কলি হোটেলে ঢুকল।কফি পান করতে করতে এডওয়ার্ড জিজ্ঞেস করল, তুমি আইন্সউইক ভালোবাসো না? আমি বলছি তুমি চিরকালের জন্য আইন্সউইকে এসো, আজকেই যেতে হবে তা বলছি না। আমি বলছি তুমি আমায় বিয়ে করো মিডগে। আমরা পরস্পরকে অনেকদিন ধরে জানি। তুমি আসবে কি?

মিডগে–আমার তো ম্যাডাম আলফ্রেজের কাছে যেতে হবে, তার ভরসা তো আমি।

এডওয়ার্ড–কিন্তু তার আগে আমাদের বন্ড স্ট্রিটে যেতে হবে।

মিডগে–আংটি?

এডওয়ার্ড–এটাই তো সচারাচর ব্যবহৃত হয়।

অনেকক্ষণ বাছাবাছির পরে এডওয়ার্ড নিজের আংটি পছন্দ করল। পরে মিডগের অনুরোধে তার আংটিটাও পছন্দ করে দিল।

.

২৫.

লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল সব শুনে অত্যন্ত আনন্দিত। তিনি বললেন–এখন থেকে সেন্ট জর্জের গির্জায় তোমাদের বিবাহ হবে।

মিডগে বলল–আমি শান্তিপূর্ণ বিবাহের পক্ষপাতী। একখানা কোট এবং স্কার্ট হলেই আমার বিয়ে হয়ে যাবে।

লুসি বলে-না, মিডগে, সাদা বাদে সার্টিনের পোশাক চাই। ম্যাডাম আলফ্রেজের দোকানের নয়, ভালো দোকানের। মিরিলীতে চলো মিডগে। হেনরি তোমাকে দেবে। তোমার বা এডওয়ার্ডের কিছু খরচ করতে হবে না।

মিডগে–হত্যাকাণ্ডের ব্যাপার তো মিটে গেছে।

লুসি-না, এখানে মূলতুবী আছে। ইনসপেক্টর গ্রাঞ্জের লোক সর্বত্র ছড়ানো রয়েছে। যে রিভলবার দিয়ে ক্রিস্টোকে গুলি করা হয়েছে সেটাই তারা খুঁজছে।

হারকিউল পৈরট সুইমিং পুলের উপরে বসেছিল। হেনরিয়েটা সেইদিকে আসতে গিয়ে পৈরটকে দেখে থেমে গেল। সুপ্রভাত পৈরট। আমি আপনার কাছে যাচ্ছিলাম। ইনসপেক্টর কী খুঁজছেন? রিভলবার? আপনার কি মনে হয় ওঁরা খুঁজে পাবে?

পৈরট–মনে হয় পাবে।

হেনরিয়েটা–আপনার কি ধারণা যে, এটা এখানেই কোথাও আছে?

পৈরটের ধারণা যে শীঘ্রই এটা পাওয়ার সময় হয়ে গেছে এবং হেনরিয়েটাই জনের হত্যাকারী। পৈরটের অনুমান হত্যাকারীর সৃজনীশক্তি আছে।

হেনরিয়েটা চুপ করে রইল, সে একটা পেন্সিল দিয়ে বেঞ্চিতে একটা গাছের ছবি আঁকতে লাগল। গাছটার নাম ইয়াগড্রাসিল। হেনরিয়েটা পৈরটকে ইয়াগড্রাসিলের আসল ইতিহাসটা বলল। এ ছবি সে আগেও তাঁবুতে গোল লোহার টেবিলে এঁকেছিল এবং পৈরটের ধারণা সময়টা ছিল রবিবার বেলা বারোটা।

পৈরট বলল–এ্যাঞ্জের লোকেরা রবিবারের বিকেলে মৃতদেহের ছবি তুলতে তুলতে তাবুতে কারা আসে লক্ষ্য করছিল।

হেনরিয়েটা বলে-সন্ধ্যার অনেক পরে ডিনারের শেষে গিয়েছিলাম।

পৈরট–আপনি কি বলতে চান রাত্রির অন্ধকারে আপনি তাঁবুতে গিয়ে গাছটা এঁকে এসেছেন?

হেনরিয়েটা–আপনার ধারণাটা কি?

পৈরট-রবিবার সকালে হয়তো আপনার জ্ঞাতসারে পেন্সিল দিয়ে ইয়াগড্রাসিলের ছবি এঁকেছিলেন।

হেনরিয়েটা–রবিবার সকালে তাঁবুতে আসিনি। জন গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরে আমি একটার আগে পুলের ধারে যাইনি।

পৈরট–আপনি তাবুতে ছিলেন এবং ডাঃ ক্রিস্টোকে গুলি করেছেন অথবা আপনি দেখেছেন কে ডাঃ ক্রিস্টোকে গুলি করেছে। অথবা এমন কেউ ওখানে ছিল যে, ইয়াগড্রাসিল সম্বন্ধে জানে এবং জেনে শুনে টেবিলের উপর এঁকেছে আপনার উপর সন্দেহটা জাগানোর জন্য।

হেনরিয়েটা–আপনারা কোনোদিন প্রমাণ করতে পারবেন না।

.

২৬.

গ্র্যাঞ্জ পৈরটের সঙ্গে এক কাপ চা খাওয়ার জন্য রেস্টহ্যাভেন-এ এল। সে বলল, আগামীকালের পরের দিন বিচারের মাধ্যমে অনুসন্ধানের তারিখ। কিন্তু কী হবে? বন্দুকটা তো পাওয়া গেল না। ভালো করে খুঁজলেও বন্দুকটা পাওয়া যাবে না বলে মনে হচ্ছে।

পৈরট–আপনি বন্দুকটা পাবেন।

গ্র্যাঞ্জ–জন ক্রিস্টো গুলিবিদ্ধ হওয়ার প্রায় দুমিনিট পরে আপনি গিয়ে পৌঁছেছিলেন। তখন লেডি ক্যাটেল এককুড়ি ডিম, মিস স্যাভারনে একটা ফুলের বাস্কেট নিয়ে এসেছিলেন এবং এডওয়ার্ড এ্যাঙ্গক্যাটেল একটা শিকারের ঢিলে কোট পরেছিলেন। তাদের যে-কেউ বন্দুকটা নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু সবচেয়ে বেশি সন্দেহজনক ব্যক্তি ভেরোনিকা ক্রে। সে ক্রিস্টোর সঙ্গে ঝগড়া করেছে। সে তাকে ঘৃণা করে।

পৈরট–আর হেনরিয়েটা স্যাভারনেক?

গ্র্যাঞ্জ–কিন্তু সেখানেও কিছু পাওয়া যায়নি। তার উপর সর্বদা নজর রাখা হচ্ছে। খানা তল্লাসীতে সে কৌতুক বোধ করল। তার স্টুডিওর সুন্দর জিনিসগুলি আমাদের লোকেদের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল। কাদামাটির মূর্তি, হ্রাসের এ্যালুমিনিয়ামের সুন্দর মূর্তি-ঘোড়ার পুতুল দেখেও মনে হবে না ঘোড়া বলে। এখানকার আবহাওয়ায় এমন কিছু আছে, যা সবাইকে জড়িয়ে ফেলেছে। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলকে দেখে মনে হয় তিনি উন্মত্তা। লেডি এ্যাঙ্গ্যাটেল বলেছিলেন যে এডওয়ার্ড মিস স্যাভারনেকের প্রেমে পড়েছেন। কিন্তু শুনছি তিনি মিস হার্ডক্যাসেলের সাথে চুক্তিবদ্ধ।

তারা দুজনে বাগানের পথ চলতে চলতে একটা রিভলবার আবিষ্কার করল।

পৈরট–আমি বলিনি যে, আমাদের ভাগা ফিরে গেছে, আঙুলের ছাপ পরীক্ষা করিয়ে আমাকে জানাবেন।

গ্র্যাঞ্জ টেলিফোন করে জানাবেন বলে চলে গেল।

পৈরট দুটি টেলিফোন পেল। প্রথমটি সেদিন সন্ধ্যায়ই, এটাই সেই হেনরির স্টক থেকে হারিয়ে যাওয়া বন্দুক এবং এটা দিয়েই ডাঃ ক্রিস্টোকে হত্যা করা হয়েছে।

পৈরট দ্বিতীয় ফোন পেল পরের দিন। বন্দুকের উপরের ছাপ হলোর কারুর হাতের ছাপের সঙ্গে মেলেনি, এডওয়ার্ড হেনরি, ডেভিড, লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল, হেনরিয়েটা, মিডগে কারুর নয়। এটা বাইরের কোনো লোকের হাতের ছাপ, যাকে আমরা কেউ চিনি না। আমরা জার্দা ক্রিস্টোকে হত্যাকারিণী বলে ভেবেছিলাম, কিন্তু তার হাতের ছাপের সঙ্গেও মিল হয়নি।

.

২৭.

জুরির ফোরম্যান সযত্নে পড়ে গেলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, মৃত ব্যক্তি কোনো অজানা হত্যাকারী বা হত্যাকারীগণ দ্বারা নিহত হয়েছেন।

পৈরট দেয়ালের ধার থেকে মাথা নাড়লেন। আর কোনো সম্ভাব্য রায় হতে পারে না উপস্থিত সকলেই একবাক্যে স্বীকার করলেন।

জাদা সেই কালো পোষাক পরেই এসেছিল। তার মুখে সেই উদাসী অসুখী অভিব্যক্তি।

লুসি বলল–আমি ভেবেছি যে, আমরা একটা উৎসব করব, সব যখন ভালোভাবেই কেটে গেল। বিচারের মাধ্যমে অনুসন্ধান শেষ হওয়ায় হোর আবহাওয়া যেন পাল্টে গেছে। একটা ভার যেন মাথা থেকে নেমে গেছে। কাজেই হাসিখুশীর জোয়ার এসেছে।

মিডগে বলল–কেন জন ক্রিস্টোকে মেরেছে এডওয়ার্ড? আমরা ভেবেছিলাম, জাদা মেরেছে। কিন্তু জার্দা তাকে মারেনি। তোমার কি মনে হয় আমাকে বলল।

এডওয়ার্ড–এখন এসবের চিন্তাভাবনা করা লাভজনক নয়। পুলিস যখন কিছু খুঁজে বার করতে পারল না, তখন ব্যাপারটা ছেড়ে দেওয়াই ভালো।

মিডগে–কিন্তু জানা তো হলো না।

এডওয়ার্ড-জেনে লাভ কি? জন ক্রিস্টো আমাদের কী ছিল?

মিডগে–কিছু না থাকলেও তার জন্য সকলেই শোক করেছে, তাকে সমাধিস্থ করেছে। জন ক্রিস্টো মরে গিয়েই শেষ হয়ে যায়নি। জন ক্রিস্টো এখনও এই হলোতে রয়েছে। মিডগে ভাবল এডওয়ার্ড বোধহয় হেনরিয়েটা এবং জন ক্রিস্টোর কথা ভাবছে। হেনরিয়েটা না জানতে পারে সে কী চায়, কিন্তু এডওয়ার্ড চিরদিনই হেনরিয়েটার থাকবে…

মিডগের মনে হলো সে হয়তো এডওয়ার্ডকে নিয়ে সুখী হবে না। কারণ, সর্বদাই হেনরিয়েটার কথা ভাববে, এটা তার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। আমি অত্যন্ত দুঃখিত এডওয়ার্ড। কিন্তু তবু আমাকে বলতে হচ্ছে, আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারি না।

এডওয়ার্ড–কিন্তু আইন্সউইককে তুমি ভালোবাসো।

মিডগে–কিন্তু শুধু আইন্সউইকের জন্য আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারি না। সেটা তোমার জানা উচিত।

এডওয়ার্ড-অবশ্য তুমি যা বলতে চাইছ তা আংশিক সত্য।

মিডগের ক্ষীণ আশা ছিল যে, এডওয়ার্ড তার সঙ্গে তর্ক করবে এবং তাকে বোঝাবার চেষ্টা করবে, কিন্তু তা সে কিছুই করল না।

মিডগে হাতের আংটিটা খুলে এডওয়ার্ডকে ফেরত দিল।

এডওয়ার্ড–মিডগে, আমার ইচ্ছে যে ওটা তুমি রেখে দাও।

মিডগে–আমি তা পারি না।

এটা সম্পূর্ণ বন্ধুত্বপূর্ণ ভাবেই হয়েছিল, সে জানত না এবং কোনোদিনই জানবে না মিডগে কী অনুভব করছে। প্লেটের উপর স্বর্গ নেমে এসেছিল। প্লেটটা ভেঙে গিয়েছে এবং স্বর্গ তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে চলে গেছে।

.

২৮.

বালিশের উপর এপাশ-ওপাশ করেও মিডগের ঘুম আসছে না। সে দরজার খিল খোলার শব্দ পেল। তার দরজার পরে বারান্দায় কার পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। এডওয়ার্ড এত রাত্রে তার দরজার পাশ দিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। সে কোথায় যাচ্ছে? সে কি বাইরে চলে যাচ্ছে? সে উঠে ড্রেসিং গাউনটা পরে হাতে একটা টর্চ নিয়ে দরজা খুলে পথে নেমে এল। সে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়ে আলোটা জ্বেলে দিল। সামনের ও পাশের দরজা তালাবন্ধ। রান্নাঘরের দরজা ভেজানো। একটা ক্ষীণ আলো এসে পড়ছিল। এডওয়ার্ড মেঝেতে শুয়ে আছে, তার মাথা গ্যাসচুল্লীর মধ্যে।

মিডগে সার্সি খুলতে না পারায় কাঁচ ভেঙে দিল, এডওয়ার্ডকে গ্যাসচুল্লী থেকে বার করে গ্যাস বন্ধ করে দিল। এডওয়ার্ড অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল এবং অদ্ভুতভাবে শ্বাস নিচ্ছিল। মিডগে এডওয়ার্ডকে জানালার কাছে টেনে নিল। কিন্তু এডওয়ার্ড কেন, কেন? মিডগে শুনতে পেল অনেক দূর থেকে এডওয়ার্ড যেন বলছে, কী ঠান্ডা! মিডগে বাহুবন্ধনে এডওয়ার্ডকে আবদ্ধ করল।

–তোমার স্পর্শ এত গরম মিডগে।

হঠাৎ আনন্দ এবং আত্মবিশ্বাসের গর্ব যেন তাকে পূর্ণ করল। সে নুয়ে পড়ে তার ঠোঁটের উষ্ণতা অনুভব করছিল। এডওয়ার্ডের মনে হল মিডগের ভালোবাসা যেন তাকে ঘিরে ধরেছে, তাকে সবকিছু থেকে আড়াল করে এবং সেই ঠান্ডা মরুভূমিতে সুখের জোয়ার বইতে লাগল, যেখানে এতদিন সে একলা ছিল।

এদিকে হঠাৎ লুসির মাথায় মতলব এল। তিনি হেনরিয়েটার ঘরে গেলেন, এটা সেই হোলস্টার, তুমি কি এটা সম্বন্ধে কিছু ভেবেছ?

–হোলস্টার? হোলস্টার সম্বন্ধে কি ভাববো?

–হেনরির সেই রিভলবারটা হোলস্টারের মধ্যে ছিল তুমি জান, সেই হোলস্টারটা পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ সেটার কথা ভাবছেও না।

.

২৯.

জাদার মাথা ব্যথা করার জন্য চায়ের জল ফুটতে দিল। এমন সময় সদর দরজায় ঘন্টা, জার্দাই দরজা খুলে দিল। সে হেনরিয়েটার গাড়ি দেখে বিস্মিত হল।

হেনরিয়েটা বলল, শোনো জার্দা, হোলস্টার ছাড়া সবই ঠিক আছে। তোমাকে আর কিছুতেই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়াতে পারবে না, তুমি পুলের ধারে ঝোঁপের মধ্যে যে রিভলবারটা ফেলেছিলে, সেটা আমি এমন জায়গায় লুকিয়েছি যা তুমি কিছুতেই পারতে না এবং তার উপরে যে আঙুলের ছাপ আছে তা পুলিস কোনোদিন সনাক্ত করতে পারবে না। এখন শুধু জানতে চাই হোলস্টারের কী করছ? হোলস্টারটা দিয়ে দিতে অনুরোধ করে হেনরিয়েটা।

জার্দা-পুলিস যখন হার্লি স্ট্রিটে এসেছিল, আমি তখন এটাকে টুকরো করে কেটে ব্যাগে করে আমার চামড়ার কাজের সঙ্গে রেখে দিয়েছি।

জাদা জনকে মহৎ ভাবত। তার বিশ্বাস ভঙ্গ হওয়াতেই সে জনকে হত্যা করতে বাধ্য হয়। সে গোয়েন্দা কাহিনীতে পড়েছিল যে, কোন বন্দুকের গুলিতে কে নিহত হয়েছে পুলিস তা বলতে পারে। তাই দুটো রিভলবার নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, একটাতে গুলি ছুঁড়ে ঝোপে ফেলে দিয়ে অন্যটা ধরে দাঁড়িয়েছিল। সেজন্যে প্রথমে তাকে খুনী সন্দেহ হলেও পরে তা প্রমাণিত হয়নি। জার্দা উঠে চা তৈরি করতে গেল। এমন সময় পৈরট এসে হাজির। হেনরিয়েটা গাড়ি নিয়ে হলো ছেড়ে বেরিয়েছে বলে পৈরট তার পিছু নিয়েছে। ছেলেমেয়েরা জার্দাকে প্রশ্ন করে বাবাকে কেন হত্যা করা হয়েছে? এই কথা বলতে বলতে জার্দার ঠোঁট নীল হয়ে এল এবং ঝুঁকে পড়ল। পৈরট ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিল, এবং বলল, সহজ এবং অপেক্ষাকৃত বেদনাহীন মৃত্যু।

হেনরিয়েটা বলল-হার্টফেল করল, না চায়ের মধ্যে কিছু ছিল? সে নিজেই কিছু মিশিয়েছিল। সে চলে যাওয়ার এই রাস্তাই পছন্দ করল।

পৈরট বললেন-না না, এটা আপনার চায়ের কাপ। সে দেখেছিল যে আপনি তার গোপন কথা জানেন, কাজেই আপনারও মরা উচিত। আপনি খুব ক্লান্ত হেনরিয়েটা।

হেনরিয়েটা–আপনি কখন অনুমান করলেন?

পৈরট–আমি শীঘ্রই বুঝেছিলাম যে, আপনারা যা করেছেন তার পেছনে আত্মীয়দের সমর্থন ছিল। কিন্তু কেন আপনি এটা করতে চেয়েছিলেন।

হেনরিয়েটা–কারণ, জন আমাকে করতে বলেছিল। সে জানত জাদা যা করেছে তার পরিণাম থেকে কেউ যদি রক্ষা করতে পারে সে আমি এবং সে জানত আমি সবকিছুই করব, কেননা জনকে ভালোবাসি। কাজেই প্রথমেই আমি রিভলবারটা পুলের জলে ফেলে দিলাম, তাতে আঙুলের ছাপ নষ্ট হয়ে যাবে। পরে যখন জানলাম যে, অন্য বন্দুক দিয়ে জনকে গুলি করা হয়েছে তখন আমি সেই বন্দুকটা খুঁজতে লাগলাম এবং খুঁজে পেলামও এবং আমার স্টুডিওতে লুকিয়ে রেখেছিলাম, পরে এনে যেখানে রাখলাম পুলিস সেখান থেকে উদ্ধার করেছে?

পৈরট–কাদামাটির মধ্যে?

হেনরিয়েটা কি করে জানলেন জিনিসটা কোথায় ছিল?

পৈরট–আপনার ঘোড়ার মডেল দেখেই বুঝেছিলাম আপনার মনে ছিল, ট্রয়-এর কাঠের ঘোড়া, কিন্তু আঙুলের ছাপ কি করে ম্যানেজ করলেন?

হেনরিয়েটা–একজন বুড়ো অন্ধ দেশলাই বিক্রি করে, সে জানত না ওটা কি? আমি তাকে ওটা ধরে থাকতে বললাম, আমি টাকা বার করছি বলে।

পৈরট–আমি জানি, বুঝতে পেরেছিলাম, জার্দা ক্রিস্টো ছাড়া সকলকেই জড়ানো হচ্ছে।

হেনরিয়েটা–জাদার কী করা হবে?

পৈরট-জার্দার ব্যাগ উল্টে দিল, তা থেকে সোয়েড এবং অনেক রঙিন চামড়ার টুকরো পাওয়া গেল। পৈরট চামড়াগুলো সাজিয়ে হোলস্টার তৈরি করল। আমি এটা নিয়ে যাচ্ছি।

হেনরিয়েটা–কেউ কোনোদিন জানবে না, প্রকৃত কি ঘটেছিল। তবে আমার মনে হয় একজন ঠিকই জানবে, সে ডাক্তার ক্রিস্টোর ছেলে। একদিন সে অবশ্যই আমার কাছে এসে সত্য ঘটনা জানতে চাইবে। কিন্তু আপনি তাকে বলবেন না।

পৈরট-হ্যাঁ, আমি তাকে বলব, টেরি কেবল জানতে চায়। বিজ্ঞানীর কাছে সত্যটাই বড় কথা। তা সে গ্রহণ করবে এবং বেঁচে থাকবার মতো নির্ভরশীল অবলম্বন করে তুলবে। আর আপনি চলে যান, আপনার স্থান জীবিতদের মধ্যে।

.

৩০.

লন্ডনের পথে গাড়ি চালাতে চালাতে দুটো চিন্তা হেনরিয়েটার মনে জেগে উঠল–আমি কী করব, আমি কোথায় যাব? এখন সে প্রতি নিশ্বাসে বলছে, জন…জন। সে ভাবল, আমি যদি সেই চা পান করতাম!

হঠাৎ তার মনের উপরের কালো পর্দা সরিয়ে সে ভাবল, হ্যাঁ আমি অবশ্যই সেখানে যাব–আমি সেন্ট ক্রিস্টোফার হাসপাতালে যাব। হাসপাতালে মিসেস ক্যাবট্রি ডাক্তার ক্রিস্টোর জন্য দুঃখ করছিল।

বৃদ্ধা বলল-দুঃখে ভেঙে পড়ো না, যা যাবার তো চলে গেছে, তা তো ফিরে আসবে না। একাকী খালি করছিল।

জন তুমি বলেছিলে, আমি যদি মরে যাই, প্রথম যে কাজ তুমি করবে, তা হচ্ছে তোমার চোখ দিয়ে অশ্রু গাল দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে–আর তুমি একটি শোকাকুল রানীর মূর্তি বা অন্য কোনো শোকের মূর্তি গড়তে শুরু করবে।

সে ভাবল, আমি যা, উহা তাহাই। মিডগে এবং এডওয়ার্ড আইন্সউইক চলে গিয়েছে। তার মধ্যে সত্যতা ছিল–শক্তি ছিল। উষ্ণতা ছিল। কিন্তু আমি একটা পূর্ণব্যক্তি নই–আমি আমার নিজের নই, কিন্তু আমার বাইরের কোনো এক সত্ত্বার। আমি আমার মৃতের জন্য শোক করতে পারি না। তার পরিবর্তে আমি আমার দুঃখ দিয়ে একটি স্ফটিকের মূর্তি তৈরি করব।

এগজিবিট নং ৫৮ ‘শোক’ স্ফটিক– মিস হেনরিয়েটা স্যাভারনেক…।

এক নিশ্বাসে সে বলল, জন আমি যা-না করে পারলাম না, তার জন্য আমাকে ক্ষমা করো, আমাকে ক্ষমা করো।

Exit mobile version