হেনরিয়েটার সঙ্গে বেড়াবার কথা তার ভুলেও স্মরণে আসবে না, জগত জুড়ে এত ব্যাধি এত যন্ত্রণা! ডাঃ ক্রিস্টো মনে মনে ভাবে, হেনরিয়েটার সাহচর্যে বোধহয় সব কদর্যতা দূরীভূত হয়ে যায়। সে যেন তাকে ঘাড়ে নতুন কোনো দুঃখের বোঝা চাপাতে চায় না। তার মোহময়ী আবেষ্টনী সে যে কোন মহিমায় সৃষ্টি করে। ভাবতেও সত্যি অবাক লাগে।
তার একজন মাত্র রুগী দেখা বাকি। কিছুক্ষণ পরেই সে টেবিলের ঘণ্টা বাজাবে। যদিও তার অনেক দেরি হয়ে গেছে। উপরে খাবারের ঘরে লাঞ্চ প্রস্তুত হয়ে পড়ে আছে, জার্দা এবং তার সন্তানেরা তার জন্যই পথ চেয়ে বসে আছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে হাজির হতে হবে।
তবু সে একইভাবে বসে আছে। নড়েচড়ে বসার শক্তি সে হারিয়েছে, আজ সে ক্লান্ত, খুব ক্লান্ত।
কিছুদিন ধরেই তাকে এক ক্লান্তি ঘিরে ধরেছে। যার ফলস্বরূপ তার মেজাজটাও দিন দিন রুক্ষ হয়ে উঠেছে। অত্যাধিক পরিশ্রম বা মনের অশান্তি বা অবসাদ এর কারণ হলেও হতে পারে। বেচারী জার্দা, সে তো তার সঙ্গে মানিয়ে নেবার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। তার স্বভাব যদি বিনীত নষস্বভাবের না হতো এবং নিজের দোষ স্বীকার করে না নিত তবে হয়তো একটা কারণ মিলে যেত। এমন একটা সময় ছিল, যখন জার্দা যা কিছু বলতো ক্রিস্টো তাতেই অগ্নিশর্মা হয়ে উঠতো, এবং সে মনে করতো যে, জার্দা যুক্তি করেই তাকে ক্ষেপানোর জন্য এরকম কথা বলছে, তার কথা বলার ধরনই ঐরকম, লোককে ক্ষেপিয়ে তোলা। তার ধৈর্যশক্তি, তার স্বার্থের ব্যাপারে উদাসীন ভাব, তার নিজের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ–ক্রিস্টোর রাগের মাত্রাকে আরও দ্বিগুণ করে ফেলত। জার্দা কখনো প্রতিবাদ করেনি, নিজের জেদ ধরে সে বসে থাকতো তা নয় কিন্তু নিজের কথার ধরনধারণ বিন্দুমাত্র পরিবর্তন করত না।
কিন্তু অদ্ভুত লাগে তখনই যখন দেখা যায় যে, জার্দার যে গুণগুলো ক্রিস্টোকে ক্ষেপিয়ে তুলত, সেই গুণগুলো সে হেনরিয়েটার মধ্যে পেতে চায়, যে জিনিষে ক্রিস্টোর রোগ হয় তা হলো হেনরিয়েটার একপ্রসঙ্গ থেকে অন্যপ্রসঙ্গে যাওয়ার সাধুতা।
একদিন ক্রিস্টো তাকে কথাচ্ছলে বলেছিল, আমার মনে হয়, সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদী তুমি। হেনরিয়েটা বলেছিলেন, বোধহয় তাই হবে।
ক্রিস্টো–তুমি সদাই লোকের মন বুঝে কথা বল।
হেনরিয়েটা–সেটাই আমার ইচ্ছে বেশি প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়।
ক্রিস্টো–সত্য বলার থেকেও কী প্রয়োজনীয়?
হেনরিয়েটা-প্রয়োজনটা সত্যই একটু বেশি।
ক্রিস্টো–তাহলে তুমি ঈশ্বরের নামে শপথ করে আমার কাছে মিথ্যে বুলি আওড়াও না কেন?
হেনরিয়েটা–তুমি আমাকে এমনটি করতে বল?
ক্রিস্টো-হা।
হেনরিয়েটা–সত্যি আমি অনুতপ্ত, জন, আমি পারি না।
ক্রিস্টো-তোমার অনেক সময় জানা উচিত, আমি কি বলতে চাই। না, হেনরিয়েটার কথা আর নয়। সে আজ বিকেলের দিকে হেনরিয়েটার সঙ্গে দেখা করতে যাবে। এখানকার যা কাজ আছে তা তাড়াতাড়ি সমাপ্ত করে নিতে হবে। দশভাগের এক ভাগ আসল রোগ, অবশিষ্টটা বিষাদ ব্যাধি বা চিত্তোন্মাদনা–একপ্রকার স্নায়বিক রোগ। নড়াচড়ার নামগন্ধও নেই, চুপচাপ স্থবিরের মতো বসে রইল, রোগী দেখার বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টাও সে করল না। ডাক্তার জন ক্রিস্টো ক্লান্ত অত্যন্ত ক্লান্ত। তার মনে হল সে বহুদিন ধরেই ক্লান্ত। কোনো একটা জিনিসের অভাব ঘটেছে তার শরীরে, খুব অভাব। হঠাৎ সে মনের তাগিদ অনুভব করল, তার বাড়ি যাওয়ার বাসনা জেগেছে।
তার খুব অবাক লাগল, কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল এই চিন্তা? এর অর্থই বা কি? বাড়ি? কোনো দিন তার বাড়ি ছিল না। তার মা-বাবা ছিলেন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, সে বড় হয়েছে কখনো মাসির স্নেহে কখনো কাকার কাছে–একটা ছুটি সে একজনের কাছেই কাটাত। হার্লি স্ট্রিটের বাড়িটা বোধহয় তার জীবনের প্রথম স্থায়ী গৃহকোণ। কিন্তু এই গৃহকোণকে সে কোনোদিন বাড়ি বলে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পেরেছে কি? সে মাথা নাড়ে। না, কোনো দিন ভাবতেও পারেনি। তবে? এই চিন্তা তার মনে উদয় হলো কী করে? কেনই বা হল? কোথা থেকে এল? চিকিৎসকের উৎসুক মনে এই চিন্তা বার বার ঘুরপাক খেতে লাগল
‘আমি বাড়ি যেতে চাই।
কারণ খুঁজলে কিছু একটার সন্ধান নিশ্চয়ই মিলবে–কোনো প্রচ্ছদপট অবশ্যই থাকবে।
খুব স্পষ্ট, সে তার মানস চক্ষে দেখতে পেল অগভীর নীল ভূমধ্যসাগর, সারিবদ্ধ পাম গাছ, কন্টকময় নাশপাতি আর ক্যাক্টাসের সমারোহ। কল্পনার জগৎ থেকে তার নাকে আসছে গ্রীষ্মের গন্ধ এবং সমুদ্রসৈকতে সূর্যের চড়া রোদে শুয়ে শুয়েই অনুভব করছে জলের শীতলতা। সল মিগুয়েল।
হঠাৎ যেন চমকে ওঠে–একটু যেন বিব্রতও বোধ করে। অনেক বছর হয়ে গেল সল মিগুয়েলের কথা তার স্মরণে আসেনি। সে আর সেখানে ফিরে যেতে চায় না। সেখানকার সবকিছুই এখন তার জীবনের অতীত অধ্যায়।
সে আজ বারো-চোদ্দ কী বছর পনেরো আগের কথা। সে ঠিক কাজই করেছে। তার কাছে তার বিচার অভ্রান্ত! সে ভেরোনিকার প্রেমে পাগল হয়ে উঠেছিল। ভেরোনিকা তার দেহমন জুড়ে বসেছিল। নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু ভাবতে পারত না এবং তা সে লুকোনোর চেষ্টাও করতো না। ভেরোনিকা একবার যা চাইত তা সে জোর করে হলেও আদায় করে নিত। কেবল জনকেই সে জোর করে নিজের করতে পারেনি। কোনো ভাবে সে মুক্তি পেয়ে গেছে। তার মনে হচ্ছে সে তার সাথে ভালো ব্যবহার করেনি। সোজা কথায় প্রেমের ব্যাপারে সে তার কাছে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু সত্যি কথা, সে নিজের মতো করে বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু ভেরোনিকা সে ব্যাপারে রাজী ছিল না। ভেরোনিকা নিজের মতো করে তার জীবন কাটাতে চেয়েছিল এবং তার জীবনে জনের স্থান ছিল অতিরিক্তের তালিকায়। সে যখন জনকে তার সঙ্গে হলিউডে যাবার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল, জন তার প্রস্তাবে রাজী না হওয়ায় সে অবাক হয়েছিল। ক্ষুণ্ণ মনেই সে বলেছিল, তুমি যদি সত্যিকারের একজন ডাক্তার হতে চাও, তুমি আমেরিকা থেকেও এই ডিগ্রি পেতে পার, তবে তার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু প্রয়োজন তোমার কাছে আছে তাই যথেষ্ট এবং আমিও প্রচুর উপার্জন করব।