স্বপ্নবিষ্টের মায়ায় বিভোর হয়ে হেনরিয়েটা ভাবতে থাকে, যাকে মারণ নামে সম্বোধন করা হয়, তবে কি এটা তাই?
যাকে আমরা ব্যক্তিত্ব বলে থাকি? তা কি কোনো ব্যক্তি বিশেষের চিন্তার গঠন। কার চিন্তার? ঈশ্বরের।
পিয়ার গিন্টের চিন্তাধারা কি একেই বলে? বোম প্রস্তুতকারীর হাতার মধ্যে ফিরে যাওয়া। আমি কোথায়? স্বয়ং আমি? সম্পূর্ণ মানুষটা? প্রকৃত মানুষটা? আমার তে ঈশ্বরের মার্কা কোথায়?
জন কি এভাবে অনুভব করেছিল? সেই রাতে সে এমনই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল–এইরূপ হতাশ হয়ে পড়েছিল। রিজওয়ের ব্যাধি–সেই বইগুলোর কোনোটাতেই উল্লেখ করেনি রিজওয়ে কে?
মুর্খ, সে ভেবে নিল, সে জানবে…রিজওয়ের ব্যাধি..জন।..
.
০৩.
ডাক্তার জন ক্রিস্টো তার রোগী দেখার ঘরে বসে সকালের সর্বশেষ রোগীর আগের রোগীটিকে দেখা শেষ করলো। তার চোখমুখ এখন সহানুভূতি ও উৎসাহব্যঞ্জনায় ভরপুর। রোগের খুঁটিনাটি জানার সময় সে বারেবারে মাথা নাড়ছিল এবং মাঝে মাঝে নির্দেশ প্রদানও করছিল।
প্রশ্নোত্তরের পর্ব সমাধা হতেই দেখা গেল, রোগীর মুখ খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ডাক্তার ক্রিস্টো সত্যিই বিস্ময়কর! রোগীর প্রতিভার প্রকৃত দরদ এবং যথার্থ নিরাময় করার উদ্দেশ্যে তার আন্তরিক প্রচেষ্টা অভূতপূর্ব। তার সঙ্গে কথা বলেও অনেক রোগীরা নিজেদের হালকা বোধ করে এবং উপকৃত হয় ও শরীরে পুনরায় শক্তিও পেয়ে যায়।
জন ক্রিস্টো একখানা কাগজ নিয়ে ব্যবস্থাপত্র লেখার কাজ শুরু করে দেয়। রেচক ওষুধের দরকার, সেই আমেরিকার সোফেন মোড়কে ফিকে গোলাপী রঙের চিত্তাকর্ষক ওষুধটাই ভালো ফল দেবে। সংগ্রহ করতে হলে ওয়ার্ডার স্ট্রিটের সেই ছোট্ট দোকানে গিয়ে উপস্থিত হতে হবে। কিন্তু মূল্য একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে, আর সব দোকানে তা মেলা ভার। আশা করা যায় দু’একমাস এতেই ভালো করে চলে যাবে এবং উপকারও ভালো হবে, পরে না হয় অন্য কিছু ভেবে ঠিক করা যাবে। এর চাইতে আর বেশি কিছু তার জন্য করা সম্ভবপরও নয়, শারীরিক গঠন খারাপ হওয়ার দরুন কিছু করাও যাবে না এবং দাঁত গজানোর জন্য কোনো উপযুক্ত ব্যবস্থা করা যাবে না। বুড়িমা ক্যাবট্রির মতো অসম্ভব অবস্থা নয়।…
একঘেয়ে সকাল, আর্থিক সুবিধা এখন উন্নতির দিকে–কিন্তু ঐ পর্যন্তই, আর কিছুই নয়। ডাক্তার ক্রিস্টো সত্যি বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। রুণ স্ত্রীলোক এবং তাদের নিত্য নতুন ব্যাধি; তাকে শরীর আর মন দুয়ের দিক থেকে অবসন্ন করে ফেলেছে।
কিছু কথা বলা বা উপশম, এছাড়া আর কিছু নয়। এমন অনেক সময় আসে যখন তার বড় অবাক লাগে, এইটুকুই কি যথেষ্ট। তখনই তার মনে পড়ে যায় ক্রিস্টোফার হাসপাতালের মার্গারেট রাসেল ওয়ার্ডের শয্যা শ্রেণী এবং মিসেস ক্যাবট্রির দন্তহীন মুখের বিগলিত হাসি।
ডাক্তার ক্রিস্টো এবং রোগিণী পরস্পর পরস্পরের কাছে পরিচিত। পাশের শয্যার থলথলে চেহারার খোসা ছাড়ানো স্ত্রীলোকটির পর্যায়ে তাকে ফেলা যায়। সে একজন যোদ্ধী। সে তার দিকেই ছিল, বাঁচার জন্য সে অধীর ছিল–একমাত্র ঈশ্বরের পক্ষে জানা সম্ভব কেন তার মধ্যে বাঁচার প্রবণতা ছিল। আমরা অবশ্য তার জঘন্য বেঁচে থাকার দুর্দশা দেখেই একথা জানতে বাধ্য হচ্ছি। সে এক নোংরা বস্তিতে বাস করত, মাতাল স্বামী আর এক দঙ্গল অবাধ্য সন্তান নিয়েই ছিল তার সংসার। দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করতে সে বাধ্য থাকত। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অসংখ্য গৃহস্থ বাড়িতে, অনেক খেটে খেটে বেড়ায় অফিস বাড়িতে, বিরতিহীন হাড়ভাঙা কঠোর পরিশ্রম,অমানুষিক কষ্ট, আনন্দ লেশহীন জীবনই সে বেছে নিয়েছিল তবু সে বাঁচতে চায়, প্রাণভরে জীবন উপভোগ করতে চায়, জন ক্রিস্টো যেমন ভাবে জীবন উপভোগ করছে। জীবনের অবস্থা কিন্তু তারা উপভোগ করতে চায় না, শুধু জীবনটাই উপভোগ করে ক্ষান্ত হয়
বেঁচে থাকার প্রয়োজনে শুধু রঙ্গকৌতুক, অস্তিত্ব বজায় রাখার প্রচেষ্টা। অত্যন্ত অদ্ভুত ব্যাপার–তার যথাযথ ব্যাখ্যা বোধ হয় কারো পক্ষেই করা সম্ভব নয়। মনে মনে ক্রিস্টো ভাবে, হেনরিয়েটার সঙ্গে সে এ বিষয়ে কথা বলতে চায়।
ডাক্তার রোগিণীকে দরজা পর্যন্ত ছেড়ে আসার জন্য উঠে পড়ল। উষ্ণ সহৃদয়তার সঙ্গে তার হাত তুলে নিল নিজের হাতের মধ্যে, বন্ধুর মতো উৎসাহ দিতে দিতে এগিয়ে চলল। তার কণ্ঠস্বর থেকে বর্ষিত হচ্ছিল সহানুভূতি এবং উৎসাহ। রোগিণী যেন তার ব্যাধির যন্ত্রণা ভুলে গেছে। তাকে দেখে অতিশয় সুখী ও সন্তুষ্ট মনে হচ্ছিল। ডাক্তার ক্রিস্টো এমনই একজন যত্নপরায়ণ চিকিৎসক।
দরজা বন্ধ হবার যতক্ষণ দেরি, দরজা বন্ধ হওয়া মাত্র ক্রিস্টোর মন থেকে তার অস্তিত্ব লুপ্ত হয়ে যায়। দরজার আড়ালে উপস্থিত থাকলেও ক্রিস্টো তার অস্তিত্ব টের পায় না। মুখ বুজে সে তার কর্তব্য করে যায়। সবই যেন গতানুগতিক। তার মনোজগতে এ বিষয়ে যদিও কোনো আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে না, তবু তার শক্তি ক্ষয়ের পথেই এগিয়ে যাচ্ছে।
আরোগ্যকারীর স্বতঃস্ফূর্ত ডাকে সে সাড়া না দিয়ে পারে না। আবার নিঃশেষিত শক্তিও অনুভব করে। সে মনে মনে এও অনুভব করে যে, সে বড় ক্লান্ত।
আর একটি মাত্র রোগী দেখা শেষ হলেই সপ্তাহান্তের স্থান পরিষ্কার হয়ে যায়। কৃতজ্ঞ চিত্তে তার মনে এই চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছিল। লাল এবং কটা রঙ মেশানো সোনালি পাতা, শরতের নরম সিক্ত গন্ধ-বনের মধ্যে দিয়ে রাস্তাদাবানল–সবকিছু মিলিয়ে অপূর্ব সুন্দর ছুটির আমেজ গৃহকত্রী লুসির কথা মনে পড়তেই এক অজানা খুশীর হিল্লোল তার সারা মনে প্রবাহিত হয়ে যায়। অতিথিপরায়ণা এবং অকপট মনের এমন স্ত্রীলোকের সন্ধান সংখ্যায় খুব কমই। মেলে। অনেক সময় তিনি এমন ইন্দ্রজাল রচনা করেন যে, তাকে আলেয়া বলে ভ্রম হওয়া খুবই স্বাভাবিক। হেনরি এবং লুসির মতো লোকের আতিথ্য গ্রহণ বোধহয় খুব কম জনের ভাগ্যেই জোটে, অর্থাৎ এরকম আতিথেয়তা পাওয়া সবচেয়ে সৌভাগ্যের বিষয়। ইংলন্ডে তারা ছাড়া আর অন্য কারো আতিথ্য গ্রহণে মনের দিক থেকে সাড়া পায় না ক্রিস্টো। তাছাড়া হলোর মতো সুদৃশ্য বাড়িও তার নজরে আসে না। রবিবারে সে বনের মধ্যে প্রমোদভ্রমণে সঙ্গী হিসেবে হেনরিয়েটাকে কাছে পাবে-কখনো পাহাড়ের চূড়ায়, কখনো পর্বতের সানুদেশে স্বচ্ছন্দে বিচরণের সুযোগ তারা পেয়ে যাবে।