নসিকার কাছে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে আসে হেনরিয়েটা। দু’চোখের অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি মেলে তাকে পর্যবেক্ষণ করে। না, কোথাও কিছু বাকি নেই–সবই ঠিকঠাক হয়ে গেছে। এইভাবে সোমবার কি মঙ্গলবার পর্যন্ত রেখে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই কারণ তার আগে যখন কিছু কাজ করা সম্ভব হবে না। ভিজে একটা কাপড় দিয়ে নসিকার সর্বাঙ্গ ঢেকে রাখল। ধৈর্য ধরে এগোতে হবে–তাই কিছুদিন বাদে। তার মধ্যে তিনটি মধুর দিনও এসে যাবে–এ তিনটে দিন সে কাটাতে চায় লুসি, হেনরি এবং মিডগের সান্নিধ্যে, আর সঙ্গে থাকবে জন।
শরীরের প্রত্যেক কটা মাংসপেশী সঙ্কুচিত আর প্রসারিত করে এক মোচড়ে শরীরটাকে টেনে টান টান করে উঠে দাঁড়াল। এতক্ষণে তার অনুভূতি হল, সে আজ সত্যিই বড্ড ক্লান্ত। গরম জলে যতটা তাড়াতাড়ি স্নানপর্ব সেরে শুতে গেল সে।
শয্যা থেকে স্কাইলাইটের মধ্যে দিয়ে সে নীলাকাশের দিকে তাকিয়ে রইল…সুদূর আকাশ জুড়ে কত-না অগুন্তি তারা…একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হল কতগুলো তারা বিশেষ পরিচিত, আর কয়েকটা শুধু নতুন আগন্তুক…হয়তো তারা-কাশে সবগুলোই তারা তার পরিচিত, বা সকলেই হয়তো অপরিচিতের দল…সকলেই হয়তো অনাহুত আগন্তুক অথবা সকলেই চিরটাকাল ধরে আকাশ জুড়ে তার পরিক্রমা অব্যাহত রেখেছে, মহাশূন্যে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত।
হেনরিয়েটা ঘুমোত চাইছে, কিন্তু ঘুম ধরা দিল না…মনের অর্গল বোধহয় ভোলা আছে, তাই চিন্তাগুলোও একে একে মুক্ত হয়ে চলে এসেছে, বাইরে থেকে আসছে গাড়ি চলার শব্দ, হর্ন, ভাঙা গলার বিদীর্ণ চিৎকার, উচ্চকণ্ঠে হাসি…এই মুহূর্তে গাড়ির শব্দটা শোনার পর তার মনে হতে লাগল বাঘ গর্জন করছে..হলদে কালো ডোরাকাটা বাঘ…রঙবাহারী পাতার মতো রঙের…আলোছায়া…ঘন জঙ্গল…নদীর তীর…গ্রীষ্মপ্রধান দেশের চওড়া নদী এসে মিশেছে নীল বিশাল সমুদ্রে…জাহাজে মাত্র দুটি প্রাণী…হেনরিয়েটা আর জন…দুজনেই ডেকের ওপর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে…নীল সমুদ্রের বুক চিরে জাহাজ এগিয়ে চলেছে কোনো এক অজানা দেশের সন্ধানে…জাহাজের ডাইনিং রুমে মুখোমুখি বসে জন ও হেনরিয়েটা ভোজন পর্ব শেষ করতে ব্যস্ত..হঠাৎ জন যেন রেগে ওঠে, ডাইনিং স্যালুনের নিচে নীল সমুদ্র, কিন্তু রাগ তাকে স্পর্শ করতে পারে না–শুধু হাসে…হেসে হেসে কোথায় কোন্ অনির্দিষ্টের পথে চলে যায় সে…জন ও হেনরিয়েটা এখন জাহাজের সুন্দর একটি সুস্থিত কক্ষে..দুজনেই আবার একই সঙ্গে লন্ডন শহরে…দু’জনে একটি ছোট্ট গাড়ির মধ্যে…পাশাপাশি…হেনরিয়েটার হাতে স্টিয়ারিং ধরা, জন তার পাশটিতে বসে…লন্ডন ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা দূরে তারা চলেছে গ্রাম্য পরিবেশের উদ্দেশ্যে..সুন্দর সুন্দর কত ঝর্ণা, পাহাড়ি নদী, লতাগুল্ম, গাছ, ফুল, ফলের বাগান…তারা যাচ্ছে কোথায়?…আবার…হলো…লুসি, হেনরি…জন…জন…জন…হেনরিয়েটার চোখে ঘুম নেমে এসেছে সুখের স্বপ্নে সে এখন বিভোর…তার অবচেতন মনে ঘুরে ফিরে একটি মাত্র ব্যক্তিত্ব ধরা দিচ্ছে–একজন পুরুষজন।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়–স্বপ্নও কোথাও বিলীন হয়ে যায়…অপরাধীর মুখে হেনরিয়েটা বাস্তব জগতে ফিরে আসে–কি যেন করা হয়নি, কোথায় যেন একটা অন্যায় করা হয়েছে, কি যেন করা উচিত ছিল, কিন্তু সে করেনি!
নসিকা?
অনিচ্ছা সত্ত্বেও হেনরিয়েটা বিছানা ত্যাগ করে, আললাগুলো জ্বেলে দেয়, নসিকার কাছটিতে এসে দাঁড়ায়, ঢাকা তুলে ফেলে–জোরে জোরে নিশ্বাস পড়তে থাকে।
নসিকা নয়–ডোরিস স্যান্ডার্স।
হেনরিয়েটা কোথায় যেন একটা অজানা ব্যথা অনুভব করে, নিজের মনকে নিজেই বোঝাবার চেষ্টা করে–আমি ভুলটা সংশোধন করে নিতে পারি, শুধরে নিতে পারি আমার করা ভুলটা। আপন মনেই বলে যেতে থাকে, মূর্খ তুমি কী জান তোমার কী করণীয়।
আগেই এখুনি সেরে ফেলতে হবে–কাল আর করার সাহস কুলোবে না। এটা যেন ঠিক নিজের রক্তমাংস ধ্বংস করার পথে। এতেই বড় আঘাত লাগে-হ্যাঁ, এটাই মনে বড় আঘাত হানে।
হেনরিয়েটার মনে হল, বেড়ালজাতটাও বোধহয় এমনটাই অনুভব করে। তাদের সদ্যোজাত কোনো ছানার মধ্যে যখন কোনো খুঁত নজরে আসে তখন তারা ছানাটিকে বাঁচিয়ে রাখে না এবং হত্যা করার ঠিক পূর্বে তাদের মনেও হয়তো যেন চিন্তাধারার উদয় হয়।
ঘন ঘন দ্রুতগতিতে নিশ্বাস পড়তে থাকে হেনরিয়েটার। মাটির মডেলটাকে সে ধরে দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে কাঠামো থেকে মাটি তুলে নিয়ে বড় মাপের একটা তাল মাটিতে পরিণত করে। কাদামাখা হাতের দিকে সে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, শারীরিক আর মানসিক দিক দিয়ে উত্তেজনা তার মনকে বড় নাড়া দিচ্ছে।
হেনরিয়েটা সঙ্গে সঙ্গে হাত ধুয়ে ফেলে। একটা অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা সঙ্গী করে সে শুতে চলল। বিষণ্ণ মনে সে ভাবতে থাকে, নসিকা এই পৃথিবীতে এসেছিল অল্প কিছুদিনের জন্য, কিন্তু রোগে তার অকালমৃত্যু ডেকে আনে। অদ্ভুত সব ভাবনা-চিন্তা, মানুষ টেরও পায় না, তার নিজের অজ্ঞাতে কখন জেগে ওঠে আবার বিলীন হয়ে যায়।
কারুর কথাই সে কানে ঢোকায়নি–তবু নিজের অজান্তেই ডোরিসের ঈর্ষান্বিত গুঞ্জন বা মন–এই দুটি বস্তু বোধহয় হেনরিয়েটার কানের মধ্যে দিয়ে বা মনের মধ্যে দিয়ে হেনরিয়েটার আঙুলগুলোকে প্রভাবিত করেছিল এবং তাই নসিকা–ডোরিস হয়ে উঠতে পেরেছিল।