পৈরট–আপনি আগে থাকতে প্রস্তুতি নিয়েই ছক কষে জন ক্রিস্টোকে এই পৃথীবী থেকে সরিয়ে ফেলেছেন একথা আমাদের মনেও আসেনি। তবে ঝোঁকের মাথায় বা আক্রোশে অন্ধ হয়ে এমনটা যদি করেও ফেলতেন, তবে নিজেকে বাঁচিয়ে করতেন।
হেনরিয়েটা এবার উঠে পড়ে। সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, বিবর্ণ এবং চিন্তাক্লিষ্ট মুখে। শুষ্ক হাসি হেসে শুধু বলে ওঠে, আমি এই ভেবে এখানে এসেছিলাম আপনার মনের কোনো এক জায়গায় আমার স্থান আছে।
হারকিউল পৈরট প্রত্যুত্তরে বলে, সেটা বোধহয় আমার দুর্ভাগ্য।
.
১৯.
হেনরিয়েটা চলে যাবার পরেও পৈরট চুপচাপ বসে থাকে। তার চোখে পড়ে নিচের রাস্তা দিয়ে ইন্সপেক্টর গ্র্যাঞ্জ দৃঢ় পদক্ষেপে পুলের পাশ দিয়ে পাশের রাস্তাটা এখন ধরেছে। ইন্সপেক্টর উদ্দেশ্য ছাড়া একটা পাও চলে না। সে হয় রেস্টহ্যাভেন-এ না হয় ডাভকোট যাবে। পৈরট শুধু ভাবছে কোথায় সে যাবে?
সে উঠে পড়ে যে রাস্তা ধরে এসেছিল সেই পথ ধরেই চলতে শুরু করে দেয়। গ্র্যাঞ্জের সাথে মুখোমুখি হবার পরেই জানতে পারবে ব্যাপারটা কতদূর এগিয়েছে।
রেস্টহ্যাভেন-এ পৌঁছে কোনো আগন্তুক তার নজরে এল না। যেদিকে ‘ডাভকোট’ সেই দিকেই পৈরট তাকায়। সে জানতো যে লন্ডনে এখনও ভেরোনিকা ক্রে ফিরে যায়নি। সে লক্ষ্য করে যে ভেরোনিকা ক্রে সম্পর্কে তার উৎসাহ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সেই লোমশ শেয়াল, দেশলাইয়ের বাক্সগুলো, হঠাৎ করে শনিবার রাতে অতর্কিতে আক্রমণ এবং পরিশেষে হেনরিয়েটা স্যাভারনেকের জন ও ভেরোনিকার সম্পর্কের রহস্য উদঘাটনের সাবলীল স্বীকারোক্তি তার উৎসাহ আরও বাড়িয়ে দেয়। তার কাছে এটা একটা চমৎকার প্যাটার্ন বলেই মনে হয়।
জার্দা ক্রিস্টো কি তার স্বামীকে গুলি করেছে? দেখেশুনে মনে হয় ব্যাপারটা মোটেই তেমন সহজ নয়? হয়তো খুবই জটিল? হেনরিয়েটার সঙ্গে কথা বলে তার মনে এই উপলব্ধি হচ্ছে যে, ব্যাপারটা জটিল না হলেও খুব সহজও নয়। হেনরিয়েটার প্রতি তার সন্দেহ জাগায় সে নিজের ওপরেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল। তবে হেনরিয়েটাকে সে কখনোই জনের হত্যাকারিণী বলে মেনে নেয়নি। সে শুধু এই ভেবেছিল যে, হেনরিয়েটা হয়তো কিছু জানে বা সে হয়তো কোনো কিছু গোপন করছে বা আড়াল করতে চাইছে? কিন্তু লুকোনোর মতো কী থাকতে পারে?
সুইমিং পুলের দৃশ্যটা আবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সত্যি সাজানো গোছানো এক দৃশ্য। ঠিক যেন একটা মঞ্চ! কিন্তু মঞ্চস্থ কে করছে? কার জন্যই বা এই মঞ্চস্থ করা হচ্ছে? দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর তার কানেই যেন খট করে লাগে। সে ভাবে, এটা ধৃষ্টতা–নিছক একটা কৌতুক। এটা এখনও ধৃষ্টতা ঠিকই–তবে কৌতুক নয়। আর প্রথম প্রশ্নের উত্তর? সে নীরবে মাথা নাড়ে। সে জানে না, বিন্দুমাত্র অনুমান করার মতোও তার জ্ঞান নেই।
আধবোজা চোখে পৈরট তার কল্পনার জগতে চলে যায়, মানসচক্ষে সকলেই তার কাছে স্পষ্ট। স্যার হেনরি–পক্ষপাতশূন্য, দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন, বিশ্বাসী, সাম্রাজ্যের শাসক। লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল–অস্পষ্ট ছায়ার মতো-প্রগভা-মোহময়ী অসম্ভব কাহিনী তৈরির ক্ষমতা বিশিষ্ট এককথায় মূল্যহীন এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনা। হেনরিয়েটা–যে নিজের থেকেও জন ক্রিস্টোকে বেশি ভালোবেসেছিল। শান্ত, ধীর এবং ঋণাত্মক এডওয়ার্ড এ্যাঙ্গক্যাটেল। ঋণাত্মক কালো মেয়েটা মিডগে হার্ডক্যাসল, অর্ধচেতন উদাস মনোভাবাপন্ন জার্দা ক্রিস্টো রিভলবার হাতে দণ্ডায়মান। তারুণ্যের ব্যক্তিত্ব বিশিষ্ট ডেভিড এ্যাঙ্গক্যাটেল। এই হত্যাকাণ্ডে সকলেই যে ভীষণভাবে বিব্রত। প্রত্যেক মানুষেরই ব্যক্তিগত দুঃখ, তার অর্থ এবং গল্প আছে। এই পরস্পর সম্পর্কশূন্য চরিত্রগুলোর মধ্যে কোথায় যেন আসল সত্য মুখ লুকিয়ে আছে। পৈরটের কাছে একটা জিনিষ ভীষণ মূল্য রাখে–সত্য, সত্যের সন্ধান। জন ক্রিস্টোর মৃত্যুর রহস্য তাকে জানাতেই হবে। সে আবিষ্কার করে জনসমক্ষে আনতে চায় হত্যাকারী কে? কার অদৃশ্য হস্ত এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কলকাঠি নেড়ে চলেছে? এই হত্যাকাণ্ডের পেছনেও কোনো উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই কাজ করেছে। এটা কোনো স্বার্থান্বেষীরই কাজের নমুনা।
.
ভেরোনিকা বলে ওঠে–অবশ্যই ইন্সপেক্টর, আমি আপনাকে সাহায্য করার ব্যাপারে সবসময়ে উগ্রীব।
গ্র্যাঞ্জ বলল–ধন্যবাদ, জেনে খুশী হলাম মিস ভেরোনিকা। শনিবার সন্ধ্যার পরে আপনি হলোতে এসেছিলেন?
ভেরোনিকা–হ্যাঁ, আমার দেশলাই ফুরিয়ে গিয়েছিল। আমি ভুলে গিয়েছিলাম গ্রামে ওটার কী মূল্য দাঁড়ায়।
গ্র্যাঞ্জ–আপনি এতটা পথ হেঁটে হলোতে এলেন কেন? পৈরট যখন আমাদের পাশেই থাকেন, তার কাছে গেলেই তো পারতেন?
ভেরোনিকা–আমি ঠিক জানতাম না, আমার পাশের ঘরে কে থাকেন। আমি ভেবেছিলাম তিনি হয়তো কোনো বিদেশী হবেন। তাঁর কাছে দেশলাই ধার করতে গেলে তিনি হয়ত মনে মনে একটু বিরক্তই হবেন।
গ্র্যাঞ্জ–আপনি দেশলাইও পেয়ে গেলেন এবং পুরনো বন্ধু হিসেবে ক্রিস্টোর দেখাও পেয়ে গেলেন?
ভেরোনিকা–হা, বেচারী জন, পনেরো বছর আমি তাকে চোখের দেখাও দেখিনি।
গ্র্যাঞ্জ-সত্যি? তাকে দেখার পর আপনার মন খুশীতে নেচে উঠল?
ভেরোনিকা-সত্যি, অস্বীকার করব না, তাকে দেখে ভীষণ আনন্দ পেয়েছিলাম। একজন পুরোনো বন্ধুর দেখা পেলে কোন্ লোক খুশী হয়ে থাকে ইন্সপেক্টর?