পৈরট–টেনিসন, আপনাদের সবার প্রিয় লর্ড টেনিসনের কবিতা বলছি।
হেনরিয়েটা কবিতার শেষ লাইন আওড়াতে থাকে। আপন মনে বলে ওঠে হ্যাঁ, এটা প্রতিধ্বনিই বটে!
পৈরট–প্রতিধ্বনির মানে কী বোঝাতে চাইছেন?
হেনরিয়েটা–এই স্থানটা হল নিজেই নিজের প্রতিধ্বনি! গত শনিবার আমি এডওয়ার্ডের সঙ্গে পাহাড়ের স্তর পর্যন্ত চলে গিয়েছিলাম। এই স্থানটা আইন্সউইকের প্রতিধ্বনিরই সমতুল্য। আসলে আমরা তো আর এ্যাঙ্গক্যাটেল নই, এ্যাঙ্গক্যাটেলের প্রতিধ্বনি।
আমরা আসল নই, যেমন জন আসল ছিল। আপনি যদি জনকে একবারও জানতে পারতেন পৈরট। সে ছিল জীবন্ত আসল। জনের মতো আমরা কেউ জীবন্ত নই, তার তুলনায় আমরা সব ছায়া। জন সত্যিকারের জীবন্ত মূর্তি ছিল।
পৈরট–আমি জানতাম। তার মৃত্যুর সময় আমি তার দর্শন লাভ করেছি।
হেনরিয়েটা–আমরা সব প্রতিধ্বনিরা শুধু বেঁচে আছি, আর যে আসল; সে আজ মৃত।
হেনরিয়েটার মুখমণ্ডল থেকে তারুণ্য যেন অপসৃত হচ্ছে, হঠাৎ বেদনায় তার ঠোঁট একেবারে তিক্ত এবং বিকৃত।
পৈরট–আপনার কাকীমা লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল, ডাঃ ক্রিস্টোকে কি পছন্দ করতেন?
হেনরিয়েটা–লুসি? সে ছিল আমার খুড়তুতো বোন, কাকীমা নয়। হ্যাঁ, সে তাকে ভীষণ পছন্দ করত।
পৈরট–মিস্টার এডওয়ার্ড এ্যাঙ্গক্যাটেলও আপনার খুড়তুতো ভাই? সেও কি ডাঃ ক্রিস্টোকে পছন্দ করত?
হেনরিয়েটা–বিশেষভাবে করত সেটা বোধহয় বলা যায় না, তখন সে তাকে ভালোভাবে জেনে উঠতে পারেনি।
পৈরট–আপনার এক খুড়তুতো ভাই ডেভিডও কি জন ক্রিস্টোকে পছন্দ করত?
হেনরিয়েটা–ডেভিড আমাদের সকলকেই ঘৃণার চোখে দেখে। লাইব্রেরি ঘরে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা পড়ে সে সময় কাটায়। ডেভিডের কথা চিন্তা করলে আমার বড় দুঃখ হয়। তার বাড়ির আবহাওয়া ছিল একদম সঙ্কটপূর্ণ। তার মায়ের অস্থিরচিত্তই ছিল এই সঙ্কটের মূলে–তাছাড়া এককথায় তিনি ছিলেন অথর্ব। নিজে রক্ষা করার ব্যাপারে ডেভিড সকলের থেকে নিজেকেই সব থেকে বেশি প্রাধান্য দিত, এই ভাবে যতদিন সম্ভব চালিয়ে যাচ্ছে।
পৈরট-সে কি নিজেকে ক্রিস্টোর থেকে উৎকৃষ্টতর মনে করত?
হেনরিয়েটা–সেই প্রচেষ্টাও সে করেছিল, কিন্তু সফলতার মুখ দেখেনি। আমার সন্দেহ হয়, ডেভিড জনের মতো একজন হয়ে উঠতে চেয়েছিল। তাই সে মনে মনে তাকে অপছন্দ করত।
বাদামবনের মধ্যে দিয়ে পৈরটের দৃষ্টি চলে যায় একেবারে সুইমিং পুলের ধারে, সেখানে একজন তোক কী যেন খুঁজছে–নুয়ে নুয়ে গভীর মনোযোগে কিসের যেন সন্ধানে ঘুরে ফিরছে। পৈরট বলে ওঠে, এরা সকলেই ইন্সপেক্টর এ্যাঞ্জের লোক।
হেনরিয়েটা–সূত্র। আমার মনে হয় কোনো সূত্র তারা হাতে পেতে চাইছে। সিগারেটের ছাই, পায়ের দাগ, পোড়া দেশলাই খুঁজছে, তাই না?
পৈরট–হ্যাঁ, পুলিস এইসবের কোনো একটা বোধহয় পেতে চাইছে। এইসব জিনিষের সুত্র ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে নিজেকে আড়াল করে থাকে।
হেনরিয়েটা–আমার মনে হয়, আমি বোধহয় আপনার কথা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
পৈরট–খুবই ছোট কথা। অর্থাৎ এইসব ক্ষেত্রে সিগারেটের ছাই প্রভৃতির প্রয়োজন নেই বলে, এখানে প্রয়োজন একটা জিনিষের অপ্রত্যাশিত কাজ..
হেনরিয়েটা–আপনি কি বিশেষ কোনো বিষয়ের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করছেন?
পৈরট–আমি শুধু একটা কথাই ভাবছি, আপনি কীভাবে এগিয়ে গিয়ে জার্দার হাত থেকে রিভলবারটা নিলেন এবং জলে ভাসিয়ে দিলেন।
হেনরিয়েটা–পৈরট, জার্দা নিঃসন্দেহে কৌশলহীনা রমণী, শোকের মুহূর্তে রিভলবারে গুলি থেকে থাকলে সে হয়তো অন্য কাউকে মেরে বসবে, এই ভয়েই তার হাত থেকে রিভলবারটা আনতে ছুটে গিয়েছিলাম।
পৈরট–কিন্তু আমার তো ধারণা, রিভলবারটা সবার অলক্ষ্যে জলে দিয়ে কৌশলহীনার মতো কাজ করেছেন স্বয়ং আপনি!
হেনরিয়েটা–যা আঘাত পাবার ছিল সেটা তো বুকেই নিয়েছিলাম আমি। আচ্ছা, পৈরট, এবার আপনি কি উপদেশ দিতে শুরু করলেন?
পৈরট-হাতে যদি থাকত তবে জানা যেত, মিসেস ক্রিস্টোর আগে কে এই বন্দুকটা ব্যবহার করেছিল। কিন্তু এখন আর সেটা জানার কোনো উপায়ই রইল না!
হেনরিয়েটা–আপনার মনে হয় এই সন্দেহই জাগছে যে, সে ছাপ আমার আঙুলের?
আপনারা হয়তো ভাবছেন জনকে গুলি করে রিভলবারটা আমি তার পাশে ফেলে রেখেছি এবং জাদা এসে সেটা নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। তাই না? কিন্তু আমি যদি সেই কাজ করেই থাকব, তবে আঙুলের ছাপ রিভলবারে রেখে দিতাম এমন বোকা আমি নই। এইটুকু বুদ্ধি আমার আছে একথা নিশ্চয়ই আপনারা মনে করেন?
পৈরট-হ্যাঁ, আমি বিশ্বাস করি, বুদ্ধি আপনার আছে।
হেনরিয়েটা–তাই হয়তো আপনারা ভেবে বসে আছেন, জনকে আর কেউ নয়, আমি হত্যা করেছি?
পৈরট–ডাঃ ক্রিস্টো মৃত্যুর পর শুধু ‘হেনরিয়েটা’ উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন?
হেনরিয়েটা–আপনারা ভেবে নিচ্ছেন, জন আমার ওপর দোষ চাপিয়ে চলে গেছে? তাই নয় কি?
পৈরট-তা হলে কী?
হেনরিয়েটা–কেন, আপনি কি এর মধ্যে ভুলে গেলেন? এই কিছুক্ষণ আগে আপনাকে আমি বলেছিলাম, আমার আর জনের মধ্যে কী সম্পর্ক ছিল।
পৈরট–আঃ, হ্যাঁ, তিনি আপনার প্রেমিক ছিলেন, তাই মৃত্যুর সময়ে হেনরিয়েটা’ বলা বড়ই হৃদয়বিদারক।
হেনরিয়েটা–জন হেনরিয়েটা’ বলে আমাকে তার মৃত্যুর জন্য দায়ী করে যায়নি। আপনাদের বোঝা উচিত ছিল যে, আমার মতো লোকের কাউকে মেরে ফেলা মোটেই সম্ভবপর নয়। আমার নামটা জনের মুখে শুনে আমাকে আপনারা দায়ী করতে উঠে পড়ে লেগেছেন।