পৈরট–কিন্তু আপনি তো দেখেছেন?
হেনরিয়েটা–তা বোধহয় হবে না। সে তার ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যক্ষ করবে তারপরে বিচার করবে।
হেনরিয়েটা–কেউ যদি জনের কোনো ক্ষতি করে থাকে সে অন্য কেউ নয় স্বয়ং আমি। জন এবং তার চিন্তার মাঝখানে আমি এসে পড়েছিলাম। আমার জন্যই সে তার সাধনায় পুরোপুরিভাবে মনঃসংযোগ করতে পারছিল না। সে ভীত মন নিয়েই ভাবতে থাকল যে, সে আমাকে তার নিজের মনে করে ভাবতে শুরু করেছে তাই সে অন্য কাউকে আর ভালোবাসার কথা মনেও আনতে পারছিল না। আমার কাছে সে প্রেম নিবেদন করল, কারণ সে আমার ব্যাপারে কোনোদিনই বেশি চিন্তা করতে একেবারেই চাইত না। ব্যাপারটাকে সে একটু হালকা করতে চাইল, সহজ করতে চাইল, তার আর ঠিক দশটা ব্যাপারের মতোই।
পৈরট–আর আপনি? আপনি সেটা খুশী মনেই মেনে নিলেন?
হেনরিয়েটা–না, আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি–হাজার হোক–মানুষ তো…
পৈরট–কেন?
হেনরিয়েটাকেন আবার, আমার মনোগত বাসনা ছিল জনকে খুশী দেখার। আমি চেয়েছিলাম জন যা চায় তাই নিয়েই সে যেন পথ চলতে পারে। তার ধ্যানজ্ঞান বলতে সে একটা জিনিষই জানত, সেটা তার কাজ। এবং এই কাজের মধ্যেই সে নিজেকে মগ্ন রাখতে চেয়েছিল–আমি সেইদিক থেকেই তার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম।
পৈরট–এইমাত্র আপনি ভেরোনিকা ক্রেরও নাম উল্লেখ করেছিলেন; সেও কি ডাঃ ক্রিস্টোর বন্ধু ছিল?
হেনরিয়েটা–শনিবারের আগে তাদের মধ্যে শেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল আজ থেকে পনেরো বছর আগে।
পৈরট–সেও তাকে পনেরো বছর আগে দেখেছিল?
হেনরিয়েটা–তাদের বিবাহের সব প্রায় পাকা হয়ে গিয়েছিল। জন ভেরোনিকার প্রেমে অন্ধ ছিল–কিন্তু ভেরোনিকাকে এক নম্বরের কুকুরী বলে সম্বোধন করলেও বোধহয় ভুল বলা হবে না, সে নিজের স্বার্থ এবং আত্মঅহমিকা ছাড়া আর কিছুই বুঝত না। তার মনের বাসনা ছিল জনকে সে নিজের কথামতো ওঠাবে-বসাবে। এককথায় তাকে পোষা-স্বামী হয়ে স্ত্রীর আঁচলের তলায় থাকতে হবে। কিন্তু জন একেবারে বেঁকে বসল, তাই বিয়েটাও ভেঙে গেল, জনের অবশ্য এই বিবাহ না হওয়ায় মনে কোনো দুঃখ ছিল না। সে জাদাকে বিবাহ করল, জার্দা অবশ্য এই ঘটনার কিছুই জানত না। দেখতে দেখতে পনেরোটা বছর কেটে গেল–এর মধ্যে তাদের আর দেখাসাক্ষাৎহয়নি, কিন্তু জন ভেরোনিকার স্মৃতি মন থেকে পুরোপুরি ভাবে মুছে ফেলতে পারেনি।
পৈরট–এত বছর বাদে দু’জন দু’জনের মুখোমুখি হল এবং জন তার সঙ্গেই বেরিয়ে গেল। জন হলোতে ফিরে এল রাত প্রায় তিনটে নাগাদ।
হেনরিয়েটা–আপনি একথা কী করে জানলেন?
পৈরট–বাড়ির এক ঝি’র দাঁতে ব্যথা হয়েছিল, তাই সে না ঘুমিয়ে জেগেই ছিল। জনের ফিরে আসা তার চোখে পড়েছিল।
হেনরিয়েটা-হ্যাঁ।
পৈরট-আপনি কী করে জানতে পারলেন?
হেনরিয়েটা–(কিছুক্ষণ নীরব থেকে) আমি জানলার দিকে তাকিয়ে বসেছিলাম, তাই তার ফিরে আসাটা চোখে পড়া খুব স্বাভাবিক ছিল।
পৈরট–আপনারও কী দাঁতে ব্যথা হয়েছিল মিস?
হেনরিয়েটা এবার হেসে ফেলে, সে হাসিমুখে শুধু বলে, ব্যথা হয়েছিল ঠিকই তবে এই ব্যথা সেই ব্যথার মতো নয় পৈরট।
তারা রাস্তা পার হয়ে এবার বনের মধ্যে প্রবেশ করল।
হেনরিয়েটা–আমাদের পুলের পাশ দিয়ে যাওয়াটা বোধহয় উচিত হচ্ছে না। বাম দিকে গিয়ে, উপরের পথ বরাবর ফুলের বাগানে বরং আমরা যেতে পারি।
একটা পথ খাড়াভাবে পাহাড়ের দিকে বনের মধ্যে চলে গেছে। কিছুক্ষণ পর তারা এসে থামল সীমান্তবর্তী একটা সমকোণের মতো রাস্তায়। হেনরিয়েটা একটা বেঞ্চে এসে বসে এবং পৈরট এসে তার পাশেই বসে পড়ে। তাদের ওপরে ও পেছনে শুধু বন আর নিচে ঘন বাদামগাছের ঝোঁপ। সামনের দিককার একটা বাঁকা পথ নিচের দিকে চলে গেছে, যেখান থেকে নজরে আসছিল নদীর জলের ঝিকিমিকি।
পৈরট নীরবে হেনরিয়েটার দিকে তাকিয়েছিল। তার মুখের ভাবে এখন একটু পরিবর্তন এসেছে, তবে উত্তেজনা নেই বললেই চলে। তার মুখের চেহারা দেখে তার আসল বয়স বোঝা দায়।
পৈরট–আপনি কী এত ভাবছেন মিস?
হেনরিয়েটা–আইন্সউইকের কথা।
পৈরট–আইন্সউইক কি?
হেনরিয়েটা–আইন্সউইক একটা জায়গার নাম। ওটা একটা স্বপ্নের জগৎ, সাদা ছিমছাম বাড়ি, ম্যাগনোলিয়ার বড় সমারোহ, পাহাড়ী বনভূমি
পৈরট-ওটা কি আপনার বাড়ি?
হেনরিয়েটা–না, আমার বলে কিছু নয়। আমি আয়ারল্যান্ডের বাসিন্দা। ছুটিতে আমরা সকলেই এখানে হাজির হয়েছিলাম–এডওয়ার্ড, মিডগে এবং আমি। আসলে বাড়িটা লুসির, বাড়িটার কর্তা ছিল লুসির বাবা কিন্তু তার মৃত্যুর পরে এই বাড়ির উত্তরাধিকারী এখন এডওয়ার্ড।
পৈরট–ঐ পথ ধরেই তো আপনি কাল সুইমিং পুলে গিয়েছিলেন?
হেনরিয়েটা–না, এ পথ মাড়াইনি, এর কাছাকাছি কোনো পথ দিয়ে। সুইমিং পুল আমার চোখে ঘৃণার বস্তু, সেই সঙ্গে হলোকেও চোখে পড়ার পর আমার চোখে ঘৃণাই ফুটে ওঠে।
পৈরট গুন গুন করে বলে ওঠে–”ঘৃণা করি আমি পশ্চাৎপটে ভয়ের গহুর, ঊর্ধ্ব মাঠে অধর তাহার রক্তে রাঙা উষর প্রান্তর, লোহিত শৈলের স্তর নীরব ভীতির মতো নামে, বিন্দু বিন্দু করে রক্তের ক্ষরণ, নিস্তব্ধ মাঝে জাগে যত প্রশ্ন, প্রতিধ্বনির জবাবে তাহারে করিছে মরণ।”–হেনরিয়েটা অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়, পৈরট কবিতার অংশবিশেষ আবৃত্তি করে চলে।