সত্যিই মিল চোখে না পড়াটাই স্বাভাবিক। হেনরিয়েটার কাল্পনিক নসিকার মুখশ্রী সৃষ্টি করতে প্রাথমিক কাজ হিসেবে যে জিনিষগুলো প্রয়োজন ছিল, শুধু আবশ্যিক জিনিষগুলোই সে ডোরিস স্যান্ডার্স-এর কাছ থেকে গ্রহণ করছে। এগুলো হল-চোখের বিন্যাস এবং চোয়ালের হাড়ের সঠিক অবস্থান। মাটির যে পুতুলটা তৈরি হচ্ছে–সেটা মোটেই ভোরিস স্যান্ডার্স নয়, –একটি অন্ধ বালিকা–যার সম্বন্ধে একটা কবিতা রচনা করা যেতে পারে।
ডোরিসের মতো এর ঠোঁট দুটোও ফাঁক করা–কিন্তু কথা বলার সময় অন্য ভাষার আশ্রয় নেবে এবং যে ভাবনা তারা ব্যক্ত করবে তাও ভোরিসের ভাবনা হবে না
মুখাবয়বের বৈশিষ্ট্যগুলোর কোনোটাই স্পষ্ট নয়, এই নসিকাকে কল্পনা করা যায় কিন্তু তাকে দেখা যায় না, সন্দেহের বশেই মিস স্যান্ডার্স বলে ওঠে, মডেলের আরও কিছু কাজ হলে হয়তো বেশ ভালোই দেখাবে…আমাকে আর কোনো প্রয়োজন লাগবে না তো?
হেনরিয়েটা সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, না ধন্যবাদ। সত্যিই তুমি চমৎকার। আমি তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ।
ডোরিসের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে হেনরিয়েটা কালো কফি বানানোর জন্য পা পাড়াল। সে সত্যিই খুব ক্লান্ত-ক্লান্তির মধ্যে তার মনে আজ খুশির ঢেউ–তৃপ্তি ও শান্তির আনন্দ, তাই প্রাপ্তির সুখও আলাদা।
হেনরিয়েটা আপন মনেই কথা বলতে থাকে, আমি আবার রক্তমাংসের মানুষ হয়ে উঠব। তার চিন্তা এবার স্থান পরিবর্তন করে জনকে আশ্রয় করল। মনের কথা মনে হতেই তার গণ্ডদেশে এক দ্যুতি খেলে গেল। হৃদয়ের আস্ফালন তার সাহসিকতাকে আকাশচুম্বী করে তুলল। সে ভাবল, কাল আমি হলোতে যাচ্ছি–সেখানে গেলেই জনের দেখা পাব..
পেটে তিন-তিনবার গরম কফি পড়তেই হেনরিয়েটার মধ্যে অনেক শক্তি ফিরে এল। ডিভানের ওপর চিত হয়ে শুয়ে নিজের মেরুদণ্ডকে সোজা ও সতেজ করে নিল।
রক্তমাংসের মানুষ হওয়া বোধহয় সবদিক থেকেই ভালো। অকারণে উদ্বাস্তুর মতো পথে পথে ছায়া আর মায়ার পেছনে ছোটাছুটি করা মোটেই ভালো নয়। নিছক অপ্রাপ্তির দুঃখে দগ্ধ হওয়ার মতো অশান্তি বোধহয় আর কিছুতে নেই। আসলে না পাওয়ার বিড়ম্বনার চেয়ে প্রার্থিত বস্তু কি, তা সঠিক না জানাই সব চেয়ে বড় দুঃখ এবং এই দুঃখই মানুষকে আর স্বাভাবিক থাকতে দেয় না, সব কিছু ভুলে তাকে পাগল করে তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটায়। কঠোর পরিশ্রম কে না করতে পারে, পরিশ্রমের ভয়ে কেউ বা পিছু হাটে। কিন্তু পরিশ্রম করেও কি সব সময় ইঙ্গিত বস্তুর দর্শন মেলে?
হেনরিয়েটা কাপ খালি করে নসিকার নিকটে এসে দাঁড়াল। অপলক নয়নে তার দিকে তাকিয়ে রইল। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকাকালীন নিজের অজান্তে ভ্র-কুঁচকে সে বলে ওঠে, না ঠিক হয়নি; যেমনটি বাসনা ছিল, এখনও ঠিক যথাযথ হয়নি। তবে কি কিছু ভূল হল? দৃষ্টিহীন চোখ। এটাই তো চেয়েছিলাম। এর সুষমার কোনো বর্ণনাই করা যায় না। যে চোখের দৃষ্টিশক্তি আছে তা এত সুন্দর নয়, মধুরও নয়। দৃষ্টিহীন চোখ না হলে কী ভালো ছিল? কিন্তু অন্ধ চোখই তো পারে মানুষের হৃদয় বিদীর্ণ করতে, বিভিন্ন পন্থায় কথা বলাতে পারে, নানান ভাষায়! সে এটাই চেয়েছিল, এর জন্যই সে অধীর হয়ে পথে পথে ঘুরে ফিরেছে। এখন নাগালের মধ্যে পেয়েও মনে এত কুণ্ঠা, কেন এই অতৃপ্তি? না, অতৃপ্তি নয়। তার ভাগ্যে যা জুটেছে এটাই তার কাম্য ছিল, ভাগ্যদেবী প্রসন্ন থাকায় হয়তো পাওয়ার অতিরিক্তই সে পেয়েছে। এই অতিরিক্ত পাওয়ার কথা সে কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি। কাঠামোটা কিন্তু ভালোই হয়েছে, ভালো শুধু নয়, খুব ভালো…কাঠামোটা মোটামুটি ভালোই কিন্তু নির্দেশ কোথা থেকে এল? কে হেনরিয়েটাকে নসিকা গড়ার প্রেরণা জুগিয়েছে? না, কেউই না। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া হয় যে কানের কাছে কেউ গুনগুন করেছে; তবে সে নিঃসন্দেহে কোনো ঈর্ষাপ্রবণ প্রকৃতির লোক…কিন্তু হেনরিয়েটা তো কারো কথা শোনেনি, শুনে থাকলেও সেই মতো কাজও সে করেনি…কিন্তু হেনরিয়েটা কাজ না করলেও তার আঙুলগুলো হয়তো মাটির তালে তালে কাজ করে বেরিয়েছে… নিজের অজান্তেই আঙুলগুলো বোধহয় মডেল বানিয়ে ফেলেছে… কিন্তু সম্পূর্ণ এখনও হয়নি… হয়তো আর কোনোদিন হবে না, অসমাপ্তই থেকে যাবে…হেনরিয়েটার মন বলছে নসিকা গড়া তার বোধহয় কোনোদিন শেষ হবে না…ভাবল, এখন যদি না করি তবে আর কোনোদিন পেরে উঠব না, কাল দিনের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে হয়তো অন্য চিন্তা ঘিরে ধরবে…নসিকার ছবি মন থেকে হয়তো চিরতরে মুছে যাবে, নয়তো অন্যরূপে সামনে হাজির হবে… হেনরিয়েটা সময় নষ্ট না করে মাটি নিয়ে কাজে লেগে পড়ল-মাটির কাজ আর বেশি বাকিও নেই, তবে তাড়াহুড়ো করার কোনো প্রয়োজন নেই…হেনরিয়েটা স্টুডিওতে তার পায়চারি শুরু করে দিল…
হঠাৎ ‘পূজারিনী’ পুতুলটির কাছে এসে দাঁড়াল..এটা মনোমতো হয়েছে, কোনো খুঁত নেই…হ্যাঁ, এটা দেখলে মন ভরে যায়। মুখে লেগে আছে বিনীত আত্মনিবেদনের ভাব, ঘাড় এবং মাংসপেশীতে শক্তি, নুয়ে পড়া কাঁধ, ঈষৎ উপরের দিকে তোলা মুখ, বৈশিষ্ট্যহীন মুখশ্রী– সব মিলিয়ে সর্বগুণে গুণান্বিতা এই মডেল, এককথায় উপযুক্ত মডেল। চমৎকার হয়েছে। হেনরিয়েটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে, জনের মনে রাগ নামক ভীষণ বস্তুটি যদি না থাকত, সে যদি অন্যের মতো শান্ত খোশমেজাজী হতো!