এখনও যদি হেনরিয়েটা মাটির পুতুলের মাথা ঠিকমতো বানিয়ে উঠতে না পারে তবে সে ক্ষেপে আগুন হবে–গত দশদিন ধরে সে চেষ্টা করে যাচ্ছে, ধৈর্য বলেও তো একটা জিনিষ আছে!
নসিকা–পুতুলের নাম রাখা হয়েছে নসিকা–কিন্তু শিল্পীর মনকে নসিকা কিছুতেই সন্তুষ্ট করতে পারছে না। সদাই নসিকার সঙ্গে থাকে, নসিকার সঙ্গে প্রাতঃরাশ শেষ করে, নসিকার সঙ্গে ভ্রমণে গিয়েও তাকে তার নাগালের মধ্যে আনতে পারছে না শিল্পী হেনরিয়েটা। অন্য কিছুতেই তার মন আজ উতলা হচ্ছে, সে চাইছে সুন্দর মুখে দৃষ্টিহীন চোখের চাউনি–যেটা হেনরিয়েটার মানস চক্ষে সর্বদা ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু যেটা দেখছে তা কিছুতেই মূর্তির মধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। সে কম মডেল দেখেনি, গ্রীক মডেল দেখে চক্ষু সার্থক করেছে, ইতস্তত করেও মনকে শান্ত করতে পারেনি, পছন্দ হয়নি, অতৃপ্ত মন নিয়েই সে…
এখন তার দরকার একটি মডেলের। প্রথম ধাপ এগোতে পারলেই আশা করা যায় বাকি কাজটাও সে নিজেই উদ্ধার করতে পারবে–তার মনে যে ছবিটা ঘুরপাক খেয়ে চলেছে তাকে একবার এনে স্থাপন করলেই হবে–কিন্তু প্রাথমিক একটা আধার দরকার। এইজন্য সে বহুদূর হেঁটে গেছে, বহু মেয়ে, স্ত্রীলোক, বালিকাও চোখে পড়েছে–দেখে দেখে চোখে ক্লান্তি নেমে এসেছে–হেঁটে হেঁটে শরীর অবসন্ন হয়ে পড়েছে, তবু মনের সাধ মেটেনি, মনের ছবির মিল খুঁজে পায়নি।
পথ চলতে চলতে হেনরিয়েটার মনে হল, তার নিজের চোখেই বোধহয় দৃষ্টিহীনতা আশ্রয় নিয়েছে, চারিদিকে চোখ বুলিয়েও কিছুই তার নজরে আসছে না…
..এই সময় নিজেকে বড় ক্লান্ত, পীড়িত আর অসহায় মনে হল…
হঠাৎ করে বাসের মধ্যে যেন তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে এল। রক্তমাংসের চোখে সে দেখতে পেল তারই সামনে বসে আছে তার নসিকা, অন্যমনস্ক ভাবেই সে বাসে উঠে পড়েছিল পা রেখেছিল–কোথায় যাবে তাও সে জানত না…এবারে স্পষ্ট তার নজরে এল…শিশুসুলভ ছোট একটি মুখ, আধ-খোলা ঠোঁট এবং চোখ–সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন, অন্ধ, ঠিক যেমনটি হেনরিয়েটার বাসনা ছিল।
ঘন্টা বাজিয়ে বালিকা নেমে গেল, হেনরিয়েটা তাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে চলল। হেনরিয়েটা এখন ধীর-শান্ত–এতদিনের দৌড়ঝাঁপ শেষ হয়েছে। প্রার্থিত জিনিষ আজ মিলে গেছে। বালিকাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, মনে কিছু কোরো না। তোমাকে একটা কথা বলতে চাইছি। ভাস্কর্য আমার পেশা, তোমার মাথাটা আমি আমার মডেল হিসেবে ব্যবহার করতে বড় উদগ্রীব।
বালিকার ব্যবহার বড়ই মধুর এবং গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু হেনরিয়েটার কথা শোনা মাত্র সে ভীত-শঙ্কিত হয়ে পড়ল। শিল্পীর কথায় আপনা থেকে গর্ব আর সন্দেহ এসে ঠাই করে নিল। আমতা-আমতা করে দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলে উঠল, দেখুন আপনার যদি সত্যি কোনো মডেল প্রয়োজন হয়ে থাকে, এ ব্যাপারে আমার কোনো আপত্তি থাকার কথা উঠছে না…কিন্তু…আমি কোনোদিন এমন কাজ করিনি…।
ডোরিস স্যান্ডার্স একটু ইতস্তত করায় হেনরিয়েটা তাকে বলল, আমি কিন্তু তোমাকে, তোমার উপযুক্ত পারিশ্রমিক গ্রহণে পীড়াপীড়ি করবো।
নসিকা মঞ্চের ওপর বসে নিজের সৌন্দর্যের অহংকারে বিভোর হয়ে নিজের মনে ভাবছে যে, তার রূপ তাহলে অমর হয়ে গেল। স্টুডিওতে কিন্তু বিন্দুমাত্র ভালো লাগেনি। তবু হেনরিয়েটার কাজকর্ম দেখে তার একটা কথাই মনে হল যে, একজন শিল্পী মনপ্রাণ ঢেলে তার রূপের সুষমা আহরণ করছে একটা মাটির পুতুলকে রূপ দেবার জন্য এর চেয়ে গর্বের বিষয় আর কি হতে পারে!
প্রকারান্তরে এটাই তো অমরত্ব লাভ।
টেবিলের ওপর মডেলের ঠিক পাশটিতে ডোরিস স্যান্ডার্স-এর চশমা জোড়া পড়ে আছে। চশমা ছাড়া সে এক-পাও চলতে পারে না, তাই সে যতটা সম্ভব কম ব্যবহার করে। হয়তো এটাও তার একটা ফ্যাশন। অনেক সময় সে চেষ্টা করে দেখেছে–চশমা ছাড়া পথ চলতে পারে কিনা–কিন্তু চশমা ছাড়া সে একগজ দূরে থেকেও কিছু ঠাওর করতে পারে না। একথা সে নিজের মুখেই হেনরিয়েটার কাছে স্বীকার করেছে। হেনরিয়েটার এখন বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না ডোরিস স্যান্ডার্স-এর চোখের চাহনির মাধুর্যের পেছনে লুকিয়ে আছে তার দৈহিক অপটুতা।
সময় এগিয়ে চলে, হেনরিয়েটা তার যন্ত্রপাতি রেখে দিয়ে হঠাৎ বাহু ছড়িয়ে উঠে পড়ল এবং এও বলল, ঠিক আছে, আমার কাজ হয়ে গেছে। আশা রাখি, তোমাকে খুব বেশি ক্লান্ত করিনি, নয় কি?
-না, না, মোটেই না। ধন্যবাদ মিঃ স্যাভারনেক, আমার তো বেশ ভালোই লাগলো। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কী করে সমাপ্ত করে ফেললেন? সত্যি কি আপনার কাজ শেষ হয়েছে?
হেনরিয়েটা শুধু হাসে। হাসিমাখা মুখেই বলে, না কাজ এখনও সম্পূর্ণ হয়নি, আমাকে আরও পরিশ্রম করতে হবে। তবে তোমাকে নিয়ে যতটা কাজ ছিল তা হয়ে গেছে। আমি যা চেয়েছিলাম তা পেয়ে গেছি–তবে আসল কাঠামো বানানো হয়ে গেছে।
বালিকা মঞ্চ থেকে নেমে এল, তার চশমা চোখে পরে নিল। চশমা মুখে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে চোখমুখের সরল সৌন্দর্য মুহূর্তের মধ্যে উবে গেল এবং তার স্থানে এসে বিরাজমান হল সহজ সস্তা এক সুষমা।
ডোরিস স্যান্ডার্স মাটির মডেলের দিকে চোখ পড়তে হতাশ কণ্ঠে বলে ওঠে, ওঃ! এটা ঠিক আমার মতো হয়নি তো, তাই না?
হেনরিয়েটা হেসে ফেলে,-ওঃ, এটা তো ঠিক ছবি নয়!