মিডগে–আমার তো মনে হয় না, আমি তোমার কোনো কাজে এসেছি বলে।
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বিস্ময়ভরা চোখে মিডগের দিকে তাকাল।–কি? করোনি? আচ্ছা, একটা ভালো ঘুম দিয়ে নাও, প্রাতঃরাশেও ওঠা চলবে না। আর যদি ডাক দিয়েও থাকি, ওঠার পরিবর্তে যত খুশী মন চায় আমার প্রতি কঠোর হবে।
হাসিমাখা মুখে লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল বেরিয়ে গেলেন। যেতে যেতে খোলা বাথরুমের দিকে চোখ পড়ল, কেটলি আর গ্যাসরিং দেখা মাত্র তার মাথায় আর এক বুদ্ধি খেলে গেল।
পৃথিবীতে এমন কোনো লোক নেই যে চা ভালোবাসে না। মিডগেকে চা করে দেওয়ার জন্য তিনি কেটলি চাপালেন। কেটলি চাপিয়েই আর দাঁড়ালেন না, চলে গেলেন।
এবার তিনি এসে দাঁড়ালেন স্বামীর ঘরের সামনে, দরজার হাতলে হাত রাখলেন হেনরি এ্যাঙ্গক্যাটেল। লুসিকে তিনি ভালোবাসতেন এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, সকলের ঘুমে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয় এটা তিনি কখনোই মনেপ্রাণে চাইতেন না। তাই সবদিক ভেবেই দরজায় তালা দিয়ে পরম নিশ্চিন্তে নিদ্রা গিয়েছিলেন।
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল নিজের ঘরে ফিরে এলেন। হেনরির সঙ্গে তাঁর আলোচনায় বসা সত্যিই দরকার ছিল, কিন্তু কি আর করেন–পরে হবে বলে এখনকার মতো তুলে রাখলেন।
ঘরের খোলা জানলার কাছটিতে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বিছানায় এসে নিজেকে এলিয়ে দিলেন। বালিশের ওপর মাথা রেখে দুমিনিটের মধ্যেই শিশুর মতো তার চোখেও ঘুম নেমে এল।
বাথরুমের কেটলিতে জল ফুটছে তো ফুটেই চলেছে…দাসী সাইমনস বলে ওঠে, মিঃ গাজন, আর একটা কেটলিও অন্তিম যাত্রা নিল, খানসামা মুখের ভাষা আর জোগাতে না পেরে তার ধূসর মাথা নাড়ে।
সাইমনস-এর কাছে সে পুড়ে যাওয়া কেটলিটা নিয়ে আসে এবং আলমারি থেকে আর একটা নতুন টেনে বের করে। আলমারিতে তার জিম্মায় আধডজনের মতো কেটলি জমা ছিল। সে বলল, দেখে নিও, মিস সাইমন, গৃহকত্রীর কানে কিছুই পৌঁছবে না।
সাইমনস–তিনি কি আজ পর্যন্ত কখনো এসব ব্যাপারে দৃষ্টিপাত করেছেন?
গাজন দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে, গৃহকত্রীর দয়ার অন্ত নেই, কিন্তু দুর্ভাগ্য তার কিছুই মনে থাকে না।
এই গৃহে তার উদ্বেগ বা অসন্তোষ যাতে কোনোদিন মাথা চাড়া না দিয়ে উঠতে পারে সেজন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাই।
.
০২.
হেনরিয়েটা স্যাভারনে একটা কাদার তালকে চাপড়ে চ্যাপ্টা করে, লম্বা করে, চেপে চেপে প্রস্তুতকার্যে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে। মাটি দিয়ে একটা বালিকার মাথা তৈরি করছিল। অভ্যাস আছে বলে তার মূর্তি নির্মাণের কাজ দ্রুতই এগিয়ে যাচ্ছিল।
মনের সৌন্দর্য মূর্তির মধ্যে স্থাপন করতে সে সক্ষম হয়েছিল। কাজের খুঁটিনাটি সব দিক, বিভিন্ন রকমের ব্যবস্থাপনা, সেইসঙ্গে একাগ্রতা আর নৈপুণ্যের ছাপ স্পষ্ট। এই সবের গুণেই একজন শিল্পী গড়ে ওঠেন। শিল্পী হেনরিয়েটা স্যাভারনেক, যতদূর মনে হয়, শিল্পীর চেয়ে শিল্পের ক্ষমতাই বোধ হয় বেশি হয়, কারণ শিল্পই পারে শিল্পীকে আত্মস্থ করতে, তখন সে আর নিজের মধ্যে থাকে না, ভূতে পাওয়া মানুষের মতো যন্ত্রচালিত হয়ে সে মুখ বুজে কাজ করে যাচ্ছে। হেনরিয়েটাও ঠিক তেমনি এক মানুষ। সে যেমন কাজ করে যাচ্ছে এবং এর-ওর সঙ্গে কথাবার্তাও চালিয়ে যাচ্ছে। বোধ হয় নিজেকে সে এইভাবে তৈরি করেছে, অন্যের সঙ্গে মিশে মনটাও ভালো থাকে। কিন্তু কাজের জন্য যে ভাগটা পৃথক করে নিয়েছে সেটাই বড় ভাগ–অর্থাৎ মনের পাঁচ ভাগের মধ্যে চার ভাগ তো বটে, বাকি এক ভাগ পড়ে থাকে বাইরের ভাগ চালানোর জন্য।
স্টুডিওতে বন্ধুবান্ধব বা অন্য দর্শনার্থী যারাই এখানে আসুক-না-কেন হেনরিয়েটা কাউকেই নিরাশ করে না। সকলকেই সে আদর করে বসায়, গল্পগুজব করে, চা-পান করায় অর্থাৎ আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রাখে না। সবকিছুর মধ্যে তার কাজ কিন্তু এগিয়ে চলেছে-কাজ সমানেই এগিয়ে চলেছে মনের সেই বড় অংশের সাহায্যে। ক্ষুদ্রতম এক-পঞ্চমাংশ গুণে কম নয়, বাইরের সব কাজ সে সুশৃঙ্খলভাবেই করে যাচ্ছে।
কারো বোঝার কোনো উপায় নেই–সকলেই খুশী হয় এবং প্রয়োজনের তাগিদেই যারা আসে, তারা নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে আবার ফিরে যায়।
বহুদিনের অভ্যাসের ফলে হেনরিয়েটার মধ্যে এমন এক শক্তি জন্মেছে যে, সে তাস খেলতে খেলতে অন্যের সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যেতেও অসুবিধা হয় না বা নির্ভুল রচনা বা কোনো তর্জমা তৈরি করতে পারে, এমন কি কাউকে কোনো বিশেষ নির্দেশ বা উপদেশও দিয়ে যেতে পারে। এই মন-বিভাজন করে বিভিন্ন কাজ একই সঙ্গে করে যাওয়া কম-শক্তি বা দক্ষতার একমাত্র পরিচয় নয়।
কিন্তু আজ যে কী হয়েছে হেনরিয়েটার, তার আরব্ধ কাজ কিছুতেই সম্পূর্ণ হচ্ছে না। মাটি দিয়ে যে বালিকার মাথা তৈরির কাজে সে নেমেছিল তা কিছুতেই তার মনোমতো হচ্ছে না। চোয়াল ঠিক হয় তো ঠোঁট ঠিক হয় না, মুখের আদলের সঙ্গে চোখের গরমিল থেকেই যাচ্ছে ইত্যাদি, ইত্যাদি। মাটির পুতুলের সঙ্গে তার মনের ছবি মিলছে না–এই ব্যাধিই তাকে আজ বড় বিব্রত করছে।
সময় কেটে যায়…পরবর্তী আধঘণ্টায় তার কাজ আরও দ্রুত এগিয়ে চলে, কপালে চুলে কাদার দাগ লাগে, অর্ধেক হাত আরও গতিশীল হয়ে পড়ে, চোখের পর্দায় ভেসে ওঠে অন্ধ অভিব্যক্তির ভীষণতা…হচ্ছে, হবে, সে করতে পারবে…