দূর থেকে ট্রাফিক আলো চোখে পড়তেই জাদা গাড়ির গতি কমিয়ে দেয়, বহুক্ষণ ধরেই আলোটা সবুজ ছিল, তাই জার্দা ভেবে নিয়েছিল যে, আলোর স্থান পর্যন্ত পৌঁছতে-না-পৌঁছতে আলো পরিবর্তিত হবে বলে। কিন্তু আলোটা সবুজ সঙ্কেত দিয়েই যেন দাঁড়িয়ে পড়েছে।
জন ক্রিস্টো তার সব সঙ্কল্পের কথা ভুলে গিয়ে বলে ওঠে, তুমি অকারণে থেমে যাচ্ছ কেন ট্রাফিক-আলো যখন সবুজ জায়গাতেই থেমে আছে? জার্দা বলে, আমি ভেবেছিলাম আলো বোধহয় পরিবর্তিত হবে। জাদা অ্যাকসেলারেটরের ওপর পায়ের চাপ দিল, গাড়ি সামনের দিকে এগিয়ে চলল, আলোটা সবেমাত্র পেরিয়ে গেছে–ইঞ্জিন হঠাৎ করে থেমে যায়। আলোও পরিবর্তিত হয়ে যায়।
ক্রশ ট্র্যাফিক ধিক্কারজনক বাঁশি বাজাতে শুরু করে দেয়, জন বলে ওঠে, জার্দা, তোমার মতো খারাপ ড্রাইভার পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই।
ট্রাফিক আলো সবসময় আমার কাছে অযথা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারো পক্ষেই বলা সম্ভব হবে না যে, কবে সে নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনবে–অসহায় কাতরোক্তি কণ্ঠ থেকে ঝড়ে পড়ে জার্দার।
জার্দার উদ্বিগ্নে ভরা অখুশী মুখের দিকে জনের দৃষ্টি চলে যায়। জন ভেবে নেয় যে, জার্দা সব ব্যাপারেই একটু বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে, সে কিন্তু বোঝার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করে না যে, এই উদ্বেগ নিয়ে বেঁচে থাকা কত কষ্টকর! তার যদি কল্পনা শক্তি বলে কোনো অস্তিত্ব বেঁচে থাকে তবে তার চোখে পড়ত জার্দার অন্তরের ছবি।
জার্দা প্রায়-প্রায়ই বলে উঠত, দেখো জন, আমি সবসময় ছেলেমেয়েদের এটাই বোঝাবার চেষ্টা করি যে, একজন চিকিৎসকের জীবন শুধু ত্যাগের এবং আত্মোৎসর্গের–অন্যের দুঃখ-যন্ত্রণা দূর করার জন্য নিজের স্বার্থত্যাগ–অন্যের উপকার করা একমাত্র লক্ষ্য। এই মহৎ কাজ করার জন্য আমি মনে মনে গর্ববোধ করি এবং ছেলেমেয়েদেরও এই সত্য বোঝাতে চাই যে, তাদেরও এই জন্য গর্ববোধ হওয়া উচিত।
কিন্তু জন সঙ্গে সঙ্গে তাতে বাধা প্রদান করে বলে ওঠে, কেন, তোমার কি কোনোদিন মাথায় আসে না যে, চিকিৎসা করার মধ্যে আমি নিজের অন্তরে একটা সুখ অনুভব করি?–ঐ কাজ আমার কাছে সুখের-ত্যাগের নয়।
কিন্তু জাদা কিছুতেই এই ব্যাপারটা বোঝে না, বোঝার কোনো চেষ্টাও সে করে না, জনের কথা উপলব্ধি করার মতো বুদ্ধি বোধহয় জার্দার নেই। জন যখন মিসেস ক্যাবট্রি এবং হাসপাতালের মার্গারেট রাসেলওয়ার্ডের কথা বলে যায় সেই সময় জন জার্দার কাছে হয়ে ওঠে মহা পরোপকারী গরীবের বন্ধু এবং স্বর্গীয় ত্রাণকর্তা, জনকে সে গরীবের পরম বন্ধু বলেই মনেপ্রাণে গ্রহণ করে।
জন যদি জাদাকে বলতো যে, ক্যানসারের ওষুধ আবিষ্কারের কাজ এখন তাকে ডুবিয়ে রেখেছে–জাদা সেটা বুঝলেও বুঝতে পারত, কিন্তু রিজওয়ের ব্যাধির জটিলতা তার মাথায় ঢোকেনি। অনেক সময় জার্দার মনে হয় যে, রিজওয়ের আসল অসুখ সম্পর্কে জন নিজেও বোধহয় টের পায়নি। মাঝেমধ্যে তার এমনও মনে হতে পারত যে টরেন্স নেহাৎ-ই ছেলেমানুষ হয়েও রিজওয়ের অসুখের ব্যাপারে তার জানার প্রচেষ্টা আছে, বা ঔৎসুক্য নিয়েও বাবার কথা শোনে, জন কিন্তু জার্দার মত পোবণ করে। জন মনপ্রাণে এটাই চায় যে, তার ছেলে তার বিচার করুক, তার যোগ্যতার সঠিক মূল্যায়ণও সে করুক।
কফি মেসিনটা ভেঙে ফেলার পর থেকে জন ছেলের ওপর বেজায় চটে আছে। অ্যামোনিয়া তৈরি করতে গিয়ে টরেন্স মেসিনটা ভেঙেছে। কি দরকার পড়েছিল অ্যামোনিয়া তৈরির? যতসব বাজে কাজ! ছেলেটার সব বাজে কাজের প্রতি ভীষণ উৎসাহ এবং কৌতূহল…।
জন নীরব আছে দেখে জার্দা মনে মনে বেশ খুশী হয়। জন একনাগাড়ে বকে গেলে সে নিজের জগতেই অন্যমনস্ক হয়ে যেত এবং সেইজন্য গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অসুবিধার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া, চিন্তার জগতে মগ্ন থাকলে ইচ্ছেমতো জার্দার গিয়ার বদল জনের চোখে ধরা পড়তো না। ভালোভাবে গিয়ার বদলে জার্দা সিদ্ধহস্ত। কিন্তু জন গাড়িতে স্বমহিমায় উপস্থিত থাকলে সে সুষ্ঠুভাবে তা করে উঠতে পারে না। সুষ্ঠুভাবে করার উৎসাহে সে এমনই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে যে, হয় সে বেশি অ্যাকসেলারেট করে, নয় উপযুক্তভাবে শেষ করে না–ফলে সব গোলমাল হয়ে যায়। সে তখন গিয়ার লিভারে গিয়ে ধাক্কা মারে এবং তাতে ঝাঁকুনিও বেশ জোরেই হয়। গাড়ি চালানোর ব্যাপারে হেনরিয়েটাও জার্দাকে কম উপদেশ দেয়নি। হেনরিয়েটা গাড়ি চালানোর সময় জার্দাকে পাশে বসিয়ে নিয়ে বলেছে, তুমি অনুভব করতে পার না জার্দা, গাড়িটা কী ভাবে চলতে চায়!-ওটা কাত হতে চায়–যতক্ষণ ধরে এমন বোধ হবে, তুমি তোমার হাতে চাপটা ধরে রাখার চেষ্টা করবে–ভুলেও কোথাও ধাক্কা লাগাবে না-এই অনুভবটা মনে সর্বক্ষণই ধরে রাখার চেষ্টা করে যাবে।
কখনোই কিছু অনুভব করার মতো শক্তি জার্দার থাকে না। গিয়ার-লিভার–এর ঠিক কী কাজ জার্দা সেটা কোনোদিন অনুধাবন করতে পারল না! কিন্তু গাড়ি যারা চালায় গাড়ির সঙ্গে তাদের একটা ঐচ্ছিক ভাবের আদান-প্রদান হওয়ার বোধহয় প্রয়োজন থাকে।
জাদার মনে কিন্তু সেরকম অনুভূতি নেই, নিজের মানসিক অশান্তিতেই সে বিভোর থাকে, এইজন্য কোনোদিকে দৃষ্টি দেবার মতো সময় তার কাছে থাকে না। জানেন মন পাবার কাজেই সে এত ব্যস্ত থাকে যে, গাড়ির মন জোগানোর অবকাশ তার মেলে কী? তাই জাদা ভেবে নেয় যে, মারসাম্ পাহাড় পর্যন্ত গাড়ি সে ভালোভাবেই চালিয়ে আনতে পেরেছে। কারণ–এই সময়টা জন নিজের চিন্তার জগতে বিচরণ করছিল এবং জার্দাকে বিন্দুমাত্র বিরক্ত করেনি। গাড়ির গতিবেগ তাই যখন বাড়তে থাকে জার্দাও গিয়ার বদলে হাত লাগায়, অবশেষে ধীরেসুস্থে গাড়ি চলতে শুরু করে এবং জন হঠাৎ-ই তার বাস্তব জগতে পুনরায় ফিরে আসে। সে রেগে বলে ওঠে, তুমি যখন খাড়া পাহাড়ের নিকটবর্তী চলেই এসেছ তখন গিয়ার বদলানোর কী বা প্রয়োজন থাকতে পারে? জার্দা মুখে কিছু না বললেও ভেতরে ভেতরে অত্যন্ত বিচলিত। জন রেগে গেলেই জার্দার কাজে সব ভুল হয়ে যায়। জার্দার কাজ যতই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে জনের মনকে খুশী করতে চায়, প্রতি পদক্ষেপেই তার ভুলের সংখ্যা তত বেশি হয়ে যায়।