হেনরিয়েটা-হা, আমি বেশ সুখেই ছিলাম।
এডওয়ার্ড–তোমার মুখ অন্য সবার থেকে একটু আলাদা লাগছে; অনেক কচি এবং সরল।
হেনরিয়েটা–আমার অজানা নয়।
এডওয়ার্ড-দেখো আমাদের উভয়ের চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু ঐ আইন্সউইক–যার সম্বন্ধে কথা বলতে, একসঙ্গে ভাবতেও আমরা ভালোবাসি! তুমি কী বুঝতে পার হেনরিয়েটা, এসবের প্রকৃত মানে কী দাঁড়াচ্ছে?
হেনরিয়েটা–এসবের মানে কী সত্যি তুমি বোঝ না এডওয়ার্ড! সারা বিকেলটা আজ অতীতের গর্ভে আমরা বসে আছি।
এডওয়ার্ড-বাসের পক্ষে অতীত অনেক সময় খুব সুখের।
হেনরিয়েটা–কিন্তু মানুষ অতীতে ইচ্ছে করলেই ফিরে যেতে পারে না, এই ফিরে যাওয়াটাই তার পক্ষে অসম্ভব।
দু-এক মিনিট সে নীরবতা পালন করে, পরে শান্ত আবেগবহির্ভূত কণ্ঠে বলে ওঠে, তোমার কথার মানে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, ক্রিস্টোর কথা ভেবেই তুমি আমাকে বিবাহ করতে রাজী নও, তাই নয় কী?
জবাব দেবার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পায় না হেনরিয়েটা। এডওয়ার্ড তার বলা থামায় না, বলে চলে–ঠিক বলেছি তো হেনরিয়েটা? জগতে যদি জন ক্রিস্টোর কোনো অস্তিত্ব না থাকত, তাহলে আমাকে বিবাহ করতে তোমার কোথাও কোনো দ্বিধা ছিল না।
হেনরিয়েটা এবার রূঢ় কণ্ঠেই বলে ওঠে, জন ক্রিস্টো নেই, এমন জগত আমি আমার কল্পনাতেও আনতে পারি না। এই সত্যটাই আমি তোমাকে বোঝানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি।
এডওয়ার্ড-তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম তোমার কথা যদি সত্যি বলে মেনেই নিই; তাহলে সে ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে ডিভোর্স করে তোমাকে বিবাহ করে না কেন?
হেনরিয়েটা–স্ত্রীকে ডিভোর্স করার কোনো বাসনা জনের এখনও নেই, যদি সে কোনোদিন স্ত্রীকে ডিভোর্সও করে তবে আমি তাকে বিবাহ করবো কিনা এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তুমি যেভাবে ব্যাপারটাকে দেখছ, বা তাই নিয়ে ভাবছ, আমরা কিন্তু জিনিষটাকে তোমার মতন করে ভাবতে পারছি না।
এডওয়ার্ডের কণ্ঠে চিন্তার ছাপ, সে কোনোরকমে বলে ওঠে, জন ক্রিস্টো! এ জগতে জন ক্রিস্টোর সংখ্যা কম নেই।
হেনরিয়েটা বলে ওঠে, তুমি আবার একই ভুল করছ এডওয়ার্ড, জগতে জনের মতো লোক কমই চোখে পড়ে।
তাই যদি হয়–তবে এটা তো উত্তম ব্যাপার! অন্তত আমি ভাবি। তার কথা শেষ না করেই এডওয়ার্ড উঠে দাঁড়ায়, বলে ওঠে, এসো আমরা ফিরে যাই।
.
০৭.
গাড়িতে উঠে বসার সঙ্গে সঙ্গে হার্লি স্ট্রিটের বাড়ির সদর দরজা বন্ধ হবার পর জাদার যেন মনে হতে লাগল সে যেন বনবাস যাত্রা করছে। চিরকালের জন্য বোধহয় সে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। এই সপ্তাহান্তিক ছুটি তার জন্য যেন নতুন কোনো অভিশাপ বহন করে আনছে। অনেক জিনিষ পড়েছিল হ্যাঁ, যাত্রা করার পূর্বে তার যেগুলো করে আসা উচিত ছিল। বাথরুমের কলটা বন্ধ করে আসতে সে ভোলেনি তো? লন্ড্রীর সেই হিসাবটা সে নির্দিষ্ট জায়গায় রেখেছে কিনা– রাখলেও কোথায় রেখে এসেছে? ছেলেমেয়েরা কি ঘরকন্নার পরিচারিকার কাছে ভালো থাকবে? পরিচারিকাও তো সেই স্বভাবের–ধরে নিন না উদাহরণস্বরূপ বলছি, টরেন্স কি পরিচারিকার কথা মতো চলার পাত্র? সত্যি বলতে কী, ফরাসি পরিচারিকাদের বশ মানানোর শক্তি পর্যন্ত নেই। সে চালকের জায়গায় বসে উদ্বিগ্ন মন নিয়ে স্টিয়ারিং চেপে ধরল, বরাবর সে এটাতে চাপ দিতে লাগল, জন এই সময় বলে ওঠে, ইঞ্জিনের বোতামে হাত পড়লেই গাড়ি খুব ভালো চলবে!
ভীতচকিত দৃষ্টি নিয়ে জাদা জনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠেছিল, আমি কি এতই বোকা। জার্দা ভেবেছিল যে, জন বোধহয় খুব ক্ষেপে যাবে। কিন্তু তাকিয়ে দেখলো রাগের পরিবর্তে তার মুখে হাসি। এ্যাঙ্গক্যাটেলদের কাছে যাচ্ছে এটা ভেবেই জন খুশিতে ডগমগ, জাদার দোষত্রুটিও তার নজরে আসছে না।
বেচারা জন! সে যথেষ্ট কঠোর পরিশ্রম করে, স্বার্থশূন্য এবং পরোপকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এমন স্বভাবের লোক বড় একটা চোখে পড়েনা! এত পরিশ্রমের পরেও সে যে ছুটি কাটানোর জন্য লালায়িত হয়ে উঠবে, তাতে আর আশ্চর্যের কী থাকতে পারে! জার্দার মন আজ বড়ই বিষণ্ণ। তার তো বাড়ি, তার ওপর ছেলেমেয়েদের জন্যেও চিন্তার শেষ নেই, এ ছাড়া সবসময় জনের মন জুগিয়ে চলার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে সে পরিশ্রান্ত। লাঞ্চ খেতে খেতে জন যেসব উক্তি করেছে যদিও সেরঙ্গ করেই এইসব বলে উঠেছে যে, রোগীদের দেখার মতো বাসনা তার নেই। জার্দা তার কথার আসল তাৎপর্য বুঝে ফেলেছে, কিন্তু যুক্তিবাদী নন টেরির, বাবার কোনো কথাকে ভ্রান্ত বলে মনে করার প্রবণতা তার মধ্যে নেই। বিশেষ করে সোজা পরিষ্কার এবং অলংকার বর্জিত মনের অধিকারী এই টেরি। জাদা অনেক সময়েই জনের অনেক কথায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে হেসে উড়িয়ে দিয়েছ, কারণ সে বোঝে জন তাকে বিরক্ত করার জন্যই এইসব বলে। সবকিছু বুঝেও সে নিজের মত থেকে একচুলও এদিক-ওদিক নড়ে না। অনেক সময় জাদা জনকে বোঝাতে চেয়েছে যে, ছেলেমেয়েদের মনে এই বোধটাও জাগাতে চায় যে, নিঃস্বার্থ, রোগীর সেবায় উৎসর্গীকৃতপ্রাণ এক চিকিৎসক রূপেই জনের পরিচিতি, কিন্তু এইকথার সহজ অর্থটুকুই উপলব্ধি করার মতো বোধও নেই। কথাচ্ছলে নিজের অসতর্কতায় এমন সব হালকা ধরনের কথা সে বলে ফেলে যাতে করে আদর্শবাদী এক নামকরা চিকিৎসক হিসেবে তার সুনাম ধুলোয় মিশে যেতে পারে।