এডওয়ার্ড–তুমি এক বার চলে এসো না, হেনরিয়েটা, সবই দেখতে পাবে! তুমি সেই কবে ওখানে গিয়েছিলে।
হেনরিয়েটা–আমি জানি।
এডওয়ার্ড-তুমি তো খুব ভালোভাবেই বোঝো যে, সেখানে গেলে তোমাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাবে! তোমার যখন মন চায় চলে যেতে পার।
হেনরিয়েটা-তুমি সত্যি কী মিষ্টি, এডওয়ার্ড! সে ভাবে, এডওয়ার্ডের কী মজবুত হাড়!
এডওয়ার্ড–আইন্সউইককে তুমি নিজের বলে ভালো দেখো বলে আমি সত্যিই ভীষণ খুশী হেনরিয়েটা।
হেনরিয়েটা স্বপ্নবিষ্টের মতো বলে চলে, পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর শ্রেষ্ঠ স্থান এই আইন্সউইক।
লম্বা পায়ের মেয়ে…অবিন্যস্ত কটাচুলের কেশর…সুখী বালিকা…জীবন সম্বন্ধে তার কোনো মূল্যবোধ নেই…সে ভালোবাসে শুধু বন আর বন…বৃক্ষের নজরকাড়া শোভা তাকে আকৃষ্ট করে…তার মন হরণ করে…
হেনরিয়েটা ভাবে, সে যদি আবার অতীত স্মৃতির দিনগুলোতে যেতে পারতো তাহলে কত না সুখ হতো! সে দৃঢ় কণ্ঠে চিৎকার করে বলে ওঠে, ইয়াগড্রাসিল এখনও সেই আগের মতনই আছে?
এডওয়ার্ড-ওটার ওপর তো বাজ পড়েছিল।
হেনরিয়েটা–না, ইয়াগড্রাসিল তো নয়।
তার নামকরণ করা হয়েছিল ইয়াগড্রাসিল–এটা তার বিশেষ নাম। বড় সেই ওক গাছটার নাম ছিল ইয়াগড্রাসিল, সেটাকেও যদি বনদেবতা আঘাত হানতে পারে, তবে জগতে কোনো কিছুরই নিরাপত্তা নেই। তাহলে সেখানে ফিরে যাওয়া মোটেই ভালো হবে না।
এডওয়ার্ড–তোমার কী ইয়াগড্রাসিলের চিহ্ন মনে আছে?
হেনরিয়েটা-হ্যাঁ, টুকরো কাগজে পেনসিল দিয়ে ঐ গাছের আমি ছবি আঁকতাম। আমাকে একটা পেনসিল এনে দাও, আমি এক্ষুনি এঁকে দেখিয়ে দেবো।
এডওয়ার্ড সঙ্গে সঙ্গে তার দিকে একটা পেনসিল এবং নোটবুক এগিয়ে দেয়। হেনরিয়েটা হাসিমাখা মুখে কৌতুকপূর্ণ ওক গাছটার ছবি আঁকতে থাকে।
হেনরিয়েটা–চেয়ে দেখো, ইয়াগড্রাসিলের ছবি।
রাস্তার শেষ প্রান্তে বসে তারা মনের সুখে অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে সুখ দুঃখের কথাই বলে চলছিল। পড়ে যাওয়া একটা গাছের গুঁড়ির ওপর বসেছিল হেনরিয়েটা এবং ঠিক তার পাশে বসে ছিল এডওয়ার্ড। গাছের ফাঁক দিয়ে সে দেখছিল।
হেনরিয়েটা বলে ওঠে, এই জায়গাটা দেখলে আইন্সউইকের কথা মনে করিয়ে দেয় একপ্রকার পকেট আইন্সউক। আমি অনেক সময়ের জন্য এই চিন্তাতেই বিভোর থেকেছি এডওয়ার্ড এবং লুসি বাড়ি করার জন্য এই জায়গাটাই বেছে নিয়েছিল।
এডওয়ার্ড–তা হয়তো সম্ভব।
হেনরিয়েটা–কেউ জানতে পারে না, লুসি তার চিন্তাজগতে কী নিয়ে ব্যস্ত থাকে। লুসির মাথায় কখন কী অদ্ভুত খেয়াল ভর করে তা কারো পক্ষেই বলা সম্ভব নয়। তোমার সঙ্গে শেষ হওয়ার পরে তুমি কী করেছিলে?
এডওয়ার্ড–কিছুই না হেনরিয়েটা।
হেনরিয়েটা-সেটা বেশ শান্তির কথা।
এডওয়ার্ড–অমি কোনো কাজই সুষ্ঠুভবে করে উঠতে পারি না।
চোখের দ্রুত পলক পড়ে হেনরিয়েটার, তার স্বরে যেন লেগে আছে কৈশোরের ছোঁয়াচ। সে হেনরিয়েটার দিকে তাকিয়ে মৃদুমন্দ হাসছিল। হেনরিয়েটাও তার প্রতি গভীর এক আকর্ষণ অনুভব করে।
হেনরিয়েটা–জ্ঞানী মানুষ তুমি।
এডওয়ার্ড–জ্ঞানী?
হেনরিয়েটা–কিছু না করা বোধহয় জ্ঞানীর লক্ষণ।
এডওয়ার্ড–তুমি আবার সেই পুরানো কথায় ফিরে আসছ হেনরিয়েটা। তুমি তো সব ব্যাপারে ভীষণভাবে কতৃকার্য হয়েছ।
হেনরিয়েটা–তুমি কী মনে কর আমি কৃতকার্য হতে পেরেছি? এটা সত্যি বড হাস্যকর ব্যাপার!
এডওয়ার্ড-তুমি বরাবরই আমার খুব প্রিয়, শিল্পী মানুষ তুমি। এর জন্য তোমার গর্ববোধ হওয়া উচিত।
হেনরিয়েটা–আমি জানি, অনেক মানুষই আছে যারা আমাকে এমনটা ভাবে এবং মুখের ওপর বলেও থাকে। কিন্তু তারা এর বেশি আর কিছু জানে না–এর প্রথম ব্যাপারটাও তাদের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। এডওয়ার্ড, তুমিও বোধহয় জানো না। ভাস্কর্য এমন জিনিষ নয়, যা শুরু করলেই কৃতকার্যের শিখরে পৌঁছন যায়। এর এমন একটা আকর্ষণী ক্ষমতা আছে যা তোমাকে পেয়ে বসে, তুমি এটাকে অগ্রাহ্য করে এড়িয়ে চলতে পার না, যা তোমার কাছে আশ্রয় পেতে চায়–অনুসরণ করে তোমার সঙ্গে চলতে চায়–তোমার পিছু নেয়–কারণ আজ হোক বা কাল হোক তোমাকে তার সঙ্গে একটা বোঝাঁপড়ায় আসতে হবেই। সেই সময়ে হয়তো তুমি মনের দিক থেকে কিছুটা শান্তি পাবে–কিন্তু তুমি যদি আবার নতুন করে শুরু না কর, তোমার মন শান্তি থেকে বঞ্চিত থাকবে।
এডওয়ার্ড-শাস্তির মুখ দেখার তোমার কী কোনো বাসনা আছে হেনরিয়েটা?
হেনরিয়েটা–কখনো কখনো তোমার মনে এই ভাবনাই জাগে যে, সবকিছুর পরিবর্তে আমি শান্তিতে থাকতে চাই এডওয়ার্ড।
এডওয়ার্ড-আইন্সউইক এসে শান্তির মুখ তুমি দেখতে পার। আমার মন বলে সেখানে তুমি সুখে থাকবে, এমন কী আমার সঙ্গে থাকলেও তুমি মনের দিক থেকে পরম তৃপ্তি অনুভব করবে।
এ বিষয়ে তোমার কী মনে হয় হেনরিয়েটা? তোমার কী মত? আইন্সউইক তো তোমার পথ চেয়ে প্রতীক্ষায় বসে আছে।
ধীরে ধীরে মুখ ঘোরায় হেনরিয়েটা এবং নিচু স্বরে বলে, আমার মনে হয়, তোমাকে একান্তভাবে প্রিয় মনে না করে আমি পারিনি এডওয়ার্ড, তাই তোমাকে মুখের ওপর বোধহয় না বলতে পারিনি।
এডওয়ার্ড-তাহলে এখন কী না বলতে চাইছ?
হেনরিয়েটা–সত্যি আমি দুঃখিত।
এডওয়ার্ড–তুমি আগে না বলেছ–এখনও সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি-ভালো। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, তোমার মুখ দিয়ে হয়তো অন্য শব্দ বেরোবে। আজ বিকেলের দিকেও তুমি বেশ খুশী এবং প্রফুল্ল ছিলে, হেনরিয়েটা–তুমি নিশ্চয়ই একথা অস্বীকার করতে পার না।