হেনরিয়েটা নিজের মনে ভাবতে থাকে, শরৎ আমার প্রিয় ঋতু। বসন্তের চেয়েও এর সৌন্দর্য অনেক বেশি। এরকম একটা সুন্দর মুহূর্তের স্পর্শ পেলে মানুষ সবকিছু ভুলে যায়। প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য বিচ্ছুরণের মধ্য দিয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিলে সম্ভোগ করতে প্রয়াসী হয়ে ওঠে অফুরন্ত সুখ। সে ভাবে, এমন আনন্দের স্বাদ সে বোধহয় জীবনে পায়নি আর পাবেও না…
সৌন্দর্যের এই নগরপুরীতে মিনিট কয়েক প্রতীক্ষা করার পর হেনরিয়েটা ফিরে আসে। তার মনে হতে লাগল, সোনার মোহময় জগৎ যেন নিজেকে তৈরি করে আবার অনন্ত শূন্যে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নিজের রূপের চর্চায় নিজেই অস্থির হয়ে কি করবে সে ভেবে পাচ্ছে না– শুধু গড়ছে আর ভাঙছে।
হেনরিয়েটা সোজা এখান থেকে হলোতে এসে উপস্থিত হল। লুসি তাকে সহর্ষ অভিনন্দন জানায়।
মিডগের মনে পড়ে যায় লুসি তাকে একবার বলেছিল, আমার গাড়ি যেন আমার ঘোড়া। সে আমার অত্যন্ত অনুগত এবং বিশ্বাসের ক্রীতদাস।
মিডগে বলে ওঠে, আমি জানি লুসি সবকিছুরই উচ্ছেদ করে, সে আজ সকালেই আমাকে বলেছে যে, এখানে থাকাকালীন আমি যেন সর্বদাই রূঢ় ভাব দেখাই।
সাপ্তাহান্তিক ছুটিতে হেনরিয়েটা এসে গেছে, জন ক্রিস্টো এবং জার্দা অল্পক্ষণের মধ্যেই এখানে এসে হাজির হয়ে যাবে। এইমাত্র এসে উপস্থিত হয়েছে এডওয়ার্ড।
মিডগে তার নিজের চিন্তাজগতে বিচরণ করতে করতে এটাই ভাবতে থাকে, লুসি সত্যি এক পরী! আমি তার কথামতো সাপ্তাহান্তিক ছুটিতে সকলের সঙ্গেই রূঢ় ব্যবহার করব–সেই রূঢ়তা এমন হয়ে উঠবে গৌরবোজ্জ্বল! গাড়ি থেকে নামতে হেনরিয়েটা জানতে চায়– কার কার পদার্পণ ঘটেছে? মিডগে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়, ক্রিস্টোরা হয়তো এখুনি এসে হাজির হবে, এইমাত্র এসে উপস্থিত হয়েছে এডওয়ার্ড।
–এডওয়ার্ড? কি মজা কৃতদিন হল এডওয়ার্ডকে দেখিনি! আর কে এসেছে?
-ডেভিড এ্যাঙ্গক্যাটেল, দাঁতে দাঁত দিয়ে নখ কাটা–তার এই বদভ্যাস তোমার কিন্তু বন্ধ করা চাই!
–আমাকে এমন একটা অপ্রীতিকর কাজ করার কথা বলছই বা কেন? অন্যের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার মতো কোনো প্রবণতা আমার নেই, আমি কারো ব্যক্তিগত অভ্যাসে পরিবর্তন আনতে চাই না। এ বিষয়ে লুসির কী বক্তব্য? হেনরিয়েটার জানার কৌতূহল ক্রমেই বাড়ে।
-তোমাকে এবার আরও অনেক কাজ করতে হবে। একটা নিষিদ্ধ ফলও আছে, সেটার ব্যাপারেও তদারকের দায়িত্ব কিন্তু তোমার ওপর।
হেনরিয়েটা ভীতকণ্ঠে বলে ওঠে, এইসব কাজ আমার ঘাড়ে চাপানোর অর্থ কী?
-এখানেই শেষ নয়, আরও আছে, জার্দার প্রতি তোমাকে দয়া প্রদর্শন করতে হবে!
হেনরিয়েটা–আমি যদি জার্দার জায়গায় থাকতাম, লুসিকে আমি ঘৃণার চোখেই দেখতাম।
মিডগে–অপরাধ শাখার একজন লোক কাল আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ করবে।
হেনরিয়েটা–আমরা কি কোনো হত্যাকাণ্ডের খেলায় মেতে উঠেছি?
মিডগে–আমার কিন্তু মনে হয় না। নেহাতই এক প্রতিবেশীর আতিথেয়তা বজায় রাখতেই এডওয়ার্ড এখানে হাজির হয়েছে।
গভীর স্নেহের সুর হেনরিয়েটার কণ্ঠ দিয়ে উচ্চারিত হয়, প্রিয় এডওয়ার্ড! এডওয়ার্ড যথেষ্ট লম্বা, স্বাস্থ্য মোটেই ভালো নয়-রোগা। যুবতীদের দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসার সময়েই তার মুখে হাসি ফুটে উঠেছিল।
-হ্যালো হেনরিয়েটা, কী ব্যাপার, তোমাকে অনেকদিন পর দেখছি! হেনরিয়েটা হেসে ওঠে, হ্যালো এডওয়ার্ড!
এডওয়ার্ড সত্যি ভীষণ সুন্দর হয়েছে! মুখে সদাদীপ্ত শান্ত হাসি, চোখেমুখে দীপ্তি এবং দেহজ গঠনও বেশ ভালো–সারা শরীর শক্ত-মজবুত হাড়ে গঠিত। হেনরিয়েটা ভাবতে থাকে, এরকম চেহারার যুবক তার দৃষ্টিতে আকর্ষণ করে, এডওয়ার্ডের প্রতি দুর্বলতার এই মূর্তি দেখে সে নিজেই হতবাক। এতদিন সে এই গোপন সত্যটা ভুলে ছিল–এডওয়ার্ডের কাছে তার মন বাঁধা পড়েছে।
লাঞ্চ শেষ হতেই এডওয়ার্ড বলে ওঠে, এসো হেনরিয়েটা, আমরা না হয় কোথাও একটু বেড়িয়ে আসি।
এডওয়ার্ডের বেড়ানোর অর্থ খানিকটা জায়গা জুড়ে পায়চারি শুরু করা। বাড়ির পেছনের দিককার একটা বনের মধ্যে আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগিয়ে চলল। হেনরিয়েটার একবার মনে হল, আইন্সউইকের বন যেন। প্রিয় আইন্সউইক! সেখানে কতই না হাস্যরস লুকিয়ে আছে। এডওয়ার্ডের সঙ্গে সে আইন্সউইকের প্রসঙ্গেই কথা বলতে লাগল। তারা যেন অতীতস্মৃতি রোমন্থন করছে–অতীরে প্রসঙ্গ চলাকালীন সে নিজের অস্তিত্ব–তাদের বর্তমান একেবারেই ভুলে গিয়েছিল।
এওয়ার্ড–আমাদের কাঠবেড়ালিটার কথা তোমার মনে আছে? যার একটা থাবা ভেঙে গিয়েছিল এবং খাঁচার মধ্যে ঢোকাতেই সে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে উঠেছিল?
হেনরিয়েটা–অবশ্যই। তার একটা কৌতুকভরা বাহারি নাম-কী যেন?
এডওয়ার্ড-কলমস্তানী-মার্জারী ব্যাঙ্কস!
হেনরিয়েটা-হা, হ্যাঁ, ঠিক তাই।
তারা দুজনেই একসঙ্গে হেসে ওঠে।
এডওয়ার্ড–আমাদের বাড়ির রান্নাঘরের ঐ পরিচারিকা, বুড়ি মিসেস বন্ডী? সে বলত, দেখে নিও চিমনীর ওপরে এটা একদিন উঠে যাবে।
হেনরিয়েটা–আমরা কিন্তু মনে মনে বিরক্ত হতাম।
এডওয়ার্ড-এটা কিন্তু ঠিক চিমনীর ওপরে উঠে গেল।
হেনরিয়েটা–মিসেস বন্ডী এটাকে তেমনভাবে তৈরী করেছিল। বীই কাঠবেড়ালির মাথায় ওটা ঢুকিয়েছিল। সে না থেমে বলে যেতে থাকে। সবই কী একইরকমের আছে, এডওয়ার্ড? না, পরিবর্তন থেকে থাকেনি–অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে? আমি কিন্তু আমার কল্পনা দিয়ে সব সময়ে এই সত্যিই উপলব্ধি করছি যে আগের মতোই সব ঠিকঠাক আছে।