মিডগে জানতে চেয়েছিল, কেন ট্রিমলেট কাকা জিওফ্রের কি ছেলেপুলে নেই? জিওফ্রের উত্তরাধিকারী সে কখনোই হতে পারবে না এবং মিস্টার হেনরি, মিস্টার জিওফ্রের ভাইপো, কিন্তু সে যখন বিবাহ করেছে তাই সে এডওয়ার্ডের মতো এত কাছের নয় তাই সেও উত্তরাধিকারী হতে পারবে না। ট্রিমলেট সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে।
এডওয়ার্ড আইন্সউইক-এ একাই থাকে এখন কদাচিৎ এখানে চলে আসে। মিডগে এই কথা ভেবে অবাক হয়ে যায়, লুসি মনে কিছু না করে থাকেই বা কেন! লুসির হাবভাব দেখেও মনে হয় তার কোনো বিষয়েই ভ্রূক্ষেপ নেই।
আইন্সউইকে তার বাড়ি ছিল এবং তার প্রথম খুড়তুতো ভাই বলতে ঐ এডওয়ার্ড।–একবার বিতাড়িত হয়েছিল এবং বয়সে সে লুসির চেয়ে প্রায় কুড়ি বছরের ছোট। লুসির বাবা জিওফ্রে এ্যাঙ্গক্যাটেল দেশের এক মহান চরিত্রের লোক বলেই খ্যাত ছিলেন। প্রভূত সম্পত্তির সে অধিকারী ছিল এবং সম্পত্তির বেশির ভাগ অংশটাই তিনি লুসিকে দিয়েছেন। তাই এডওয়ার্ডকে গরীবই বলা যায় এবং সম্পত্তি বজায় রাখার উদ্দেশ্যেই তার সব ব্যয় হয়ে যায়।
বাবুগিরি করে যে এডওয়ার্ড সব ওড়ায়, তা নয়। কূটনৈতিক বিভাগে সে চাকরি করত, কিন্তু যে সময় আইন্সউইকের সম্পত্তির সে অধিকারী হল, তখন সম্পত্তি রক্ষার কথা ভেবেই চাকরি ছেড়ে আইন্সউইক-এ বসবাস শুরু করে দিল। বরাবরই সে ছিল বইয়ের পোকা, নতুন বই প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রথম সংস্করণ সে কিনে ফেলত। মাঝেমধ্যে ছোট পত্রিকায় সে ব্যঙ্গ রচনাও লিখত। সে তার দ্বিতীয় খুড়তুতো বোন হেনরিয়েটা স্যাভারনেককে বিবাহ করার প্রস্তাব বার তিনেক উত্থাপন করেছিল।
শরতের স্বর্ণবিগলিত মোহনকান্তি সূর্যালোকে বসে থেকে মিডগে এই সবই একের পর এক ভেবে যাচ্ছিল। এডওয়ার্ডকে দেখার পর তার মনে খুশীর উদ্রেক হবে কিনা সে জানে না, কারণ এখনও সে নিজেই মনস্থির করতে পারেনি। এডওয়ার্ডের মতো লোককে এড়িয়ে চলা মোটই সম্ভবপর নয়, আইন্সউইক-এ তাকে নিজের মতোই বাস্তব বলে মনে হয়েছে। লন্ডনের এক রেস্তোরাঁয় খাবার টেবিল থেকে দাঁড়িয়ে সে তাকে অভ্যর্থনা করেছিল। যতদূর তার মনে আছে, সেই থেকেই এডওয়ার্ডকে মন দেবার পালা চলেছে তার…স্যার হেনরির কণ্ঠস্বরে তার যেন সম্বিত ফিরে আসে।
-লুসিকে দেখে তোমার কেমন মনে হয়?
–খুবই ভালো, চিরটাকালই সে একইরকম রয়ে গেল। মৃদুহাসি হাসে মিডগে।
–হ্যাঁ, হ্যাঁ। স্যার হেনরি মন দিয়ে এবার পাইপ টানতে শুরু করে দেন।
অপ্রত্যাশিত ভাবেই তিনি শুধু বলে ওঠেন, মিডগে আমার অনেক সময় লুসির জন্য বড় চিন্তা হয়।
মিডগে বিস্ময়ের সুরে বলে ওঠে, উদ্বিগ্নতা? কেন?
স্যার হেনরি কেবল মাথা নাড়েন, লুসির এখনও উপলব্ধি করার মতো সেই বয়েস হয়নি যে, জগতে এমন অনেক জিনিষ আছে, যা তার একার পক্ষে করা সম্ভব নয়।
মিডগে অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকে। তিনি তার বক্তব্য অকপটে বলে যেতে থাকেন। জিনিষপত্র নিয়ে সে বেরিয়ে যায়। সরকারী প্রথাকে সে বিদ্রূপ করে-ডিনার পার্টিতে নানাধরনের কটুক্তি ছোঁড়ে-ডিনার টেবিলে বর্ণবৈষম্য-র কথা তুলে ঝগড়া বাধিয়ে শক্রতার সংখ্যা তৈরি করে নেয়! এমন সব কাজ সে করে যাতে ব্রিটিশ সরকারের অসম্মানে মাথা হেঁট হয়–অথচ আমার মতো একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীর স্ত্রী বলে তাকে মুখে কেউ কিছু বলে না, মনে মনে অসন্তোষ দানা বাঁধে নিশ্চয়ই। সকলের সঙ্গে মুচকি হাসি হেসে কথা বলে এবং এমন ভাব দেখানো এটা তার স্বভাবের একটা দিক–বড়ই বিরক্তিকর। চাকরগুলোও হয়েছে সেইরকম–সে যতই তাদের অসুবিধার সৃষ্টি করুক-না কেন, তবু তাকে তেল দিয়ে তোয়াজ করে চলাই তার স্বভাব।
মিডগের কণ্ঠে চিন্তার ছাপ, চিন্তিত সুরেই সে বলে ওঠে, আমার অজানা নয়, আপনি কী বলতে চাইছেন, সে কাজ অন্য লোকের দ্বারা সম্পন্ন হয় আপনি সহ্য করতে পারেন না, লুসি সেই একটাই কাজ করলে আপনি শুধু বলেন, ঠিক আছে। এর মানে কী? মোহিনী শক্তি? চৌম্বকত্ব?
নিঃশব্দে শুধু ঘাড় নাড়ে স্যার হেনরি।
তিনি বলতে থাকেন, ছেলেবেলা থেকেই লুসির স্বভাব চরিত্র ঐরকম, অনেক সময় এটাই ভেবে দেখেছি যে, ওর এই দোষটা মজ্জাগত হয়ে যাচ্ছে। সে বোঝে না যে, সব কিছুরই একটা সীমা থাকা ভালো, আমি মনেপ্রাণে এটাই বিশ্বাস করি যে, কাউকে প্রাণে মেরেও সে বোধহয় মুক্তি পেয়ে যেতে পারে!
মিডগে জানত যে, লুসিরও অনেক দোষ আছে, এমন অনেক চপলতা তার সঙ্গী, যেগুলো তার পদমর্যাদার পরিপন্থী। এমন সরকারী কর্মচারীর স্ত্রী হিসেবে তার যেটুকু গাম্ভীর্য থাকা প্রয়োজন, তার মধ্যে সেটা বিন্দুমাত্র ছিল না। সে তার মর্জির মালিক ছিল, নিজের খেয়ালখুশী মাফিক কৌশলের সঙ্গে সে গাড়ি চালাত। লন্ডন থেকে বাইরে যাওয়ার সময় নিজের বিচার করা পথ দিয়েই যাবে। এমনকি লন্ডনের মতো শহরেও সে গলিঘুজি দিয়ে এবং শর্টকাট রাস্তা ধরেই গাড়ি চালাবে। এই শহরের অলিগলি তার যেন নখদর্পণে, লুসির রাস্তা সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা, কোনো ট্যাক্সি চালকেরও বোধহয় এমন জ্ঞান নেই। লুসি শহরতলীর নতুন নতুন মোড় এবং রাস্তা সন্ধানী চোখে আবিষ্কার করে ফেলেছে।
হেনরিয়েটা সোভেল ডাইনের কাছে এসে যখন দাঁড়ায়, বেলা তখন সাড়ে বারোটা। এই স্থানটা তার খুব প্রিয়, এখান থেকে হেনরিয়েটা পাহাড়ের মনোরম দৃশ্য দেখতে খুব ভালোবাসত। তাই এমন জায়গায় এসে সে থামে, যেখান থেকে রাস্তা সোজা নিচের দিকে চলে যাচ্ছে। চতুর্দিকে এবং তার নিচে পরিবেষ্টিত বৃক্ষরাজির সমারোহ, সেই সঙ্গে সোনালী থেকে কটা রঙ ধারণ করতে শুরু করেছে। শরতের উজ্জ্বল মোহনকান্তি চতুর্দিকে যেন সোনার হোলি খেলায় মেতে উঠেছে। অবিশ্বাস্য রকমের সুন্দর নৈসর্গিক দৃশ্য।