চঞ্চল হাত দুটো অত্যন্ত রমণীয় এবং অসহায় ভাবে মেলে ধরলেন লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল-হাত, নেড়ে বলে ওঠেন, সব খারাপ লোকেরাই তো একসঙ্গে হাজির হচ্ছে, মানে–আমার বক্তব্য হল- যারা আসছে তারা লোক হিসেবে খারাপ নয়, সত্যি তারা ভালো লোক, শুধু ভালো নয় খুব ভালো।
চতুষ্কোণ আকৃতির কপাল থেকে চুলগুলো ধীরে ধীরে সরাতে সরাতে মিডগে জিজ্ঞাসা করে, কারা আসছে?
কেন, জন এবং জার্দা? ব্যক্তি হিসেবে জন খুবই ভালো এবং তার একটা আশ্চর্য আকর্ষণী শক্তিও আছে। তবে বেচারা জার্দা-তাকে আমরা সকলেই দয়ার চোখে দেখব এবং আমাদের প্রায় সকলেরই তার প্রতি অনুকম্পা থাকা একান্তই উচিত।
জার্দার পক্ষ সমর্থন করে মিডগে বলে ওঠে, খারাপ যতটা ভাবছো তত খারাপ সে নয়।
-না, না, বোন, সে সত্যিই করুণার পাত্রী, তার কারণ সকলের বক্ষ জুড়ে দয়ার উদ্রেক হয়, লোকের একটা কথারও মানে বোঝে না।
-হয়তো বোঝে না, তোমার কথার অর্থ না বোঝার জন্য আমি তাকে চাপ দিতে পারি না। লুসি, তোমার মন এত দ্রুত এগিয়ে চলে যে, তার সাথে তাল রাখতে গিয়ে তোমার কথোপকথনের মাত্রাকেও বিস্ময়কর লাফ লাগাতে হয়। সংযোগের সব সূত্রই তাই মাঝপথে খেই হারিয়ে ফেলে।
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল–ঠিক বাঁদরের মতো? কি বলো?
মিডগে–ক্রিস্টোস ছাড়া আর কে আছে? হেনরিয়েটা নিশ্চয়?
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেলের মুখ মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তিনি বলে ওঠেন, হা, তবে আমার মন বলে, হেনরিয়েটা একটা শক্তির পাহাড়। সে চিরটাকাল একইরকম রয়ে গেল। তোমার নিশ্চয়ই অজানা নয় হেনরিয়েটা দয়ার সাগর। সে জাদার ব্যাপারেও যতটা সম্ভব সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। গতবারের কথা ভেবে দেখো, সে কত সাহায্য করেছিল। সে বারে আমরা লিমেরিক বা শব্দবাঁধন বা উদ্ধৃতি নিয়ে খেলছিলাম এবং খেলা প্রায় শেষের দিকে তখন খেয়াল হলো, জার্দা সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে; শুরুটাই সে করতে পারেনি। সে বুঝতেই পারেনি, কোন্ খেলায় আমরা মেতে উঠেছি! সত্যি এটা বড় বিপজ্জনক। নয় কি, মিডগে?
মিডগে-অন্যের কথা আর কি বলব, তোমার উর্বর মস্তিষ্কের ফল, রাউন্ড গেম, সেই সঙ্গে তোমার কথা বলার ধরন–এসব আমার কিছুই বোধগম্য হয় না। সত্যি লুসি, তোমার কথা বলার ধরনধারণ কি বরাবরই অদ্ভুত?
মিডগের কথায় কর্ণপাত না করে লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল তার বক্তব্য পেশ করেই যেন এগিয়ে চলেছে, হ্যাঁ বোন, আমাদের সকলেরই উচিত চেষ্টা করে দেখা, কিন্তু চেষ্টা করতে গেলে জার্দার মনে ঘৃণা জন্মাবে। আমার মনে হয়, জার্দার যদি সাহস থেকে থাকে তবে সাহসিকতার পরিচয় না দিয়ে সে যেন দূরে নিজেকে সরিয়ে রাখে। কিন্তু তা সে করে না, হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে খুব অল্পেই, বিমর্ষের লক্ষণ চোখে-মুখে ফুটে ওঠে। জন এইসব দেখে ধৈর্য হারিয়ে ফেলে, আমি কিছুতেই ভেবে পাই না, কী করলে অবস্থাটা স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। আর, ঠিক তখনই হেনরিয়েটা ব্যাপারটাকে আরো ঘোলা করে তোলে। জার্দার দিকে ফিরে সে এমনভাবে পুলওভার সম্বন্ধে মুখরোচক আলোচনা জুড়ে দেয় যে, জার্দাও নিজের পোষাকের গর্বে এমন ভাব দেখাতে থাকে যে পুলওভারটা যেন তার নিজের হাতেই বোনা। ধীরে সুস্থে পূর্বের বিমর্ষতা কাটিয়ে জাদার মুখ খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, সমস্ত পরিবেশটা পরিচ্ছন্নতার আলোয় প্রস্ফুটিত হয়ে একটা নতুন দিকে বাঁক নেয়। বিশেষ এই গুণটার জন্য হেনরিয়েটার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ–সমস্ত সমস্যার এমন সুন্দর সুষ্ঠু সমাধান, সেইসঙ্গে মেঘমেদুর নীলাকাশে সূর্যালোকের আলোকে ভাসিয়ে দিতে হেনরিয়েটার জুড়ি নেই।
মিডগে–হ্যাঁ, সে ঝুঁকিটা ঘাড়ে নেয়।
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল-হা, সে জানে কোথায় কী বলতে হবে, কি করতে হবে।
মিডগে-কাজ করার শক্তিও আছে। সেবারে সে পুলওভারটা হেনরিয়েটা গায়ে চাপিয়েছিল, সত্যি কী সুন্দরই না তাকে মানিয়েছিল। হেনরিয়েটা ওটা নিজের হাতেই তৈরি করেছিল।
-সত্যি?
–নিশ্চয়ই।
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল–এই জন্যই তো, হেনরিয়েটার প্রশংসায় আমি পঞ্চমুখ। আর দেখো, হেনরিয়েটা যা করে ঠিকই করে, সুন্দর করে–সকলেই এক বাক্যে তার কাজের প্রশংসায় সামিল হয়। আর ঠিক এই একটা জায়গাতেই জার্দা ও হেনরিয়েটার মধ্যে অমিল চোখে পড়ে। তুমি আমার কথা মিলিয়ে নিও, সাপ্তাহাত্তিক ছুটিতে হেনরিয়েটা নানা ভাবে আমাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। সব কাজেই তার চাতুরী স্পষ্ট ধরা পড়ে। জাদাকে সে সাহায্য করবে, হেনরিয়েটাকে আনন্দ দেবে, জনকে তার মেজাজ বুঝে পরিচালনা করবে, আমার তো মনে হয় সে ডেভিডকেও সাহায্য করবে।
মিডগে–কোন ডেভিড? ডেভিড এ্যাঙ্গক্যাটেল?
লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল-হ্যাঁ, এই তো সবে সে অক্সফোর্ড না কেমব্রিজ থেকে ফিরে আসছে। এই বয়সের ছেলেগুলোর সম্বন্ধে সমালোচনা করা সত্যি বড় কঠিন, বিশেষ করে যদি সে প্রখর বুদ্ধির অধিকারী হয়। ডেভিড তো নিঃসন্দেহে তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন যুবক। এই ধরনের যুবকদের ক্ষেত্রে যে বৈশিষ্ট্যটা চোখে পড়ে তা হল, হয় তারা গম্ভীর, না হয় অত্যন্ত তার্কিক মনোভাবাপন্ন হয়। তবে আমার স্থির বিশ্বাস, হেনরিয়েটা যেভাবেই হোক নিজের মতো করে তাকে মানিয়ে নেবে, কারণ অত্যন্ত কৌশলের সঙ্গে সে কাজ করে। এছাড়া আরও একটা গুণ, তার ভাস্কর্যের জন্যও সকলে তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। সে শুধু পাথর কেটেই মূর্তি তৈরি করে না, নানাপ্রকার ধাতু ও প্লাস্টার দিয়ে সুন্দর সুন্দর শিশু, জন্তু বা মানুষ নির্মাণেও সে সিদ্ধহস্ত। গতবারে নিউ আর্টিস্ট-এ তার হাতের তৈরি বহু জিনিসের প্রদর্শনী হয়ে গেছে–সেগুলো দেখতে রবিনসনের মই বেয়ে ওঠার মতোই যেন লাগছিল। সুচিন্তার উর্ধ্বারোহন তাতে খুবই সুন্দর ভাবে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল। ডেভিডের মতো যুবক এই সব জিনিসের প্রতি সহজে আকৃষ্ট হবে।…আমার কাছে কিন্তু এইসব নিছক বালখিল্য বলেই মনে হয়।