জেনা নিজের খেয়ালেই তাসের খেলা দেখিয়ে যাচ্ছে। এই তো বাবা, তুমি মাঝেই আছ, হরতনের সাহেব। যার ভাগ্য ভালো হবে সে সদাই হরতনের সাহেব থাকবে। এখন আমি অন্য মুখগুলো উল্টে নিচের দিকে করে রাখব। তোমার বামে দুটো, ডাইনে দুটো এবং মাথার উপরে একটা–তার প্রভাব থাকবে তোমার ওপর–এবং ঠিক তোমার পায়ের কাছে যেটা থাকবে, তার ওপর থাকবে তোমার প্রভাব। এটা কিন্তু তোমাকে ঢেকে দেবে। জেনা এক নিশ্বাসে বলে চলে, আমরা তাসগুলোকে এখন উল্টে দিলাম–ডাইনে রুইতনের বিবি–খুব কাছেই।
জন ভেবে নেয়, জেনার চাপল্য ভরা আন্তরিকতায় হেনরিয়েটা নিশ্চয়ই খুশী হতো।
জেনা বলে ওঠে, পরেরটা হল চিড়িতনের গোলাম–নিঃসঙ্গ এক যুবক। তোমার বাম দিকে ইস্কাবনের আট–তার পরিচিতি সে হল এক গুপ্ত শত্রু। বাবা, তোমার কি কোনো গুপ্তশত্রু আছে?
-আমি তো ঠিক জানি না।
তারপরে আছে ইস্কাবনের বিবি–সে এক বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা।
জন বলে ওঠে, লেডি এ্যাঙ্গক্যাটেল।
তোমার মাথার ঠিক ওপরে এখন যে অবস্থান করছে তার প্রভাব এসে সরাসরি পড়বে তোমার ওপর–সে হল হরতনের বিবি।
জন ভাবতে থাকে, ভেরোনিকা হলেও হতে পারে! না, আমি কি এতই নিরেট। ভেরোনিকা হতে যাবে কোন্ দুঃখে? ভেরোনিকার সঙ্গে আমার কোনো সম্বন্ধ নেই।
তোমার ঠিক পায়ের নিচে আছে চিড়িতনের বিবি-তোমার প্রভাব আছে এর ওপর।
এমন সময় ব্যস্ত পদক্ষেপে জার্দা এসে ঢুকে বলে ওঠে, আমি একেবারে প্রস্তুত জন।
একটু অপেক্ষা কর মা, একটু। বাবার ভাগ্য বলা সবে মাত্র শুরু করেছি। শেষের তাসটি বাবা? এটা সবথেকে বেশি প্রয়োজনীয়। এইটাকে তোমাকে ঢেকে রেখেছে।
জেনার ছোট্ট কাঠির মতো আঙুলগুলো তাসগুলোকে উল্টে দেয়। সে একবার শাস টেনে নিয়ে বলে, ওঃ–এটা তো ইস্কাবনের টেক্কা। এটা তো পরকালের–কিন্তু।
জন বলে ওঠে, লন্ডন ছেড়ে বেরিয়ে আসার পথে তোমার মা হয়তো কাউকে চাপা দিয়ে তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে। চলে এসো জাদা, টেরি এবং জেনা,-তোমাদের উভয়ের কাছেই বিদায়!
০৬. মিডগে হার্ডক্যাসল
৬
মিডগে হার্ডক্যাসল শনিবার সকাল এগারোটার সময় নিচে নেমে আসে। বিছানায় বসেই সে তার প্রাতঃরাশ সমাপ্ত করেছে, বই পড়েছে, মাঝেমধ্যে ঝিমুনিও এসেছে এবং তারপরেই শয্যা ত্যাগ করেছে।
অলক্ষ্যে কাল কাটানোই সবথেকে বোধহয় উপভোগ করার উত্তম পথ।
সামনের দরজা দিয়ে শরতের মনকাড়া প্রভাতী সূর্যালোক নেমে এল। স্যার হেনরি এ্যাঙ্গক্যাটেল একটা সাধারণের আসনে বসে মনোযোগ সহকারে টাইমস পত্রিকা পড়ছিলেন। তিনি একবার মুখ তুলে তাকালেন এবং মুচকি হেসে ওঠেন।
মিডগেকে সত্যি তিনি ভীষণ ভালোবাসেন।
হ্যালো জামাইবাবু, আমার কি সত্যি খুব দেরি হয়ে গেছে?
হেনরি তেমনি হাসিমাখা মুখে উত্তর দেন, লাঞ্চ তো আছে, সেটা হারিয়ে বসোনি তো!
মিডগে তার পাশটিতে বসে পড়ে এবং দীর্ঘনিশ্বাস নেয়। এখানে আসা তো বড়ই সুখের।
-তোমাকে আজ বড় কৃশ দেখাচ্ছে।
-না, না, আমি বেশ ভালোই আছি। হৃষ্ট-পুষ্ট মহিলাগণ যেখানে তাদের মাপের চাইতে অনেক ছোট একাধিক পোষাক পরার চেষ্টায় না থেকে, সেখানে কি কোনো মজা আসবে।
হেনরি আবার একটু থেমে বলে ওঠেন, সাংঘাতিক তো! পরে হাতঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই বলেন, এডওয়ার্ড ১২.২৫ নাগাদ আসছে।
-তাই নাকি? মিডগে থেমে যায়, কিছুক্ষণ পরে বলে ওঠে, এডওয়ার্ডের আমি অনেকদিন দর্শন পাইনি।
-তার স্বভাবও ঐরকম, আইন্সউইক থেকে কদাচিৎ বেরোয়-স্যার হেনরি জবাব দেন।
আইন্সউইক! মিডগে ভাবতে থাকে, আইন্সউইক! কথাটা মনে পড়তেই তার অন্তরে কোথায় যেন একটা ব্যথা মোচড় দেয়। আইন্সউইকের মনোরম সেই দিনগুলো। মনে হয় এই যেন সেদিনের কথা। আইন্সউইকের স্মৃতি মিডগের মনের মণিকোঠায় এখন জ্বলজ্বল করছে। আইন্সউইকে চলে যাবার আগে করাত সে দু’চোখের পাতা এক করতে পারেন। শুধু কেবল জল্পনা-কল্পনা আর সেখানে যাওয়ার পর করণীয় কী হবে এটাই বোধহয় সকলের একমাত্র চিন্তাভাবনা। দেখতে দেখতে যাত্রার দিনও এসে উপস্থিত। গ্রামের ছোট স্টেশন। গার্ডকে আগে থাকতে নোটিশ দেওয়া থাকলে বড় লন্ডন এক্সপ্রেসকেও থামতে হবে। গাড়ি থেকে নেমে সুদীর্ঘ বনের পথ অতিক্রম করে তবে আসবে জনমানবশূন্য ফাঁকা মাঠ–সেখানে বিরাজমান সাদারঙের সুন্দর বড় বাড়ি–সে সাদরে অভ্যর্থনা জানাবে, আর দেখা মিলবে বৃদ্ধ কাকা জিওফ্রের। যার পরনে থাকে রঙ-বেরঙের কোট।
যুবক-যুবতীদের মনের সুখে ছুটি উপভোগ করার এটা বোধহয় উপযুক্ত স্থান। যেমন খুশী বিচরণ করতে পারে। আনন্দ উল্লাস করে দিন কাটাতে পারে। সেবারে হেনরিয়েটা আয়ারল্যান্ড থেকে এসে হাজির হল। এডওয়ার্ড তার বাড়ি এটন থেকে এসেছিল এবং সে নিজেই উপস্থিত ছিল উত্তরাঞ্চলের এক শিল্প-প্রধান শহর থেকে। তারা সকলেই ভেবেছিল তারা একত্র হয়েছে বুদ্ধিস্বর্গের নন্দন কাননে।
তাদের সমস্ত আনন্দের কেন্দ্রবিন্দু একজনকে ঘিরেই ছিল, সে এডওয়ার্ড। এডওয়ার্ড বেশ লম্বা, এবং শান্ত ভদ্র স্বভাবের। মিডগের দিকে সে তেমন ভাবে নজর রাখতে পারেনি, কারণ হেনরিয়েটা স্বয়ং সেখানে উপস্থিত ছিল।
এডওয়ার্ড অত্যন্ত চাপা স্বভাবের, বিশেষ করে অতিথিবৃন্দের কাছে, তার এই স্বভাবের জন্য কেউ তাকে ঠিকভাবে বুঝে উঠতেও পারে না। বুড়ো মালীর কাছ থেকে মিডগে যখন শুনেছিল যে এই বাড়িটা একদিন এডওয়ার্ডেরই হবে, শোনামাত্র সে কম অবাক হয়নি। বুড়ো মালীর নাম ট্রিমলেট, বাগানের সেই প্রধান মালী।