কিন্তু যে কথাটা শোনার জন্য জন উদগ্রীব ছিল তা সে একটিবারের জন্যেও উচ্চারণ করল না। সে একেবারে নিশ্চুপ রইল। তার চোখ দুয়ে রহস্য সন্ধানে আপ্লুত হল। বহুক্ষণ এভাবে নীরব থাকার পর সে আবার বলে উঠল, হা, ছেড়ে দিলেও দিতে পারি; যদি তেমন কোনো প্রয়োজন সত্যি সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। একটু থেমে থাকার পর আবার তার বক্তব্য চালু করে, তুমি বোধহয় রেগে আছ। কিন্তু কি বললে তোমার এই রাগ গলে জল হবে–এমন কিছু যা শুনলে তুমি খুশি হও?
-তুমি খুব ভালো ভাবেই সেটা জান। একটিমাত্র শব্দই বোধহয় যথেষ্ট।
–হ্যাঁ, তুমি আসল কথা দুরে রেখে, ঝুড়ি ঝুড়ি বাজে কথা বলে লোকের মন ভোলাতে চাও কেন, ঐসব মিথ্যে বুলি আমার কাছে আওড়াও না কেন?
তবু খুব ধীরে ধীরে সে উত্তর দেয়, আমি জানি না…সত্যিই, আমি বুঝি জন, আমি পারি না–এই পর্যন্ত জানি, আমি পারি না। মিনিট খানেক এদিক-ওদিক পায়চারি করতে করতে জন বলে ওঠে, তুমি কী আমাকে শেষ পর্যন্ত পাগল না করে ছাড়বে না হেনরিয়েটা? আমার কখনও মনে হয় না যে, তোমার ওপর আমার কোনো অধিকার বা প্রভাব আছে বলে।
-তুমি অধিকার নিয়ে অযথা মাথা ঘামাচ্ছ কেন–কেনই বা এই প্রভাব পেতে চাইছ? হেনরিয়েটা জিজ্ঞেসা করে।
-আমি নিজেও জানি না, কেন চাই, কিন্তু আমি অন্তত দিতে চাই। কথা বলতে বলতে জন ধপ করে চেয়ারে এসে বসে।
জন–আমি আগে থাকতে চাই।
হেনরিয়েটা–আমার অজানা নয়, জন।
জন–আমি যখন আর এই জগতের বাসিন্দা থাকব না, তখন তোমার প্রথম কি করণীয় হবে জান? তোমার গণ্ডদেশ প্লাবিত করে অশ্রুবারি ঝরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তুমি কোনো শাকার্ত রমণীর মডেল বা কোনো সেবকের প্রতিমূর্তি গড়বে।
হেনরিয়েটাওঃ, সত্যিই কী সাংঘাতিক কথা! হ্যাঁ, যত সাংঘাতিক হোক-না কেন আমি করব–আমি সেই ভীষণ ভয়ঙ্কর কাজ উদ্ধার করেই ছাড়ব।
বিষণ্ণ চোখে হেনরিয়েটা জনের দিকে তাকিয়ে বসে রইল। পুডিং পুড়ে গেছে। সেদিকে চোখ পড়তেই ক্রিস্টোর, জাদা কোনো কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে তাড়াতাড়ি মাপ চেয়ে নেয়। সে তার স্বীকারোক্তিতে বলে যায়, আমি সত্যিই এর জন্য অনুতপ্ত জন। আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না, আমার বেলাতেই কী করে এগুলো হয়–এই সব আমারই দোষ। পুড়ে যাওয়া উপরের অংশটা না হয় আমাকে তুলে দাও এবং নিচের অংশটা তুমি নাও।
জনের দোষেই পুডিং-এর এই হাল। প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত প্রায় পনেরো মিনিট ধরে বেশি রোগী দেখার ঘরে ঠায় বসে–হেনরিয়েটা, মিসেস ক্যাবট্রি সল মিগুয়েল প্রভৃতির কথা চিন্তা করার ফলেই তার আজ এই দুর্দশার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ঠিক সময়েই যদি জনের আবির্ভাব ঘটত তবে আজ পুডিংটা পুড়ে যেত না। কিন্তু নিজের সব অপরাধ নিজের ঘাড়ে টেনে নিয়ে সে যে সমস্যার সমাধান করতে প্রত্যাশী হয়েছে এটা তার নির্বুদ্ধিতার পরিচয়। পুডিং-এর পোড়া অংশ নিজের জন্য নেওয়া তার নিছক পাগলামি ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে। সর্বদাই সে শহীদের যন্ত্রণা ভোগ করে আসছে কেন? টরেন্সের চোখের দৃষ্টি জনের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে? জেনাই বা অনবরত নাকের শব্দ করে শ্বাস টেনে চলেছে কেন? সকলের ব্যবহার এমন অপ্রীতিকর ঠেকছে কেন? তার সব রাগ এসে পড়ে বেচারি জেনার ওপর।
-তুমি সমানে নিচের দিকে নাক ঝাড়ছ কেন?
জাদা–ওর বোধহয় সর্দি হয়েছে!
জন–না, না, সর্দি ওর হয়নি। তোমাদের সবসময়ই এক চিন্তা যে ওর সর্দি হয়। জেনা বেশ ভালোই আছে।
এই সময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে জার্দা। তার মাথাতে কিছুতেই একটা ব্যাপার ঢোকে না যে, একজন ডাক্তার যে সর্বদা অন্যের রোগের চিকিৎসা করে বেড়ায়, সে নিজের ঘরের লোকের অসুখের ব্যাপারে কী করে এমন উদাসীন থাকতে পারে! ঘরের কারো রোগের কথা শোনামাত্রই সে অদ্ভুত আচরণ করে, উপহাস করে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেয়।
জেনা বলে ওঠে, লাঞ্চ নেবার পূর্বে আমি সময় করে বার আষ্টেক নাক ঝেড়েছি।
জন প্রত্যুত্তরে সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, গরমের হচি।
টরেন্স এতক্ষণ বাদে এই প্রথম কথা বলে, গরম তো নেই বাবা, আমাদের হলের তাপমাত্রা ৫৫ ডিগ্রি।
জন উঠে পড়ে। আমাদের ভোজন প্রায় সমাপ্ত? ভালো উঠে পড়! ফেরার জন্য এবার প্রস্তুত হয়ে নাও জাদা।
-এক মিনিট জন, আমার কিছু জিনিস নিয়ে যাওয়ার আছে।
নিশ্চয়ই নিয়ে যাবে, কিন্তু আগে সেরে রাখতে পারতে! সারা সকালে বসে কী এমন রাজকার্য করেছিলে?
রাগে গজরাতে গজরাতে খাবার ঘর থেকে বেরিয়ে যায় জন, জার্দা একছুটে নিজের শোবার ঘরে আসে। তাড়াতাড়ি করার উদ্বেগে তার যেন আরও দেরি হয়ে যায়। কিন্তু এখনও সে প্রস্তুত হতে পারেনি কেন? জনের নিজের স্যুটকেস ভর্তি হয়ে হলঘরের মাটিতে পড়ে আছে!
জেনা হাতে কয়েকটা কার্ড নিয়ে বাবার পাশটিতে এসে দাঁড়ায়, খেলা দেখানোর বাসনা নিয়ে।
–তোমার ভাগ্য আমি বলে দিতে পারি বাবা, বলব? আমি বলতে পারি। মায়ের টেরির, জেনের এবং কুবের ভাগ্যের কথাও আমি বলে দিয়েছি।
-ভালো বল।
জনের সত্যি বিরক্ত লাগছিল, জার্দার যে কত দেরি হবে। সে এই বাড়ি থেকে, ভয়ানক এই বাড়ি থেকে, বাড়ির এই ভয়ঙ্কর রাস্তা থেকে এবং রোগে পরিপূর্ণ শহর থেকে বেরিয়ে আসতে চায়–তবেই হাঁফ ছেড়ে সে বাঁচবে। বনানীর স্পর্শ চায়, পেতে চায় সে সবুজ পাতার স্পর্শ লুসি এ্যাঙ্গক্যাটেলের নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে তার দেহ মন লাবণ্যের সান্নিধ্যে আসতে চায়।