আর এমন সাধের রাসায়নিক পরীক্ষার কথা কার কাছে বলেই বা আনন্দ পাবে? ধৈর্য ধরে বসে শোনার মতো অবকাশ আছে?
কেউ না! কেউ না!
জার্দা চমকে ওঠে, তার কানে আসে জনের রোগী দেখার ঘরের দরজার শব্দ। জন ছুটে উপরে আসছে।
জন ক্রিস্টো ঘরে ঢোকে, নিজের উৎসাহের তাগিদ তাকে ঘরে এনে হাজির করেছে দ্রুতগতিতে। যদিও সে রঙ্গকৌতুক ভালোবাসে, কিন্তু এখনকার পরিস্থিতিটা একদম আলাদা ক্ষুধার জ্বালায় তার এখন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে।
চেয়ারে বসতে বসতে সে বলে ওঠে, রোগীদের আমি বড় একটা ভালো চোখে দেখি না–আমার কাছে তারা ঘৃণার পাত্র।
-ওঃ জন, এমন বলা তোমার শোভা পায় না, তোমার রোগীদের মনে তোমার সম্পর্কে খারাপ মনোভাব সৃষ্টি করবে–জার্দা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়।
ছেলেমেয়েদের উদ্দেশ্যে ইঙ্গিত দেয়, তারা যেন নিজেদের ভোজন শুরু করে।
জন ক্রিস্টো এবার মুখ খোলে, আমার বক্তব্য হল, অসুস্থ হওয়া বোধহয় কারও উচিত নয়।
টরেন্সের উদ্দেশ্যে জার্দাও জবাব দিতে দেরি করে না, তোমার বাবা আজ রঙ্গরসে মেতে উঠেছেন।
গভীর মনোযোগের সঙ্গে টরেন্স তার বাবাকে পরীক্ষা করে। সব জিনিষই সে গভীর মনোযোগ দিয়ে সম্পন্ন করে।
টরেন্স এবার বলে ওঠে, আমার তো মনে হচ্ছে না বাবা কৌতুক করছেন।
-তুমি যদি রুগণ লোককে ঘৃণার চোখে দেখ, তবে তোমার ডাক্তার হওয়া একেবারেই অনুচিত হয়েছে-জাদা হাসিমাখা মুখেই উত্তর দিয়েছে।
জন ক্রিস্টো–সেই জন্যেই বোধহয় ডাক্তারদের চোখে রোগীর ব্যাধি ধরা পড়ে না, হা ঈশ্বর মাংস যে পাথরের মতো ঠান্ডা-হিম হয়ে গেছে! কেন এটাকে, নিচে পাঠিয়ে রান্নাঘরে গরম করতে পারলে না?
জার্দা–তোমার যে আসতে এত দেরি হবে কী করে জানব? আমি তো ভেবে বসেছিলাম তুমি এসে হাজির হবে বলে।
জোরে জোরে জন ক্রিস্টো ঘন্টা বাজাতে থাকে, চটপট চলে আসে লুই। এই মাংসটা বরং পাঁচক দিয়ে গরম করিয়ে নিয়ে এসো।
সে সংক্ষেপে কোনোরকমে বলে, হ্যাঁ, মহাশয়। এই বলেই লুই তাড়াতাড়ি চলে যায়।
জাদা–সত্যি আমি দুঃখিত জন, সবাই আমার দোষ, প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসবে, তারপর যত সময় পার হতে লাগল ততই একটা চিন্তা আমার মাথায় ঘুরপাক করতে শুরু করে দিল, গরম করতে পাঠালে অনেক দেরি না হয়ে যায়–
অধৈর্য কণ্ঠে বাধা দিয়ে জন বলে ওঠে, ওঃ তাতে কিছু যাবে আসবে না, এটা এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় যে, এর জন্য নাচ আর গানের বন্দোবস্ত করতে হবে।
পরে সে জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা, গাড়িটা এখানে আছে তো?
–আমার তো তাই মনে হয়; কাল তো অর্ডার দিয়েছিল।
–তাহলে লাঞ্চের পরই আমরা বেরিয়ে পড়তে পারি।
জন শুধু ভেবে যায়। অ্যালবার্ট ব্রীজ পেরিয়ে ক্ল্যাপহ্যাম–কমনের ঠিক উপর দিয়ে–ক্রিস্টাল প্যালেসের পাশ দিয়ে সোজা পথ–ক্রয়ত–পারলিওয়ে, পরে প্রধান রাস্তাটা ঠিক বাদ দিয়ে –ডানদিককার মেথ্যার্ডলি হিল-এর মধ্য দিয়ে সোভেলের নিচে দিয়ে সোনালি সারি সারি বৃক্ষশ্রেণীর মধ্য দিয়ে শরৎ বনানীর ভেতর দিয়ে শরতের মৃদু গন্ধ নিতে নিতে পাহাড়ের চূড়ার পাশ দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
লুসি এবং হেনরি…হেনরিয়েটা…।
চারদিন হল জন হেনরিয়েটার দেখা পায়নি। তার সঙ্গে যেদিন শেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল সেদিন সে রেগে গিয়েছিল। হেনরিয়েটার চোখেমুখেও সেই প্রভাব পড়েছিল। দুৰ্জেয় নয়, অন্যমনস্কতাও নয়–ঠিক বর্ণনা সে দিয়ে উঠতে পারছে না–কিছু–যার মধ্যে জন ক্রিস্টোর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না।
সে নিজের মনেই বলতে থাকে, আমি জানি, তার পরিচিতি সে একজন স্ত্রী-ভাস্কর। আমার অজানা নয়, তার হাতের কাজ উত্তম পর্যায়ের। চুলোর-দুয়ারে যাক সব! কখনও কি সে তার কাজ একাঁপাশে রেখে সে নিজেকে মুক্ত করতে পারে না? কখনও কি সে এক মনে আমার কথা ভাবার সময় পায় না? শুধু আপনার কথা? ঐকান্তিক ভাবেই শুধু আমার কথা?
সে ভালো নয়। সে খুব ভালো করেই এই সত্য বোঝে যে, লোক হিসেবে সে মোটেই ভালো নয়–অন্ততপক্ষে নিজের সম্পর্কে তার চিন্তাধারা এইরকম। হেনরিয়েটা নিজের সম্বন্ধে মুখে কিছু প্রকাশ করে না। নিজের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মুখে একেবারে কুলুপ এঁটে থাকে। অন্যান্য শিল্পীদের মতোই সে নিজের কাজ সম্বন্ধে কিছু বলা পছন্দ করে না। তবে তার শিল্পকে সমস্ত অন্তর দিয়েই সে ভালোবাসে। তাই শিল্পকে তার মনের সঙ্গে কতটা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়েছে, এই সংবাদ নেওয়ার সুযোগ অবশ্য জনের ভাগ্যে জোটেনি। তবে এমন ঘটনা খুবই কম চোখে পড়েছে যখন নিজের চিন্তার জগতে বিচরণ করতে করতে হেনরিয়েটা জনকে উপেক্ষা করেছে। জনের প্রতি হেনরিয়েটার বিন্দুমাত্র উদাসীনতা সে একদম বরদাস্ত করতে পারে না। তার বিন্দুমাত্র অন্যমনস্কতাও জনের মনে খুব সহজেই ক্রোধের সৃষ্টি করে।
একদিন সে সোজাসুজি হেনরিয়েটার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়েছিল, আমি যদি মরি তোমার পক্ষে এসব ছেড়ে দেওয়া কী সম্ভব?
–এসবগুলো কী? তার কণ্ঠজুড়ে বিস্ময়ের ধ্বনি।
সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল, বোকা! তুমি কেন ওকে এসব বলছ? পরে আবার চিন্তাভাবনা করে দেখেছে, দেখাই যাক না সে কি বলতে চায়! মিথ্যের আশ্রয় নিয়েই না হয় কিছু বলুক হ্যাঁ, জন আমি নিশ্চয়ই ছেড়ে দিতে পারি–শুধু তোমার মুখ চেয়ে।