জাদা মনে মনে ভাবে, জন সত্যি বড় ভালো,কী অত্যাশ্চর্য! জন সকলের কাছেই প্রিয়পাত্র। মেধাবী, যত্নশীল এমন ডাক্তার, যিনি রোগীদের প্রতি এমন স্নেহপ্রবণ, সকলের সঙ্গে এমন সুন্দর ব্যবহার–সত্যিই এমন মানুষের দর্শন খুব কমই মেলে। জন যে শুধু নিজের রোগীদের ক্ষেত্রেই যত্ন নেয় একথা ঠিক নয়। হাসপাতালের রোগীদের প্রতিও সমান যত্ন তার, জন তাই সত্যিই মহৎ। জার্দা প্রথম থেকেই এটা জানতো যে, ছাত্র হিসেবে জন সত্যিই মেধাবী এবং ডাক্তারি পরীক্ষাতেও সসম্মানে সে উত্তীর্ণ হয়েছিল। সে যে বৃক্ষের শীর্ষদেশে আরোহণ করবে এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ ছিল না। জার্দার সবথেকে অবাক লাগতো এই ভেবে যে, জন কেন তাকে পছন্দ করে বিবাহ করেছিল। জার্দা দেখতে মোটেই সুন্দরী নয়, নয় বুদ্ধিমতী, সেই সঙ্গে চাতুরী কলাও তার মধ্যে বিরল। সব কার্যেই তার মন্থর গতি! এর থেকে অনেক ভালো মেয়ে ডাক্তার জন চাইলে পেয়ে যেত। সে যখন তাকে পছন্দ করল, তখন সে ভালো ভাবেই জেনে গিয়েছিল যে জার্দা ধীরজ, বোকা এবং রূপের ডালিও নয়। জন শুধু বলেছিল, তুমি এ নিয়ে কিছু ভেবো না জার্দা, আমি তোমাকে খুব যত্ন করব…
একজন পুরুষ এর থেকে আর বেশি পৌরুষ কী বা দেখাতে পারে। জাদা শুধু নয়, জার্দার আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সকলেই একসঙ্গে অবাক হয়েছিল যখন তারা শুনেছিল যে জন জার্দাকে পছন্দ করেছে। শুধু জন নামী-দামী বড় ডাক্তারই নয়, রূপেও সে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, কথাবার্তায় তুখোড় এবং লোকের সঙ্গে ব্যবহারে অমায়িক। এরকম পাত্র সকলের কাছেই লোভের বিষয়, আর যদি সৌন্দর্যের কথাই উল্লেখ করা যায়, তাহলে সে মঞ্চ বা চিত্রজগতে নায়কের ভূমিকায় অনায়াসেই অবতীর্ণ হতে পারবে।
সব দিক থেকে বিচার করলে জনের স্ত্রী হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতাও জার্দার মধ্যে ছিল না।
নজরকাড়া হাসি হেসে জন বলে উঠেছিল, আমি আমার নিজের পথ ভালোবাসি, জার্দা।
জাদা প্রত্যুত্তরে বলেছিল, সে তো অতি উত্তম, সেটাই করা উচিত। সেও জনের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। অনেক সময় এমনও হয়েছে যে, জার্দার কোনো কাজ জনের ভালোই লাগেনি, তবু সে জার্দাকে দোষী বলে সাব্যস্ত করেনি। কারণ জন সর্বদাই তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত এবং নিজের স্বার্থের ব্যাপারে সে ছিল বরাবরই উদাসীন–এজন্যই বোধহয় জনের কোনো কাজই জাদার কাছে দোষের ছিল না।
হা ঈশ্বর! ভেড়ার মাংসের টুকরোটা বরফের মতো ঠান্ডায় জমে গেছে। সেটাকে একবার রান্নাঘরে পাঠানো তার উচিত ছিল, কিন্তু জনের তো দর্শন মেলাই ভার! জনও আসছে না, অন্যদিকে জাদাও তার কর্তব্য স্থির করতে পারছে না। জার্দা তার দায়-দায়িত্ব কর্তব্যের ব্যাপারে কেন স্থির সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না? এই চিন্তা মাথাতে আসতেই তার মন দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে, হায় ভেড়ার মাংস! ভীতিপ্রদ এই সাপ্তাহান্তে–এ্যাঙ্গক্যাটেলদের সঙ্গে ছুটি কাটানো অখণ্ড অবসর-সত্যি বড় খারাপ লাগছে! কপালের দু’পাশে হঠাৎ একটা ব্যথা তাকে বড্ড অধীর করে তুলছে। এক্ষুনি মাথার যন্ত্রণায় সে কাতর হয়ে পড়বে, জনের কানে যদি একবার যায়, সে ক্ষেপে আগুন হবে, ওষুধ তো দেবেই না বরং পরামর্শ দেবে যে, মাথা ধরেছে এই কথাটা মনে আনতে নেই, ওটাকে ভুলে যাও, দেখবে মাথাধরাও উধাও। এক কাজ কর, চটপট পা চালিয়ে একটু ঘুরে এসো, অযথা ওষুধ গিলে শরীরকে আর বিষাক্ত করে তুলতে হবে না। ভেড়ার মাংস! এই ভেড়ার মাংসই হয়েছে কাল–মাথা ধরার একমাত্র কারণ। এই মাংসই হলো সব অশান্তির মূল..
জাদার চোখ জলে ভরে যায়। সে মনে মনে ভাবে, আমার বেলায় কেন কোনো কিছুই ভালো হয় না। আমার সব কাজেই একটা না একটা গোলমাল লেগে থাকে।
টরেন্স খাবার টেবিলের অন্যপ্রান্তে বসা মায়ের দিকে একবার তাকাল, তারপরে চোখ নিয়ে গেল মাংসের টুকরোর দিকে। নিজের মনেই ভাবতে থাকে। ডিনার শুরু না করার পেছনে আমাদের কী কারণ থাকতে পারে? বয়স্ক লোকজন যারা উপস্থিত হয়েছে, এক কথায় সকলেই বোকার দল। জ্ঞান বলে কোনো বস্তু তাদের মধ্যে আছে বলে মনে হয় না।
একটু জোর দিয়েই বলে ওঠে, মা, আমি আর নিকলসন তাদের বাড়ির লতাগুল্মের উদ্যানে নাইট্রোগ্লিসারিন বানাবো। স্ট্র্যাথামে তাদের বাস। সম্মতির সুরে জার্দা বলে ওঠে, সে তো খুব উত্তম প্রস্তাব, একদিকে খুব ভালো হল।
–এখনও সময় আছে, ঘন্টা বাজিয়ে লুইকে বললেও এখন বলতে পারো, মাংসের টুকরোটা একবার গরম করে নাও।
টরেন্স উবে যাওয়া উদ্দীপনা নিয়েই মায়ের দিকে তাকাচ্ছিল। সে অনুভব করতে পারে, নাইট্রোগ্লিসারিন তৈরি এমন কোনো কঠিন কাজ নয়, যাতে করে মাতা-পিতার উৎসাহও মিলে যায়। সে ভেবেছিল, সুযোগ বুঝে মাতা-পিতার অনুমতি আদায় করার পালা, কারণ দুর্ঘটনা যদি কোনো ঘটে থাকে তবে আহত কণ্ঠে বলতে পারবে, মাকে আমার বলা তো বলেছিলাম।
কিন্তু এসব সত্ত্বেও তার মনে আজ হতাশা।
সেভাবে, নাইট্রোগ্লিসারিন তৈরির ব্যাপারটা মার কাছে একবার খুলে বলারও প্রয়োজন আছে।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে টরেন্স, অসহায়তা এবং একাকিত্ব তাকে এখন ঘিরে ধরেছে। একথা শোনার মতো ধৈর্য এখন বাবার নেই, মাও সমান অমনোযাগী, জেনাকে তো ধর্তব্যের তালিকায় নেওয়া যায় না, নেহাতই ছোট এবং বোকা।