সে তার মায়ের আশান্বিত চোখে তাকাল, কিন্তু আশার পরিবর্তে তাকে নিরাশ হতে হল। টরেন্সের মতে পিতা-মাতা সর্বদাই নিরাশ করেন।
-মা, তুমি জান কি?
আমি রসায়নশাস্ত্র সম্বন্ধে ঠিক কিছুই জানি না বাবা। টরেন্স সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়, তোমার বইতে এটা থাকলেও থাকতে পারে।
এর কতগুলো সহজ অভিব্যক্তি, কিন্তু এর পেছনেও অনেক আশা।
জাদার কোনো আশার কথাই পৌঁছচ্ছে না। সে যে এক উৎকণ্ঠার ফাঁদে পা দিয়েছে। বারংবার সে একই দুশ্চিন্তার কবলে আটক হচ্ছে। সকালে চোখ ভোলা থেকেই তার মন ভালো লাগছে না। এবং সবশেষে তার এটা বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে, এ্যাঙ্গক্যাটেলদের সঙ্গে সাপ্তাহান্তিক ছুটি কাটানোর সময় এসে উপস্থিত। এই অবসরকে সে আগে থাকতে ভয় পাচ্ছিল।হলোতে বাস করা তার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। সদাই তার বুদ্ধিভ্রম হতো এবং একাকিত্ব তার একমাত্র সঙ্গী হয়ে দাঁড়াত। লুসি এ্যাঙ্গক্যাটেল তার অসম্পূর্ণ বাক্যের দ্বারা দ্রুত অসঙ্গতি এবং বিনয়ের ব্যর্থ প্রচেষ্টায় এমন ভীতির সঞ্চার করতেন..যা, জাদার কাছে সত্যিই অহস্য লাগত। অন্যরাও তেমন ভালো নয়। জাদা এই দুটো দিন যেন শহীদের দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ করতো, শুধু জনের মুখ চেয়েই তাকে সহ্য করতে হতো। সেদিন শুয়ে জন খুশীমনেই বলছিল, ভাবতেও ভালো লাগে যে, সপ্তাহের শেষে আমরা পল্লীগ্রামে যাব। তোমার পক্ষেও এটা ভালো হবে জাদা, কারণ এটা একান্তই প্রয়োজন।
জাদা কিন্তু যন্ত্রচালিতের মতোই মুখ নিয়ে বলে উঠেছিল, হা, আনন্দ বৈকি! তার কারণ সুখহীন চোখ ঘরের দিকেই তাকিয়েছিল। দেয়াল-সাজানো কাগজ, ডোরাকাটা পোষাকের আলমারি, মেহগিনী কাঠের সুন্দর ড্রেসিং টেবিল, তাতে ঝোলানো রয়েছে মনোহারি সুদৃশ্য আয়না, নীল রঙের চাকচিক্যে ভরা কার্পেট, জলরঙের হ্রদের ছবিগুলো–এইসব চির-পরিচিত প্রিয় জিনিষগুলো সে আর সোমবারের পূর্বে প্রত্যক্ষ করতে পারবে না। বাড়ির চাকরানী একদিন মনের সুখে রাজত্ব চালাবে, তার শোবার ঘরে এসে জামাকাপড় সাজানোর নামে ওলটপালট করবে, পর্দা টেনে দিয়ে হয়তো গভীর ঘুম দেবে, নয়তো মন যা চাইবে তাই করবে–এটা ভাবতেই জাদার বিশ্রী লাগছে। জাদা একদম পছন্দ করে না সে ছাড়া কেউ তার জিনিষ নিয়ে নাড়াচাঙ্গা করে। ছুটি কাটাতে গিয়েও সে নিশ্চিন্ত হতে পারবে না, মন পড়ে থাকবে এখানেই, সদাই তার মনে হবে, তার সব প্রিয় জিনিষগুলো এই বুঝি নষ্ট হয়ে গেল! নিজের মনকে সে এইভাবে সান্ত্বনা দেবে, আর মাত্র তো একটা বা কয়েক ঘণ্টার মকদ্দমা। স্কুলের শিশুরা যেমন হা-পিত্যেশ করে গণনায় বসে যায় কবে ছুটির দিন আসবে, জার্দাও শিশুর মতোই ছুটি কাটাতে গিয়েও দিন-ঘন্টা গণনা করতে বসে যাবে–কবে ছুটি শেষ হবে আর কখন আবার বাড়ির মুখ দেখবে।
স্কুলও কোনোদিন জার্দার কাছে সুখের ছিল না। বাড়ি অবশ্য সেই তুলনায় ভালো ছিল, কিন্তু সেটাও তার পক্ষে ভালো ছিল একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। বাড়িতে জার্দা ছাড়া বাকি সকলেই বেশ চালাক-চতুর ছিল, সকলেই তাকে উপদেশ দিয়ে চলত। জার্দা, চটপট করো, তুমি এত ধীরজ কেন?–এইসব উপদেশ এবং বিদ্রূপ-বাণ তার নিকট শীতের দিনের শিলাবৃষ্টির মতোই মনে হতো। জার্দা অবশ্য তার জন্য কোনো আক্ষেপ করত না।
কিন্তু এইসব উপদেশ তার উন্নতির থেকে অবনতির কারণ হয়ে দাঁড়াল। যতদিন যেতে লাগল সে আরও বেশি বোকা এবং ধীরজ হতে লাগল। উপস্থিত বুদ্ধি তার একদম ছিল না। অনেক সময় কোনো কথার জবাবে সে শুধু উদাস নয়নে চেয়ে থাকতো, মুখে বাক্য সরত না।
অবশেষে একদিন সে তার আত্মরক্ষার কৌশল খুঁজে পেল। হ্যাঁ কৌশলই বটে, অস্ত্র হিসেবেও উপযুক্ত।
যত দিন যেতে লাগল সে যেন আরও ধীর হয়ে যেতে লাগল। খানিকটা ইচ্ছে করেই সে কাজে দেরি করতে লাগল। অন্য লোকগুলো ধৈর্য হারিয়ে তাকে যতই তাড়া দিতে থাকে সে যেন আরও ধীর গতিতে চলতে থাকে। অবশেষে তারা তার ওপর আর ছেড়ে না দিয়ে নিজেরাই সেটা করে ফেলে। জার্দা ফ্যালফেলে চোখে বোকার মতোই তার মনের চাহিদার তাগিদে তাকিয়ে থাকে। অপরপক্ষতার এই ভাব দেখে ভেবে নেয় ওর দ্বারা কিছুই হবার নয় এবং সেই সঙ্গে পরামর্শ দেয়, ওকে বেশি কাজ না দেওয়াই ভাল–বেশী কাজ দিও না। জাদার বেশ সুবিধাই হয়েছে, কাজের হার কমে যাওয়ায় তাকে খুব বেশি পরিশ্রমও করতে হয় না। এই কৌশলই সে শিখেছিল, মনে মনে সে খুব খুশী হতো, সকলে একটা কথাই ভাবতো, জার্দার জ্ঞানগম্যি আর হলো না, কোনো কাজ সে ভালো করে শেষ করে না। তারা মনে মনে এই ভাবনা ভেবেই সুখী থাকে যে তারা নিজেদের যথেষ্ট চালাক মনে করে, সেই সঙ্গে জ্ঞানীও।
জার্দা প্রকৃতপক্ষে মোটেই নিরেট নয়, তবে কাজের বেলায় শুধুমগতি। অনেকে সেটা পছন্দও করে না এবং তাতে অবশ্য সুবিধাই হয়। জাদার সবচেয়ে বড় অস্ত্র নীরবতা। কারুর কোনো কথায় সে প্রতিবাদ তোলে না। উত্যক্তর মাত্রা যদি একটু বেশি হয়, তবে আরও বোকা বোকা ভাব এনে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকাই শ্রেয়। পাষণ্ডের চোখে পড়লে তারও মায়া না হয়ে পারবে না।
তবু এ্যাঙ্গক্যাটেলদের মনে মনে সে ভয়ই পেত। এঁরা এত বেশি নিজেদের চতুর ভাবত যে, এদের নাগাল পাওয়া জার্দার পক্ষে সত্যি সম্ভব ছিল না। জার্দার গোপন অস্ত্রের কার্যকরী করার ক্ষেত্র এটা নয়, জার্দা এ্যঙ্গক্যাটেলদের যতই ঘৃণা করুক, জন এঁদের ভালোও বাসে। সেই জন্যই সাপ্তাহান্তে ছুটি কাটানোর জন্য ভালোবাসার টানে যেতে হয়।