সে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি করে জানলে?
হেনরিয়েটা-একখানা বইতে আমি পড়েছি।
জন–কি বই? কার বই?
হেনরিয়েটা ছোট্ট একটা বইয়ের টেবিলের দিকে এগিয়ে চললো। বই দেখে নিয়ে জন বলে উঠলো, স্কুবেলের বই মোটেই ভালো না, তার গোড়ায় গলদ। তোমার যদি বই পড়ার ইচ্ছা থাকে আমি তোমাকে উচ্চমানের ভালো বই দিতে পারি।
সে তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বলে ওঠে, না না, আমায় বই দিয়ে কি হবে? আমি শুধু তোমার বক্তব্যগুলো বুঝতে পারছি এই পর্যন্ত, তার চেয়ে বেশি জানতে চাওয়ার কোনো প্রবণতা আমার আছে কি? তুমি বলে যাও, মোটামুটি বোধগম্য আমার হবে।
আচ্ছা, মনে রেখো কিন্তু স্কুবেলের বই ঠিক নয়।
জন আড়াই ঘন্টা ধরে চিকিৎসাবিজ্ঞানের নানা তত্ত্ব পরিবেশন করে নিল। সে যখন হেনরিয়েটাকে এইসব কিছু বোঝাচ্ছিল, তখন তার এই খেয়ালও আসেনি যে, হেনরিয়েটা উপস্থিত আছে কিনা! তার দৃঢ় বিশ্বাস যে সে ভ্রান্ত নয়, নানান পদ্ধতিতে তার উপপাদ্য প্রমাণের চেষ্টায় লেগে গেল।
হঠাৎ সে মনের দিক থেকে ক্লান্তি অনুভব করল। আমি অত্যন্ত ক্লান্ত’ একথা বলতে বলতে বিছানায় শুয়ে পড়ে মরার মতো নিদ্রাদেবীর কোলে ঢোলে পড়ল।
শিশুর মতো সে ঘুমিয়ে পড়ল। পরের দিন সকালে যখন সে চোখ খুলল, তার চোখে পড়ল যে হেনরিয়েটা তার দিকে তাকিয়ে ফিকে হাসি হাসছে এবং সকালের চা তৈরি করতে বসে গেছে।
জন হেসে বইয়ের টেবিলের দিকে তাকিয়ে হেনরিয়েটার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, তুমি সত্যি খুব ভালো লোক, তবে দেখ, বই যদি পড়তে চাও তবে আমি তোমার হাতে ভালো বই তুলে দেব, স্কুবেলের নিম্নমানের বই পড়া তোমার বোধহয় উচিত হবে না।
হেনরিয়েটা সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, না-না ওসব পড়াশোনার ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। আমি যা কিছু উদ্দীপনা পাই তোমার মধ্যে এবং তোমার কথা শোনার পরই। এই বলে সে হেসে ফেলে।
জন কিন্তু বুঝে উঠতে পারে না, হেনরিয়েটার হাসির পেছনে আসলে কোনো কারণ লুকিয়ে আছে কি না? তবে কি হেনরিয়েটা স্কুবেলের বইকে উন্নতমানের বলে মনে করে? হেনরিয়েটা তবে কি তাকে উপহাস করছে? এমন পরিহাসে সে বড় একটা অভ্যস্থ নয়। জাদা তার সঙ্গে এভাবে ঠাট্টা-তামাশা করে না। ভেরোনিকা তো নিজেই স্বার্থ ছাড়া কিছু বুঝতে চায় না। হেনরিয়েটা কিন্তু অভিনবপন্থায় মাথা পেছন দিকে ফিরিয়ে আধবোজা চোখে তার দিকে তাকিয়ে রহস্য করে বলতে পারে, আমি কৌতুকপূর্ণ চোখে জনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বহুদূরে চলে যেতে পারি…।
সে ভেবে নেয় হেনরিয়েটা বোধহয় এখন একটু পালটে গিয়েছে–বোধহয় নিজেকে অনেক দূর সরিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু সেটা তার মনোগত বাসনা নয়। জন চায় যে, হেনরিয়েটা তার কথা ভাবুক, শুধু মাত্র তার কথাই ভাবুক–কোনো সময়ের জন্য যেন জনের অস্তিত্ব ছেড়ে অন্য কোথাও যেন চলে না যায়। কিন্তু যে গুণগুলো জার্দার মধ্যে দেখে জন নিজেকে ধরে রাখতে না পারে, সেগুলোই বা সে কেন হেনরিয়েটার মধ্যে পেতে চায়? এর একমাত্র অর্থ হয় যে, ন্যায়শাস্ত্র সম্বন্ধে সে একেবারে অজ্ঞ এবং তার মনের আকাঙ্ক্ষা সম্বন্ধে সে নিজেই জানে না।
আমি বাড়ি যেতে চাই–কি সম্ভবের বাইরে এবং বিদ্রুপের কথা! তার মানে কী দাঁড়াচ্ছে?
দু-একটা ঘন্টার মধ্যে জন লন্ডন থেকে বেরিয়ে পড়বে এবং শরৎ বনানীর মধ্যে দিয়ে পল্লীর পথ ধরে এগিয়ে যাবে…গাড়ির গতি তার মনে খুশী ডেকে আনবে…পল্লীপ্রকৃতির লতা-গুল্ম, ফল-ফুল, ঝর্না-নদী তার মনে আনন্দের ঢেউ তুলবে…
কিন্তু এসব কিছুই নির্ভর করছে একমাত্র জার্দার ওপর, ঈশ্বর জাদার প্রতি সহায় হোন। জার্দা খুব ভালো গাড়ি চালাতে পারে না।
সে থেকে থেকে গিয়ার বদল করে, জন তখন একেবারে নীরব থাকে। কখনও কখনও দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ওঠে, কিন্তু সাহস করে কিছু বলার মতো ক্ষমতা তার নেই। কারণ অতীতের অভিজ্ঞতা তাকে অনেক কিছু জানিয়েছে–সে জানে কিছু বললেই জাদা ক্ষেপে যাবে। আশ্চর্যের কথা এটাই যে, জার্দাকে কেউ গিয়ার বদল করা শেখাতে পারল না, এমনকি স্বয়ং হেনরিয়েটাও নয়। হেনরিয়েটার হাতে সে জাদাকে সমর্পণ করেছিল কারণ সে ভেবেছিল যে, তার উগ্র মেজাজের চাইতে হেনরিয়েটার শান্ত, উৎসাহ তাকে ভালো করার পেছনে যথেষ্ট লাভজনক।
হেনরিয়েটা গাড়ি ভালোবাসে। গাড়ির নাম উঠলেই সব কিছু ভুলে যায়। কেউ এ নিয়ে কোনো কথা বললেই তার মনে কাব্যরসের সঞ্চার হয় এবং সে এমন প্রাকৃতিক দৃশ্য নির্ণয়ের সঙ্গে গাড়ির শব্দধ্বনি, গতিবেগ প্রভৃতি তুলনা করে দেয় যে, শ্রোতারা বিরক্ত হয়ে ওঠে। জন তো বলেই বসল, হেনরিয়েটা তুমি কি তোমার গাড়ির কথা তুলে রেখে আমার জন্য দু’এক মিনিট ব্যয় করতে পার না? একদিন তো জনের এই ব্যাপারকে কেন্দ্র করে তার সঙ্গে বিরাট মনোমালিন্য হয়ে গেল!
জাদা একদিন জনকে বলে উঠেছিল, হেনরিয়েটা আমাকে যাবার জন্য বলেছে, আমার সঙ্গে তার কি কাজ আছে।
জন–কি কাজ? তোমাকে আবার কোন কাজে লাগবে তার? বোধহয় তোমার সঙ্গে ছলচাতুরি কিছু করবে।
জার্দা-কাল আমি স্টুডিওতে যাচ্ছি।
জাদাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে খুব খুশী। জনের মনে হল জার্দা বোধহয় মডেল হতে চায়–মুখে কিছু বলল না।