টরেন্স স্বপ্নালু চোখে বলে উঠল, এটা একটা রাসায়নিক পরীক্ষা।
জেনা বোধহয় এই ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহ পাবে।
ন-বছরের জেনা তার সুন্দর মুখের মুখভঙ্গী করে বলে ওঠে, আমি আমার ডিনার চাইছি। মা, আমরা কি শুরু করে দিতে পারি না?
এক মিনিটের মধ্যেই কিন্তু খেতে শুরু করবে, তোমার বাবার জন্য কিছুক্ষণ প্রতীক্ষা অন্তত কর।
টরেন্স সঙ্গে সঙ্গে বলে, আমরা শুরু করতে পারি, বাবা মনে কিছু করবেন না। দেখোনি, তিনি কত চটপট ভোজন সমাপ্ত করেন?
জাদা নীরবে মাথা নাড়ে।
মাংস কাটবো? সে ঠিক করে উঠতে পারে না, কোন্ দিক থেকে চাকু বসানো উচিত। লুই অবশ্য ঠিক ভাবেই চাকু দিয়ে সুন্দর করে মাংস কাটছিল। কিন্তু অনেক সময় হয়েছে যখন সে ভুল করে ফেলেছে এবং জন তাতে ক্ষেপে গেছে। লুই ভুল করে চাকু ধরলে জার্দা তাকে ধমক লাগাতে ভোলে না। কিন্তু আজ আর ধমক বর্ষণ হলো না। আজ সে অন্য কারণে উদ্বিগ্ন।
মাংসের ঝোল এর মধ্যে ঠান্ডাও হয়ে গেছে এবং ঝোলের ওপর একটা পাতলা সুর ভেসে উঠেছে। তাকে যতশীঘ্র সম্ভব ওটা রান্নাঘরে পাঠিয়ে দিতে হবে–কিন্তু জন যদি এর মধ্যে এসে হাজির হয়ে যায়–এখন তার আসার সময় হয়েই গেছে। তার মনে ক্রমেই দুশ্চিন্তা আসতে লাগল..ঠিক খাঁচায়বন্দী প্রাণীর ন্যায়।…
আবার কেদারায় বসে ডাক্তার জন ক্রিস্টো কতকিছুই না ভেবে চলেছে। এক হাত সামনের টেবিলের ওপর রেখে অতীতে ফিরে গিয়ে তখনকার স্মৃতিচারণ করতে করতে হঠাৎ তার মনে হচ্ছে জাদা এবং ছেলেমেয়েরা ওপরে খাবার টেবিলে তার জন্য প্রতীক্ষায় বসে আছে। তার সত্যি অনেক দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু কিছুতেই সে উঠে দাঁড়াবার শক্তি সঞ্চয় করতে পারছে না।
চোখের সামনে এসে ভিড় জমাচ্ছে সব মিগুয়েল..নীল সমুদ্র…সিনেমার গন্ধ…উজ্জ্বল সূর্য…ধূলিকণা…দুঃসাহসিক সেই ভালোবাসা এবং যন্ত্রণা…
সে ভাবতে থাকে, হায় ভগবান, আবার এসব চিন্তা কেন! এসব চিন্তার দিনের অবসান ঘটেছে?
হঠাৎ তার মনে হল, তার সঙ্গে ভেরোনিকার যদি কোনো পরিচয় না থাকতো, জার্দার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ না হতো, এবং হেনরিয়েটার সঙ্গে যদি সাক্ষাৎ না হতো।…
মিসেস ক্যাবট্রির কথা তার মনে পড়ে যায়। তার বর্তমান অবস্থা যথেষ্ট সন্তোষজনক। প্রতিক্রিয়া তো খুবই উত্তম, সে এখন .০০৫ সহ্য করার ক্ষমতা রাখে। টক্সিসিটির অসম্ভব শ্রীবৃদ্ধি এবং ডি.এল, প্রতিক্রিয়া ধনাত্মক না হয়ে ঋণাত্মক-এ দাঁড়িয়েছে। তার রোগ নিয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চলছে। ডাক্তার তার দিকে চেয়ে হাসিমুখে বলেছিল, আপনাকে আমরা সুস্থ করেই তুলবো।
সে প্রত্যুত্তরে বলেছিল, ভগবান তোমার সহায় হোন, তুমি পরীক্ষা চালিয়ে যাও।
নাড়ী ধরে ডাক্তার শুধু প্রশ্ন করেছিল, আপনি অসুস্থ বোধ করছেন কি?
ডাক্তারের হাতের স্পর্শ পেতেই রোগিণীর মধ্যে যেন সতেজ ভাব ফিরে আসে। শ্বাস নিতে নিতে রোগিণী শুধু কটা কথা উচ্চারণ করেছিল, তুমি কিছু ভেবো না, আমি ঠিক সহ্য করতে পারব, তোমার কাজ তুমি বন্ধ রেখো না, চালিয়ে যাও।
জন ক্রিস্টো উৎসাহিত হয়ে বলে উঠেছিল, আপনি বড় মহৎ। আমার সব রোগী যদি আপনার মতো মন পেত।
–আমি সুস্থ হতে চাই, তাই সবকিছু সহ্য করার মতো শক্তি পেয়ে যাই। আমার মা আশি বছর পর্যন্ত বেঁচেছিলেন, ঠাকুমা নব্বই বছরের ওপর ইহকাল ত্যাগ করেছিলেন। আমার দীর্ঘ আয়ুর গোষ্ঠী হওয়াটাই স্বাভাবিক।
ডাক্তার মনে দুশ্চিন্তা আর সংশয় নিয়ে ফিরে এসেছিল। যদিও সে তার কাজের ব্যাপারে পরম নিশ্চন্ত ছিল যে, সে ঠিক পথেই এগোচ্ছে, তবু তার মনে ভয় ছিল। কোনো কিছু ভুল হয়ে যায়নি তো?
নিশ্চিন্ত থেকেও তার মনের চিন্তা আর দূর হয় না। কল্পনার জগতে বিচরণ করতে করতে হাসপাতালের সিঁড়িতে একটা দুরন্ত অবসাদ এসে ক্রিস্টোফারকে ঘিরে ধরল–বহুদিন ধরে এই গবেষণার কাজ করতে করতে তার ঘৃণা জন্মে গেছে। হঠাৎ করে হেনরিয়েটার কথা মনে পড়ে গেল। ঠিক তার জন্য নয়, তার রূপ, সজীবতা, স্বাস্থ্য এবং তার আলোকোজ্জ্বল জীবনীশক্তির জন্যই তার কথা বারে বারে মনে পড়ে যায়, আর মনে পড়ে তার চুলে আটকানো গোলাপের মোহিত করা গন্ধের জন্য।
বাড়িতে টেলিফোন করে খবর পাঠিয়ে সোজা হেনরিয়েটার কাছে গিয়ে উপস্থিত হলো, হেনরিয়েটার স্টুডিওতে পা রেখেই সে তাকে জড়িয়ে ধরল এবং সজোরে টেনে আনল বুকের খুব কাছে।
তাদের সম্পর্কে এমন আলিঙ্গনের বহর এই প্রথম। হেনরিয়েটার চোখেমুখে অবাক বিস্ময়। জনের উষ্ণ আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে কফি তৈরি করে খাওয়াল জনকে। স্টুডিওর মধ্যে চলাফেরা করতে করতে সে তাকে নানা প্রশ্নও করতে লাগল। সে জানতে চাইল, জন সোজা হাসপাতাল থেকে আসছে কিনা। জন কিন্তু চুপ করে থাকে। সে এখানে এসে হাজির হয়েছিল খানিকটা মোহগ্রস্ত হয়ে, আবার কিছুটা হেনরিয়েটার প্রেমে অন্ধ হয়ে।
হাসপাতালের কথা উল্লেখ করতে জনের ঠিক মন চাইছিল না। হেনরিয়েটার সঙ্গে প্রেমের গল্প করার বাসনা নিয়েই তাকে কাছে পাবার আশা নিয়েই সে হাজির হয়েছিল, হাসপাতলের কথা এবং মিসেস ক্যাবট্রি এবং রিজওয়ের রোগ সংক্রান্ত সব কথাই সে ভোলার জন্য উপস্থিত হয়েছিল।
প্রথমটায় অনিচ্ছাসত্ত্বে এবং পরে খুব দ্রুত তার প্রশ্নের জবাব ও দিল। চিকিৎসাবিদ্যার কতগুলো সহজলভ্য ভাষা তাকে বোঝাতে গিয়ে জন দু-একবার চুপ করে গিয়েছিল, হেনরিয়েটা চটপট উত্তর দিয়েছিল, হা, হা ডি. এল. প্রতিক্রিয়া ধনাত্মক-এ রূপান্তরিত হতে হবে। আমার ওসব বুঝতে অসুবিধে হয় না, তুমি বলে যাও।