ওতেই…
অথচ ভদ্রমহিলার কোনো ব্যাধি নেই, শরীরস্বাস্থ্যও বেশ ভালো। কণ্ঠস্বর ঘন্টার মতো, সারা দেহে তার কোনো জ্বালা-যন্ত্রণা নেই, তবু মুখে একটাই বুলি লেগে আছে, রোগের জ্বালা আর সে সহ্য করতে পারছে না।
হটেনহ্যামের মিসেস পিয়ারস্টক এবং পার্ক লেন কোর্টের মিসেস ফরেস্টার একই প্রকৃতির স্ত্রীলোক। তারা যেন পরস্পর পরস্পরের সহোদরা। অর্থ আর সময়ের কোনো হিসেব তারা রাখে না, তাই তার সদ্ব্যবহারও বোধহয় একই পদ্ধতিতে করে থাকে…
জন ক্রিস্টোর সরল সাদাসিধে স্বভাবের এক সেক্রেটারি আছে এবং সে বিবাহও করেছে সহজসারল্যযুক্ত একটি মেয়েকে। এটাই বোধহয় তার মনোগত বাসনা ছিল।নয় কি? সে নিজের সৌন্দর্যের এক ডালি, অন্য লোকের ক্ষেত্রে হলে হয়তো অনেক কিছুই করতে পারতো! জীবনে চলার জন্য পৃথক পথই হয়তো বেছে নিত, কিন্তু সে তো তা করলো না। সে তো সোজা পথ ধরেই চলতে শুরু করেছিল এবং এখনও সে তার চলার পথে কোনো পরিবর্তন করেনি। মানুষ রূপের জোরে কি করতে পারে তা সে ভেরোনিকাকে না দেখলে হয়তো বুঝতে পারতো না। তাছাড়া, রূপবান পুরুষদের দর্শনও সে পেয়েছে তারা কি করতে চায় এবং করে থাকে। ভেরোনিকার কাছ থেকে সে জীবনের নিরাপত্তা পেতে চেয়েছিল, আর সেইসঙ্গে শান্তি ও নিশ্চিন্ত জীবন সুখেরও কামনা করেছিল। কিন্তু তার মনের বাসনা মনেই রয়ে গেছে–তা সে কোনোদিন পায়নি! জার্দাকে জীবনসঙ্গিনী রূপেই সে হয়তো চেয়েছিল। জাদার মধ্যে সে জীবনের শান্তি, সহনশীলতা আর জীবনের প্রতি তার আনুগত্য এইগুলোর সন্ধান পেয়ে গেছে! তবে কী জার্দার মধ্যে সে সব কিছু খুঁজে পেল? জার্দাই কী তার জীবনের সাদ মিটিয়েছে? জন কিন্তু এ কথার সঠিক উত্তর খুঁজে পায় না। মনে মনে সে বোধ হয় জার্দাকেই চেয়েছিল। কিন্তু তার মনে এত অস্থিরতা কেন?
কার মুখে জন শুনেছিল, মানুষ যা পাবার আশা করে; তা সে পেয়ে গেলেই জীবনে নেমে আসে ট্র্যাজেডি!
ক্রুদ্ধভাবে জন টেবিলের ঘন্টায় ঘা বসায়।
.
এখন সে মিসেস ফরেস্টারকে দেখবে। দর্শন পেতে মিনিট পনেরোর বেশি লাগল না। আরও একবার সহজেই হাতের মুঠোয় টাকা এসে গেল। এবার সে রোগিণীর কথা মন দিয়ে শুনলো, জিজ্ঞাসাবাদ করলো, সহানুভূতিও দেখাল, সাহস দেখাল, সব শেষে নিজেকে সারিয়ে তোলার শক্তিও একই সঙ্গে রোগিণীকে দান করল। পরিশেষে মূল্যবান একটা ওষুধের ব্যবস্থাপত্র শোনানোর পরেই তার কর্তব্য শেষ হল।
এতক্ষণ ধরে ঠায় বসে বসে যে রোগিণী নিজের ব্যাধির চিন্তায় আকুল হয়ে অবসন্ন মনে বসেছিল, এখন সে অন্য এক মানুষ, সদর্পে উৎসাহ-উদ্দীপনাকে সঙ্গে করে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল–তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন নতুন জীবনের স্বাদ পেয়েছে, চোখমুখ জুড়ে বিরাজ করছে নতুন এক রঙ।
জন ক্রিস্টো চেয়ারে গিয়ে আবার নিজেকে হেলিয়ে দিল। এখন তার অবকাশ, উপরে গিয়ে জার্দা এবং ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিলিত হবার কথা। সারা সপ্তাহ ধরে রোগ আর রোগীর যন্ত্রণা উপশমের প্রচেষ্টার অফুরন্ত বিশ্রাম।
কিন্তু কিছুতেই আর নড়েচড়ে বসতে মন চাইছে না। এই কি তার সদিচ্ছার অদ্ভুত অবসাদ?, মনের ক্লান্তি, সে অত্যন্ত ক্লান্ত, ক্লান্ত…।
.
০৪.
রোগী দেখার ঠিক উপরের ফ্ল্যাটে জার্দা ক্রিস্টো একদৃষ্টে অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে একটা ভেড়ার মাংসের টুকরোর দিকে।
কল্পনার জগতে থেকে সে আবার চিন্তার জাল বুনতে শুরু করে দিয়েছে, রান্নাঘরে গরম রাখার জন্য মাংসটাকে পাঠাবে কিনা তাই ভাবছে। জন যদি আসতে একটু দেরি করে তবে মাংস একদম ঠান্ডা হয়ে যাবে এবং ব্যাপারটা তখন বড়ই খারাপ দেখাবে। কিন্তু মাংসটা যদি রান্নাঘরে গরম করতে পাঠানো হয় এবং এই সময় যদি জন এসে উপস্থিত হয়ে যায় তাহলে ব্যাপারটা বিসদৃশ ঠেকবে। কারণ জন দেরি হোক এটা কিছুতেই মেনে নেবে না। সে অধৈর্য হয়েই বিরক্তির সুরে বলে উঠবে, তুমি তো জান আমার রোগী দেখা যখন শেষ হয়ে গেছে, আমি এক্ষুনি চলে আসব।…জনের এই ধৈর্যচ্যুতি নানা অশান্তি ও ভুল বোঝাবুঝির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাছাড়া বেশি গরম করলে মাংস সেদ্ধ হয়ে যাবে এবং জন তখন আরও চটে যাবে, ফারণ বেশি সিদ্ধ করা জিনিস জন কখনোই খুশী মনে মুখে তুলবে না। আবার মাংস ঠান্ডা থাকলেও সে রেগে যাবে, কারণ ঠান্ডা খাদ্য সে একেবারেই পছন্দ করে না।
মাংসের পদটা কিন্তু খুবই সুস্বাদু হয়েছিল। তার মন এখন দোদুল্যমান এবং দুঃখ ও দুশ্চিন্তা একইসঙ্গে তার মনকে আরও বিচলিত করে তুলেছিল।
সমস্ত জগৎ যেন তার চোখের সামনে মেষের পায়ের মাংসের ওপর সঙ্কুচিত হয়ে শীতল হয়ে যেতে লাগল। ডাইনিং টেবিলের অন্য প্রান্তে বারো বছরের টরেন্স বলে ওঠে, বোরাসিক সল্ট সবুজ শিখাতেই জ্বলে, হলদে রঙের শিখা সোডিয়াম সল্টের।
জার্দা টেবিলের অন্য প্রান্ত থেকে উদ্ভ্রান্তের মতো একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। ছেলে কী বলে চলেছে এ ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র অনুমান পর্যন্ত নেই।
মা, তুমিও জান না? ]
জার্দা-কি আর জানবো, বাবা?
টরেন্স–সল্ট সম্বন্ধে?
জাদার চোখ গিয়ে থামল লবণ রাখা কৌটার দিকে।
হ্যাঁ, লবণ এবং গোলমরিচের গুঁড়ো টেবিলের ওপর সযত্নে রাখা আছে, তা ঠিকই আছে। গত সপ্তাহে লুই ওটা রাখতে ভুল করেছিল এবং জন আরও রেগে গিয়েছিল। সদাসর্বদাই একটা-না-একটা গোলমাল…