জন খুব দৃঢ়তার সঙ্গে বলে উঠেছিল, আমি যে পেশার সঙ্গে যুক্ত আছি সেই পেশার বিষয়ে আমি যথেষ্ট উৎসাহী এবং মনোযোগী। র্যাড়লের সঙ্গে কাজ করার জন্যই আমি যাচ্ছি।
তার কণ্ঠস্বর-উৎসাহী-উগ্রীব তরুণের কণ্ঠস্বর–অত্যন্ত দৃঢ়চেতা, গুরুগম্ভীর এবং নির্ভীক। ভেরোনিকার কণ্ঠ দিয়ে নিশ্বাস টানার শব্দ বেরিয়ে আসে। বলে, সেই নস্য-টানা বুড়োটা? জন ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে ওঠে, সেই নস্য-টানা বুড়ো লোকটা প্র্যাটু তার রোগ নিয়েই তার মূল্যবান গবেষণা করছে।
বাধা প্রদান করে সে বলে ওঠে, পাটের রোগ নিয়ে কারা এত মাথা ঘামাচ্ছে– ক্যালিফোর্নিয়ার জলহাওয়া কি সত্যি চমৎকার! জগৎটাকে দেখা কি কৌতুকের। এই জন্যই তোমাকে আমার প্রয়োজন জন!
প্রত্যুত্তরে জন বলেছিল, ভেরোনিকা, তুমি হলিউডের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আমাকে বিবাহ কর এবং চল, আমরা বরং লন্ডনে গিয়ে বসবাস করি। জনের এই প্রস্তাব শুনে ভেরোনিকা মনে মনে হেসেছিল তাই বলেছিল যে, হলিউডে যাবেই এবং জন যখন তাকে মন দিয়ে বসে আছে, বিবাহ তাদের কোনো কারণেই আটকাবে না। নিজের রূপ এবং শক্তি সম্বন্ধে তার খুব অহংকার ছিল।
জনের কাছে তখন একটা রাস্তা খোলা ছিল, বাগদান সে ভেঙে দিল।
সে যথেষ্ট ভুগেছে কিন্তু সে, যে কাজ করেছে তাতে তার গভীর জ্ঞানের পরিচয়ই মেলে। সে আবার লন্ডনে ফিরে এল এবং র্যাড়লের সঙ্গে কাজও শুরু করে দিল। একবছর বাদে জাদার সঙ্গে তার বিবাহ ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়ে গেল। সব দিক থেকে বিচার করলে জার্দা ভেরোনিকার থেকে একেবারে পৃথক ছিল…
দরজা খুলে গেল এবং সেক্রেটারি বেরিল ভেতরে প্রবেশ করল।
মিসেস ফরেস্টারের সঙ্গে সাক্ষাৎ আপনার এখনও বাকি।
সংক্ষেপে ছোট্ট উত্তর দিল সে, আমি জানি।
সেক্রেটারি বলে উঠল, আমি ভাবলাম, আপনার হয়তো মনে নেই।
ঘর থেকে সে বেরিয়ে গেল। ক্রিস্টোর দৃষ্টিও নিঃশব্দে নিষ্ক্রমণ অনুসরণ করলো। বেরিল একটা সাধারণ মেয়ে, কিন্তু খুবই কর্মঠ। ছ’বছর ধরে সে এখানে কাজ করে যাচ্ছে, এর মধ্যে এমন একটা দিনও যায়নি যেখানে একটা ভুলও হয়েছে। চঞ্চলতা, উদ্বেগ, বা ব্যস্ততা এর কোনোটাই তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তার কালো কেশ, মেটে মেটে রঙ এবং দৃঢ়চেতা চিবুক।
যথেষ্ট শক্তিসম্পন্ন চশমার সাহায্যে সে তাকে এবং পুরো জগৎটাকে সমান নিরাসক্ত ভাবে দেখতে পায়।
সে খুব সাধারণ, সৎ স্বভাবের সেক্রেটারি চেয়েছিল এবং সে তার বরাত জোরে পেয়েও গেছে। কিন্তু জন ক্রিস্টো মাঝে মাঝে অকারণেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। মঞ্চ এবং কাহিনীর সব নিয়মে বেরি তার মা প্রভুর কাছে নিরাশ মন নিয়েই অনুগতশীল, কিন্তু সে জানে যে সে বেরিলকে কখনোই মূল্যহীন ভাবে না। কোনো ভক্তি বা আত্মোৎসর্গ নয়–বেরিল তাকে নিশ্চয়ই ভ্রমণশীল এক মানুষ রূপেই গণ্য করে। সে তার ব্যক্তিত্বে অভিভূত বা মাধুর্যে বিগলিত হবার পাত্র নয়। অনেক সময় তার মনে এই সন্দেহ দানা বাঁধে যে, বেরিল হয়তো তাকে পছন্দ করে না।
জন একদিন নিজের কানে বেরিলকে তার বন্ধুকে টেলিফোনে বলতে শুনেছে, না, আমি এটা ভাবি না যে, তিনি আগের থেকেও আরও বেশি স্বার্থপর হয়ে উঠেছেন বরং চিন্তারহিত ও অবিবেচক হিসেবেই তিনি জ্ঞাত।
জন ক্রিস্টোর বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি যে, বেরিল ও তার বন্ধুর আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু সে নিজে এবং এই কথা শোনা মাত্র পুরো চব্বিশ ঘন্টা সে ক্রুদ্ধ ছিল।
জার্দার অসংলগ্ন ভঙ্গীপনা যেমন জনকে স্বাভাবিক থাকতে দেয় না, তেমনি বেরিলের হৃদয়হীন মূল্যায়নও তাকে সহজেই রাগিয়ে দেয়। বেরিলের ধারণা যে, প্রায় সব ব্যাপারেই জন ক্ষেপে যায়…
কোনো একটা গোলমাল নিশ্চয়ই আছে। অতিরিক্ত পরিশ্রম? হয়তো তাই। না, সেটা নেহাত ঐ অজুহাত মাত্র। অধৈর্য, কাজে বিরক্তি, হঠাৎ রেগে ওঠা–সবকিছুর মূলে একটা না-একটা নিশ্চয়ই থাকবে। সে ভাবে এভাবে চলতে পারে না, আমি এভাবে থাকতে পারি না! আমার কী হয়েছে? আমি যদি পালিয়ে যাই..
আবার সেই এক চিন্তা–অন্ধ আবেগ আর মুক্তির পথের সন্ধানে ঘুরে ফিরছে–পালিয়ে যাওয়ার কথা মাথায় আসছে!
আমি বাড়ি যেতে চাই…জাহান্নামে যা সব। ৪০৪, হার্লি স্ট্রিটের বাড়ি আমার!
ওয়েটিং রুমে চুপচাপ বসেছিলেন মিসেস ফরেস্টার। বিরক্তিকর স্ত্রীলোক। অত্যধিক অর্থের অধিকারিণী এবং নিজের ব্যাধি সম্বন্ধে চিন্তা করার অফুরন্ত সময় তার হাতে। কে যেন তাকে বলেছিল, ধনী রোগীরাই তোমাকে আরও ক্লান্ত করে তুলবে, আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে নিও। তারা সদাই চিন্তা করবে এবং এটাই দেখাতে চাইবে যে, তারা পীড়িত, কিন্তু গরীব লোকেরা তোমার কাছে তখনই হাজির হবে যখন তারা সত্যি-সত্যিই কোনো রোগের শিকার হবে। একমাত্র ধনী লোকেরাই বিনা কারণে ডাক্তারখানায় এসে ভিড় জমায়। বৃদ্ধ মিসেস পিয়ারস্টক পাঁচটি বিভিন্ন ক্লিনিকে প্রতিসপ্তাহে উপস্থিত হয় এবং পিঠের, বুকের, ঘাড়ের, সর্দি, কাশির, হজমের, মাথা ঠাণ্ডা রাখার, হাত-পা কন্ করার সবরকম ব্যাধির কথা ভেবে সব ওষুধ নিয়ে থাকে। সেবারে বয়সে তরুণ এক ডাক্তার তাকে সাদা রঙের ওষুধ দিয়েছিল, ভদ্রমহিলা ওষুধের রঙ দেখামাত্র বলে ওঠে, চোদ্দ বছর হয়ে গেল আমি বাদামী রঙের ওষুধ ব্যবহার করছি এবং তাতে একটু উপকারও হয়, কিন্তু এ সাদা ওষুধে আমার কোনো কাজ হবে না। আমাকে বাদামী রঙের ওষুধ দাও।