ভাবতে পারিনি যে হকের দেখা পাব। ঘামে ভেজা কলার আর বিরাট টাই দেখে তাকে ঠিক চেনা যাচ্ছে। তার সাদা চুলে পানামার ছাপ সহজেই চোখে পড়ে। মুখে সস্তা দামের চুরুট। তার দীর্ঘ বাহু প্রসারিত করে এগিয়ে এলেন আমার দিকে–বললেন, নিক, তোমাকে ঠিক একজন দস্যুর মতো দেখাচ্ছে। আমার পাশাপশি হাঁটতে হাঁটতে বলতে থাকেন-হাতে বেশী সময় নেই, ওয়াশিংটন থেকে অনেক নির্দেশ এসেছে। জরুরী কথা আছে। মনে হচ্ছে কিউবাতে অস্ত্রের সংকট দেখা দিয়েছে। আমি মৃদু শিস দিই খুবই উদ্বেগজনক। পাপাডকের হাতের থাবা থেকে কি ভ্যালডেজকে ছিনিয়ে আনা যাবে?
আনতেই হবে? তাছাড়া আরও কিছু কাজ আছে। চাবির গোছাটা হাতে দিয়ে বললেন, তুমি পালাও, মনে হচ্ছে শত্রুরা তোমার হদিশ হারিয়ে ফেলেছে। কোনদিকে যাব?
তুমি গাড়ি চালিয়ে যাও। আমি সব বলব। গাড়ির আয়নার মধ্যে দেখলাম একটি কোর্ড আমাদের অনুসরণ করছে। নিজেকে খুব নিরাপদ মনে হল। হক বললেন, অতটা আশ্বস্ত হয়ো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই কিছু একটা ঘটবে। হকের কথা মতো কোর্ডটাকে পিছনে ফেলে আরনেষ্ট হেমিংওয়ে মিউজিয়াম পার হয়ে ট্ৰপ্যান অ্যাভিনিউ দিয়ে গ্যারিসন বাইটের দিকে চলেছি। পথটা গ্রীন স্ট্রীটে গিয়ে শেষ হয়ে গেল। লাল ফোর্ড গাড়িটা আমাদের পেছনে আর সামনে এম জি মোটরকার। হক কণ্ঠে বিরক্তি ফুটিয়ে বললেন, এতটা যে হবে তিনি ভাবতেও পারেননি। আমাকে নির্দেশ দিলেন চলে আসতে। হঠাৎ আমার মনে হল, হাইতি থেকে সাতশো মাইল দূরে আছি। কখন ভাবেই পারলো উত্তর কোরিয়ানদের সম্পর্কে চিন্তা করতেন। এরপর হক তার পকেট থেকে এক টুকরো পাতলা কাগজ বের করে আমাকে দিয়ে বললে, হাইতি যাবার পথে অবসর সময়ে পড়ে দেখতে, তারপর নষ্ট করে ফেলতে। দেখলাম, টাইপ করা কুড়ি পাতা মতো কাগজ। তিনি ভুডু চার্চের সেই বয়স্কের রাতের পর থেকে ঘটে যাওয়া সমস্ত কাহিনী সংক্ষেপে বলে গেলেন ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগার চেপে। বললেন, মেয়েটার দিকে নজর রেখো। হাইতির লোকেরা ড, ভ্যালডেজকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে চায়। তারা পাপাডককে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছে। কেননা দেশের অভিজাত শ্রেণী তাদের আখ কফির মতো ফেরত পাবার জন্য ভ্যালডেজকে সমর্থন করতে চাইছে। ব্যক্তিগত জীবনে ভ্যালডেজ একজন চিকিৎসক। জানি না, পাঁচ বছরে তিনি চিকিৎসা বিদ্যা ভুলে গেছেন কিনা। তিনি এবার সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন। সম্প্রতি বন থেকে তিনটে সাইন উইণ্ডার রকেট চুরি গেছে। ঐগুলিই মস্কোতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু ওরা মস্কোতে পৌঁছতে পারেনি। ওগুলো আবার চুরি করা হয়। এখন তা হাইতিতে পৌঁছে গেছে। পাপাডকের হাতে সাইনউইণ্ডারের মডেলে তৈরী মিশাইল আছে। তিনি নাকি আণবিক বোমা তৈরি করতে চান। ক্যাসট্রো খবরটা জানেন।
পাপাডকের হাতে মিশাইল থাকলে তিনি ক্যারিবিয়ান দেশকে পায়ের তলায় রাখতে পারবেন। ঘোট ঘোট দেশগুলো নির্বিবাদে তার প্রভুত্ব মেনে নেবে। কলম্বিয়ায় পড়বার সময় ভ্যালডেজ ছিল কমিউনিস্ট। তাই এফ. বি. আই. ও. সি. আই. এ তার ওপর গোপন ফাইল রেখেছে। আমরা তাকে আমেরিকায় ফেরাতে চাইছি না।
প্রশ্ন করলাম, লিডা কি সব জানে?
সম্ভবতঃ না। কারণ সিয়ার সঙ্গে তার পরিচিত এত বেশী নয় যে, সে সমস্ত খবর পাবে। সে শুধু জানে, ভ্যালডেজ হাইতিতে বন্দী আছেন। হয়তো তার নিজস্ব গোপন সংগঠন আছে। সে কালো চামড়ার লোকদের ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে।
কালোরা কি তাকে সাহায্য করেব?
করতেও পারে। কারণ পাপাডকের শাসন এত জঘন্য যে জনগণ ক্ষেপে আছে। তাদের দরকার প্রচণ্ড আন্দোলন।
লিডার পক্ষে তেমন কিছু করা কোন মতেই সম্ভব নয়। নিশ্বাস ফেলে ছাদের দিকে তাকিয়ে হক বললেন, ঠিক আছে, তোমার বক্তব্য মেনে নিলাম কিন্তু মনে রেখো ক্যারিবিয়ান নিথর বেশী সময় দেওয়া যাবে না। কেননা মধ্যপ্রাচ্য ও ভিয়েতনামের সমস্যা আরও জটিল। আরও কিছু প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে ভবিষ্যতে কিভাবে তার সঙ্গে পোর্ট অফ প্রিন্স দেখা হতে পারে তা বললেন। করমর্দন করে হক বললনে, তিনি আমার ফেরার জন্য অপেক্ষা করবেন। ডিঙি নৌকা বেয়ে সী-উইকের দিকে যেতে মনে হলো হকের প্রতীক্ষা যেন সফল হয়।
৭. কিউবান থেকে বাহামা
০৭.
কিউবান থেকে বাহামা চ্যানেলের মধ্যে দিয়ে ছুটতে ছুটতে দক্ষিণ দিকের উইনওয়ার্ডে এগোনো মাত্র ম্যাথুর শহরের এক রাশি ধোঁয়ার সামনে দাঁড়ালাম।
এক্সক্যালিকুর আমার পেছনে ছুটতে লাগল অর বন্দরে পৌঁছনো মাত্র আমার সামনে এসে হাজির হল। সেখানকার লোকেরা আমায় লক্ষ্য করতে লাগল। তখন লিডা একেবারে অনাবৃতা উর্ধাঙ্গে বসে আছে। পি. পি. টমেদের চোখে লোকের ইশারা দেখলাম। আমি খুব অবাক হয়ে গেলাম যে, সে সী-উইচটাকে সে একটা জাহাজের যন্ত্রের মধ্যে রেখেছিল এবং ওয়াশিংটনের খবরে বার করেছিল, এবং যখন খবরটা পড়া হচ্ছিল তখন হকের মুখের কি অবস্থা হয়েছিল এটাই ভাবার ব্যাপার।
এরপর লিডা আমার পাশে এসে দাঁড়াল। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই পরস্পরে জিপে গেলাম। এক্সক্যালিবুরকে তারপর আর দেখা গেল না। বললাম, গুয়াতেমালার দিকে যাব। তারপর সেই স্টেশনে পৌঁছবে, যীশুর নামে শপথ করছি যে, আমি তার সঙ্গে দেখা করব।
পশ্চিমদিকে তখন সূর্য খুব তাড়াতাড়ি ডুবে যাচ্ছিল। এবং চারদিকের গাঢ় লাল, সোনালী রঙগুলো ভিজে যাচ্ছিল। সুমদ্রটা বেশ শান্ত। আফ্রিকা থেকে ঠাণ্ডা বাতাস খুব আস্তে আস্তে আমাদের সামনে দিয়ে চলে গেল।