- বইয়ের নামঃ দি ডেথ গেম
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই
দি ডেথ গেম
একদম সুস্থ ছিলাম না
আমি একদম সুস্থ ছিলাম না, যন্ত্রণাকাতর অবস্থায় ক্রমশঃ মৃত্যুপথযাত্রী হয়ে উঠেছিলাম। অবশেষে বসার আদেশ পেলাম, আমি বুঝতে পারলাম আমার বোধশক্তি সব হারিয়ে গেছে। একটা কথাই আমি শেষ পর্যন্ত পরিষ্কার শুনতে পেয়েছিলাম–দণ্ডাদেশ এসে গেছে–তা মৃত্যুর দণ্ডাদেশ।
তদন্তকারীদের সমস্ত কথাই তারপরে আমার কাছে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে এক নির্দেশহীন, স্বপ্ন ভাবে নিবিষ্ট গুঞ্জনের মতো আমার মধ্যে ঘূর্ণনের ধারণা এনে দিল, চাকা ঘোরার সাথে তার মিলের জন্যই হয়তো।
তবে তা কিছুক্ষণের জন্যই মাত্র, কারণ এরপর থেকে আমি কিছুই শুনতে পাইনি। তবুও ক্ষণকালের জন্যে আমার দেখার শক্তি ছিল–তা যা দেখেছিলাম তাকে খুব ভয়াল অতিশয়োক্তি বলেই ধারণা হবে-কালো জামা পড়া বিচারকদের ঠোঁট নাড়াচাড়া আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার কাছে তাদের ঠোঁট প্রচণ্ড সাদা বলে মনে হচ্ছিল।
–যে কাগজটাতে আমি লিখছি মনে হচ্ছিল তার চেয়েও সাদা,আর অদ্ভুত ধরনের। সিদ্ধান্তেই অনড় সেই অধরোষ্ঠ পাতলা কঠিন আর মানুষকে কষ্ট দেওয়ার প্রতি খুব বেশিমাত্রায় ঘৃণার প্রকাশ তাতে। আমার ভবিষ্যৎ ঠিক হবে যে দণ্ডাদেশের উপর তখনও তা সেই অধরোষ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসছে, এবং ভয়ঙ্কর কথার প্রকাশে যেন জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। সেই সকল ঠোঁটের বিকৃতি আমার চোখ এড়ায়নি যখন আমার নাম উচ্চারিত হচ্ছিল কিন্তু কোনো কথাই আমার কানে ঢুকল না বলে আমি ভয়ে কেঁপে উঠলাম।
ভয়ার্ত প্রলাপের কিছু সময়ে আমি লক্ষ্য করলাম যে-সব কাপড় ঘরের দেওয়ালে আছে সেগুলো খুব আস্তে নড়ে উঠল, যেটা প্রায় দৃষ্টিগোচর হয় না, এরপরে টেবিলের উপরের মোমবাতি সাতটার ওপর আমার চোখ পড়ল। আগে তাদের মনে হয়েছিল দয়ার চিহ্ন হিসেবে, যেন ক্ষীণতনু দেবদূত আমাকে বাঁচাবে। তবে তারপরেই আমার মধ্যে এক ভীষণ আকারের বিভীষিকা জাগ্রত হলো আর সমস্ত শরীর এমন কেঁপে উঠল যেন বিদ্যুৎ-এর ছোঁয়া লেগেছে এবং দেবদূত বলে যাদের মনে হয়েছিল সেগুলো হয়ে পড়ল অর্থছাড়া বিভীষিকা, তাদের মাথায় আগুন।
বোঝা গেল যে, কোনো সাহায্যই ওদের কাছে থেকে পাওয়া যাবে না। পরক্ষণেই অপরূপ গানের মতো আমার মনে হলো, কবরের মাঝে অপরিমেয় শান্তি, আস্তে আস্তে কল্পনাটা গড়ে উঠল আর পুরোপুরি গড়ে উঠতে অনেক সময় নিল। আর যখন পুরোপুরি উপভোগ করতে পারলাম তখন সাথে সাথে বিচার করা ম্যাজিকের মতো উবে গেল। বড় বড় মোমবাতিগুলোর আলোও সব কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল, অন্ধকারের কালিমায় সব জায়গা ঢেকে গেল। মাটির নিচে আত্মার মিলিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সমস্ত অনুভব উমত্ত গতিতে নিম্নমুখী হলো। পরক্ষণেই শুধু নিস্তব্ধতা, নিথরতা, আর সমস্ত পৃথিবী জুড়ে শুধুমাত্র রাত্রি আর রাত্রি।
আমি অজ্ঞান হয়েছিলাম ঠিকই, তবুও আমি বলব আমার সমস্ত অনুভবই হারিয়ে গিয়েছিল। যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তার স্বরূপ প্রকাশের অথবা বর্ণনার চেষ্টা করব না,–বাকি ছিল কিছু কিছু। কিন্তু তা কি গভীর ঘুমের মধ্যে ছিল, না প্রলাপের মধ্যে, না জ্ঞান হারানো অবস্থায়? না, কারণ এমনকি কবরের ভেতরেও যে সবকিছুই উধাও হয়ে যায় তাও নয়, কারণ তা হলে মানুষের অমরত্ব বলে কিছু অবশিষ্ট থাকতো না। গভীর ঘুম থেকে উঠে আমরা কোনো স্বপ্নের সুতাতন্তু বিচ্ছিন্ন করি। আর পরক্ষণেই, সেই তন্তু যত ক্ষুদ্রই হোক, মনে হয় না যে স্বপ্ন দেখছিলাম। জ্ঞান হারাবার পর সংবিৎ ফিরে আসার পথে দুটো ধাপ আছে: এক– মানসিক বা আত্মিক, এবং দুই-দৈহিক। দুনম্বর ধাপে পৌঁছে যদি আমরা আগের ধাপের স্মৃতি স্মরণে রাখি তাহলে দেখবো এইসব স্মৃতি ওপারের স্মৃতিতে মধুর হয়ে আছে। তবে কী সেই স্মৃতি? কবরের স্মৃতি থেকে আমরা এই স্মৃতিকে কিভাবে আলাদা করে রাখব? প্রথম ধাপ বলে যাকে নাম দেওয়া হয়েছে তার স্মৃতি যদি অনেক দিন মনে না করা হয় তবে দীর্ঘদিন পরেও তখন তারা অনাহূত হয়েও স্মরণে আসে, আশ্চর্য হই তখন।
যে ব্যক্তি কখনও জ্ঞান হারায়নি তার চোখে কি জ্বলন্ত কয়লার মাঝে অদ্ভুত অদ্ভুত হৰ্ম আর ভুলে যাওয়া মানুষের ছবি প্রস্ফুটিত হয় না, শূন্য আকাশে সবকিছুই তার চোখে ধরা পড়ে, যা অন্য লোকে দেখতে পায় না? জানা নেই এমন ফুলের গন্ধ কি মনে পড়ে না, যে সকল গানের ছন্দ পূর্বে মনকে নাড়া দেয়নি তার প্রভাব কি তখন মস্তিষ্ককে তোলপাড় করে তোলে না?
আপাতদৃষ্টিতে যা অস্তিত্বহীন তার মধ্যে নিমজ্জিত আত্মার কিছু চিহ্ন মনে আনার চেষ্টার সময় কিছু কিছু সময় ফুটে ওঠে যখন সাফল্যের স্বপ্ন ফুটে ওঠে, অস্পষ্ট মনে হয় অতি অল্প সময়ের জন্যে, কিছু বিশাল আকৃতির মূর্তি নিস্তব্ধে আমাকে কোন পাতালে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। আতঙ্কের প্রকাশ তাতে কিন্তু তা অস্পষ্ট, হৃৎপিণ্ডের অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা যার কারণ, কিছুক্ষণ পরেই হঠাৎ সমস্ত কিছুর মাঝে এক স্থায়ীত্ব এসে পড়ে। মনে হয়, যারা আমাকে নিয়ে এসেছিল বয়ে তারা নামতে নামতে অবনমনের কোন অতলে পৌঁছে ক্লান্তি বিনোদনের জন্য সেখানে স্তব্ধ হয়েছে। তারপরেই মনে পড়ে শুধু উন্মত্ততা নিষেধিত বস্তুগুলির মাঝে চলাফেরা।