ঘাতকরা পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেল। এলোমেলো বুলেট ছুটছে। স্টিলেটোর অস্তিত্ব অনুভব করলাম সেই মুহূর্তে।
কালো মেয়েটি ছাগলটাকে নিয়ে পালাতে চাইছে। কালো মেয়েটির ঘন চোখে জন্তুর সোনালী চোখের ছায়া কাঁপছে। মেয়েটির মুখে এঁটো পাতা, সে পাতা চিবিয়ে জন্তুটার বুকে তার ঠোঁট রাখল।
সামনে বেদী দেখতে পেলাম। বেদীটার পেছনে খোলা দরজা। লিডা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, খুব তাড়াতাড়ি না হলেও যে কোন সময়ে পুলিশ এসে যেতে পারে। অন্ধের মতো সিঁড়ি দিয়ে নেমে লিডাকে অনুসরণ করে চলেছি। যদি হক এখানে থাকতেন তাহলে তিনি তার প্রশ্নের জবাব পেয়ে যেতেন। ব্রডওয়ে স্টেশনে এসে আমি সাবওয়ে ট্রেনের কিছুটা দুরে সেই কাঁপুনির শব্দ পেলাম। লিডা হেসে বলল–নিক, তাড়াতাড়ি এস। আমরা যখন ছুটতে আরম্ভ করলাম তখন সাবওয়েটা ভীড়ে ভর্তি। লিজার যৌবনাবতী উরু ঝলসাচ্ছে, মিনি স্কার্টে তার শরীর বিকশিত। লিডা প্রশ্ন করল, আমার দিকে তাকাতে কেমন লাগছে বলতো? কোন জবাব দিতে পারলাম না। প্রায় আধঘণ্টা ছুটতে ছুটতে টপসাইডে পৌঁছলাম। পৌঁছে বুঝলাম আমরা তখন বেশ কিছুটা নিরাপদ। আমার শেষ লক্ষ্য ছিল ওয়েস্ট এণ্ড এভিনিউ। তার আগেই আমরা ৮৪নং হ্যামস্টারডাম-এ থাকা করেছিলাম। তখন মোটর মালিক ছিলেন বুলান, এখন আমরা নিউইয়র্কে ছুটছি।
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি। এলিভেটারে উঠে একটু আলো দেখতে পেলাম। রাতের অস্বাভাবিকতার মধ্যে এমনভাবে শুরু বা শেষ হলো আমাদের নেশ অভিসার। রাত মাত্র এগারোটা। লিডা আর আমি হাঁটতে হাঁটতে এক কোণে এলাম। বললাম–একটা জায়গায় বসে আমরা বেশ কিছু সময় ধরে নানা জিনিস নিয়ে কথা বলব। রাস্তার নিয়নের আলো এসে আমাদের উপরে পড়ল। লিডার নাকের ডগাটা কাঁপতে লাগল, গভীর চিন্তিত দেখাল তাকে।
৭৯তম স্ট্রীট স্টেশন অভিমুখী পাতাল রেলের শব্দে ফুটপাত কেঁপে উঠল।
লিডা ও আমি দুজনের অপরিচিত ছিলাম। সেইদিন সন্ধ্যেবেলা মারা যাবার কয়েক ঘণ্টা আগে স্টেভ বেনেট আমাদের আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। লিডার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। লিডা তখন আমার মনটাকে বেশ বুঝে নিয়েছে। আমার হাত ধরল লিডা, উদ্বেগ কণ্ঠে আহ্বান জানাল নদীর কাছে গিয়ে নিজের হৃদয়ে উন্মোচন করবে বলে। আমরা ওয়েষ্ট এণ্ড পার হয়ে ড্রাইভের দিকে হাঁটতে লাগলাম। লিডা বলল, স্টেভ বেনেট যে তাদের লম্বাভাবে সাহায্য করেছে সে আর নেই। হঠাৎ থেমে গিয়ে পেছনে ঘুরে লিডা ফেলে আসা রাস্তাটা দেখতে লাগল। হাতের আঙ্গুলে ঠোঁট স্পর্শ করে লিডা আমার খুব কাছে চলে এল। তার চোখ দুটো তখন জলে ভরা। আমি ওর হাতটা নিজের হাতে নিলাম। বললাম–তুমি কি আমার ফ্ল্যাটে যাবে, না অন্য কোথাও? নিজেকে বড় অসহায় বলে মনে হল। জিজ্ঞেস করলাম সে কি কোন রাস্তা খুঁজে পেয়েছে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে লিডা বলল–সে আমায় বিশ্বাস করে। তার যৌবন ও সম্পত্তি বিপদের মুখে। আমি তাকে এ অবস্থায় সাহায্য করব কিনা। আমি বললাম, তুমি কখনোই মেয়ে হয়ে তোমার বুঝে উঠতে পারবে না। কিন্তু ওরা তো তোমাকে কালো রাজহংসী বলে ডাকে। তাই না? নীরবে চোখে জল নিয়ে তাকিয়ে রইল লিডা। বললাম, আমি তাকে এখানে একলা রেখে চলে যাব। যদি সে আমাকে সাহায্য করতে না চায় তবে আমি তাকে জোর করে কিছু করাতে চাই না। ভাবলাম, তাকে আমার ফ্ল্যাটে নিয়ে গেলে অপহরণের দায়ে পড়তে পারি। কারণ ওকে ঘরে রাখার তো আমার কোন আইন ছিল না।
ছুটে এসে লিডা বলল, আমি যেন তাকে ফেলে না যাই। প্রশ্ন করলাম–লিডা কোথায় যাবে? লিডা জানল-৭৯নং বেসিনে তার একটা বোট আছে। যদি টলটন মাকাউট বোটটার সন্ধান পায় তাহলে বিপদের শেষ থাকবে না।
হককে ফোন করে একটা বোট জোগাড় করে নিরাপদেই যাত্রা আরম্ভ করলাম। আমার ভয় হচ্ছিল বেনেট, হক, সি আই এ কেউই বোট সম্পর্কে কিছু বলেনি। মনে হলো লিডা খুব চালাক। আবার মনে হলো এ এক অন্তবিহীন নৌকা ভ্রমণে রহস্যময়ী লিডা আমার সঙ্গিনী।
.
০৩.
সী-উইচ একটা পেমব্রোক, যার উচ্চতা প্রায় ৫৭ ফুট। একশো ফুট-দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বোটটার দিকে তাকিয়ে তার শান্ত সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করলাম, বুঝলাম এটি অভিজাত জাহাজ।
ঠাকুরে ডিঙিতে যেখানে সী-উইচ নীল রঙের দাগ কাটা অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল সেখানে পৌঁছলাম। তীরের খুব কাছেই দুটো হাউসবোট, একটা কালো রঙের দুই মাস্তুলওলা জাহাজ দাঁড়িয়ে।
লিডা খুব আস্তে আস্তে জাহাজের পিছনে গিয়ে বসল। বলল, এর আসল নাম টৌসিয়ান্ট, নামটা পুরোনো বলে বদলে দিয়েছে। তারপর লিডা আমাকে খুব বিশ্বাস করতে লাগল, আমি তার সঙ্গে এমন ভাবে আচরণ করতে লাগলাম যাতে তাকে মানিয়ে দিলাম সে ইংরেজী তার মাতৃভাষা নয়? লিডার অপটু উচ্চারণ, ভুল শব্দের প্রয়োগ আর অকারণ কুণ্ঠা আমার আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করল।
এইভাবে কথায় কথায় ওর সম্পর্কে বেশ কিছুটা জানতে পারলাম, শুনলাম যে সে একজন হাইতি মেয়ে ও তার বাবা কোন ইউরোপীয়। মানলাম সে পাপাডকের মেয়ে। বয়েস তার পঁচিশের নীচে, তাকে নিরীক্ষণ করতে হবে এবং তার সঙ্গে কাজ করতে হবে–সেটাই আমার প্রতি শিয়ার আদেশ। বড় একটা জাহাজের পাশে আমরা এলাম। সে সিঁড়ি দিয়ে উঠল। সে বলল মাথাটাকে এখনি একটি নিরাপদ আশ্রয় নিয়ে যেতে হবে। লিডার প্রতি আকর্ষণ বোধ করলাম। যতক্ষণ না সে একটু সহজ হয় ততক্ষণ আমি কোন জায়গায় যাব না বা তার সঙ্গে কোন কথাও বলতে পারব না।