আমার হিসেব সম্পূর্ণ নির্ভুল ছিল আর যে কষ্ট সহ্য করেছি তাও আমার ব্যর্থ যায়নি। আর কিছু না হোক, এখন আমি সম্পূর্ণ মুক্ত; আমার দেহটা যে কাপড়ে ঢাকা তা খণ্ড খণ্ড হয়ে গেছে, আবার দুবার নেমে এলো দোলকটা, প্রত্যেকটা গ্রন্থিতে যন্ত্রণার তীব্রতার অনুভূতি হলো। তবুও মুক্তির সময়টা এসে গেল, হাত নাড়াচড়া করতেই ইঁদুরটা তাড়াতাড়ি করে পালিয়ে গেলো। খুব আস্তে আস্তে আমি বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে দোলকের পরিধি ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে এখন আমি মুক্তি পেলাম।
ভয়ের সেই বিছানা থেকে পাথরের মেঝেতে পা দিতে না দিতে দেখলাম ঐ বিশাল আকৃতির দোলকটার দোলা বন্ধ হয়েছে, সেটা টেনে ছাদের ভেতর দিয়ে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। কোন এক অদৃশ্য শক্তি। আমার সমস্ত নাড়াচাড়ারও যে দৃষ্টি আছে তা বুঝতে কোনই অসুবিধা হলো না। আমি এই ধরনের মৃত্যু থেকে যে মুক্তি পেলাম তা নিঃসন্দেহে বলা যায়, তাহলেও অন্য কোনো অথবা এর থেকে বীভৎস যন্ত্রণার মৃত্যু আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। চারদিকে কিছুটা ভয়ে ভয়েই তাকালাম, একটা অস্বাভাবিক পরিবর্তন দৃষ্টিতে এল, যা এতক্ষণ আমার কাছে স্পষ্ট ছিল না এবং তার অর্থ আমি এতক্ষণ বুঝতে পারিনি, এই প্রথম সেই আলোের আসল রূপটি উপলব্ধি করতে পারলাম। প্রত্যেকটা দেওয়ালের নিচে আধ ইঞ্চি পরিমাণ ফাঁকা দিয়ে এই আলো আসছে। কিন্তু উঁকি মেরে কিছু দৃষ্টিগোচর হলো না।
সেখান থেকে ওঠার পরে সেই রূপান্তরের রহস্য আমার সামনে প্রকাশ পেল। দেখলাম দেওয়ালের যে সব দৃশ্যগুলো আবছা ছিল এখন সেগুলো খুবই স্পষ্টভাবে দেখা দিচ্ছে, যে সব বীভৎস ভয়ার্ত সিনারি ঐ ফটোতে দেখা যাচ্ছে তা আমার চেয়ে শক্তিমান স্নায়ুর অধিকারীকে কাঁপানোর জন্যে যথেষ্ট। অগুন্তি বীভৎস দৈত্যের ছবি সেই দেওয়ালে যেরকম ফুটে উঠছে সেগুলি বাস্তব বলেই ধরতে হবে।
অবাস্তব? আমার নাক যে গরম লোহার গন্ধ পাচ্ছে তাও নিশ্চয়ই অবাস্তব,–সেই ঘ্রাণে দম আটকে আসার উপক্রম। যে সমস্ত ছবি আমার অসহায় অবস্থা প্রত্যক্ষ করছে, তাদের চোখ আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। রক্তপাতময় ভয়ঙ্কর দৃশ্যে রক্তে রঙের মাত্রাও চোখে পড়লো। শ্বাস নিতে পারছি না, হাঁপাচ্ছি। বুঝলাম ওদেরই পরিকল্পনা। ওঃ কী মর্মান্তিক, কী বীভৎস শয়তানি। দেওয়ালের তাপ থেকে সরে আমি ঘরের মাঝখানে চলে যেতে বাধ্য হলাম, তাপে পুড়ে যাওয়ার থেকে কুঁয়োর ঠান্ডা ভাবই আমার কাছে ভালো লাগলো। কুঁয়োর কাছে তাড়াতাড়ি করে গেলাম। নিচের দিকে তাকালাম। ছাদের থেকে যে তাপের ঝলকানি নেমে এলো তাতে কূপের ভেতর পর্যন্ত স্বচ্ছ লাগছে। যা দৃষ্টিগোচরে এলো তার অর্থ বুঝতে কিছুক্ষণের জন্য আমি স্বীকার করলাম না। অবশেষে তবে মানতেই হলো, সেই অনুভব আমার হৃদয়ের অন্তঃস্থলে পৌঁছে কাঁপুনির সঞ্চার করলো। হায়, আমি কথা হারিয়ে ফেলেছি। কি মর্মন্তুদ আতঙ্ক–যে কোনো ভয়ঙ্কর আতঙ্ক এর থেকে আশাপ্রদ। তীব্র চিৎকার করে আমি কুয়োর মুখ থেকে দুহাতে মুখ ঢেকে সরে এলাম, অসহ্য কান্নায় চোখ ভাসিয়ে।
গরম ক্রমশঃ বেড়ে চলেছে–আবার একবার মুখ তুলে তাকালাম, কাঁপতে কাঁপতে জরাগ্রস্তের মত। গর্তের মধ্যে আবার একটা রূপান্তর এসেছে, এবারকার রূপান্তর আকারগত। এবারও আমি আগের বারের মতো বুঝতে পারিনি কী ঘটনা ঘটতে চলেছে। কিন্তু বেশি সময় লাগল না বুঝতে। দুবার রক্ষা পেয়ে যাওয়ায় ওদের প্রতিশোধ নেবার আকাঙ্ক্ষা খুবই বেড়ে গেছে। তারা এবার আর এ ধরনের খেলা নিয়ে ব্যস্ত নয়। সমচতুষ্কোণ ছিল ঘরটা, এখন দৃষ্টি গেল তার দুটো কোনো সমকোণের থেকে সরু হয়ে গেছে, অন্য দুটো সমকোণের চেয়ে বড় হয়ে গেছে। কিন্তু ক্রমশই কোণগুলোর এই পার্থক্য বেড়ে যেতে লাগলো। তার সাথে সাথে একটা ক্ষীণ আওয়াজ কানে ঢুকলো আর অল্পক্ষণের মধ্যে ঘরটা একটা লনের আকৃতি ধারণ করলো। তবে তা এখানেই শেষ না, আর আমি তা চাইওনি। লাল টকটকে দেওয়ালটাকে আমি প্রচণ্ড শান্তির আস্তরণের মতো চেপে ধরতে পারতাম। নিজের মনেই ভাবলাম, ঐ গর্তে পড়ে মৃত্যুর চেয়ে যে কোন বীভৎস মৃত্যুও ভালো। বোকা, বোকা আমি! আমার বোঝা কি উচিত ছিল না, যে ওদের লক্ষ্যই হলো আমাকে বাধ্য করা ঐ গর্তে পড়তে, এই উত্তাপ আর চাপ সহ্য করা কি আমার পক্ষে অসম্ভব হবে? সেই লনের আকার এখন এমন তাড়াতাড়ি চ্যাপ্টা হতে থাকলো যে আমি আর চিন্তা করতে পারলাম না। এর মধ্যিখানটা, যা সবচেয়ে চওড়া, তা ঠিক গর্তের ব্যাদিত মুখ পর্যন্ত চলে গেলো। গুটিয়ে গেলাম আমি, তবে দেওয়ালগুলো ক্রমেই ছোট হতে হতে ভীষণ ক্ষমাহীন ভাবে আমাকে চাপ দিতে চাইলো, অবশেষে একটা অদ্ভুত অবস্থার সৃষ্টি হলো যে, পা দেওয়ার পর্যন্ত এক ইঞ্চি জায়গাও রইল না। পুনরায় আর চেষ্টা করলাম না। নিরাশার তীব্র, দীর্ঘ, শেষ আর্ত চিৎকারে আর যন্ত্রণা প্রকাশ পেল। বুঝতে পারলাম আমি গর্তের মুখে গিয়ে টলছি–আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
আমার কানে মানুষের গলার আওয়াজ সুরহীন হয়ে একই সাথে যেন অনেকগুলো তুরী, ভেরী বেজে উঠলো, হাজারটা বিদ্যুৎ গর্জন করে উঠলো, আগুনে নিমগ্ন দেওয়ালগুলো পিছনে সরে যেতে শুরু করলো। আমি অজ্ঞান হয়ে গর্তের মধ্যে পড়ে যাচ্ছিলাম, একটা হাত আমাকে আঁকড়ে ধরলো। এই হাত জেনারেল লাসেনের ফার্সি ফৌজ টলেডোয় ঢুকেছে, তারা জয়যুক্ত হয়েছে।