আর কিছুক্ষণ সময় কেটে গেলো পুরোপুরি অসাড় অবস্থায়। কিন্তু বেশি সময় কাটেনি কারণ এর সাথে দোলকটার নেমে আসা অনুভব করার মতো হয়নি। তবে একথা খুব জোর দিয়ে বলা যায় না, হয়তো শয়তানরা আমাকে জ্ঞানহারা অবস্থায় দেখে দোলকের গতি কমিয়ে এনেছিল, হয়তো তারা চায় না যে, জ্ঞানহীন অবস্থাতেই আমার দেহ খণ্ডিত হয়ে যায়, তবে তো সে কষ্টের আশু উপশম হবে। জ্ঞান ফিরে এলেও আমি কত যে দুর্বল বোধ করছিলাম তা বলা সম্ভব নয়। অনেকদিন ধরে নিশ্চেষ্ট থাকার জন্যই এই দুর্বলতার সৃষ্টি। সেই অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যেও শুধুমাত্র নিজের দেহের প্রয়োজনেই খাবারের আশায় ছিলাম। বাঁ হাতটা যতটা সম্ভব বাড়িয়ে দিয়ে ইঁদুরদের খাবার পর যতটুকু খাবার বেঁচেছিল তাই তুলে নিলাম। সেই খাবারটা খেতে যাব ঠিক সেইসময় আশার একটা আলো আমার মধ্যে ছুটে এলো। তবে কেন যে আমার মধ্যে আশার উদ্বেগ হবে? এধরনের আশার আলো প্রায় সময়ই মানুষের মধ্যে জেগে ওঠে, তবে তা কিন্তু কোনোদিন বাস্তবায়িত হয় না। আমার মনে হলো তা আশা ও আনন্দের আর সেইসাথে আমি বুঝতে পারলাম যে তা দূর হয়ে গেছে। আবার সেই অনুভূতিকে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করলাম কিন্তু ব্যর্থ হলাম। আমার মনের জোর অনেক কমে গেছে, শুয়ে শুয়ে আমি একেবারে কর্মহীন হয়ে পড়েছি।
আমার দেহের কোণাকুণি ভাবে দোলকটা নেমে আসছে। বুঝতে পারলাম সেটা যেভাবে নিম্নে ধাবমান হচ্ছে যে তা আমার হৃৎপিণ্ডকে খণ্ডিত করবে। সর্বপ্রথমে পোশাকটা কাটবে তারপর পুনরায় কাটবে কাটতেই থাকবে। প্রায় ত্রিশ ফুট জায়গা ঘিরে হিসহিস শব্দ করে দোলকটা দুলছে। এই ঘরের দেওয়ালের লোহার পাত কাটারও শক্তি আছে তার, তবুও বেশ কিছুক্ষণ ধরে ঐ দোলকটা শুধুমাত্র আমার পোশাকটাই ছিঁড়বে। এত অবধি আসার পর আমার চিন্তা ভাবনা আর এগোলো না।–এই চিন্তা থেকে মনটা সরালেই দোলকটার নেমে আসা বন্ধ হবে। দোলকটা আঘাত করলে যখন আমার পোশাক ছিঁড়ে যাবে তখন শব্দটা কিরকম হবে তা চিন্তা করার চেষ্টা করলাম। দাঁতে দাঁত চেপে সমস্ত কথা ভাবছি।
আস্তে আস্তে দোলকটা নামছে নামছে। তার নেমে আসা আবার ওঠার এই দুটোর তুলনা করে এক উন্মত্ত আনন্দ আমার মনে জাগ্রত হলো। বাঁ দিক ডান দিকে সেটা দুলছে এবং অভিশপ্ত প্রেতাত্মার মতো তা আওয়াজ করছে, আর কোনো শব্দ না করেই বাঘের মতো চুপিচুপি তা নেমে আসছে।
দোলকের গতিকে প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না, তা নামছেনামছে। আমার বুকের তিন ইঞ্চির মধ্যে এসে তা কাঁপছে। খুবই প্রচেষ্ট হলাম দুটো হাত বন্ধনমুক্ত করতে,–শুধুমাত্র তা কনুই পর্যন্তই খোলা ছিল। যাতে প্রচণ্ড চেষ্টার পর আমি হাতটা মুখ পর্যন্ত আনতে পারি, এর বেশি না। কিন্তু দোলকটার দোলন আমি থামাতে পারতাম যদি কুনুইয়ের ওপর দিককার বাঁধন খুলতে পারতাম,–তবে হিমানীপ্রপাত রোধেরই মতো সে চেষ্টা হতো।
অমোঘভাবে দুলতে দুলতে নেমে আসছে ক্রমশঃ নামছে। দোলার সাথে সাথে আমি হাঁপাচ্ছি। একেবারে গুটিয়ে যাচ্ছি, থরথরিয়ে কাঁপছি, এবং যখন নেমে আসছে তখনই প্রচণ্ড ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলছি–অবশ্য মৃত্যুকে কিন্তু আমি যথেষ্ট আহ্বান করছি।
বুঝতে পারলাম আর দশ বারো হাত নেমে এলেই দোলকটা আমার পোশাককে ছুঁতে পারবে। সাথে সাথে আচমকা একটা হতাশাগ্রস্ত শান্তিতে আমার মন ভরে উঠলো। অনেকদিন পরে–অনেক সময় পরে আমার চিন্তা করার শক্তি ফিরে এলো। বুঝলাম যেভাবে আমি বাঁধা আছি তার একটা বৈশিষ্ট্য হলো যে, আলাদা আলাদা দড়িতে আমি বাঁধা নেই, একটা দড়ি দিয়েই পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধা। দোলকের প্রথম আঘাতটাতেই তা ছিঁড়ে যাবে ফলে তখন আমার কাছে বাঁ হাতের দ্বারা মুক্তি পাওয়া সহজ হবে। তবে পুনরায় দোলকের ফিরে আসার মধ্যে কি আমার মুক্তি পাওয়া সম্ভব হবে? তবে পরক্ষণেই দেখলাম যে বুকের ঠিক যে স্থানে দোলকটা পড়বে সেখানে কোনো বাঁধন নেই। ফলে সেই আশাও ফলপ্রসূ হলো না।
মনটা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়লো। মাথাটা নামিয়ে নিলাম।
আমি যে স্থানে শুয়ে আছি সেখানে অনেক উঁদুর। তারা বন্য যেমন তেমনি সাহসীও। আর ঠিক তেমনই ক্ষুধার্ত। লাল চোখ মেলে তারা আমাকে দেখছে, আমার নড়াচড়া কখন স্তব্ধ হবে তার জন্যেই যেন অপেক্ষারত, আর সেই সময়েই আমি তাদের শিকারে পরিণত হব। তবে এখানে ওরা কি খাবার পায়?
আমার যথেষ্ট সাবধানতা সত্ত্বেও তারা আমার ডিসের মাংস খেয়ে খেয়ে খুব সামান্যই আমার জন্য রেখেছে। ইঁদুর তাড়াবার জন্য সবসময় হাত নাড়ান আমার অভ্যাস হয়ে গেছিল। আমার কাছ থেকে এভাবে বাধা পেয়ে মাঝে মধ্যেই ইঁদুররা আমার আঙুলে দাঁত বসিয়ে দিত।
মাংসের যে তেল তেল ঝোল অবশিষ্ট ছিল তা নিয়ে দড়ির যেখানে যেখানে হাত গেলো লাগাতে থাকতাম, এরপরে দম বন্ধ করে মাথা তুলে শুয়ে রইলাম।
এ ধরনের পরিবর্তন দেখে ইঁদুররা প্রথমে চমকে উঠেছিল–ভীতও হয়েছিল–নাড়াচড়া করছে না কেন লোকটা? তারা পেছনে সরে গেল, আবার অনেকে ছায়া দিয়ে নেমে গেলো। তবে ক্ষণকালের জন্যে,–আমি দেখছিলাম ওরা কতটা খাবার সম্বন্ধে লোভী। আমাকে নিথর ভাবে থাকতে দেখে দুটো-একটা ইঁদুর আমার বিছানায় উঠে এসেছিল, তারা গন্ধ নেবার চেষ্টা করলো। এটা মনে হয় কোনো কিছুর সঙ্কেত, কারণ সাথে সাথে দলে দলে ইঁদুর ছুটে এলো। তারা আমার ওপরে শয়ে শয়ে ঝাঁপ দিলো। দোলকের দোলন তাদের বাধা সৃষ্টি করলো না। আমার ঠোঁটে, শরীরে পর্যন্ত তারা মুখ দিল, আমার দম আটকে যাবার মতো অবস্থা হলো তাদের চাপে। ঘিন ঘিন করতে লাগল গা, ঠান্ডা হয়ে গেলো বুক। তবে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার সমস্ত চেষ্টার অবসান হবে কারণ বাঁধন থেকে আমি মুক্ত হয়ে যাচ্ছি তা আমি বুঝতে পারছিলাম। মনে হয় দু-এক জায়গায় তা কেটেও গেছে। প্রচণ্ড মানবসুলভ প্রচেষ্টায় আমি নিশ্চুপ হয়ে রইলাম।