ঘরটার আকার সম্পর্কেও আমার ভুল ধারণা ছিল। আন্দাজে আন্দাজে দেওয়ালের যে সব জায়গা আমার কোণ বলে মনে হয়েছিল আদপে সেগুলো কোণ না, দেওয়ালের কয়েকটা খাঁজ বা কুলুঙ্গি; ঘরটা আসলে সম-চুতুষ্কোণই। ঘরের দেওয়াল পাথরের তৈরি নয়, লোহা অথবা অন্য কোন ধাতু দিয়ে তৈরি, যেখানে যেখানে জোড় ছিল আমার সেগুলোকে কোণ বলে মনে হয়েছিল। ধর্মোন্মাদদের আঁকা দেওয়ালে সমস্ত ভয়ঙ্কর দৃশ্য সেই সব ছবি কঙ্কাল, পিশাচ, শয়তান ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের। রঙ উঠে গেলেও এইসব দৃশ্যে দেহরেখা কিন্তু স্বচ্ছ। এতক্ষণ বাদে মেঝের দিকে দৃষ্টি পড়ল, সেটাও পাথরের, ঘরের মাঝখানে সেই গর্ত যার দেওয়াল থেকে অবশেষে আমি রক্ষা পেয়েছি। কিন্তু একটিই গর্ত ঐ কয়েদখানার।
যা দৃষ্টিগোছের এলো তা সবই অস্পষ্ট আর অনেক চেষ্টার পরেই তা দেখেছিলাম, কারণ ঐ ঘুমের ফলে আমার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছিল, আমি এখন লম্বালম্বিভাবে পিঠে ভর দিয়ে শুয়ে আছি, চামড়ার ফিতে দিয়ে খুব শক্ত করে একটা নিচু ফ্রেমের মধ্যে বাঁধা অবস্থায়। খুব শক্তপোক্ত ভাবেই বাঁধা, আমার মাথা আর বাঁ বাহুর একটা অংশ শুধু বাঁধা নেই কারণ যাতে আমি খুব চেষ্টা করে পাশেই রেখে দেওয়া মাটির পাত্রের খাবারটা খেতে পারি। আর প্রচণ্ড ভয়ের সঙ্গে দেখলাম জলের পাত্রটা আর নেই কিন্তু প্রচণ্ড তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। আমাকে যে মাংস খেতে দেওয়া হয়েছিল তা রান্না করা হয়েছিল এমন করে যাতে জলের তৃষ্ণা খুব ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে আর আমি যেন এই তৃষ্ণাকে ভালো ভাবে অনুভব করি।
কয়েদখানার ছাদের দিকে মুখ তুলে তাকালাম। ত্রিশ থেকে চল্লিশ ফুটের মতো তার উচ্চতা, দেওয়ালগুলোর মতো করেই সেটা তৈরি। আমার সব মনোযোগ আকর্ষণ করলো তার প্যানেলের একটা ছবি। মহাকালের ছবিটা, যেভাবে তার ছবি অঙ্কিত এটা সেই একইভাবে আঁকা–পার্থক্য শুধু এই যে, প্রথম দেখাতেই তার হাতে কাস্তের পরিবর্তে একটা বিরাট দোলক। পুরানো আমলের ঘড়িতে যে রকম দোলক থাকত, এমন একটা জিনিষ ছিল তার গঠনে। সেই জন্যেই আমি খুব গুরুত্ব দিয়ে সেই বস্তুটা দেখতে লাগলাম, আমার মনে হলো সোজা সেটার দিকে তাকিয়ে যেন তা নড়ছে (সেটা আমার ঠিক উপরে ছিল) আর পরক্ষণেই তা সত্যি প্রমাণ পেল। অত্যন্ত আস্তে আস্তে অনেক সময় ধরে সেটা নড়ছিল। কিছুটা ভীত কিন্তু তার থেকেও প্রচুর বিস্ময় নিয়ে আমি কিছু সময় সেটা দেখলাম বটে। তার এই আস্তে আস্তে নড়াচড়া ভাব দেখে ক্লান্তিতে আমি শেষ পর্যন্ত চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
একটা অস্পষ্ট শব্দ আমার মনোযোগ আকর্ষণ করলো। দেখলাম মেঝেতে অনেকগুলো ধেড়ে ইঁদুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। কুঁয়োর ভেতর থেকে ইঁদুরগুলো বেরিয়ে এসেছে। আমার ডানদিকেই কুঁয়োটা একেবারে দৃষ্টিসীমার মধ্যেই। তারা লোভী দৃষ্টিতে সেই অবস্থাতেই আমার চোখের সামনে এগিয়ে এলো। মাংসের লোভেই তারা এগিয়েছে। অনেক চেষ্টা করার পর তবেই তাদের তাড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব হলো।
উপরে পুনরায় যখন চোখ ফেরালাম তার মাঝে আধঘণ্টা হয়তো-বা এক ঘণ্টা কেটে গেছে (সঠিক সময় সম্পর্কে ধারণা করা যায়নি)। যা দৃষ্টিগোচর হলো তাতে আশ্চর্য হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। সম্ভবতঃ এক গজের মতো জায়গা নিয়ে দোলকটার দোলন যাচ্ছে আর স্বাভাবিকভাবেই তার গতিও বেড়েছে। যা দেখে বিশেষভাবে অস্বস্তিবোধ করলাম তা হলো, সেই দোলকটা ক্রমশঃ নিচের দিকে নেমে আসছে। অসম্ভব ভয়ের সঙ্গে দেখলাম, দোলকটার নিচের দিকটা ঝলমলে ইস্পাতের তৈরী, প্রায় এক ফুটের মতো দূরত্ব হবে দুপ্রান্তের। সেই দোলকের প্রান্তভাগ ক্ষুরধার। প্রচণ্ড ভারী একটা পেলের পাতের সাথে সেটা দুলছে। দোলার জন্যে একটা হিসহিস শব্দ হচ্ছে।
যন্ত্রণা কষ্ট দেবার জন্য ধর্মোন্মাদরা যে এক নতুনত্ব পথ বেছে নিয়েছে সে সম্পর্কে আমার কোন সন্দেহ নেই। গর্তটা যে আমি দেখেছি তা তারা জেনে গেছে,-যে গর্তের ভয়ার্ততাই আমার ভাগ্যলিপি, লোকমুখে যে গর্তটি নরকের চিহ্ন বহন করে আর শাস্তির চরম উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। যথেষ্ট ভাগ্যের শক্তিতে তাদের এই মতলব ছিল না যে, আমাকে সেখানে ঠেলে ফেলে দেবে, অত্যন্ত হাল্কা ব্যবস্থাই ছিল আমার মৃত্যুর জন্যে; হা হাল্কাই বলা যায়, সেই ভারাক্রান্ত মনেও এই কথাটা মনে হওয়াতে আমার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো।
ইস্পাতনির্মিত সেই দোলকের দোলা শুনতে শুনতে যে ভীষণ ভয়ের মধ্যে দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাকে কাটাতে হয়েছিল তা সহ্য করা যে কোনো মানুষের কাছেই সম্ভব ছিল না বলেই মনে হয় তবে তার বিস্তৃত বর্ণনা দিয়ে কী লাভ? সেটা নিচের এক ইঞ্চির মতো নেমে আসছে, আর তার নামার সময়টা আমার কাছে যেন অনন্তকাল বলে মনে হচ্ছে। তবে তার নিয়ম অনুযায়ীই তা নেমে আসছে। একের পর এক দিন কেটে গেল অবশেষে আমার মনে হলো যে দোলকটার দোলার হাওয়াও যেন আমি বুঝতে পারছি, তীক্ষ্ণ ইস্পাতের গন্ধও আমি পেলাম। ভগবানকে আমি বারবার প্রার্থনা করতে লাগলাম যাতে সেটা তাড়াতাড়ি নেমে আসে। পাগলের মতো হয়ে গেলাম আমি, উঁচু হয়ে চেষ্টা করতে লাগলাম ঐ ভীষণ আকৃতির অস্ত্রের ছোঁয়া অনুভব করতে। সেই উজ্জ্বল মৃত্যুর নিচে শুয়ে হাসতে শুরু করলাম এমনভাবে যেন কোনো শিশু কোনো দুষ্প্রাপ্য ছবি দেখছে।