ঘুম থেকে যখন উঠলাম। হাত বাড়িয়ে পাশে একখানা রুটি আর এক কলসি জল দেখতে পেলাম। তখনকার অবস্থা সম্বন্ধে ভাবনা চিন্তা কবার সময় ছিল না, লোভীর মতো খেতে শুরু করলাম। বেশ কিছু সময় পরে আবার পায়চারি শুরু করলাম। কয়েদখানা ঘিরে আর অনেকক্ষণ কসরৎ করার পর পুনরায় পোশাকের টুকরোটা পেয়ে গেলাম। হোঁচট খেয়ে যখন পড়ে গিয়েছিলাম তখন বাহান্ন পা হেঁটেছি, এরপরে আর আটচল্লিশ পা হাঁটলাম। এক গজ দুই পা হাঁটলে সেই হিসাব করে বোঝা গেল কয়েদখানার পরিধি পঞ্চাশ গজের মতো। কিন্তু দেওয়াল ধরে চলার সময় অনেক কোণ বুঝতে পেরেছিলাম, সেই কারণে দেওয়ালের আকার সম্পর্কে কোনো ধারণা করা আমার পক্ষে অসম্ভব হলো।
এধরনের পরীক্ষায় আমার যে কোনো লক্ষ্য ছিল তা নয়,–তাছাড়া এর উপরে যে কোনো কিছু নির্ভরশীল ছিল তাও নয়, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তবুও কোনো নির্দেশ ছাড়াই কৌতূহলবশতঃ আমি চলছিলাম। কিছুপরেই ঠিক করলাম দেওয়াল ছেড়ে দিয়ে বেষ্টনীর মধ্যে পরীক্ষা চালাবো। মেঝে শক্ত হলেও খুবই পেছল; পড়ে যাওয়ার ভয় আছে সেইকারণে প্রচণ্ড সতর্ক থেকেই প্রথমটায় পা ফেলে ফেলে এগোচ্ছি। অবশেষে যাইহোক খুব শক্ত পায়ে এগিয়ে চললাম। উদ্দেশ্য ছিল যতটা সম্ভব সোজা এগিয়ে যেতে পারি, দশ বারো পা এইরকম ভাবে এগোনোর পর হঠাৎ পোশাকের ছেঁড়া অংশটা আমার পায়ে জড়িয়ে গেলো, আর সাথে সাথে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলাম।
সেই সময় যখন পড়ে গেলাম, একটা বীভৎস ব্যাপার উপভোগ করতে পারিনি, কিন্তু একইভাবে কিছু সময় পড়ে থাকার পর তা আমার মনোযাগ আকর্ষণ করলো। কারণটা হলো এই : মেঝে ছুঁয়ে রয়েছে বটে তবে আমার থুতনি আর আমার ঠোঁট মাথার উপর দিক থুতনির থেকে উপরে হলেও কোনো কিছুই ছোঁয়নি, আর সেই সময় আমি যেন বুঝতে পারলাম আমার কপাল চটচটে একটা বাষ্পে ভিজে গেছে, একই সাথে পচা ছত্রাকের গন্ধও আমি পাচ্ছি। হাত প্রসারিত করে দিতে বুঝতে কষ্ট হলো না যে, এক গোলাকার গর্তের একেবারে মুখে আমি পৌঁছে গেছি,–গর্তের আয়তন কত ছিল সেই সময়ে আন্দাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না, নিম্ন দিকে হাতড়াতে হাতড়াতে একটা গাঁথনি আমার হাতে চলে এলো। গাঁথনিটা আমি গর্তের মধ্যে ফেলে দিলাম। ঢিলটা গর্তের দেওয়ালে দেওয়ালে ধাক্কা খেতে খেতে নামছে আর তার প্রতিধ্বনি উঠছে, একের পর এক সময় কেটে যাচ্ছে শেষ পর্যন্ত। অবশেষে সেটার জলে পড়ার আওয়াজ আমার কানে এলো, কিছুক্ষণ বাদেই খুবই সজোরে তার প্রতিধ্বনি শোনা গেলো। একই সময়ে মাথার উপরের একটা দরজার খুব জোরে খোলার আর বন্ধ হওয়ার শব্দ কানে এলো, আর আচমকাই সেখান দিয়ে একটা আবছা ঝলক দেখা দিয়েই তখনি মিলিয়ে গেলো।
আমার জন্য যে ধরনের শাস্তি অপেক্ষা করছিল তা আমার চোখে অস্পষ্ট রইল না, আর নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানালাম যে, আমি সেই গহ্বরে পড়ে যাইনি। আর একটা পা যদি এগোতাম তাহলে আর আমার নিস্তার থাকত না। এই হাত সে ধরনের মৃত্যু বা ধর্মোন্মাদদের ব্যবহারের বীভৎসতম কাহিনী শুনে বিশ্বাস করতে পারিনি তেমনি এক ভয়ঙ্কর পরিণতি। ওরা যারা সকলকে শাস্তি দিত তাদের কাছে মৃত্যুকে বেছে নেওয়ার দুটো ভিন্ন রাস্তা ছিল: সোজাসুজি চরম শারীরিক যন্ত্রণা হলো একটা, আর অন্যটা বীভৎস মানসিক যন্ত্রণার। ঐ দ্বিতীয় রাস্তাটাই আমার জন্যে ঠিক হয়েছিল। অনেক দিন যন্ত্রণা ভোগের ফলে আমার স্নায়ুমণ্ডলী অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছিল, নিজের গলার স্বরেই কেঁপে কেঁপে উঠছি।
একইভাবে কাঁপতে কাঁপতে আমি হাতড়াতে হাতড়াতে পুনরায় দেওয়ালে ফিরে গেলাম, সিদ্ধান্ত নিলাম বরং সেখানেই মরব, কুঁয়োর ঐ বীভৎসতার মধ্যে তবুও যাবো না। আমি সাহসে ভর করে ঐ কুঁয়োর গর্তে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যু বরণ করতাম যদি মনের অবস্থা অন্যরকম থাকতো। তবে সেই সময় আমি মনের সমস্ত সাহস হারিয়ে ভীষণ ভীতু হয়ে পড়েছিলাম, সেই কারণে সাহস হলো না। আর সেই গর্ত দেখে আমি যা বুঝেছিলাম তাও ভোলার নয়,ভুলিনি আমাকে যে ওরা হত্যা করার ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা করেছিল তার মাঝে আচমকা জীবননাশের কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
মানসিক যন্ত্রণাগ্রস্ত হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জাগ্রত থাকার পর অবশেষে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আর ঘুম থেকে উঠে এবারও পাউরুটি আর জল পেলাম। তৃষ্ণায় ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিলাম, একবারেই জলটা শেষ করলাম। জল খাওয়ার সাথে সাথে আমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম, মনে হয় জলে কোনো ওষুধ ছিল! মৃত্যুর মতোই সেই ঘুম। কতক্ষণ যে ঘুমিয়ে ছিলাম জানি না। কিন্তু যখন চোখ মেলোম আশেপাশের জিনিষগুলো তখন চোখে পড়লো। কোথা থেকে যে ফসফরাসের আলো এসে পড়েছে জানি না। কয়েদখানাটা সেই আলোয় দেখতে পেলাম।
কয়েদখানাটার আয়তন সম্পর্কে আমার ধারণা ভুল ছিল, দেওয়ালটার পরিধি বেশি হলেও পঁচিশ গজ। সেই মাপে অবশ্য কি আসে যায়? তবুও, সেই মাপের সম্বন্ধে কোথায় আমার ভুল ছিল তা বোঝবার চেষ্টা করতে লাগলাম, অবশেষে বুঝতেও পারলাম। বাহান্ন পা গিয়ে প্রথমবার পড়ে গিয়েছিলাম, আসল ব্যাপার হলো তখন পোশাকের টুকরোটা মাত্র দুএক গজ দূরে ছিল। আর ঘুম থেকে উঠে যখন হাঁটা শুরু করেছিলাম তখন যে দিক থেকে এগিয়েছিলাম আবার পুনরায় সেই দিকেই চলছিলাম। এই কারণে দূরত্বটা আমার ধারণায় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল। ভারাক্রান্ত মনের অবস্থা, আমি খেয়াল করিনি ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমি বাঁ-হাতে দেওয়াল ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আর পরের বার ডান হাত দিয়ে দেওয়াল ধরে এগোচ্ছিলাম।